#কেবিন_নং_থার্টি_সিক্স
পর্ব:০৬
জাহান আরা
কলেজ ছুটির পর বের হতে হতে আমার আরো দশ মিনিট সময় লেগে যায়।বের হতেই দেখি নেহাল দাঁড়িয়ে আছে বাইক নিয়ে।
আমার মনে পড়ে গেলো অনেক বছর আগের কথা।
এসএসসি তে গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়ায় ইন্টারে উঠার পর নেহাল কে আংকেল বাইক কিনে দেয়।নিজের বাইক হওয়ার পর নেহালের সে-কি উত্তেজনা।
সাথে সাথেই আমাদের বাসায় গিয়ে হাজির নেহাল।মুখে কথা নেই,প্রচন্ড উত্তেজিত থাকায় গলা দিয়ে ওর কথা বের হচ্ছিলো না।কোনো মতে আমার হাত ধরে টানতে টানতে নিচে নিয়ে এলো।
নেহালের হঠাৎ এই পাগলামি দেখে বাবা মা ও কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়।বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে বাবা মা।
নিচে গিয়ে দেখি বাইক নিয়ে আংকেল দাঁড়িয়ে আছে।আংকেলের হাত থেকে বাইকের চাবি নিয়ে বাইক স্টার্ট দেয় নেহাল।তারপর আমাকে পিছনে বসিয়ে ছুটে চলে।
সেদিন আমরা অনেক অনেক অনেক দূর পর্যন্ত গিয়েছি।শহরের গণ্ডি পেরিয়ে গ্রামে চলে গিয়েছি।মাঠের পর মাঠ ধানক্ষেত,পাশে বয়ে চলা নদী।নদীর স্বচ্ছ টলটলে জল।দেখেই তৃষ্ণা জেগে গিয়েছিলো। বাইক থেকে নেমে দুজনে আঁজলা ভরে পানি পান করি।
বুনো ফুলের ঘ্রাণে মাতোয়ারা হয়ে যাই।
বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়।জীবনে প্রথম বাবা মা ভাইয়াদের ছাড়া একা এতো দূর গিয়েছি।
তারপর থেকে কলেজ আসা যাওয়া হতো নেহালের সাথে।
আমাকে থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নেহাল বাইকে হর্ণ দেয়।কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরে আসি আমি।তারপর গিয়ে নেহালের বাইকে বসি।নেহাল যেতে যেতে আমাকে জিজ্ঞেস করে,”লাঞ্চ করেছিস তুই?”
“বাসায় গিয়ে করবো।”
“আমি করি নি,চল আজ বাহিরে খাই।”
“না আমি বাসায় গিয়ে খাবো,আম্মা অপেক্ষা করবে আমার জন্য।”
আমার কথা শুনে নেহাল কিছুটা আশাহত হলো।কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,”আজ এতো বছর পর তোর সাথে আমার দেখা কাজল,অথচ আজকের জন্যও তুই নিয়ম ভেঙে আমার সাথে খেতে পারবি না?
মনে আছে কাজল তোর,স্কুলে থাকার সময় তোর টিফিনের টাকা দিয়ে তুই সাজগোজের জিনিস কিনতি,সাজতে খুব ভালোবাসতি তুই।তোকে ক্ষেপানোর জন্য আমি তোকে ডাকতাম লিপস্টিক কোম্পানি বলে।কতো হাজার লিপস্টিক তোর কালেকশনে ছিলো সেটা ভেবেও আমি শকড হতাম।
টিফিন টাইমে তারপর দুজনে মিলে আমার টিফিন ভাগ করে খেতাম।দু’দিন পর পর তুই রেস্টুরেন্টে খাওয়ার জন্য ঘ্যানঘ্যান শুরু করতি।পথে আমাকে অসংখ্য চড়-থাপ্পড় খেতে হতো তোকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে যাই না বলে।সবসময় তুই আমার সাথে খেতে পছন্দ করতি।”
নেহালের কথা শুনতে শুনতে আমার চোখে পানি চলে এলো।কি সুন্দর ছিলো সেই সময়টা।তবুও কিছুটা দূরত্ব আসে নেহাল যখন টিউশন শুরু করে।
“তুই মধ্যখানে আবার টিউশন শুরু করলি কেনো?”
আমার প্রশ্ন শুনে নেহাল হাসতে থাকে।আমি কিছুটা বিরক্ত হই।
হাসি থামিয়ে নেহাল জবাব দেয়,”তখন আমার বয়স ছিলো কতো বল,পকেট মানি পেতাম কতো আর?
তোর রেস্টুরেন্টে খাবার বায়না মেটাতাম কি করে নয়তো আমি টিউশন শুরু না করলে।”
আমি যেনো আকাশ থেকে পড়লাম নেহালের কথা শুনে।কি বললো এটা নেহাল?
আমাকে চুপ থাকতে দেখে নেহাল আবার বলতে লাগলো,”তোর সব স্মৃতি আমার মনে আছে লতা,আজীবন মনে থাকবে।আমি আজও আগের নেহাল আছি লতা,কিন্তু তুই পালটে গেছিস।এখন আর আমার সাথে খেতেও তোর ইচ্ছে করে না।কতো দায়িত্ববোধ তোর এখন!
স্বামীর প্রতি,শ্বশুর শাশুড়ির প্রতি,শিক্ষার্থীদের প্রতি।নেই শুধু নেহালের প্রতি।নেহাল কখনো তোর কেউ ছিলো না,কখনো তোর বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো না।”
বলতে বলতে নেহালের কণ্ঠ কেমন হয়ে এলো।আমি জানি নেহালের এখন কান্না পাচ্ছে।ভীষণ কান্না পাচ্ছে নেহালের।কিন্তু এ ও জানি নেহাল এখন কাঁদবে না।কিছুতেই কাঁদবে না।
নেহালকে ধাতস্থ হবার সময় দিয়ে আমি বললাম,”আমি একজন বিধবা মহিলা নেহাল,আগের সেই কাজললতা নেই রে।এখন আর আমার ঝাড়া হাত পা নেই,চাইলেই মাইলের পর মাইল ছুটে যেতে পারি না তোর সাথে।
বাসায় কোনো খাবার পছন্দ না হলে এখন আর তোর বাসায় হাজির হয়ে বলতে পারি না,চল বাহিরে খেতে যাবো,ক্ষিধা লাগছে আমার।
রাস্তায় কারো গাছে বড়ই দেখলে এখন আর তোকে বলতে পারি না,ঢিল মার নেহাল,বড়ই খাবো।নিজের আইসক্রিম শেষ হয়ে গেলে তোর হাতের আইসক্রিম কাড়াকাড়ি করে খেতে পারি না নেহাল।আমি এখন অনেক বড় হয়ে গেছি।তোর কল্পনার চাইতে বেশি বড় হয়ে গেছি আমি নেহাল।
এখন আমার মাথায় অনেক দায়িত্ব। অভ্রর খুনীদের খুঁজে বের করতে হবে।বৃদ্ধ শ্বশুর শাশুড়ির দেখাশোনা করতে হবে।তাদের ছেলের অভাব আমাকে পূরণ করতে হবে।
আমি এখন আর পুঁচকে কাজল নই,কতোদিন হয়ে গেছে আমি কাজল ছুঁয়ে দেখি নি।কাজল তো দূরের কথা,শেষ কবে চুলে চিরুনি করেছি,আমার তাও মনে পড়ে না।
আমার এখন সাদাকালো জীবন,এখন আর রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়ার বিলাসী জীবন আমার নেই।
এখন আর স্বাদ চেখে দেখি না খেতে বসলে,এখন খাই বেঁচে থাকতে হবে বলে।বেঁচে থাকার জন্য যতোটুকু না খেলেই নয়,সেটুকু খাই।”
নেহাল আর কিছু বললো না।ওর মামার বাসায় গিয়ে বসার ২ মিনিটের মাথায় ওর মামা বের হয়ে এলেন।নেহালকে দেখেই বুকে জড়িয়ে ধরলেন।কুশল জিজ্ঞেস করে জানতে চাইলে সমস্যা কী।
নেহাল বিস্তারিত খুলে বললো শুরু থেকে।সব শুনে নেহালের মামা আমাকে বললেন সেই নাম্বারে আবার কল দিতে।
আমি জানতাম নাম্বার বন্ধ থাকবে,কিন্তু অবাক হয়ে গেলাম কল দিয়ে।নাম্বারটা অন পেলাম।
রিং হচ্ছে ওপাশে।
কিছুক্ষণ পর কেউ একজন রিসিভ করলো।কিছুক্ষণ হ্যালো,হ্যালো করে কল কেটে দিলো।
উত্তেজনায় আমার সারা শরীর কাঁপতে শুরু করলো।নেহালের মামা পুলিশ কমিশনার আলতাফ আহাম্মেদ কন্ট্রোল রুমের সাথে যোগাযোগ করলেন।নাম্বারটার লোকেশন জানার জন্য।
কন্ট্রোল রুম থেকে জবাব এলো,ফোনের লোকেশন মিরপুর বস্তি শো করছে।
আলতাফ আহাম্মেদ সাথে সাথে বললেন ফোর্স নিয়ে তার বাড়িতে চলে আসতে,এখনই একটা মিশনে যাবে।
আমাদের অপেক্ষা করতে বলে তিনি ভিতরে চলে গেলেন,ইউনিফর্ম পরতে।
আনন্দে আমি কেঁদে ফেললাম।আমার প্রতিশোধ নেয়ার স্বপ্ন পূর্ণ হতে যাচ্ছে।আর মাত্র কিছু সময়।তারপর আমি খুঁজে পাবো অপরাধীদের মধ্যে একজন কে।একজনকে পেলেই বাকীদের ধরা এক মুহূর্তের কাজ।
১০ মিনিটের মাথায় পুলিশ ফোর্স এসে হাজির।বাসায় কল করে আম্মাকে বলে দিলাম আমার দেরি হবে আজ আসতে,খেয়ে নিন আপনারা।
তারপর আমিও ওনাদের সাথে গাড়িতে উঠে বসলাম।
চলবে….