#কেবিন_নং_থার্টি_সিক্স
পর্ব:১১
লিখা: জাহান আরা
জানালায় দিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে প্রকৃতি দেখছি আর ভাবছি জীবন আর ঋতুর মধ্যে আসলে কোনো পার্থক্য নেই।
জীবন যেমন এক বার এক রকম রঙ বদলায় তেমনি ঋতুও একবার এক রকম রঙ বদলায়।
মেইন রোডের পাশে কিছুক্ষণ পর পর জারুল,সোনালু,কৃষ্ণচূড়া গাছ দেখা যাচ্ছে।প্রতিটি গাছের যেনো আলাদা আলাদা সৌন্দর্য।
প্রকৃতির কি অপূর্ব সৌন্দর্য।
যখন যেই ফুল দেখি সেটাই ভালো লাগে,সেটা দেখলেই মনে হয় আল্লাহর সৃষ্টি কতো সুন্দর।
সোনালু গাছের হলুদ রঙা ফুল দেখলেই মনে হয় যেনো হলুদ পরী।কি সুন্দর ফুলে ফুলে সেজে আছে গাছটি।
প্রকৃতি দেখতে দেখতে আমি মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি। নেহাল
চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছে।সেই কখন থেকে নেহাল চুপ হয়ে আছে, আমি লক্ষ্য করেছি যদিও তবুও কিছু বললাম না আর।
হঠাৎ করে মনে হলো আমরা কোন দিকে যাচ্ছি?
এটা তো আমাদের বাসায় যাওয়ার রাস্তা না।এই রাস্তা তো অন্যরকম। এতোক্ষণ অন্য জগতে থাকার ফলে আমি বুঝতেই পারি নি নেহাল আমাকে অন্যদিকে নিয়ে যাচ্ছে।নেহাল কে জিজ্ঞেস করতেই নেহাল চুপ হয়ে রইলো।যেনো কোনো মানুষ না ও,পাথরের কোনো মূর্তি।
জিজ্ঞেস করতে করতে ক্লান্ত হয়ে চুপ হয়ে গেলাম আমিও।সময় হলে নেহাল নিজেই বলবে।শহরের রাস্তাঘাট,দালান অনেক আগেই দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে গিয়েছে,রাস্তার দুপাশে ধানক্ষেত আর ধানক্ষেত। হঠাৎ করেই আমি চিনতে পারলাম রাস্তাটা।এই সেই রাস্তা যেই রাস্তায় নেহাল আমাকে প্রথম বার নিয়ে এসেছে বাইক কেনার পর।
সেই আগের জায়গায় থামতেই নেহাল আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো।সারি সারি গাছের মাঝ দিয়ে যেতে যেতে একটা গাছের সামনে নিয়ে দাঁড় করালো।
একটা বিশাল দেবদারু গাছ।আমার দৃষ্টি আটকে গেলো একটা লিখাতে।
লাভ সাইনের মধ্যে লিখা N+L।
বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছি দুজন,কিন্তু নেহালের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
নেহালের দিকে তাকাতেই দেখলাম নেহালের চোখে যেনো একরাশ বিষণ্নতা এসে বাসা বেঁধেছে।নিচের দিকে তাকিয়েই নেহাল বললো,”তোর মনে আছে কাজল,এখানে আমরা আরো একবার এসেছি।সেদিন আমি তোকে এখানে নিয়ে এসেছি ভালোবাসার কথা বলতে।কিন্তু বলতে পারি নি।সেই কবে থেকে তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড মনে আছে তোর?
বন্ধু থেকে কবে যেনো তুই আমার জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছিস আমি নিজেও বুঝতে পারি নি।আমার সকাল বিকাল রাত কিছুই ওকে ছাড়া কাটতো না।কিন্তু তোকে বলতে ও পারতাম না।তুই যদি ভুল বুঝিস আমাকে এই ভয়ে।ভেবেছিলাম মাস্টার্স শেষ করে কোনো জবে ঢুকে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিবো।
তাই সেদিন এখানে এনেও তোকে আর বলা হয় নি ভালোবাসি। কিন্তু এই গাছটি তে লিখে গিয়ে গেছিলাম আমার ভালোবাসার কথা।
তোর মনে আছে আমার কাছে সবার আগে তুই ছিলি।পৃথিবীর সব এক দিকে আর তুই ছিলি অন্যদিকে।তোর আবদার মিটানোর জন্য আমি এক সময় টিউশনি শুরু করি।যখন তুই যা বলেছিস সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছি তোর কথা রাখার।আমি ভেবেছি তুই বুঝবি আমি তোকে কতো ভালোবাসি কিন্তু হলো উল্টো।
তুই প্রেমে পড়ে গেলি অভ্রর।জানিস,যেদিন তুই আমাকে বলেছিলি অভ্রর কথা,সেদিন সারারাত আমি কেঁদেছি মা’কে ধরে।মা জানতো শুধু আমি তোকে কতোটা চাই,আর কেউ জানতো না।
আমার কান্না দেখে মা বারবার বলেছিলো তোর বাবা মায়ের সাথে কথা বলে রাখবে আমাদের বিয়ের জন্য কিন্তু আমি নিষেধ করেছি।
তুই তো তখন অন্য কাউকে ভালোবাসতি,আমি কিভাবে তোর মনে কষ্ট দিয়ে তোকে জোর করে আমার করার চেষ্টা করতাম বল?
পারি নি আমি সেটা।
কিন্তু কখনো তোকে বুঝতে দিই নি তবুও নিজের বুকের ভিতর কিসের শূন্যতা বয়ে বেড়াই।
অভ্র এক সময় বুঝতে পারে তোর প্রতি আমার কোনো দুর্বলতা আছে হয়তো। তাই তোর আড়ালে আমাকে নিষেধ করে তোর সাথে কম মিশতে।
সেদিন আমার খুব জেদ চেপে যায়।ঠিক করেছিলাম আমি আর কখনো তোর সামনে আসবো না।
তাই মা’কে বলে বড় মামার সাথে কথা বলে কানাডা চলে যাই।
এই যে এতোগুলো দিন পার হয়ে গেলো কাজল,আমি আজও বুকের ভিতর তোর জন্য আমার ভালোবাসা বিন্দু মাত্র কমতে দেখি নি।আমি তোকে ভীষণ ভালোবাসি কাজল।কতো বেশি তা হয়তো কখনো বুঝাতে পারবো না।
তুই বিবাহিতা নাকি ডিভোর্সি নাকি বিধবা আমার তাতে কোনো মাথা ব্যথা নেই,আমার কাভহে আমার কাজল আজীবন পবিত্র। আমার পবিত্র ভালোবাসা।
আমাকে আর খালি হাতে ফিরিয়ে দিস না কাজল,আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারবো না।আমাকে একটা সুযোগ দে লতা,আমি ভালোবাসা দিয়ে তোর বিষাক্ত অতীত মুছে দিবো।”
পবিত্র!
তাও আমি?
কথাটা শুনেই হেসে উঠলাম আমি।ঠোঁটে যদিও হাসি আমার কিন্তু দুই চোখ জলে টইটম্বুর হয়ে যায়।নেহাল আমার দিকে অপ্রস্তুত হয়ে তাকিয়ে থাকে।
নেহাল কাকে পবিত্র বলছে?
নেহাল কি জানে আমি যে অপবিত্র একটি মেয়ে?
আমি যে ধর্ষিতা?
নেহালের দিকে তাকিয়ে চোখের জল মুছে বললাম,”তোর ছোট একটা ভুল হয়েছে নেহাল।তুই আমাকে যতোটা পবিত্র ভাবছিস আমি আসলে ততটা না।তুই জানিস না নেহাল,আমি যে ধর্ষিতা। অভ্রর সামনে ডাকাত দলের ২ জন লোক আমাকে সেদিন ধর্ষণ করেছে।আমার সারা শরীরে তাদের নোংরা ছোঁয়া আমি সারাক্ষণ টের পাই।আমার শরীরের প্রতিটি জায়গায় ওরা স্পর্শ করেছে।কি বিশ্রীভাবে স্পর্শ করেছে তা ভাবলেই আমার সমস্ত শরীর ঘৃণায় রি রি করে উঠে।নিজেকে ইচ্ছে করে আগুনে পুড়িয়ে ফেলি।
আমি কাউকে বলতে পারি নি সেই কষ্টের কথা।সেই লজ্জার কথা।কেউ জানে না।কিভাবে বলবো বল?
তুই ভুল মানুষ কে ভালোবেসেছিস নেহাল।”
আচমকা নেহাল শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। শক্ত করে ধরে ফিসফিস করে বললো,”আমার কাজল আমার কাছে আজীবন পবিত্র থাকবে,আমার হৃদয় মন্দিরে যে কাজলকে বসিয়েছি আমি দেবী করে,সেই দেবীকে অপবিত্র করে সেই সাধ্য কার রে কাজল?
আমার কাজলের মনটা কে তো ওরা ছুঁতে পারে নি,আমার কিসের ভয়?
তুই আমার,আজ থেকে ১১ বছর আগেও জানতাম তুই আমার,আজও জানি তুই আমার,আজ থেকে এগারোশো বছর পরেও জানবো তুই শুধু আমার।”
মুচকি হেসে নেহালকে ছেড়ে দিলাম।সোজা গিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম।বৃষ্টিতে ভিজে,রাস্তার কাঁদায় আমার অবস্থা শোচনীয়।নেহাল এসে গাড়িতে বসলো।
বাসায় পৌঁছে দিয়ে আব্বা আম্মার সাথে দেখা করে নেহাল চলে যায়।আমার ভীষণ মাথা ধরেছে।আলমারি থেকে ঔষধ বের করতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম।অভ্র আমার মাথাব্যথার ঔষধ,সর্দির ঔষধ,সব ঔষধ আলাদা আলাদা ভাগ করে সাজিয়ে রেখেছে।
ঔষধ খেয়ে আবার রেখে দিলাম।রাখতে গিয়ে বিয়ের শাড়িটি চোখে পড়লো।একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো বুকের ভিতর থেকে।শাড়িটি বিয়ের দিন এসে যে খুলে রেখেছি,অভ্র ভাঁজ করে রেখে দিয়েছে তারপর আর পরা হয় নি।দেখা ও হয় নি ছুঁয়ে।
দেখার জন্য শাড়িটি ধরে টান দিতেই একটা লাল ফাইল পড়ে গেলো শাড়ির ভিতর থেকে।
ফাইলের অদ্ভুত রকম নাম দেখে আমার কেমন যেনো সন্দেহ হলো।বুকের ভিতর একটা মোচড় দিয়ে উঠলো আচমকা।
ফাইলের উপর বড় অক্ষরে লিখা,”কেবিন নং থার্টি সিক্স ”
চলবে…..???