কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে পর্ব-০৩

0
2731

কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৩.
সারারাত মুষলধারায় বৃষ্টির পর একটা ঝকঝকে, তকতকে সকাল এসেছে। পরিষ্কার আকাশে কয়েক গুচ্ছ সাদা মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে। পাখিরা নীড় ছেড়ে বেরিয়েছে খাবারের খোঁজে। গ্রামের রাস্তায় ছোটো ছোটো বাচ্চাদের হুল্লোড় পড়েছে। সকাল-সকাল ঘুম থেকে উঠে নৈঋতার মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। ঘর থেকে বেরিয়ে চকচকে আকাশের দিকে তাকিয়ে সে বুকভরে নিঃশ্বাস নিল। কিন্তু সারা উঠান কাঁদায় মাখামাখি। এসব কারণেও বৃষ্টি তার একদমই পছন্দ না। সামনে তাকিয়ে দেখল মেহমানের ঘরের দরজা এখনও বন্ধ। শহরের মানুষ, হয়তো খুব দেরী করে ঘুম থেকে ওঠে। কোমরের নিচ অবধি লম্বা চুলগুলো হাতখোপা করতে-করতে নৈঋতা বাবা-মায়ের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। বাবাকে ঘরে পেল না। মা মুরগিকে খাবার খাওয়াচ্ছেন। নৈঋতা সিলভারের কলসি আর আরএফএলের বালতিটা হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। রান্নার জন্য নদী থেকে পানি তুলে আনতে হবে। নিত্যদিনের এ কাজে সে অভ্যস্ত। কয়েক পা এগোতেই দেখল রৌদ্রুপ দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। পরনের কালো ট্রাউজার আর সাদা টি-শার্টে তাকে বেশ মানিয়েছে। গতকাল লোকটার দিকে খুব ভালোভাবে তাকানো হয়ে ওঠেনি। খুব বেশি ফরসা না হলেও দেখতে সে মন্দ নয়। তাকে দেখে পা’গল না হলেও, মুগ্ধ হওয়া যায়। নৈঋতাও মুগ্ধ হলো। কিন্তু বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না। লজ্জা লাগছে বলে রৌদ্রুপকে দেখেও মাথা নিচু করে চলে যেতে উদ্যত হলো। কিন্তু দুপা এগোতেই রৌদ্রুপ তাকে দেখে ফেলল। আর দেখামাত্রই পিছু ডাকল,
“শোনো মেয়ে।”
অগত্যা নৈঋতা পা থামিয়ে মাথার ওড়নাটা টেনেটুনে পিছু ফিরে তাকাল। রৌদ্রুপের চক্ষু স্বার্থক হলো। নজরকাড়া সৌন্দর্যের অধিকারিণীর রূপ সে গতকালই দেখেছিল। কিন্তু তখন চারদিকে এত আলো ছিল না। সকালের এই প্রাণবন্ত পরিবেশটার মতোই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট রমণীকে প্রাণবন্ত লাগছে তার দৃষ্টিতে। রৌদ্রুপের দৃষ্টিতে নৈঋতা লজ্জায় মিইয়ে পড়ল। মাথা নিচু করে বলল,
“আপনার কিছু লাগবে?”
রৌদ্রুপ প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করল,
“তুমি কোথায় যাচ্ছ?”
“নদীর ঘাটে।”
“পানি আনতে?”
নৈঋতা ওপর নিচে মাথা দোলালো। রৌদ্রুপ পুনরায় প্রশ্ন করল,
“ফ্রেশ হব কোথায়?”
‘ফ্রেশ’ শব্দটার অর্থ নৈঋতার জানা আছে। এসএসসি অবধি এমন অনেক ইংরেজি সে শিখেছে। তবে তাকে পুনরায় লজ্জায় পড়তে হলো। কারণ তাদের বাড়িতে টিউবওয়েল নেই। পাশের বাড়ির টিউবওয়েল থেকে তারা খাবার পানি আনে। বাকি সব কাজ নদীর পানি এনে সারতে হয়। সে ভেবেছিল শহরের অতিথি ঘুম থেকে ওঠার আগেই তার জন্য পানি এনে রাখবে। তা আর হলো কই? আড়ষ্টতা নিয়ে সে আমতা-আমতা করে বলল,
“নদী থেকে পানি আনতে হবে। আমাদের বাড়িতে কল নেই। আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি এখনই নিয়ে আসছি।”
“নদী কতদূর?”
