কোথাও কেউ ভালো নেই পর্ব -১২

0
1044

#কোথাও কেউ ভালো নেই
জাহান আরা
পর্ব-১২

সারা রাত পূরবী অপেক্ষায় ছিলো কখন পূব আকাশে সূর্য উদয় হবে।অপেক্ষা করতে করতে পূরবীর মনে হলো আজকের রাতটা যেনো পৃথিবীর দীর্ঘতম রাত।কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। ঘড়ির কাটা সেকেন্ডের ঘর পার হতেও যেনো ঘন্টা লাগছে।
অবশেষে তিমির কেটে উদয় হলো ভোরের আলো,সারা জাহান ভোরের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠলো।
ঝড়ের আঘাতে ভেঙে গিয়েছে গাছপালা,মানুষের ঘরবাড়ি।
লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে সব।প্রকৃতি শান্ত হয়ে আছে।যেনো গতরাতে কিছুই হয় নি। ভোরের ঠান্ডা বাতাস মন প্রাণ জুড়িয়ে দিচ্ছে সবার।শুধু পূরবী টের পাচ্ছে,বাতাসে আজ ভেসে বেড়াচ্ছে যেনো একটা চাপা গুঞ্জন।
কে জানে কিভাবে পূরবীর মন সেই গুঞ্জন টের পেলো। যেনো বাতাস ফিসফিস করে পূরবীকে কোনো দুঃসংবাদ দিচ্ছে।
পূরবীর বুকের ভেতর জ্বলছে ধিকিধিকি আগুন।ছোট বোনটা কেমন আছে না জানা পর্যন্ত এই আগুন নিভবে না।
এতো বড় একটা পৃথিবীর কেউ-ই জানলো না একটা মেয়ে বুকের ভেতর চেপে রেখেছে একটা দুঃখের নদী। যে নদীর ঢেউয়ের আঘাতে ভেঙে যাচ্ছে মেয়েটার ছোট্ট বুকটা।

নামাজ পড়েই তানভীর পূরবীকে নিয়ে বের হলো। তানভীরের মোটেও ইচ্ছে ছিলো না দ্বিতীয় বার ওই বাড়িতে যাওয়ার। কিন্তু পূরবীর জন্য যেতে হচ্ছে।
আড়চোখে তাকালো পূরবীর দিকে তানভীর। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটছে পূরবী।

পূরবী নিজেদের বাড়িতে পা দিতেই টের পেলো বাড়িটা আজকে নিরব হয়ে আছে। এক অজানা ভয় পূরবী কে চেপে ধরলো। বুকের ভেতর একটা চিনচিনে ব্যথা শুরু হলো পূরবীর।
জোর গলায় পূরবী ডাকলো সুরভীর নাম ধরে।

একবার ডাকলো,দুইবার ডাকলো,তারপর বারবার ডাকলো।
নেই নেই নেই,কোথাও নেই আজ সেই কোকিলকণ্ঠী। পূরবী ডাক প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এলো পূরবীর কাছে। কেউ জবাব দিলো না।
সালমা বিরক্ত হলো ভীষণ। এতো ভোরে আবারও এরা এসে হাজির হয়েছে।
কামরুল এক চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। অন্য চোখে সে দেখলো ঘরের পিছনে সুরভী শুয়ে আছে। সুরভীর মুখ দেখেই কামরুল বুঝে গেলো এই মেয়ে আর বেঁচে নেই।তড়িঘড়ি করে কামরুল বের হয়ে গেলো ঘর থেকে। পূরবীদের পাশ দিয়েই ছুটলো সে কেউ কিছু জানার আগেই।এই বাড়ি থেকে বের হবার আর কোনো দ্বিতীয় রাস্তা নেই।

কামরুল কে ওই ঘর থেকে বের হতে দেখে তানভীর দৌড়ে এলো ঘরে। কোথাও সুরভীকে পেলো না।
ডাকতে ডাকতে ঘরের পিছনে গেলো। পূরবী ও গেলো তানভীরের পিছনে।
সুরভীকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে তানভীর ডাকতে নিলো।পূরবী থামিয়ে দিয়ে বললো,”ডাকবেন না ওকে,সুরভী ঘুমাচ্ছে।ঘুমাক ও,আপনি কোলে করে নিয়ে ওরে ঘরে বিছানায় শুইয়ে দিন।আর দেখুন তো ওর জ্বর আছে কি-না। ”

