#কোথাও কেউ ভালো নেই
জাহান আরা
পর্ব-০৪
ওয়াশরুমে গিয়ে পূরবী থম মেরে বসে রইলো কিছুক্ষণ। কান্না করবে না করবে না করেও কান্না করে দিলো।পূরবীর একটা ন্যাপকিন দরকার,কিন্তু কোথায় পাবে এখন ন্যাপকিন?
কাকে বলবে সে ন্যাপকিন দিতে?
বাহিরে তানভীর আছে,এই লোকটা কে কিভাবে বলবে সে?
লজ্জায় পূরবী লজ্জাবতী লতার মতো নুয়ে গেলো।সেই সাথে তীব্র পেটব্যথা পূরবীকে কুঁকড়ে দিলো।তানভীর অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে,পূরবীর বের হবার কোনো লক্ষণ না দেখে জিজ্ঞেস করলো,”১ নাম্বারের জন্য এসে এতোক্ষণ সময় লাগছে তোমার,২ নাম্বার হলে তো আজকে সারাদিন যাবে।”
তানভীরের ফাজলামি করে বলা কথা পূরবী বুঝলো না।পূরবীর মনে হলো পূরবীকে লজ্জা দেয়ার জন্য তানভীর এটা বলছে।ফর্সা মুখখানা আষাঢ়ের আকাশের মতো কালো হয়ে গেলো অপমানে এবং পেটব্যথায়।
টিস্যু হোল্ডার থেকে অনেকটা টিস্যু ছিঁড়ে নিলো পূরবী। কিন্তু আরেক বিপত্তি দেখা দিলো।টিস্যু নেয়ার মতো কিছু নেই পূরবীর কাছে।
ভয়ে পূরবী কেঁদে উঠলো। নিজেকে মনে হলো পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মেয়ে।
ভিতর থেকে কান্নার মৃদু শব্দ পেয়ে তানভীর ভড়কে গেলো।দরজায় নক করে বললো,”কি হয়েছে পূরবী?
আমাকে বলো?”
পূরবী বললো না,বরং কান্নার তোড় আরো বাড়লো।তানভীর বাহিরে থেকে আরো কয়েকবার ডাকলো কিন্তু জবাব এলো না।
মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো তানভীরের। এই মেয়ে এতো ন্যাকা কেনো!
তারিন কে ডেকে নিলো তানভীর। তারপর বললো,”আপা দেখ তো এই মেয়েটা কাঁদছে কেনো এরকম করে? আমি কি ওকে কামড়েছি না-কি? ”
তারিন এসে ডাকতেই পূরবী দরজার ফাঁক দিয়ে মাথা বের করে তারিনকে আস্তে করে কিছু বললো।শুনে তারিন ভাইকে বললো,”লাগেজটা এখানে দিয়ে তুই যা এখান থেকে।”
মেজাজ খারাপ করে তানভীর লাগেজ দিয়ে গেলো।যাবার সময় বললো,”আজব মেয়েমানুষ তো!আমাকে এতোক্ষণ বললে কি হতো লাগেজের জন্য কান্নাকাটি করছে,তাহলে আমি কি না এনে দিতাম?
আরো দশটা লাগেজ এনে দিতাম দরকার হলে।ওয়াশরুমে গেছে ভাইরে ভাই,ওখান থেকে বের হতে হলেও কি সাজগোজ করে,মেকাপ করে বের হতে হবে?
এইরকম নখরা কেমনে যে করে এরা!”
তারিন চোখ বড় করে তাকিয়ে বললো,”ভাগ এখান থেকে।”
তানভীর যেতেই তারিন দ্রুত হাতে প্যাকেট খুলে ন্যাপকিন বের করে দিলো পূরবীকে।
ন্যাপকিন নিয়ে বের হলো পূরবী।এতোক্ষণে স্বস্তি পাচ্ছে সে।
তারিন আর কথা না বলে চলে গেলো।পূরবী আগের জায়গায় গিয়ে বসে রইলো।সন্ধ্যা থেকে রাতের ১১ টা পর্যন্ত একই জায়গায় বসে রইলো পূরবী। বসে থাকতে থাকতে কোমর ব্যথা বেড়ে গেলো।
তানভীর এসে একবার ডাকলো খেতে যাবার জন্য,পূরবী নড়লো না।কথাও বললো না।
রেগেমেগে তানভীর চলে গেলো।তারপর গিয়ে মা,বোন,ভাবীদের বললো,পূরবীকে খেতে ডাকতে। বাড়ির মহিলারা কেউই খেতে ডাকে নি পূরবীকে।পূরবী কিছু না বুঝলেও এটুকু বুঝতে পারলো এই বাড়ির মহিলারা কেউই ওকে তেমন একটা পছন্দ করছে না।
মনে মনে আল্লাহকে ডেকে বললো,”অভাগা যেদিকে যায়,সাগর সেদিকে না শুকালেই কি নয়?
একটু তো রহম করো আমায়।এতিমের আর্তনাদ কি তোমার আরশ পর্যন্ত পৌছায় না আল্লাহ?
সাত আসমানের উপরের আরশে বসে কি তুমি দেখতে পাও না এই এতিমের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ?
আর কতো পুড়বো আল্লাহ? ”
১২টার সময় পূরবীকে রুমে নেওয়া হলো।ক্ষিধেয় ততক্ষণে পূরবীর পুরো শরীর কাঁপছে। গতকাল বিকেলে দুই বোন মিলে ভাত খেয়েছে,তারপর আর খায় নি।দুপুরে ও খায় নি পূরবী।
এখন ক্ষিধে পেয়েছে কিন্তু কেউ ডাকছে না ওকে।নিরুপায় হয়ে পূরবী গুটিসুটি মেরে বসে রইলো।
তানভীর রুমে এলো যখন তখন রাত সাড়ে বারোটা। এসে দেখে পূরবী হেলান দিয়ে বসা অবস্থায় ঘুমিয়ে গেছে।
পুতুলের মতো মুখটি ঘামে ভিজে আছে।
তানভীরের মনে হলো এসব যেনো শিশির বিন্দু।
আলতো করে পূরবীর হাত ছুঁতেই পূরবী জেগে উঠলো। তানভীরকে এতো কাছে বসে থাকতে দেখতে বুক ধড়ফড় করে উঠলো পূরবীর।
একটু দূরে সরে বসে তানভীর জিজ্ঞেস করলো,”খেয়েছ তুমি?”
পূরবী মাথা নাড়িয়ে জানালো খায় নি।
তানভীর জিজ্ঞেস করলো,”মা ডাকে নি খেতে যেতে?”
পূরবী বুঝতে পারছে না কি বলবে এই প্রশ্নের জবাবে।
তানভীরের রাগ হলো ভীষণ। এই একটা বাজে স্বভাব তার।অল্পতেই মাথা গরম হয়ে যায়।রেগে গিয়ে রুম থেকে বের হয়ে মায়ের রুমের সামনে গিয়ে চিৎকার করে ডাকতে শুরু করলো।
রেবেকা তখন সবে মাত্র বিছানায় পিঠ লাগিয়েছেন।ছেলের এরকম গলা ফাটানো চিৎকারে হন্তদন্ত হয়ে উঠে গেলেন।আনিকা,মিম,তারিন ও ছুটে এলো চিৎকারে।
তারিন জিজ্ঞেস করলো,”কি হয়েছে তোর,এমন হেড়ে গলায় চেচাচ্ছিস কেনো?”
তানভীর জিজ্ঞেস করলো,”তোমাদের সবার রাতের খাবার হয়েছে?”
রেবেকা বললো,”হ্যাঁ হয়েছে তো।কেনো?”
দরজার পাশে থাকা ফ্লাওয়ার ভাসটা ফ্লোরে ছুঁড়ে মেরে তানভীর বললো,”সবার খাওয়া হলে আমার বউয়ের খাওয়া হয় নি কেনো?
এতোগুলা মানুষ তোমরা কেউ একবার ডাকো নি কেনো ওকে?
দুপুরে তো তোমরাই দেখেছো ও এক দানা ভাত ও মুখে দেয় নি।
সবাই সবার খাবার ঠিকমতো খেয়ে নিয়েছে,আমার বউকে রেখে!
কিসের এতো অবহেলা আমার বউকে?
তোমাদের পছন্দ মতো হয় নি বলে? ”
আচমকা এতোগুলো প্রশ্ন শুনে রেবেকা থতমত খেলেন।ঝড়ের মতো তানভীর রান্নাঘরে ঢুকে গেলো।নিজের হাতে পেঁয়াজ,কাঁচামরিচ কেটে ডিম ভাজি করলো।
এক চুলায় ভাত গরম করে নিয়ে,ধোঁয়া উঠা গরম ভাতের সাথে পিরিচে করে ডিম ভাজা,এক বাটিতে ভাজা ইলিশ মাছ নিয়ে রুমের দিকে গেলো।
বিদেশে নিজের রান্না নিজেই করে বিধায় সব কাজই তানভীরের জানা।রুমে ঢুকে সবার মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিলো।
সবাই সবটা দেখলো।মিম আনিকার হাতে চাপ দিয়ে বললো,”দেখলেন ভাবী,আজ বিয়ে হয়েছে অথচ আজকেই বউয়ের গোলাম হয়ে গেছে।”
আনিকা ক্রুর হেসে বললো,”সবই ধলা চামড়ার খেলা রে মিম।”
পূরবী রুমে বসে তানভীরের চেচামেচি শুনলো সবটা।শুনে লজ্জায় কুঁকড়ে গেলো। অজানা এক অপরাধবোধে ভুগতে লাগলো। যদি পূরবী মিথ্যা করে বলতো যে খেতে ডেকেছে তাহলে তো এতো কথা হতো না।
তানভীর পুরবীর সামনে বসে ভাত মাখতে মাখতে বললো,”জানো পূরবী, আমি তো সারাজীবন দেশে থাকবো না।আমি তাই সবসময় ভাবতাম আমার বিয়ের পর আমি আমার বউয়ের এতো যত্ন নিবো,এতো এতো এতো যত্ন নিবো যে আশেপাশের যতো ভাবীরা আছে সবাই যাতে আমার বউকে হিংসে করে। আমার বউ যাতে আফসোস করার সুযোগ না পায় আমি তার পছন্দসই না বলে।
লোকে বলে প্রবাসীদের বউরা বেশিরভাগই পরকীয়া করে।আমি এতো ভালোবাসবো আমার বউকে যে আমার বউ যাতে কখনো ভাবতেই না পারে পৃথিবীতে তার স্বামী ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পুরুষ আছে তাকে ভালোবাসার জন্য।
আমার পাগলের মতো ভালোবাসাই আমার বউকে আমার করে রাখবে।
এবার হা করো,আমি তোমাকে খাইয়ে দিবো সবসময়। যতোদিন দেশে আছি,আমি তোমার সব কাজে হেল্প করবো।তুমি কখনো আমাকে ভয় পেও না।মনে রেখ,এই পৃথিবীতে তোমার একান্ত আপন মানুষ শুধু আমিই আছি।”
তানভীরের কথায় পূরবী কিছুটা স্বস্তি পেলো। লজ্জা না পেয়ে খেয়ে নিলো।
খাবার পর তানভীর জিজ্ঞেস করলো,”তোমার কি কোনো সমস্যা হচ্ছে পূরবী?
তোমার মুখে কেমন ব্যথার ছাপ।”
পূরবী ভাবলো বলবে কি-না। তারপর ভাবলো,একে ছাড়া আর কাকে বলবো।কেউ তো নেই আর।
ভেবেচিন্তে বলেই দিলো,একটা বোতলে করে ওর গরম পানি লাগবে।ভীষণ পেটে ব্যথা,কোমরে ব্যথা হচ্ছে।
শুনে তানভীর থমকে দাঁড়ালো। তারপর জিজ্ঞেস করলো,”তোমার কি পিরিয়ড চলছে? ”
লজ্জায় মাথা নিচু করে পূরবী বললো,”হ্যাঁ। ”
আবারও রেগে গেলো তানভীর। চেয়ারে লাথি মেরে বললো,”মানে কি এসবের?
আজকে বিয়ে হয়েছে,কোথায় বাসর হবে তা না তোমার এসব হলো কেনো?
আমি কতো প্ল্যানিং করে রেখেছিলাম,কতো এক্সাইটেড ছিলাম।আমার সব প্ল্যানে তুমি জল ঢেলে দিলে।
ভাল্লাগেনা এখন আমার।”
পূরবী বুঝতে পারলো না এই লোকের সমস্যা কোথায়।এরকম হুটহাট রেগে যায় কেনো।পিরিয়ড তো প্রতিমাসেই হয় তাতে সমস্যা কি এর?
দরজা খুলে রুম থেকে বের হয়ে গেলো তানভীর। রেবেকার রুমের সামনে গিয়ে আবারও ডাকতে লাগলো। প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হলো রেবেকার ছেলের ডাক শুনে।বিরক্তি চেপে রেখে বললো,”কি হয়েছে আবার?
এখন কি তোর বউয়ের কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইতে হবে না-কি? ”
তানভীর ভ্রু কুঁচকে বললো,”হট ওয়াটার ব্যাগটা দাও,পূরবী অসুস্থ ওর লাগবে।আর শুনো মা,এতিমের মাথায় হাত বুলালে আল্লাহ খুশি হয়।পূরবীকে আপন করে নেয়ার চেষ্টা করো।”
রেবেকা ওয়াটার ব্যাগ এনে দিতেই তানভীর চলে গেলো।
রুমে গিয়ে নিজেই বসে ব্যাগে চার্জ দিয়ে ব্যাগ গরম করলো।তারপর পূরবীর কোমরে সেঁক দিলো।আরামে পূরবীর দুচোখ বন্ধ হয়ে এলো।
এক সময় ঘুমিয়ে গেলো পূরবী।
বাকী রাত তানভীরের কাটলো বউয়ের কোমরে আর পেটে গরম সেঁক দিতে দিতে।
পূরবীর কপালে চুমু খেয়ে বললো, “রেগে যাই বলে আমায় খারাপ ভেবো না বউ।যতোটা রাগ করতে জানি তার চাইতে হাজার গুণ বেশি ভালোবাসতে ও জানি।”
চলবে….?