#কোথাও কেউ ভালো নেই
জাহান আরা
পর্ব-১৪
বর্ষা কাল শেষ হয়ে শরৎ এসেছে। কিন্তু বৃষ্টি এখনো বন্ধ হয় নি।সাদা মেঘেরা আকাশে উড়ে বেড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ বৃষ্টি হয়ে ঝরঝর করে ঝরে পড়ে।
কাশফুল বনে অকারণেই মন খারাপের আবেশ ছড়িয়ে পড়ে তখন।
বৃষ্টি ও হচ্ছে তুমুল বেগে,যেনো এটাই বর্ষাকাল।
সকাল থেকে পূরবীর ভীষণ মন খারাপ। ইদানীং লেখাপড়া কিছুই পূরবীর ভালো লাগে না।আগের মতো কোনো যথাযথ কারণ খুঁজে পায় না পূরবী লেখাপড়া করার জন্য।মনে হয় বৃথাই সময় নষ্ট।
জীবনে আসলে কিছুই নেই,বেঁচে থাকাটাই এখন নিরর্থক মনে হয় পূরবীর।
যেই জীবনে নিজের বলে দাবি করার মতো একটা মানুষ নেই,মন খারাপ হলে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না করার জন্য একটা মানুষ নেই,অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকলে এক নজর দেখার ও কেউ নেই,সেই জীবন কেনো মিছেই বয়ে বেড়ানো?
গত তিন দিন ধরে পূরবীর জ্বর।দিনের বেলায় হুট করে গা কাঁপিয়ে জ্বর আসে আবার আপনাতেই চলে যায়। রাতে সারারাত জ্বর থাকে।এজন্য গত রাতে তানভীরের সাথে কথাও বলতে পারে নি পূরবী। কোনো হুঁশ ছিলো না সারারাত।এই তিন দিন পূরবী এক দানা ভাত ও খায় নি,অথচ কেউ জানেও না পূরবী যে খেতে যায় না।
সজীবকে দিয়ে একটা পাউরুটি আনিয়েছিলো পূরবী,যখন ইচ্ছে করে পানিতে ভিজিয়ে এক স্লাইস খেয়ে নেয়।
ফর্সা গোলগাল মুখখানায় যেনো রাজ্যের ব্যথা নেমেছে। দেখে মনে হয় একটা দুঃখপুরীর রাজকন্যা সে।এই মুখের হাসি ফিরিয়ে দিবে কে আবার?
তানভীর মালয়েশিয়া গিয়েছে ১৫ দিন হলো।এই ১৫ দিনে পূরবী দুইবার মাত্র ভিডিও কলে কথা বলেছে তানভীরের সাথে।
আজকে পূরবীর কলেজে পরীক্ষা আছে।প্রাইভেট কলেজে পড়ার এই এক হ্যাপা।
রেগুলার ক্লাস করতে হয়,এক্সাম দিতে হয়।
ফজরের নামাজের পর পূরবী বই নিয়ে বসলো। নিজেকে বারবার বুঝাতে লাগলো,”বইয়ের চাইতে আপন আমার আর কেউ নেই এই জীবনে। যখন যাকে আঁকড়ে ধরেছি সবাই ছেড়ে চলে গেছে আমাকে একা করে দিয়ে।শুধু আজীবনের সঙ্গী হয়ে আমার বই আমার পাশে আছে।যেই বই আমাকে ছেড়ে যায় নি,আমি কেনো অভিমান করে তাকে ছেড়ে দিবো?”
নিজেকে দেওয়া নিজের মোটিভেশান কাজে লাগিয়ে পূরবী প্রিপোজিশান নিয়ে বসেছে।
দরজায় নক হতে দেখে পিছনে ঘুরে তাকালো পূরবী। দেখে রেবেকা দাঁড়িয়ে আছে। এই প্রথম রেবেকা পূরবীর রুমে এসেছে।রেবেকাকে দেখে পূরবী চমকে উঠলো। চেয়ার থেকে নেমে দাঁড়িয়ে বললো,”মা আপনি? ”
কঠোর গলায় রেবেকা বললো, “রাতে রাহেলার হাত কাটা গেছে,আইজ থাইকা ঘরের রান্ধন বন্ধনের কাজ তোমার করতে অইবো।বাপের বাড়িতে তো আছিলা দাসীবাঁদীর মতো, এইখানে আইসা রানী সাইজা বসছো।
এসব পড়ালেখা ধুইয়া আমরা পানি খামু না।”
পূরবী অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো রেবেকার দিকে।তারপর বই নিয়ে চলে গেলো রান্নাঘরে। চুলায় চায়ের পানি চাপিয়ে দিয়ে রেবেকাকে জিজ্ঞেস করলো কি কি বানাতে হবে।
রেবেকা একটু ভেবে বললো,”ভাত রানবা ৫ কেজি চাইলের,ডাল,মাছ ভাজা,আলু ভাজি,গরুর মাংস আলু দিয়ে রানবা,শিলপাটায় ভর্তা বানাইবা,লাউ শাক ভাজি করবা।
আর এখন নাশতার জন্য রুটি বানাও।লগে সবাইরে ডিম ভাইজ্জা দিবা। ”
পূরবী চমকালো এতো আইটেমের কথা শুনে।এখন সাড়ে ছয়টা বাজে,১০ টায় কলেজে ক্লাস শুরু,১১টায় পূরবীর পরীক্ষা। কলেজে যেতেই ৪৫ মিনিট লাগে।
কিছু না বলে এক চুলায় আটা সিদ্ধ করে নিলো রুটির জন্য।চায়ের পানি নামিয়ে ভাত বসিয়ে দিলো।
আটা সিদ্ধ হলে সেই চুলায় ডাল বসিয়ে দিলো।দ্রুত রুটি বানাতে লাগলো। ৪০ টা রুটি বানাতে বানাতে পূরবীর ডাল রান্না হয়ে গেলো। সেই সাথে প্রিপোজিশান ও পড়া হলো।
এর মধ্যে সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। বুক ফেটে কান্না এলো পূরবীর। কখন বাকি কাজ করবে,কখন রান্না শেষ হবে!
তানভীর কল দিলো এর মধ্যে,পূরবী রিসিভ করতে পারলো না।হাতে মাছের রক্ত।মাছ কাটতে বসেছে সে।মাছ কাটতে কাটতে বইয়ের দিকে বার কয়েক চোখ বুলালো। একটা রিপোর্ট আসতে পারে এক্সামে,সেটা পড়ে নিচ্ছে।
পূরবী কল না তোলায় তানভীর তারিনকে কল দিয়ে বললো,”আপা,পূরবী কোথায়,কল তুলছে না।গিয়ে দেখ তো রুমে আছে কি-না,শরীর খারাপ মনে হয় ওর।”
তারিন ভীষণ বিরক্ত হলো ভাইয়ের উপর। পূরবীর রুমে গিয়ে ভিডিও কল দিয়ে বললো,”তোর বউ রুমে নাই।আমি এখন কি মাইক দিয়ে চারদিকে এনাউন্স করমু যে তানভীরের বউ হারাইয়া গেছে,কোনো সহৃদয়বান ব্যক্তি যদি….. ”
তানভীর বাকী কথা না শুনে ফোন রেখে দিলো।ভীষণ বিরক্ত লাগছে তানভীরের এখন।গতরাতে ও পূরবী কল রিসিভ করে নি।
এখনও কল রিসিভ করছে না।বুকের ভিতর এক অজানা ভয় এসে বাসা বাঁধলো। তার পূরবী ঠিক আছে তো?
শুধু তারই আছে তো!
পূরবী চুলার আঁচ একেবারে কমিয়ে দিয়ে মাছ ভাজতে দিলো।তারপর মাংসের জন্য আলু কাটলো। আলুভাজির জন্য আলু কুঁচি করলো।
পেঁয়াজ,মরিচ,টমেটো সব কাটতে কাটতে মাছ ভাজা হয়ে গেলো।
ভাত নামাতে গিয়ে পূরবীর বুক কেঁপে উঠলো। এতো বড় ভাতের পাতিল আগে কখনো পূরবী নামায় নি।এই পাতিলের মাড় কিভাবে ফেলবে সে?
নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হলো পূরবীর।স্বামী ছাড়া এই সংসারে তার দাম নেই।
আজ তানভীর থাকলে নিশ্চয় এই সাহস হতো না কারোর।
তানভীর কে কিছু বলতেও পারবে না পূরবী। এই মাথা গরম লোকটা রেবেকাকে তুমুল গালাগালি করবে হয়তো কিন্তু সেই তো সে দূরেই থাকবে।
অযথা রেবেকার সব কাজ তো পূরবীকে করতে হবেই সেই সাথে গালাগালি ফ্রী তে শুনতে হবে।অনেক কষ্টে ভাতের মাড় ফেললো পূরবী।
তার পর এক চুলায় মাংস বসালো অন্য চুলায় আলুভাজি। তারপর বসলো শাক বাঁছতে।শাকে অনেক পোকামাকড় থাকে,তাই ভালো করে না বাঁছা হলে পূরবীর মন খুঁতখুঁত করে।
আলু ভাজি হলে শাক ভাজি বসিয়ে দিলো। ঘড়িতে ইতোমধ্যে ১০টা বেজে গেছে। তারিন রান্নাঘরে এসে বললো,”পূরবী, আমার ছেলের জন্য খিচুড়ি রান্না করতে হবে,একটু তাড়াতাড়ি করে দাও তো। আর আমার রুমে এক কাপ চা দিও।”
পূরবী কি করবে বা কি বলবে বুঝতে পারছে না।একটু পেঁপে,গাজর,আলু,ডিম,পুইশাক, ডাল এসব মিশিয়ে তারিনের ছেলে রকির জন্য খিচুড়ি রান্না করে সবসময় রাহেলা।
পূরবী বসলো এসব নিয়ে,কাটার জন্য।
তানভীর আবারও কল দিলো তখন।পূরবী ফোন কানে নিয়ে হ্যালো বলতেই শুনতে পেলো তানভীর বলছে,”কাল রাত থেকে তোমাকে কল দিচ্ছি,তুমি কল ধরো না।এতোক্ষণ কল দিছি,কল ধরো নাই,ঘরে ও ছিলা না আপা গিয়ে খুঁজে আসছে তোমাকে,কই ছিলা তুমি?
আমার সাথে কথা বলতে এতো বিরক্ত লাগে তোমার?
এরকম অবহেলা করো কেনো আমাকে তুমি? ”
তারিন সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো,পূরবী কোনো কথা বলতে পারলো না তাই। তানভীর কে জবাব না দিয়ে ফোন নামিয়ে রাখলো।
এখন কথা বলার সময় নেই।১০ টায় যেখানে ক্লাস শুরু হয়ে গেছে,এখন তানভীরের রাগ ভাঙাবে কখন পূরবী।
তারিনের তানভীরের সাথে মিথ্যা কথা বলায় পূরবীর প্রচুর রাগ হলো তারিনের উপর।
সব কেটে দিয়ে তাই তারিনকে বললো,”আপা,আমার ক্লাসের সময় যাচ্ছে,আমি যাই।আপনি রেঁধে নিন আজ একটু।”
রুমে গিয়ে বোরকা পরেই ব্যাগ আর মোবাইল নিয়ে পূরবী ছুটলো। উঠোনে নামতেই দেখে সজীব যাচ্ছে বাইক নিয়ে।
পূরবীকে দেখে বললো,”ভাবী আপনার ও আজকে দেরি হয়েছে দেখছি,আমার সাথে উঠে আসেন,নয়তো এক্সাম দিতে পারবেন না।”
তমিজ মিয়া উঠোনে বসে চুলে মেহেদী দিচ্ছিলেন।সজীবের কথা শুনে পূরবী কে বললেন,”ক্লাস আছে যখন এতো দেরি করলা ক্যান,যাও সজীবের লগে যাও।পড়ালেখা অইলো গিয়া সবকিছুর আগে।”
পূরবী সজীবের বাইকে করে চলে গেলো কলেজের উদ্দেশ্যে।
তারিন অগ্নিমূর্তি হয়ে মায়ের রুমের দিকে গেলো পূরবীর নামে বিচার দিতে।
চলবে……