তানভীর সুরভীর গায়ে হাত দিতেই ওর সারা শরীর ঝাঁকি দিয়ে উঠলো। এই শরীর তো বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে আছে।
চমকে তাকালো নিজের বউয়ের দিকে।পূরবী দেখলো তানভীরের দুচোখ আস্তে আস্তে জলে টইটম্বুর হয়ে যাচ্ছে। তারপর টুপ করে এক ফোটা জল শিশির বিন্দুর মতো ঝরে পড়লো তানভীরের চোখ থেকে।

তানভীর আস্তে করে বললো,”সুরভীর ঘুম আর কখনো ভাঙবে না পূরবী। ”

একটা কথাই পূরবীর চিন্তাভাবনা সব কিছু এলোমেলো করে দিলো। ধপ করে মাটিতে বসে গেলো পূরবী। তারপর কোমল সুরে বললো,”চলে গেছে?
মায়ের কাছে বুঝি নিয়ে গেছে মা ওকে?
মা ওকে বেশি ভালোবাসতো তো,ছোট বলে। তাই বুঝি আদরের মেয়েকে ছেড়ে মা থাকতে পারলো না বলেন?
দেখলেন তো,এই দুনিয়ায় আমাকে কেউ-ই ভালোবাসে না।আমাকেও সাথে নিলে কি এমন ক্ষতি হতো মা’য়ের?
আমি কি সুরভীর আদরে ভাগ বসাতাম না-কি বলেন? ”

পৃথিবীর সব ভাষা যেনো আজ থেমে গেছে পূরবীর কথা শুনে।কি জবাব দিবে পূরবীকে তানভীর?

সুরভী কে কোলে করে নিয়ে গেলো তানভীর। উঠোনে পাটি পেতে শোয়ালো সুরভীকে।বিষে নীল হয়ে যাওয়া মানুষটার মুখে যন্ত্রণার চাপ।
তানভীর পূরবীর দিকে তাকালো,পূরবী ও তাকালো তানভীরের দিকে।
যা বুঝার পূরবী বুঝতে পেরে গেছে।বোনের পায়ের পাশে বসে পূরবী বললো,”কাউকে কিছু বলবেন না প্লিজ,আমার অনুরোধ রইলো। পুলিশ জানতে পারলে আমার বোনটাকে পোস্টমর্টেম করতে নিবে।আমার বোনকে তো আমি ফিরে পাবো না আর।তবে শুধু শুধু এসব করে কি লাভ হবে।তাছাড়া আজকাল মর্গেও মেয়েদের লাশ নিরাপদ না।”

তানভীর পূরবীর কথায় যতোটা আঘাত পেলো তারচেয়ে বেশি অবাক হলো পূরবীকে এরকম শান্ত থাকতে দেখে।কোনো চিৎকার করছে না,কাঁদছে না।কেমন শান্ত হয়ে আছে।
যেনো কিছুই হয় নি।সুরভী মরে যাবারই ছিলো যেনো।গতরাতের দেখা সেই অস্থির মেয়েটার সাথে আজকের এই শান্ত মেয়েটির কোনো সাদৃশ্য তানভীর খুঁজে পেলো না।
পূরবীর হাত ধরে তানভীর কেঁদে দিয়ে বললো,”পূরবী তুমি কেনো কাঁদছো না,তোমার এই শান্ত ভাব আমার সহ্য হচ্ছে না। তুমি একটু কাঁদো পূরবী,কেঁদে হালকা হয়ে নাও তুমি। ”

মুচকি হাসলো পূরবী। তারপর হেসে বললো,”কেনো কাঁদবো বলেন?
যাকে আমি নিজেই শক্ত হাতে ধরে রাখতে পারলাম না তার জন্য এখন মায়া কান্না করে কি লাভ হবে?
আমার বোনটাও বুঝি বুঝে গেছে যে তার বোন একটা অযোগ্য মেয়ে,দায়িত্বজ্ঞানহীন মেয়ে।তাই তো সে মায়ের কাছে চলে গেলো। আমার তো খুশি হবার কথা।আমার আর কোনো পিছুটান নেই।কাউকে নিয়ে আর ভাবতে হবে না।আমি এখন সুতো কাটা ঘুড়ি।”

পূরবীর বলা প্রতিটি কথা যেনো কাঁটার মতো বিঁধছে তানভীরের বুকে।তানভীর জানে এই মেয়েটা মেন্টালি আনস্টেবল,এ কি বলছে কিছুই বুঝে বলছে না।
পূরবী গিয়ে সালমা কে ডেকে বললো,”ছোট মা,সুরভী মরে গেছে। আর কোনো যন্ত্রণা রইলো না আপনার। ”