“এই তো কাছেই। বাড়ি থেকে বের হয়ে ডান দিকের রাস্তা ধরে সোজ যেতে হয়।”
“আচ্ছা, চলো আমিও যাব।”
রৌদ্রুপ দরজা ছেড়ে নৈঋতার দিকে এগিয়ে এল। নৈঋতা বেচারী পড়ল বিপাকে। সে চায় লোকটার থেকে দূরে থাকতে, আর লোকটা কি না যেচে তার সাথে যেতে চাইছে! বাধ্য হয়েই নৈঋতা সম্মতি জানিয়ে সামনের দিকে পা বাড়াল। পেছন-পেছন রৌদ্রুপও চলল। তারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে ডান দিকের রাস্তা ধরে হেঁটে নদীর তীরে এল। নদীর তীরে দাঁড়িয়ে রৌদ্রুপ প্রাণখোলা হাসি দিয়ে বলল,
“বাহ্! দারুণ তো।”
পরক্ষণেই মাথায় হাত দিয়ে বলল,
“এই যা! ব্রাশ আনতে ভুলে গেছি। এখন?”
নৈঋতা ততক্ষণে হাতের কলস আর বালতি রেখে অন্যদিকে হাঁটা দিয়েছে। রৌদ্রুপ গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কোথায় যাচ্ছ?”
‘আসছি’ বলে নৈঋতা এগিয়ে গিয়ে একটা আম গাছের নিচে দাঁড়াল। লাফ দিয়ে একটা ডালা ধরে পরিষ্কার দুটো পাতা ছিঁড়ে রৌদ্রুপের কাছে ফিরে এল। রৌদ্রুপ মুখে হাত ঠেকিয়ে এতক্ষণ নৈঋতার কাণ্ড দেখছিল। সে ফিরে আসতেই প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“গাছের পাতা দিয়ে কী করবে?”
“দাঁত মাজব। এই নিন।”
রৌদ্রুপের দিকে একটা পাতা এগিয়ে ধরতেই রৌদ্রুপ অবাক দৃষ্টিতে নৈঋতার দিকে তাকিয়ে বলল,
“পাতা দিয়ে দাঁত ব্রাশ করে কীভাবে?”
নৈঋতা হেসে শুধাল,
“আপনি জানেন না?”
“না।”
“আমি দেখিয়ে দিচ্ছি। নিন।”
রৌদ্রুপ নৈঋতার হাত থেকে পাতাটা নিয়ে উলটে-পালটে দেখল। নৈঋতা তার হাতের পাতাটা কয়েকটা ভাঁজ করে দাঁত ঘষতে লাগল। এবার রৌদ্রুপ কাহিনির মর্মার্থ বুঝতে সক্ষম হলো। সে-ও নৈঋতার মতো করে নিজের হাতের পাতাটা ভাঁজ করে আস্তে-আস্তে দাঁত ঘষতে লাগল। কিন্তু অভ্যাস না থাকায় প্রথমবারেই পাতার রসের স্বাদে মুখটা বিকৃত হয়ে এল। তবু নৈঋতার দেখাদেখি ধীরে-ধীরে দাঁত ঘঁষল। তারপর নৈঋতার সাথে এগিয়ে গিয়ে নদীর পানিতে হাত-মুখ ধুয়ে নিল। নৈঋতা নিজের ওড়নায় মুখ মুছে নিয়ে বলল,
“ইশ্! আপনার জন্য গামছা আনতে ভুলে গেছি।”
রৌদ্রুপ মুচকি হেসে বলল,
“সমস্যা নেই।”
নৈঋতা কলস আর বালতিতে পানি ভর্তি করে কলসটা বাঁ কাঁখে আর বালতিটা ডান হাতে তুলে নিল। তা দেখে রৌদ্রুপ বলল,
“দুটো একসাথে নিবে কীভাবে? ভারী লাগে না?”
“অভ্যাস আছে। চলুন।”
নৈঋতা সামনের দিকে পা বাড়াতেই রৌদ্রুপ বলে উঠল,
“বালতিটা আমাকে দাও।”
নৈঋতা মাথা দুলিয়ে বলল,
“না, না। আপনি আমাদের অতিথি। কষ্ট করবেন কেন?”
“দুটো একসাথে নিয়ে তোমার কষ্ট হচ্ছে না, আর আমি একটা নিলে আমার কষ্ট হবে? দাও বলছি।”
“আমি পারব।”
রৌদ্রুপ শুনল না। নৈঋতার হাত থেকে একপ্রকার জোর করেই বালতিটা নিজের হাতে নিয়ে নিল। নৈঋতা বাঁধা দিতে না পেরে চুপচাপ হাঁটা শুরু করল। রৌদ্রুপ এবার তার পাশাপাশি হাঁটতে-হাঁটতে বলল,
“প্রতিদিন এভাবে পানি নাও?”
নৈঝতা ওপর-নিচে মাথা ঝাঁকাল। রৌদ্রুপের হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ল। দ্রুত প্রশ্ন করল,
“তোমার নাম যেন কী? জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি।”
“নৈঋতা।”
“নাইস! এত সুন্দর নাম কে রাখল?”
নৈঋতা মুচকি হেসে বলল,
“আব্বা।”
“নাম যেমন, তুমিও তেমন।”
রৌদ্রুপের হাস্যোজ্জ্বল মুখের এই ছোট্ট প্রশংসায়ও নৈঝতা লজ্জা পেল। রৌদ্রুপের মনে হলো মেয়েটা একটু বেশিই লাজুক। কথায়-কথায় লজ্জায় মাথা নত করে ফেলে। তবে নৈঋতার এই লজ্জা পাওয়ার ব্যাপারটা রৌদ্রুপের মন্দ লাগেনি। বরং বেশ ভালো লেগেছে। বাড়িতে ঢুকে রৌদ্রুপ নৈঝতার হাতে বালতিটা ফিরিয়ে দিলো। তা নিয়ে নৈঋতা ঘরের দিকে দুপা বাড়াতেই রৌদ্রুপ পিছু ডাকল,
“শোনো মেয়ে।”
নৈঋতা দাঁড়িয়ে পড়ল। পেছন ফিরে প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকাতেই রৌদ্রুপ ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে বলল,
“আমার সাথে তোমায় শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে হবে না। সব অঞ্চলের মানুষের নিজস্ব ভাষার স্বাধীনতা আছে। তোমার ভাষা তোমার ব্যাক্তিগত অধিকার। এত বড়ো অধিকার কেড়ে নেওয়ার আমি কে? নিজের ভাষাকে ভালোবাসলে তা নিয়ে কখনও লজ্জা পেয়ো না। কারণ এই ভাষাটা তুমি তোমার মায়ের থেকে শিখেছ। মায়ের ভাষাকে লুকানোর কোনো মানেই হয় না। তাছাড়া আমার মনে হয় তোমার মুখে আঞ্চলিক ভাষাই বেশি ভালো লাগে।”
নৈঋতা দুচোখে চরম বিস্ময় নিয়ে রৌদ্রুপের মুখপানে তাকিয়ে তার কথা শুনল।‌ একটা মানুষের চিন্তাধারা এতটাও সুন্দর হতে পারে! মানুষটা যেমন, চিন্তাধারাও তেমন। ভেবেই নৈঋতার মুখে হাসি ফুটল। সে ঘাড় কাত করে মুচকি হেসে বলল,
“আচ্ছা।”
রৌদ্রুপ মাথা দুলিয়ে বলল,
“উঁহু, আঞ্চলিক ভাষায় বলো তো।”
“আইচ্ছা।”
ঠোঁটের কোণের মুচকি হাসিটা গাঢ় করে কথাটা বলেই নৈঋতা প্রস্থান করল। রৌদ্রুপও মুচকি হেসে ঘুরে দাঁড়াতেই মধ্যবয়স্ক এক লোকের মুখোমুখি হলো। রোদে পো’ড়া গায়ের রং, গালভর্তি দাঁড়ির অর্ধেক কালো আর অর্ধেক সাদা। লুঙ্গি পরিহিত উদোম শরীর কাঁদায় মাখামাখি। কাঁধে ঝুলানো মাছ ধরার জালটা থেকে টপটপ করে পানি ঝরছে। ডান হাতের সিলভারের পাতিলে কিছু মাছ। রৌদ্রুপ কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে প্রশ্ন করল,
“আপনি কি জেলে?”
জবাবে লোকটা প্রশস্ত হেসে বলল,
“না, তয় মাঝে মাঝে মাছ ধরি। তুমি আমারে চেনোনায় বাপ? তোমার লগে তো দেহাই হয়নায়। আমি তোমার খালু।”
“আপনি সামসুদ্দীন আঙ্কেল?”
“হ, হ।”
রৌদ্রুপ হেসে বলল,
“আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল। কেমন আছেন আপনি?”
“আল্লার রহমতে ভালা আছি বাপ। তুমি কেমন আছো?”
“ভালো।”
“কহন উঠছো? হাত-মুখ ধুইছো?”
“হ্যাঁ। একটু আগেই উঠেছি।”
“আইচ্ছা, তাইলে ওই ঘরে লও। আমি আবার তাড়াতাড়ি ঘুম থিকা উইঠা গেছিলাম মাছ ধরতে,” ঘরের দিকে পা বাড়িয়ে বললেন সামসুদ্দীন বেপারী।
রৌদ্রুপ তাকে অনুসরণ করে প্রশ্ন করল,
“কোথা থেকে ধরেছেন?”
“বিলের থিকা।”
“এরপর গেলে আমাকে নিয়ে যাবেন?”
“তুমি যাইবা? ঠিক আছে, ঠিক আছে।”
সামসুদ্দীন বেপারী দরজায় দাঁড়িয়ে উঁচু গলায় ডাকলেন,
“কই গো রিতার মা?”
সঙ্গে-সঙ্গে আফিয়া বেগম রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বললেন,
“মাছ পাইছেন?”
“পাইছি কিছু।”
আফিয়া বেগম এগিয়ে এসে স্বামীর হাত থেকে মাছের পাতিলটা নিলেন। সামসুদ্দীন বেপারী স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“পোলাডারে নিয়া ঘরে বহাও। আমি নদীরতে ডুব দিয়া আইতাছি।”
“আইচ্ছা,” ঘাড় কাত করে বললেন আফিয়া বেগম।
পরক্ষণেই হাঁক ছেড়ে ডেকে বললেন,
“ও রিতা, তোর আব্বার লুঙ্গি আর গামছা দিয়া যা তো।”
ভেতর থেকে নৈঋতার কন্ঠ ভেসে এল,
“আনতাছি।”
সামসুদ্দীন বেপারী উঠানের একপাশের একটা পেয়ারা গাছের সাথে মাছ ধরার জালটা ঝুলিয়ে রাখলেন। হাতে একটা পুরোনো লুঙ্গি আর গামছা নিয়ে ঘরের দরজায় দাঁড়াল নৈঋতা। তখন তার মাথায় কাপড় ছিল না। রৌদ্রুপকে দেখেই দ্রুত ওড়নার কোণা টেনে মাথায় রাখল। আফিয়া বেগম নৈঋতার হাত থেকে লুঙ্গি আর গামছা নিয়ে স্বামীর হাতে দিলেন। তা নিয়ে সামসুদ্দীন বেপারী বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। আফিয়া বেগম বললেন,
“রিতা, ওনারে নিয়া ঘরে বহা। আমি আইতাছি।”
নৈঋতা বাধ্য মেয়ের মতো ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাল। মা রান্নাঘরে চলে যেতেই নৈঋতা দরজা থেকে একপাশে সরে দাঁড়িয়ে বলল,
“ভেতরে আসুন।”
রৌদ্রুপ সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
“আঞ্চলিক?”
নৈঋতা লাজুক হেসে বলল,
“আহেন।”
ঘরে ঢুকে রৌদ্রুপ চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখল। আসবাবপত্র বলতে একটা চৌকি, আলনা আর কাঠের আলমারি ছাড়া সবই হাবিজাবি জিনিসপত্র। নৈঋতা নিজেদের পরিবেশের জন্য লজ্জিত হলো। রৌদ্রুপ চৌকিতে পা ঝুলিয়ে বসল। নৈঋতা এবার পড়ল বিপাকে। তার এখন এখানে দাঁড়িয়ে থাকা উচিত, না কি চলে যাওয়া উচিত বুঝে উঠতে পারল না।‌ মেহমানকে একা বসিয়ে রাখা নিশ্চয়ই ভালো দেখাবে না। নৈঋতাকে মাথানত করে হাত কচলাতে দেখে রৌদ্রুপ ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করল।
“তুমি কি কিছু নিয়ে চিন্তিত?”
