কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
১৯.
চারপাশের করুণ আ’র্তনা’দের মাঝে হঠাৎ নসিবের কন্ঠের ‘আপা’ ডাকটা অতিশয় অবিশ্বাস্য ঠেকল রৌদ্রুপের কানে। তড়াক করে মাথা তুলতেই সে নিজের চোখ দুটোকেও বিশ্বাস করতে পারল না। তার সামনে এ কে দাঁড়িয়ে আছে? সত্যিই কি নৈঋতা এসেছে? কল্পনা নয় তো? রৌদ্রুপের স্তব্ধ অবস্থার মাঝেই তাকে দুটো কোমল হাত টেনে দাঁড় করানোর চেষ্টা করল। চির পরিচিত স্পর্শ অনুভব করতেই রৌদ্রুপের চেতনা ফিরল। বুকের ওপর থেকে মস্ত বড়ো এক পাথর নেমে গেল। বন্ধ হওয়া দমটা পুনরায় সচল হলো। সেই হাত দুটোর বদৌলতে রৌদ্রুপ উঠে দাঁড়াল। খপ করে ওই চিন্তাগ্রস্ত কোমল মুখটা নিজের দুহাতের মধ্যখানে চেপে ধরল। ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে ভ’য়া’র্ত চোখে তাকিয়ে ধরা গলায় ডাকল,
“নৈঋ!”
পরক্ষণেই ব্যস্ত হয়ে নৈঋতার পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে তবেই আশ্বস্ত হলো। নৈঋতার মাথায়, গালে পাগলের মতো হাত বুলিয়ে উদগ্রীব হয়ে শুধাল,
“ঠিক আছো তুমি? কীভাবে বেরুলে? লাগেনি তো কোথাও? তাপ লেগেছে? কষ্ট পেয়েছ? শরীর খারাপ করছে না তো?”
নৈঋতার চোখ ছাপিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। মানুষটার মনের অবস্থা টের পেয়ে ভেতরটা কেঁপে উঠছে। কত ভয় পেয়েছে মানুষটা! নৈঋতার চোখে পানি দেখে রৌদ্রুপের উদ্বিগ্নতা বাড়ল। পাশ থেকে নসিব রৌদ্রুপকে থামানোর চেষ্টা করছে। নৈঋতা রৌদ্রুপের এক হাতের বাহু শক্ত করে ধরে আশ্বস্ত করল,
“আমার কিচ্ছু হয়নায়। দ্যাহেন, একদম ঠিক আছি আমি। আপনে শান্ত হন তো। আহেন।”
নৈঋতা আর নসিব মিলে রৌদ্রুপকে ধরাধরি করে মার্কেটের একপাশে দাঁড় করানো গাড়ির কাছে নিয়ে গেল। নৈঋতা নসিবকে বলল দোকান থেকে ঠান্ডা পানির বোতল কিনে আনতে। এই উদ্বিগ্নতা নিয়ে রৌদ্রুপ গাড়ি চালাতে পারবে না। একটু অপেক্ষা করে রৌদ্রুপ শান্ত হওয়ার পর রওয়ানা দিবে ভেবে নৈঋতা রৌদ্রুপকে নিয়ে পেছনের সিটে উঠে বসল। রৌদ্রুপ ক্লান্ত ভঙ্গিতে সিটে শরীরের ভার ছেড়ে দিলো। দুহাতে মুখ ঢেকে বড়ো-বড়ো দম নিতে লাগল। নৈঋতা রৌদ্রুপের হাত দুটো টেনে সরিয়ে আনল। চোখের পানিতে ভিজে আছে সমস্ত মুখ। চোখ দুটো ফুলে লাল হয়ে গেছে। আ’ত’ঙ্কে এখনও রৌদ্রুপের শরীর কাঁপছে, চোখের পানি ঝরছে। নৈঋতা রৌদ্রুপের চোখের পানি মুছে দিলো। ধরা গলায় বলল,
“এইটুকেই এত ভয়! সত্যি সত্যিই মইরা গেলে কী করতেন? আ’গুন থিকা না হয় বাঁচলাম, বাবু আসার সময় যদি ম’ইরা যাই? তহন কী করবেন? সইহ্য করা লাগব না?”
রৌদ্রুপ ফট করে রেগে গেল। ঝটকা মে’রে নৈঋতার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে রাগত স্বরে ডাকল,
“নৈঋ।”
নৈঋতার ঠোঁট জোড়া তিরতির করে কেঁপে উঠল। চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল নোনা জল। রৌদ্রুপ ঝুঁকে পড়ে নৈঋতার পেটে হাত বুলিয়ে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়াল। তারপর সোজা হয়ে বসে নৈঋতার ছোট্ট মুখটা নিজের দুহাতের আঁজলায় নিল। আলগোছে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো পাতলা ঠোঁট জোড়ায়। অতঃপর কপালে গাঢ় চুমু এঁকে দিয়ে বলল,
“আমার সব ভেসে যাক। শুধু তুমি থেকে যেয়ো। তুমি হারিয়ে গেলে যে আমি নিজেকেই হারিয়ে ফেলব। তখন আর কোনোকিছুই আমার কাজে লাগবে না। আমাকে বাঁচাতে হলে থেকে যেয়ো নৈঋ।”
নৈঋতা হুঁ-হুঁ করে কেঁদে উঠল। বাচ্চা জন্মের সময় যদি সত্যি সত্যিই কিছু একটা হয়ে যায়, তবে? মানুষটার এই মাত্রারিক্ত ভালোবাসা হারিয়ে সে কীভাবে হারিয়ে যাবে? এই মানুষটা তো একদম ভালো থাকবে না। রৌদ্রুপের প্রশস্ত বুকে মুখ লুকিয়ে দুহাতে শার্ট আঁকড়ে ধরে নৈঋতা কান্না থামানোর প্রয়াস চালাল। ফুঁপিয়ে উঠে বলল,
“কী কন এইগুলা? একদিন ম’র’তে হইব না? এমন কতা কইবেন না, আমার ডর লাগে।”
রৌদ্রুপ খুব সাবধানে নৈঋতাকে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
“তাহলে আমার কেমন লাগছে বুঝতে পারছ?”
নসিবকে আসতে দেখে রৌদ্রুপ নৈঋতাকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসল। নসিব এসে রৌদ্রুপের হাতে পানির বোতলটা দিলো। রৌদ্রুপ সেটা আগে নৈঋতাকে দিতে গিয়েও বেশি ঠান্ডা দেখে দিলো না। এত বেশি ঠান্ডা খাওয়া ঠিক হবে না। অগত্যা নিজেই বোতলের ছিপি খুলে ঢকঢক করে অর্ধেকটা পানি খেয়ে নিল। নসিব খাবে না বলায় বাকিটা নৈঋতার জন্য রেখে দিলো। ঠান্ডা ভাবটা একটু ছাড়লে খেতে দিবে।
বাড়িতে যখন নৈঋতার ঘটনাটা জানানো হলো, তখন সবাই আ’ত’ঙ্ক প্রকাশ করল। সবাই সমস্ত রাগ ঝাড়ল রৌদ্রুপের ওপর। সে কেন নৈঋতাকে একা ছাড়ল, এটাই তার দোষ। নৈঋতার বাবা-মা তো ফোনে ম’রাকান্না জুড়ে দিলো। শাহানা খানম কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন, সুস্থ হওয়ার আগে কলেজ ছাড়া অন্য কারণে যেন নৈঋতা বাইরে কোথাও না যায়। ভাগ্য অনুকূলে ছিল বলে, নয়তো আজকের পরিস্থিতি খুব ভয়াবহ হতে পারত। রৌদ্রুপ নিজেও এখনও আ’ত’ঙ্ক থেকে বেরোতে পারেনি। রাতেও নৈঋতাকে বুকে চেপে ধরে আ’ত’ঙ্ক প্রকাশ করতে লাগল। ভ’য়া’র্ত চোখ জোড়ায় যেন আজ ঘুম নেই। নৈঋতা ভালোবাসার স্পর্শে রৌদ্রুপের পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে-দিতে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“রাগ কইরেন না, একখান কতা কই। একটা মাইয়ার জীবনের সবচাইতে ঝুঁকিপূর্ণ সময় হইলো সন্তান জন্ম দেওয়া। হায়াত থাকলে কেউ বাঁইচা আহে, না থাকলে ওই অছিলায়ই ম’র’ণ হয়। এইডা বাস্তব কতা। আল্লাহ্ না করুক আমার যদি কিছু একটা হইয়া যায়, তাইলে তো আপনের শক্ত থাকতে হইব। আমগো সন্তানরে বুকে রাইখা মানুষ করতে হইব। আপনে কোনোদিনও ওরে মায়ের অভাব বুঝতে দিবেন না। আমি জানি আপনে পৃথিবীর সবচাইতে ভালো বাবা হইবেন।”
রৌদ্রুপ হাতের বাঁধন একটুখানি শক্ত করে মিইয়ে পড়া ব্যাকুল কন্ঠে বলল,
“আমি পারব না নৈঋ। তোমাকে ছাড়া কিচ্ছু পারব না আমি। আমার বাবুকে বড়ো করতে তার আম্মুকেই লাগবে। বাবুর আম্মুকে ছাড়া আমার জীবন প্রাণহীন হয়ে পড়বে। তোমার দুটো হাতে ধরি নৈঋ, এসব বোলো না। আমার দমবন্ধ লাগে।”
নৈঋতা মাথা তুলে রৌদ্রুপের চোখের দিকে তাকাল। অস্থির হয়ে বলল,
“আপনের পারতে হইব, আমার লাইগা পারতে হইব। ও আপনের-আমার ভালোবাসার চিহ্ন।”
রৌদ্রুপ একহাত এগিয়ে নৈঋতার ডান গালে আলতো করে রাখল। শান্ত স্বরে বলল,
“পৃথিবীতে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মেয়েরা মা হয়। তারা নিজেদের সন্তান নিয়ে কয়েক যুগ বেঁচেও থাকে। মা হলেই সবাই চলে যায় না, নৈঋ। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখো। তোমার কিচ্ছু হবে না, দেখো। তুমি, আমি আর আমাদের ছোট্ট একটা বাবু, আমরা তিনজন এই ঘরে থাকব। দিনের বেলায় তুমি বাবুকে সামলাবে, রাতে আমি। তাছাড়া প্রতিদিন আমার বুকের বাঁ পাশটায় ঘুমানোর জন্য বাবুর আম্মুকে লাগবেই। বি পজিটিভ মেঘবতী।”
নৈঋতার দুচোখ টলমল করে উঠল। এই মানুষটা তাকে এত বেশি কেন ভালোবাসে? মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসায় য’ন্ত্র’ণাও বেশি, তা কি সে জানে না? তার চোখের কোল ঘেঁষে গড়াতে চাওয়া অশ্রুকণাটা রৌদ্রুপ চট করে মুছে ফেলল। কন্ঠে মেকি রাগ টেনে গম্ভীর মুখে বলল,
“আমি রেগে যাচ্ছি নৈঋ। ঘুমাও, রাত জেগে বকবক করতে হবে না। ইদানিং তুমি বড্ড নেগেটিভ হয়ে পড়ছ। চুপচাপ ঘুম দাও, আমার ঘুম পাচ্ছে।”
রৌদ্রুপ নৈঋতার মাথাটা পুনরায় নিজের বুকে রাখল। নৈঋতা ঠোঁট ফুলিয়ে তীব্র অনীহা প্রকাশ করল।
“ঘুম নাই চোখে, চলেন বৃষ্টিতে ভিজি।”
রৌদ্রুপ গোল-গোল চোখে চাইল। অবাক কন্ঠে শুধাল,
“তুমি বৃষ্টিতে ভিজতে চাইছ?”
“হ, ওঠেন।”
নৈঋতা উঠে বসে রৌদ্রুপকেও উঠতে তাড়া দিলো। রৌদ্রুপ উঠে বসে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“এই, তুমি সিরিয়াস? তুমি তো বৃষ্টি পছন্দ করো না।”
“উফ্! এত কতা কন ক্যান? আপনে যাইবেন কি না কন। নইলে আমি একলাই গেলাম।”
নৈঋতা বিছানা ছেড়ে নেমে দরজার দিকে হাঁটা ধরতেই রৌদ্রুপ হুড়মুড় করে গিয়ে তার হাত টেনে ধরল।
“হয়েছে, রাগ দেখাতে হবে না। আমিই নিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু বেশি ভেজা যাবে না। ঠান্ডা লেগে গেলে পরে আবার আরেক সমস্যা।”
“অহনও নিলই না, আগেই নিষেধাজ্ঞা জারি করতাছে।”
নৈঋতার কথা শুনে রৌদ্রুপ হেসে তার গালটা আলতো করে টিপে দিলো। তারপর হাত ধরে নিয়ে গেল সদর দরজার কাছে। শব্দ না করে সন্তর্পণে সদর দরজা খুলে বেরিয়ে এল বাড়ির বাইরে। নৈঋতার হাত শক্ত করে ধরে খুব সাবধানে নেমে পড়ল ঝুম বৃষ্টির নিচে। বাড়ির সামনের ছোট্ট উঠানের মাঝখানটায় দাঁড়াল তারা। দুই পাশে সব ফুলে ভরা গাছের সারি। বৃষ্টিবিমুখ নৈঋতা শেষ কবে এমন ঝুম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ভিজেছিল, তা এই মুহূর্তে ঠিক মনে পড়ছে না। বহু বছর হয়ে গেছে বোধ হয়। এতগুলো বছর পর ঝুম বৃষ্টির একেকটা ফোঁটার শব্দ যেন নৈঋতার কানের কাছে উল্লাসের গান গেয়ে উঠল। সারা শরীর কাঁ’টা দিয়ে উঠল তার। দুহাত দুদিকে মেলে দিয়ে সে শরীরের সাথে মনটাকেও ভিজিয়ে নিল এই অপূর্ব বর্ষণে। সামনে দাঁড়িয়ে রৌদ্রুপ অপলক চেয়ে তার বৃষ্টি বিলাসী মিষ্টি মেঘবতীর হাস্যোজ্জ্বল মুখ আর অকৃত্রিম উচ্ছাস দেখছে। এ যেন সম্পূর্ণ নতুন এক সফেদ মেঘের টুকরো। কী প্রফুল্ল তার চিত্ত! এই অপরূপ বর্ষণের অসাধারণ সৌন্দর্যও যেন হার মেনেছে ওই ছোট্ট পেলব তনুর কাছে। এগিয়ে গিয়ে নৈঋতার ভেজা কপালে নিজের আর্দ্র ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো রৌদ্রুপ। প্রসারিত হাত নামিয়ে নিয়ে বলল,
“হয়েছে আমার লক্ষ্মী বউ, এবার চলো।”
নৈঋতা জেদ ধরে বসল। শক্ত হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল ওই জায়গাতেই। বায়না করল আরও কিছুক্ষণ ভিজবে। কিন্তু রৌদ্রুপ নারাজ। এই অবস্থায় ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা লেগে গেলে বিপদ। অসুখ বাঁধলে বউকে নিয়ে তার হাঁসফাঁস করা লাগবে, মায়ের বকুনিও তাকেই খেতে হবে। নৈঋতা দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
“বাবুর আম্মুর লাইগা ওইটুকু বকা মধু মনে কইরা গিলে ফেলবেন।”
“তোমার হঠাৎ অপছন্দের বৃষ্টিকে এত মধুর মতো লাগছে কেন শুনি?”
“জানি না। ইদানিং বৃষ্টি ভালা লাগে।”
“তাহলে তো আমার ভবিষ্যতবাণী মিলে গেল।”
“কী?”
“একদিন বলেছিলাম, আমার সাথে থাকতে-থাকতে একদিন তোমারও বৃষ্টি ভালো লাগবে। দেখলে? ঠিকই তোমার মন পালটে গেল।”
নৈঋতা দাঁত বের করে হাসল। রৌদ্রুপের গলায় দুহাত বেঁধে ঝুলে পড়ে বলল,
“এমন একটা মানুষ যার আছে, তার মন না পালটায়া উপায় আছে?”
রৌদ্রুপ অতি সাবধানে নৈঋতার কোমর জড়িয়ে হাসিমুখে বলল,
“হ্যাঁ, বুঝেছি। কিন্তু আমি এখন মোটেও গলছি না বাবুর আম্মু। দুঃখিত।”
চট করে নৈঋতাকে পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে রৌদ্রুপ বাড়ির ভেতরে হাঁটা দিলো। নৈঋতা বাচ্চাদের মতো পা দুলিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
“অহন না, আরেকটু থাকেন। আরেকটু, প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ। কী হইব আরেকটু দেরি করলে? একটুও ভালোবাসে না আমারে। বাবু-ই সব, আমি কেউ না। বুঝি তো।”
নৈঋতার অভিযোগ শুনে রৌদ্রুপ হেসে ফেলল। তাল মিলিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, আমি আমার বাবুর যত্নই নিচ্ছি। বাবুর আম্মু তো এখন বুড়ি হয়ে যাচ্ছে, তাই ভালোবাসা কমে গেছে।”
নৈঋতা রাগত দৃষ্টিতে তাকাল। রৌদ্রুপ ফিক করে শব্দ তুলে হেসে বলল,
“মাফ করুন বুড়ি বউ।”
নৈঋতাকে নিয়ে মার্কেটে গিয়ে ওই দুর্ঘটনার কারণে শপিং না করেই ফিরে এসেছিল বলে রৌদ্রুপ আজ নিজেই নৈঋতার জন্য শপিং করে নিয়ে এসেছে। দুইটা শাড়ি, দুইটা সুতি ড্রেসের সাথে টুকটাক কিছু কসমেটিকস। সেসব দেখে নিদ্রার কিঞ্চিত মন খারাপ হয়। আজকাল তিহান নিজে তার জন্য তেমন কিছু কিনে আনে না। চলাফেরায় কষ্ট হয় বলে অফিস ছাড়া কোথাও পা রাখে না সে। নিদ্রার কিছু দরকার পড়লে টাকা ধরিয়ে দেয়। রৌদ্রুপ যেমন রোজই নৈঋতার জন্য এটা-ওটা নিয়ে আসে। তিহানও আগে মাঝেমাঝে এমনটা করত। ইদানিং নৈঋতার ভাগ্যকে বড়ো হিংসা হয় নিদ্রার। তার কপালটা এমন কেন হলো? তিহান মানুষটা তো তার চেয়ে হাজার গুণ ভালো। সেই মানুষটার সাথেই এই বয়সে এমন খারাপ কিছু হতে হলো? নিদ্রার আরো খারাপ লাগে যখন তুলি আগের মতো যখন ইচ্ছে তখন বাবার হাত ধরে এখানে-ওখানে ছুটাছুটি করতে পারে না। যদিও রৌদ্রুপ নিজের সময় বুঝে তুলিকে সময় দেওয়ার চেষ্টা করে। তবু, বাবা তো বাবাই। তিহান নিদ্রার মনের অবস্থা বুঝতে পারে। এই বয়সী একটা মেয়ের চোখের সামনে নিজের স্বামী পা হারিয়ে বসে আছে, ব্যাপারটা নিশ্চয়ই তার জন্য সুখকর নয়। যথেষ্ট ব্যথাদায়ক। তিহানের নিজেরও যে খারাপ লাগে স্ত্রী, মেয়ের কথা ভেবে। তবু ভাগ্যকে সবারই মেনে নিতে হয়। নিদ্রা যে হুট করে বদলে যাওয়া ভাগ্যকে এভাবে মেনে নিবে, এতটাও আশা তিহানের ছিল না। বরাবরই সে ছিল উচ্চাকাঙ্ক্ষী মেয়ে। এই তো তিহান যখন সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল, তখনও ঘন্টার আগায়-মাথায় তিহানের সাথে কথা কাটাকাটি করতে তার বাঁধত না। অথচ তিহানের অসুস্থতার পর থেকে আজ পর্যন্ত মেয়েটা তিহানের সামনে এ-ও মুখে তোলেনি যে, তিহানকে এভাবে দেখতে তার ভালো লাগে না। মনের ব্যথাটুকুও সে যেচে প্রকাশ করে না। বরং তিহান যখন এ বিষয়ে কথা তোলে তখন তার বুকে মুখ গুঁজে একচোট কেঁদে মনের সমস্ত ব্যথা বিসর্জন দেওয়ার চেষ্টা করে। নিজের মনের সকল খারাপের মধ্যেও মেয়েটার সবচেয়ে সুন্দর দিকটাই ছিল বোধ হয় তিহানকে মনেপ্রাণে ভালোবাসা। তিহানের বাঁধন ছাড়তে না পারা। এ-ই বা কম কিসে? নিখাদ ভালোবাসারা বোধ হয় মানুষের ভালোসহ খারাপ দিকগুলোও এভাবেই জয় করে নেয়।
ওদিকে রৌদ্রুপ নতুন শাড়ির মধ্য থেকে একটা নিয়ে তখন থেকে নৈঋতার পেছন-পেছন ঘুরছে। শাড়িটা টুকটুকে লাল রংয়ের। রৌদ্রুপ এটা খুব শখ করে কিনেছে। শাড়িটা দেখেই তার ইচ্ছে জেগেছে নৈঋতাকে এই শাড়িতে একবার দেখার। অনেকদিন হলো মেয়েটাকে সে শাড়ি পরিহিতা দেখে না। শরীর ভার হওয়ার পর থেকেই শাহানা খানমের আদেশে সে ঢিলাঢালা সুতি ড্রেস পড়া শুরু করেছে। এতদিন পর হুট করে যখন অসময়ে রৌদ্রুপ শাড়ি পরার কথা বলল, তখন নৈঋতার ভারী শরীরটা যেন অলসতায় আরও এক গুণ ভার হয়ে গেল। চরম অনীহা নিয়ে সে উলটো অনুরোধ করল অন্য একসময় পড়বে বলে। কিন্তু রৌদ্রুপ আজ নাছোড়বান্দা। তার আজ ইচ্ছে জেগেছে মানে আজই তা পূরণ করতে হবে। নৈঋতা হাত-পা গুঁজে বিছানায় ঠাঁয় গুটিয়ে পড়ে আছে। রৌদ্রুপ তার মাথায়, পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“ও মেঘবতী, ওঠো না।”
নৈঋতা অসহায় চোখ তুলে ঠোঁট উলটে বলল,
“আমার শরীর চলব না অহন। ভালা লাগে না।”
“তুমি তো বললে শরীর ভালো আছে।”
“আইলসামি লাগতাছে।”
“আচ্ছা, আমি নিজেই পরিয়ে দিবো। তুমি শুধু দাঁড়িয়ে থেকো।”
“তবু পরাইতে হইব?”
“হুঁ। বেশিক্ষণ পরিয়ে রাখব না।”
“প্রমিস?”
“প্রমিস।”
“তবু ওঠতে ইচ্ছা করতাছে না আমার,” নাকি সুরে বলল নৈঋতা।
“আমার লক্ষ্মী বউটা, এসো।”
নৈঋতাকে দুহাতে আগলে বিছানা থেকে তুলল রৌদ্রুপ। কাঁচা হাতে শাড়ি পরাতে গিয়ে সে হাঁপিয়ে উঠল। কুঁচিকে তো কুঁচি বলাই যায় না। কোনোরকম পেঁচিয়ে যেভাবে পারল, সেভাবেই শাড়ি পরিয়ে দিলো। নৈঋতা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ঠোঁট টিপে হাসছে। সে নিজেও যে আজও গুছিয়ে শাড়ি পরতে পারে না। এদিক থেকে দুজনেই আনাড়ি। শাড়ি পরানো শেষ হলে নৈঋতাকে ধীরে-ধীরে নিয়ে আয়নার সামনে বসাল রৌদ্রুপ। তারপর তার চুলে চিরুনি চালিয়ে যত্ন করে পিঠময় ছড়িয়ে দিলো। কাজল হাতে নিয়ে ভয়ে-ভয়ে চোখে লাগাতে গিয়েও হাত থামিয়ে চিন্তিত মুখে বলল,
“এটা বরং তুমি লাগাও। আমি দিলে যদি চোখের ভেতরে খোঁ’চা লাগে?”
নৈঋতা হেসে বলল,
“কিছু হবে না। ধীরে-ধীরে লাগান।”
নৈঋতা দেখিয়ে দিলে রৌদ্রুপ সাহস করে ধীর হাতে চোখে কাজল লাগাল। এই কাজে লেগে বেচারার নাকের ডগাসহ নাকের নিচে ঘাম জমে গেছে। নৈঋতা আবার সেই ফাঁকে ঘামটুকু মুছিয়ে দিয়েছে। দুই চোখে কাজল পরানোয় সফল হয়ে রৌদ্রুপের মুখে যুদ্ধ জয়ের হাসি ফুটল। হাঁফ ছেড়ে বলল,
“তোমাদের মেয়েদের সাজগোজ এত কঠিন কেন? শাড়ি আর কাজল পরাতে গিয়েই ঘেমে গেলাম, না জানি মেয়েরা ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকে মেকআপ করে কীভাবে! ভালো হয়েছে তুমি অত মেকআপ করো না। বাপ রে! জটিল কাজ।”
চলবে, ইন শা আল্লাহ্।