#কেবিন_নং_থার্টি_সিক্স
পর্ব:১৫(শেষ পর্ব)
লিখা:জাহান আরা
বিয়ের ১ বছর পার হয়ে গেলো নির্বিঘ্নে। অভ্রর কথা আমি পুরোপুরি ভুলে গেছি বলতে গেলে।না ভুলি নি,মনে পড়ে মাঝে মাঝে।
যখনই মনে পড়ে তখনই করুণা হয় নিজের উপর নিজের।হায়,কাকে ভালোবাসলাম আমি?
একজন ধর্ষককে!
ছি!
নেহালের দিন খুব ব্যস্ততার মধ্যে কাটে,সকাল শুরু
হয় নাস্তা বানানোর কাজে,নাস্তা শেষ করে আমাকে কলেজে দিয়ে আসে,বাসায় এসে রান্না সেরে ফেলে।গোসল করে নামাজ পড়ে আবার হাজির হয় গিয়ে আমার কলেজের সামনে আমাকে নিয়ে আসার জন্য।
দুপুরে আব্বা আম্মাসহ এক টেবিলে বসে লাঞ্চ শেষ করি।বিকেলে ছাদে বসে গল্প,সন্ধ্যায় চা বানানো,তারপর ডিনার রেডি করা।সবকিছুই নেহাল নিজ হাতে করে।
কে জানতো কোনো একসময় আমার কপালেও এরকম সুখ লিখা থাকবে!
আমি তো ভাবি নি কখনো। অন্তত অভ্রর মৃত্যুর পর ভেবে নিয়েছি জীবনের সব রঙ মুছে গেছে।সব ত্যাগ করেছি জীবন থেকে,অথচ শেষে এসে দেখলাম আমার হিসাব আগাগোড়ায় ভুল।
যাকে ভেবে নিজের জীবনকে বিষাদময় করে নিয়েছি সেই মানুষটাই ভুল ছিলো।সেই ছিলো একজন ধর্ষক।
যার জন্য আমাকে হতে হয়েছে ধর্ষিতা। ভাবলেই আমার সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে।নিজেকে তখন মনে হয় অশুচি।
ঘন্টার পর ঘন্টা ঝর্ণার নিচে দাঁড়িয়ে ভিজতে থাকি শরীর থেকে নোংরা স্পর্শ মুছে ফেলার বৃথা চেষ্টায়। কিন্তু হায়!
এ ও কি সম্ভব!
এই কলঙ্কের দাগ কি দিয়ে মুছলে যাবে!জানা নেও আমার।গুম মেরে যাই যখনই এসব মাথায় আসে।কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না।নিজেকে গুটিয়ে নিই শামুকের মতো খোলসের ভিতর।
রাতে নেহাল যখন কাছে টানে আমাকে,গভীর আদরের জন্য,সেই মুহূর্ত টা আমার কাছে মনে হয় নরকীয়।আমি পারি না সহ্য করতে।মন চায় শাস্তি দিই ওদের কিন্তু পারি না।
হতাশ হয়ে নেহাল হাল ছেড়ে দেয়।নেহালের এই জিনিসটা আমার ভালো লাগে,অন্তত যখন বুঝতে পারে আমি আপসেট তখন আর জোরাজুরি করে না।
তবে উদাস হয়ে বসে থাকে বাহিরের দিকে তাকিয়ে। মাঝে মাঝে আফসোস করে বলে তোমার খুব কষ্ট হয় না?
কেনো এতো ভাবছো তুমি?
এটা একটা এক্সিডেন্ট জাস্ট,এর বেশি কিছু না।মানুষের জীবনে এরকম কতো এক্সিডেন্ট থাকে।
হুট করে একদিন আব্বা আম্মা আমাকে নিয়ে যায় পাসপোর্ট করার জন্য,দেশের বাহিরে ঘুরতে যাবে বলে প্ল্যান করে যাতে রিফ্রেশমেন্ট হয়।
আমি ও আর আপত্তি করি নি,সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে আব্বা আম্মা।
দুজনের উৎসাহ আনন্দ দেখে আমার নিজেরই মন ভালো হয়ে যায়।
মাঝেমাঝে আম্মা আফসোস করে বলে এই দেশে আর থাকতে ইচ্ছে করে না রে বাবু,এই দেশের মানুষ খুবই খারাপ।আমার একটা বাবুকে তো হারিয়েছি,তোকে যেনো আর না হারাই।
আব্বা আম্মাকে জানাই নি কেনো অভ্র খুন হয়েছে,নিজের মৃত সন্তানের নামে এরকম কথা শুনতে কোনো বাবা মা-ই পারবে না।ভেঙে পড়বে খুব।
আরো মাস ছয়েকের মধ্যে আমাদের ভিসা হয়ে যায়,সব কিছু ঠিক করে নেহাল জানায় আমরা একেবারে লন্ডন চলে যাচ্ছি।
কথাটা শুনে আমি চমকে উঠি।দেশ ছেড়ে চলে যাবো ভাবতেই কেমন কষ্ট হয়। কিন্তু আব্বা আম্মা ভীষণ খুশী। নেহালকে জিজ্ঞেস করতেই নেহাল জবাব দিলো,”এই দেশে থাকলে এখানকার পারিপার্শ্বিক চাপে তুমি অতীত ভুলতে পারবে না।আমার চাকরি,বাসা সবই তো ওখানে।তাছাড়া আব্বা আম্মা ও এখানে থাকতে চায় না।
আমাদের ফ্লাইট সন্ধ্যা ৭টায়,সকাল থেকে সব রেডি করা শুরু করি আমরা। আব্বা অভ্রর বড় ভাইদের জানায় সব,সবাই প্রথমে আপত্তি করলেও আব্বা আম্মার দৃঢ়তার কাছে হেরে যায়।
দুপুরের দিকে নেহাল বের হয়ে যায় বাসা থেকে,জরুরি কোনো কাজ আছে বলে।বিকেল হতেই আমার কেমন যেনো অস্থিরতা শুরু হয়ে যায়।নেহাল তো কখনো বাহিরে একা বের হয় না এতো সময়ের জন্য।নেহাল না থাকায় আমি গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারলাম,নেহালের উপর আমি কতটা নির্ভরশীল,নিজের অজান্তে ওকে কতটা ভালোবাসি।
নেহাল ফিরে আসে সন্ধ্যার একটু আগে।দেখেই কেমন ক্লান্ত মনে হয় ওকে।বাসায় এসেই আমার দিকে কেমন ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকায় কিছুক্ষণ। তারপর কিছু না বলে চলে যায় তোয়ালে নিতে।হঠাৎ করে আমার চোখে পড়ে একটা দাগ।
নেহালের শার্টে লাল কিছুর দাগ।এই দাগ আমার চেনা।
প্রবল একটা ঝাঁকি খেলাম আমি।কিছু বলার আগেই নেহাল ওয়াশরুমে চলে যায়।গোসল করে আজ সময় নিয়ে।ভিতরে ভিতরে আমি যেনো মরে যাচ্ছি অস্থিরতায়।নেহাল কই ছিলো,কিসের রক্ত ওর শার্টে?
নেহাল বের হতেই আমি আর থাকতে পারি নি স্থির,ঝাঁপিয়ে পড়ি নেহালের বুকে।
বিয়ের পর এই প্রথম বারের মতো নিজ থেকে আমি নেহাল কে জড়িয়ে ধরেছি।আমার কান্না দেখে নেহাল আমার পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে,”কি হয়েছে লতা?”
নিজেকে সামলে জিজ্ঞেস করি আমি,”কিসের রক্ত ছিলো নেহাল?”
নেহাল একটুও চমকায় নি আমার প্রশ্ন শুনে।একটা গভীর দম নিয়ে বলে,”যারা তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে তাদের শাস্তি দিয়ে এসেছি আমি লতা।তবে প্রাণে মারি নি।জীবনে যাতে কোনো মেয়ের সাথে আর এরকম করতে না পারে তার ব্যবস্থা করে এসেছি নিজ হাতে।
ওরা এখন থানায় আছে।”
আমার বুকের ভিতর একটা আগুন চাপা পড়ে ছিলো,হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম সেই আগুন নিভে গেছে।কেউ যেনো বরফ শীতল পানি ঢেলে দিয়েছে সেই আগুনে।
আজ থেকে আমি পরম নিশ্চিন্ত। শান্তির দিন শুরু আজ থেকে।
“কিভাবে করেছো?”
“তোমার ভাবীদের বাসা আমি চিনি,তুমি কলেজে চলে গেলে আমি বাসার কাজ সেরে চলে যেতাম ওই নজরদারি করতে।
আশেপাশের লোকজনের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম ভাবীর ভাই আবদুল হক,একজন টিচার।
তারপর তাকে কিডন্যাপ করতে খুব একটা বেগ পেতে হয় নি।
টিউশনির টোপ দিয়ে শিকার করে ফেললাম।
তাকে জিম্মি করে কৌশলে তার দুলাভাই রাহাতকে কব্জা করে ফেললাম।
তারপর আর কী!
নিজ হাতে ওদের পুরুষাঙ্গ কেটে দিলাম।বাকীদের ধরার জন্য মামা ফোর্স পাঠিয়েছে। ওরাই স্বীকার করেছে সব।আমি মামাকে সব খুলে বলেছি,ভাবীকে আড়ালে রাখা হবে সব কিছু থেকে।”
নেহাল আরো শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে নিলো।আজ আর আমি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করি নি।
সময় স্থির হয়ে যাক এখানে,আজীবন যেনো এভাবে থাকতে পারি। ”
(সমাপ্ত)