নৈঋতা মাথা তুলে দ্রুত গতিতে ডানে বায়ে দুলিয়ে বলল,
“না। আপনের ক্ষুধা লাগছে?”
“নাহ্।”
তখনই আফিয়া বেগম ঘরে ঢুকলেন। তার হাতে একটা চায়ের কাপ। সেটা রৌদ্রুপের দিকে এগিয়ে ধরে বললেন,
“নেও বাপ, চা খাও। ততক্ষণে আমার রান্ধা হইয়া যাইব।”
রৌদ্রুপ মুচকি হেসে আফিয়া বেগমের হাত থেকে চায়ের কাপটা নিল। আফিয়া বেগম যেভাবে এসেছিলেন সেভাবেই চলে গেলেন। হঠাৎ মেঘ ডাকার শব্দ হলো। নৈঋতা দৌড়ে গিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে বাইরে উঁকি দিলো। ফোঁটা-ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হয়েছে দেখেই ছুট লাগাল ঘরের বাইরে। উঠানের গাছের সাথে বাঁধা দড়িতে মেলে রাখা জামাকাপড় ভিজে যাবে যে। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে তার মাথার ওড়না পড়ে খোঁপাটাও খুলে গেল। ফলস্বরূপ কোমরের নিচ অবধি ঘন কালো লম্বা চুলগুলো ছড়িয়ে পড়ল মুখে-পিঠে। দুহাতে কাপড় থাকায় আটকাতেও পারল না সে। ওদিকে ঘর থেকে এই দৃশ্য চোখে পড়তেই রৌদ্রুপের চায়ের কাপ মুখ পর্যন্ত গিয়েও থেমে গেল। চুমুক দেওয়া আর হলো না। ঘন কালো লম্বা চুলওয়ালী সুন্দরী রমণী সে ইতিপূর্বে অনেক দেখেছে। কিন্তু এতটা মুগ্ধতা হয়তো এই প্রথমবার কড়া নাড়ল। তবে হুট করে আগত এই মুগ্ধতার কারণ তার জানা নেই। নৈঋতা ততক্ষণে ছুটে এসে ঘরে ঢুকে হাতের কাপড়গুলো বিছানার এক কোণে রাখল। হন্তদন্ত হয়ে ওড়না মাথায় টানতে যেতেই চোখ পড়ে গেল রৌদ্রুপের চোখে। স’র্বনা’শা দৃষ্টি বিনিময়ে নৈঋতার বুকটা হঠাৎ ধক করে উঠল। পরক্ষণেই রৌদ্রুপের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নতজানু হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে দুপা বাড়াতেই রৌদ্রুপ কোমল কন্ঠে পিছু ডাকল,
“শোনো মেয়ে।”
নৈঋতা পা থামাল, কিন্তু ফিরে তাকাল না। রৌদ্রুপকে কেমন ঘোরে পেল। পুনরায় একইভাবে বলে উঠল,
“সর্বগ্রা’সিনী রূপে দর্শন দিয়ো না মেঘবতী। কঠিন
পুরুষালি হৃদয়ও চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যেতে পারে।”
আঠারো ছুঁই-ছুঁই নৈঋতার বুকে যেন সশব্দে হাতুড়ি পেটা শুরু হলো। এক অজানা অনুভূতি এসে খুব গোপনে হৃদয় ছুঁয়ে দিলো। ‘মেঘবতী’ নামটা তার মনে একসঙ্গে আনন্দের দোলন আর বিস্ময়ের সৃষ্টি করল। হঠাৎ করেই লোকটা এমন পরিস্থিতিতে ফেলবে তা তার কল্পনাতীত ছিল। লজ্জায় আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভবপর হলো না। ফাঁকা একটা শুকনা ঢোক গিলে এক ছুটে পাশের ঘরে চলে গেল। তার যাওয়ার দিকে মিনিট খানেক তাকিয়ে থাকার পর রৌদ্রুপের ধ্যান ভাঙল। নিজের করা বোকামির জন্য তার শক্তপোক্ত পুরুষালি মনটাও খানিক লজ্জায় পড়ল। তবে ঠোঁটের কোণে ঠাঁই পেল এক চিলতে হাসি। তখনই ওপাশের ঘর থেকে নৈঋতার চাপা স্বর শোনা গেল। ‘নসিব’ বলে কাউকে সে অনবরত ডেকে চলেছে। সম্ভবত তার ছোটো ভাইয়ের ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করছে।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে