গল্পঃ কে তুমি ( প্রথম পর্ব )
লেখাঃ ইমতিয়াজ আহমেদ চৌধুরী
মাঝরাতে হঠাৎ করে হিমিকে টেনে বুকের ওপর তুলে শক্ত করে বুকে চেপে ধরে নিলয়, তারপর পাগলের মতো কপালে ঠোঁটে গালে চুমু খেয়ে বলে,– তোমাকে হারানোর আগে আমি নিজে হারিয়ে যেতে চাই পৃথিবী থেকে, নয়তো তোমাকে হারিয়ে আমি বাঁচতে পারবো না।
হিমির ঘুম ভেঙে যায়, নিলয়ের কপালে চুমু খেয়ে ভাঙা গলায় মৃদু হেসে হিমি বলে,– নিশ্চয়ই আবার সেই দুঃস্বপ্ন দেখেছো! শোনো নিলয় স্বপ্ন স্বপ্নই হয়, আমি তোমায় ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না, তোমার ছিলাম, তোমার আছি, তোমার থাকবো।
আসলে কয়েকদিন ধরে খুব বাজে একটা দুঃস্বপ্ন দেখছে নিলয়, হিমির মৃত্যুর। তাই প্রতিক্ষণ অজানা আতঙ্কে কাটে তার।
হিমি আবারও নিলয়ের ঠোঁটে চুমু খেয়ে বললো,– স্বপ্নের কথা ভেবে ঘুম নষ্ট করে লাভ নেই, চলো দুজন দুজনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমাই।
তারপর দুজন দুজনকে জড়িয়ে আবার ঘুমের দেশে।
ঠিক তার দুদিন পরে–
ট্রাকের ধাক্কায় নিলয়ের গাড়ি ছিটকে গিয়ে গাছের সাথে ধাক্কা খেয়ে উল্টে যায়। সামনের গ্লাস ভেঙে বেশ বড়ো সাইজের একটা টুকরো হিমির মাথায় অনেকখানি ঢুকে যায়। রক্তাক্ত হাতে নিলয়ের মুখটা স্পর্শ করে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে অস্পষ্ট ভাবে হিমি বলে,– নিজের দিকে খেয়াল রেখো। তারপর হিমির শরীর নিথর হয়ে যায়।
মাস দুই আগে নিলয় এবং হিমি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। সপ্তাহ শেষে দুজনে লং ড্রাইভে বের হয় তারা। সুনসান নিরিবিলি রাতের রাস্তা, গাড়ির স্পিড একেবারে কম। একটু পরে পরে দুজনের চোখে চোখ, মুচকি হাসি। এই মুহূর্ত যেন বর্ননা করা যায়না, ভালোলাগা, ভালোবাসা, আনন্দের আবেশ।
হঠাৎই মালবাহী একটি ট্রাক প্রচন্ড গতিতে রং সাইডে এসে নিলয়ের গাড়িটা ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। নিলয়ের গাড়িটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ছুটে গিয়ে একটা গাছের সাথে প্রচন্ড জোরে ধাক্কা খেয়ে উল্টে যায়। ভাঙা গ্লাসের একটা টুকরো হিমির মাথায় অনেকখানি ঢুকে যায়, শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার আগেও রক্তাক্ত হাতে নিলয়ের মুখটা স্পর্শ করে কাঁপা কাঁপা অস্পষ্ট কণ্ঠে হিমি বলে,– নিজের দিকে খেয়াল রেখো। তারপর হিমির শরীর নিথর হয়ে যায়। ভালোবাসা বুঝি এমনই হয়, শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার আগেও ভালোবাসার মানুষটার কথা ভাবা, নিজের মৃত্যু জেনেও ভালোবাসার মানুষকে আগলে রাখার প্রবল চেষ্টা, ভালোবাসা যদি দৃশ্যমান হতো তবে মৃত্যুর আগেও ভালোবাসার মানুষটির জন্য একজন মানুষ কি পরিমাণ ভালোবাসা রেখে যায় সেটা দেখা যেতো।
কিছু বলতে পারছেনা নিলয়, চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে, পৃথিবীটা অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। নিলয় অজ্ঞান।
নিলয়ের যখন জ্ঞান ফেরে তখন সে হাসপাতালের বেডে। হিমিকে না দেখে হন্তদন্ত হয়ে উঠতে গিয়ে খেয়াল করে তার হাত এবং পায়ে ব্যান্ডেজ করা। ‘ ডাক্তার আমার হিমি কোথায়,’ বলে গড়িয়ে বেড থেকে ফ্লোরে পড়ে নিলয়, স্যালাইনের পাইপ টেনে খুলে ফেলে হামাগুড়ি দিয়ে দরজার দিকে যেতে যেতে বলতে থাকে,– আমি আমার হিমির কাছে যাবো, হিমি একলা থাকতে ভীষণ ভয় পায়, কোথায় আমার হিমি।
ডাক্তার এবং কয়েকজন নার্স মিলে নিলয়কে ধরাধরি করে বেডে এনে শুইয়ে দেয়।
নিলয় ডাক্তারকে প্রশ্ন করে,– আমার হিমি কোথায় ডক্টর?
ডক্টর মাথা নিচু করে জবাব দেয়,– হিমি বেঁচে নেই।
‘হিমি’ বলে চিৎকার করে আবার নিলয় বেড থেকে ফ্লোরে গড়িয়ে পড়ে।
আবার ডাক্তার এবং নার্স মিলে নিলয়কে ধরে বেডে শুইয়ে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি করে নিস্তেজ হয়ে পড়ে নিলয়।
এভাবে কয়েকমাস হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠে নিলয়।
নিলয় এবং হিমির প্রথম পরিচয় হয়েছিল কীভাবে চলুন জেনে নেই–
বছর খানেক আগে একটা রেলস্টেশনে মধ্যরাতে পরিচয় হয়েছিল নিলয় ও হিমির। নিলয় হেটে যাচ্ছিল এমন সময় পেছন থেকে হিমির কণ্ঠ ভেসে এলো,– মাতৃভূমিতে সামান্য হেল্প পাবার মতো একটা মানুষ নাই, কি অদ্ভুত!
ঘুরে দাড়িয়ে হিমিকে দেখে নিলয় চোখ ফেরাতে পারছিল না। মানুষ এত সুন্দর হতে পারে! শ্যামলা রঙ্গের মেয়েটির চেহারার সৌন্দর্য যেন স্বর্গের অপ্সরাদের হার মানাবে। চোখ, মুখ, নাক, কান যেন মায়ার সমুদ্র। তার মুখের হাসি যেন চৈত্রের খাঁখাঁ রোদ্দুরে পথিকের মাথার উপর উড়ে এসে ছায়া দেয়া এক খন্ড মেঘের মতো প্রশান্তির।
হিমি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,– হাই, আমি হিমি, জন্মস্থান বাংলাদেশ কিন্তু বেড়েওঠা লন্ডনে, প্রচুর ঘোরাঘুরি করতে ভালোবাসি, এডভেঞ্চার আমার নেশা বলতে পারেন। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিশ্বের সামনে তুলে ধরার ইচ্ছা, তাই সময় হলে ছুটে আসি। নিজের জন্মভূমির এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত যদি ঘুরতে না পারলাম, তবে বিশ্ব ভ্রমণের ছাড়পত্র আর পড়ালেখা না করে টাকা দিয়ে সার্টিফিকেট কিনে নেয়া বিষয়টি এক হয়ে গেল না! মানে পরিপূর্ণ জ্ঞানার্জন ছাড়াই সার্টিফিকেট।
নিলয় হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডসেক করে বললো,– আমি নিলয়, একজন ব্যবসায়ী। নিলয় গ্রুপের মালিক, কয়েকটা ফ্যাক্টরি আছে ওগুলো নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়, তবুও সময় পেলে বেড়িয়ে পড়ি প্রকৃতির সান্নিধ্য পেতে। তবে আমার যেটা মনে হয়, আপনি ভীষণ স্মার্ট এবং উচ্চশিক্ষিত, আপনার সাথে পরিচিত হতে পেরে দারুণ লাগলো।
হিমি তার হাতের লাগেজটা নিলয়ের দিকে ঠেলে দিয়ে বললো,– আপাতত লাগেজটার দায়িত্ব আপনি নিলে আমার আরও দারুণ লাগবে।
হিমির চঞ্চলতা এবং চতুরতা দেখে নিলয় অবাক! মেয়েটির খুব সহজে কারো সাথে মিশে যাবার জাদুকরী ক্ষমতা আছে।
হিমি লং-স্লিভ শার্ট পরা, হাতা ভাজ করে কনুই পর্যন্ত ওঠাতে ওঠাতে বললো,– এদেশে হেল্পিং হ্যান্ড এখনও চিন্তার বাইরের বিষয়! কেউ কারো হেল্প করতে চায়না।
নিলয় বললো,– এই যে আমি হেল্প করছি।
হিমি শব্দ করে হেসে বললো,– তাও তো ঠ্যালায় পরে, জোর করে লাগেজটা দিয়েছি তাই সাহায্য করতে বাধ্য হলেন।
: হাহাহা, যেভাবেই হোক করলাম তো। থাকবেন কোথায়?
: এখনও ঠিক করিনি।
: কোনো হোটেল বুকিং না করে এসে ভুল করেছেন, রাতের বেলা একটা মেয়ের পায়ে পায়ে বিপদ।
: আচ্ছা, আপনি হোটেল বুক করেছেন?
: হ্যাঁ।
: আমি ওখানেই থাকবো আপনার সাথে, একটা মেয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আপনার দায়িত্ব, একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে।
: এক রুমে তাও আবার একটি অপরিচিত মেয়ের সাথে।
: সমস্যা নেই, আমি ক্যারাটে জানি, আপনার মনে কুমতলব জাগলে পিটিয়ে পাটিসাপটা বানিয়ে ফেলবো।
হিমির কথা শুনে নিলয় হো-হো করে হেসে উঠে বলে,– সমস্যা নেই, রাত যেটুকু বাকী আছে গল্প করে কাটিয়ে দেবো।
এভাবেই পরিচয় হয়েছিল দুজনার, তারপর ভালোলাগা, ভালোবাসা। বছরখানেক হিমি নিলয়ের নিলয় গ্রুপের সিনিয়র একাউন্ট ম্যানেজার হিসেবেও কাজ করে। তারপর আবার লন্ডন চলে যায়। এবং বছর খানেক পরে আবার ফিরে আসে, তারপর বিয়ে।
এই বিয়েতে সম্মতি ছিলনা হিমির পরিবারের। লন্ডনে হিমির বাবার বিভিন্ন ব্যাবসার কছে নিলয়ের নিলয় গ্রুপ তুচ্ছ। নিলয়ের যা সম্পদ তা হিমির বাবার অর্থ সম্পদের কাছে কিছুই না। ভালোবাসার দেয়াল এখান থেকেই তৈরী হয়। সবাই অর্থবিত্তের প্রতি দূর্বল, দুটি হৃদয়ের ভালোবাসা নিঃশেষ হয় চাপা পড়ে এই অর্থবিত্তের নিচে, সেদিকে কজন খেয়াল রাখে! এই অবস্থায় হিমি সবাইকে ছেড়ে লন্ডন থেকে চলে এসেছিল নিলয়ের সাথে ঘর সংসার সাজানোর আশায়। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, বিয়ের মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই অসম্পূর্ণ স্বপ্ন নিয়ে পৃথিবী ছাড়তে হলো।
এবার বলতে পারেন মৃত্যু হয়েছে ভালো হয়েছে, মা-বাবার মনে কষ্ট দিয়ে কেন আসলো এভাবে!
আসলে হিমির চিন্তা ছিল অন্য রকম। তার বিশ্বাস মা-বাবা কোনদিন সন্তানকে দূরে ঠেলে দিয়ে থাকতে পারেনা, ঠিকই বুকে টেনে নেয়। কিন্তু ভালোবাসার মানুষকে হারালে তাকে না পাবার ক্ষতটা আজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। প্রত্যেকটা মানুষের নিজের সুখের পথটা বেছে নেয়ার অধিকার আছে, তবে ভেবেচিন্তে। নিলয়ের ভালোবাসা কখনও মিথ্যে মনে হয়নি হিমির, মনে হয়নি নিলয়ের ভালোবাসায় খুঁত আছে। মনে প্রাণে বিশ্বাস এবং ভালোবেসেছিল বলেই হিমি ছুটে এসেছিল নিলয়ের কাছে, তার স্বপ্নের রাজপুত্রের কাছে, তার সুখের ঠিকানায়। অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছে হিমি তার মা-বাবাকে, যখন কিছুতেই মানছিল না, তখন বাধ্য হয়ে হিমি চলে আসে। হিমির প্ল্যান ছিল বিয়ের কিছুদিন পরেই নিলয়কে নিয়ে লন্ডনে মা-বাবার সামনে উপস্থিত হবে। তারা মেনে নিতে না চাইলে দুজনেই ক্ষমা চাইবে, কিন্তু সেই সুযোগ আর পেলনা হিমি।
যা-ই হোক হিমিকে হারানোর ক্ষত নিয়ে বিধ্বস্ত নিলয় আজও দিশেহারা।
রাস্তার ওপাশের রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এপাশে আসতে আসতে কিছু একটা দেখে রাস্তার মাঝখানেই থমকে দাড়ায় নিলয়। সমস্ত খেয়াল যেন একত্র হয়ে নিক্ষিপ্ত ঐ এক দিকেই। প্রচন্ড স্পিডে ছুটে আসা একটি গাড়ী বারবার হর্ণ বাজিয়েও নিলয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পেরে কড়া ব্রেক করে গাড়ি থেকে একজন লোক নেমে এসে ধাক্কা দিয়ে নিলয়কে বলে,– মরতে হলে নদীতে ঝাপিয়ে মরো, এখানে মরলে নিজেও মরবে আমাদেরও মারবে।
নিলয়ের ধ্যান ভাঙে, ‘স্যরি’ বলে দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে অসংখ্য লোকের ভীড়ে কাউকে খুঁজতে থাকে পাগলের মতো। নিলয়ের ভীষণ ইচ্ছা তাকে একটিবার জিজ্ঞেস করা,– কে তুমি?
কিন্তু এত লোকের ভীড়ে কাঙ্খিত সেই মুখ যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। তবু নিলয় অসংখ্য লোকের মাঝে পাগলের মতো খুঁজে চলছে। খুঁজে না পেলে হয়তো হিমিকে হারানোর ক্ষতটা আরও জীবন্ত হয়ে উঠে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিলয়ের বুকটা আরও ছারখার করে দেবে।
ডাক্তার বললো হিমি বেঁচে নেই, তাহলে এক ঝলক দেখে যাকে হুবহু হিমির মতো মনে হলো, সে কে?
চলবে…