সালমা চমকে গেলো পূরবীর কথা শুনে।সুরভী মরে যাবে এটা তার ভাবনাতেও ছিলো না। মারুক আর যাই করুক,মেরে ফেলতে চায় নি সালমা কখনো। ছুটে এলো সালমা উঠানে। সুরভীর লাশ থেকে বুক কেঁপে উঠলো সালমার।
পূরবী বললো,”ভয় পাবেন না।আমার কোনো অভিযোগ নেই কারো উপর। আল্লাহ বিচার করবে যাদের জন্য আমার বোন আজ দুনিয়া ছেড়ে চলে গিয়েছে। ”

তানভীরের সহ্য হলো না।সালমার দিকে তেড়ে গেলো সে,পূরবী বাঁধা দিলো।

ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই সুরভীর দাফনকার্য শেষ হয়ে গেলো। গোসল করাতে গিয়ে পূরবী দেখতে পেলো সুরভীর গায়ে নখের আঁচড়।ঠোঁটে কামড়ের দাগ।
বুক ছিঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস এলো পূরবীর। সব কিছু বুঝে গেলো পূরবী।
১০-১২ জন মানুষ নিয়ে জানাজা পড়িয়ে পারভীনের পাশেই কবর দিলো সুরভীকে।

দুপুরের মধ্যেই পূরবী চলে গেলো নিজের শ্বশুর বাড়ি। নিজের রুমে গিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে রইলো।
শান্ত পূরবীকে দেখে তানভীরের বুক ফেটে যাচ্ছে। কেনো এই মেয়েটা এতো শান্ত হয়ে আছে?
কেনো একটুও আহাজারি করছে না।এতো ব্যথা বুকে জমিয়ে রাখলে ব্যথার চাপে যে এই মেয়েটাও মরে যাবে।
তানভীর বললো,”আমাদের থানায় যাওয়া উচিত ছিলো পূরবী। এভাবে কেনো ছেড়ে দিবে এদেরকে?”

পূরবী বললো, “আইনের রক্ষক যখন ভক্ষক হলো,বিচার করবে কে?আমার বোনকে ওই লোকটা রেপ করতে চেয়েছিলো।যখন আর লড়ার শক্তি পায় নি সুরভী তখনই বিষ খেলো।

আমার বোন কি ফিরে আসবে পুলিশের কাছে গেলে?
আমাদের কাছে কি কোনো প্রমাণ আছে?
অযথা আমার বোনের লাশটা কাটাছেঁড়া হবে।কম তো যন্ত্রণা পায় নি ও বেঁচে থাকতে,মরে গিয়ে ও শান্তি দিবো না বলেন?
আর কতো?”

তানভীর চুপ করে রইলো।তানভীরের মা ডাকলো দুপুরে তানভীর কে ভাত খেতে যেতে।
তানভীরের আগে পূরবী গেলো খাবার জন্য।পিছন পিছন তানভীর ও গেলো।আর দিনের চাইতে ভালো করে খেলো আজ পূরবী।নিজ থেকে চেয়েই মাছ দুই পিস নিলো।
তানভীর খেতে পারলো না।ভাত নিয়ে নেড়েচেড়ে উঠে গেলো। কাউকে কিছু বললো না বাবাকে ছাড়া।

তমিজ মিয়া ব্যথাতুর নয়নে তাকালো পূরবীর দিকে।চেহারায় কোনো কষ্টের ছাপ নেই,শান্ত হয়ে খাচ্ছে মেয়েটা।
তমিজ মিয়া অবাক হলো পূরবীর সহ্যশক্তি দেখে।কিভাবে হজম করলো মেয়েটা সব?এইটুকু একটা মেয়ের এতো সহ্যশক্তি কিভাবে হলো?

তানভীরের মনে অনুশোচনা জাগতে লাগলো,”কেনো সে রাতে নিয়ে গেলো না পূরবীকে!”

তানভীর কিছু বলার আগে পূরবী নিজেই বললো,”গত রাতে যদি ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আমি একবার বাড়ি যেতাম,তবে হয়তো আমার বোনটা আজ বেঁচে থাকতো। আপনি গেলেন না আমাকে নিয়ে। ”

তানভীর কি জবাব দিবে বুঝতে পারলো না। করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো পূরবীর দিকে।যেই ঝড় ছিলো তাতে বের হবার কোনো অবস্থা ছিলো না তার উপর পূরবীর পায়ের অবস্থা ও খারাপ ছিলো। পূরবী জানালায় মাথা ঠেকিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে