কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে পর্ব-১৫+১৬

0
2493

কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৫.
নসিব এই প্রথম শহরে এসেছে। সবকিছুতেই তার বিস্ময়ের অন্ত নেই। বারবার করে সে রৌদ্রুপকে এটা-ওটা জিজ্ঞেস করে আর বিস্ময় প্রকাশ করে। ইতোমধ্যে রৌদ্রুপ নসিবের কাজের ব্যাপারেও তাকে সব জানিয়েছে। নসিবের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, বিধায় ছোটো-খাটো একটা চাকরি জোগাড় করতে পেরেছে রৌদ্রুপ। নসিব তাতেই খুশি। আসার পরদিন থেকেই নসিব কাজে জয়েন করেছে। নতুন জায়গা, নতুন কাজ, নতুন মানুষের ভীড়ে নসিব একটু দ্বিধায় পড়লেও, বেশ খুশি। এদিকে রৌদ্রুপ নিজের অবসর সময় বুঝে একটা-দুটো করে সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে আনে। মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যেই রৌদ্রুপ আর নৈঋতা নিজেদের মনের মতো করে সংসার সাজিয়ে তুলেছে। এর মাঝে রৌদ্রুপ নৈঋতাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে সরফরাজ চৌধুরী আর তিহানের সাথে দেখা করে এসেছে। বাড়িতেও ফোন করেছিল খবর নেওয়ার জন্য। কিন্তু কেউই তার সাথে ভালোভাবে কথা বলেনি। সোজা কথায় বুঝিয়ে দিয়েছে, তারা নৈঋতাকে বাড়ির ছেলের বউ মানতে নারাজ। রৌদ্রুপ আর এই নিয়ে বেশি কথা বাড়ায়নি। বাসার কাছাকাছি একটা কলেজে নৈঋতাকে ভর্তি করে দিয়েছে রৌদ্রুপ। নৈঋতার ভর্তির পর থেকেই তাদের সংসার চলে নিয়মিত রুটিনে। সকালে ঘুম থেকে উঠে দুজন নামাজ আদায় করে। একসাথে রান্না করে। নৈঋতার আগে-আগেই রৌদ্রুপ সব কাজ আগে করার চেষ্টা করে। এই নিয়ে নৈঋতা রাগ করে, গাল ফুলায়। রৌদ্রুপ হাসে। নৈঋতার গাল টিপে দিয়ে বলে,
“রাগলে তোমায় মিষ্টি লাগে, বউ। সবসময় রেগে থেকো তো। আচ্ছা, একটা হোটেল খুললে কেমন হয় বলো তো? তুমি আর আমি একসাথে সেখানে নিজ হাতে রাঁধব আর প্রেম করব।”
“প্রেমের হোটেলে লাভ কিছু নেই।”
“কে বলল? এই যে আমি সারাক্ষণ তোমার কাছাকাছি থাকতে পারব। এটাই তো লাভ। বাংলা লাভ হবে, ইংরেজি লাভ বাড়বে। ডবল লাভ।”
নৈঋতা গাল ফুলিয়ে থাকতে পারে না। রৌদ্রুপের উলটা-পালটা কথায় খিলখিল করে হাসে। সকালের নাস্তা সেরে নসিব তার কাজে চলে যায়, আর রৌদ্রুপ
নৈঋতাকে কলেজে পৌঁছে দিয়ে নিজে অফিসে যায়। কলেজ থেকে ফিরে দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নৈঋতা একাই সময় কা’টায়। রান্না করে, ঘুমায়, টিভি দেখে, ঘর গোছায়, ফাহাদের বউয়ের সাথে গল্প করে, আবার কখনও বই পড়ে। সন্ধ্যার পর নসিব আসে, আর রৌদ্রুপ আসে রাত দশটার দিকে। রাতের খাবারটা তিনজন একসঙ্গে খায়। সারাদিনের ব্যস্ততার ভিড়েও রৌদ্রুপ বাসায় ফেরার সময় নৈঋতার জন্য এটা-ওটা আনতে ভোলে না। এতকিছুর মাঝে দুজনের একটা অভ্যাস অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে। আজও রৌদ্রুপ খাবারের শেষ অংশ না খেয়ে রেখে দেয়। নৈঋতা সেই অংশটুকু তৃপ্তি সহকারে খায়। রৌদ্রুপ সবসময় বলে,
“এই খাবারটুকু না খেলে কি পেট ভরে না?”
নৈঋতা স্পষ্ট স্বরে উত্তর দেয়,
“না। আপনে রাখেন ক্যান?”
“আমার অভ্যাস হয়ে গেছে।”
“আমারও।”
দিন, সপ্তাহ, মাস পেরিয়ে অর্ধ বছর গড়ায়। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে দুজনের ছোট্ট সংসার চলছিল বেশ। নৈঋতা প্রথমদিকে পড়াশোনা নিয়ে অনেক সমস্যায় পড়ত। রৌদ্রুপের অবদানে তার সব সমস্যা কা’টিয়েও উঠেছে খুব সহজেই। রৌদ্রুপ নিজের কাজের ফাঁকে নৈঋতার পড়াশোনায় যথেষ্ট সাহায্য করে। মাঝেমাঝে নৈঋতা কোনো বিষয় নিয়ে হতাশ হয়ে পড়লেই রৌদ্রুপ বিজ্ঞের মতো তাকে নানাভাবে বোঝায়। বলে,
“ছোটোবেলায় যখন চক দিয়ে স্লেটে প্রথম লিখতে শিখেছিলে, তখন কি একবারের চেষ্টাতেই সুন্দর করে লিখতে পেরেছিলে? চক ভাঙেনি? কাঁচা হাতের লেখা ত্যাড়াবাঁকা হওয়ায় সেটা মুছে বারবার একই লেখা লেখনি?”
নৈঋতা দুচোখে প্রশ্ন নিয়ে ওপর-নিচে মাথা ঝাঁকায়। রৌদ্রুপ মুচকি হেসে বলে,
“তাহলে? তখন তো একবার ব্যর্থ হয়ে হাল ছাড়নি। এখন ছাড়বে কেন? কবি কালিদাস কী বলেছেন জানো?
পারো কি না পারো করো যতন আবার,
একবার না পারিলে দেখো শতবার।
বুঝলে? একবারে হাল ছাড়ে অলস ছাত্র-ছাত্রীরা। তুমি তো অলস নও। তাই তোমার অধ্যবসায়ের প্রতি যত্নশীল হও।”
নৈঋতা মুগ্ধ হয়। মানুষটার এমন বিজ্ঞের মতো কথা শুনলে সে মনে জোর পায়। নতুন করে শেখার সাহস পায়। মনেপ্রাণে চায়, একদিন সে এই মানুষটার মুখ উজ্জ্বল করবে। পড়াশোনা করে অনেকদূর এগিয়ে যাবে। যাতে এই মানুষটা তাকে নিয়ে গর্ব করতে পারে।রৌদ্রুপ সময় করে সবসময় নিজের পরিবারের খোঁজ নেয়। মায়ের আদরের ছেলে সে। নৈঋতাকে মানতে না পারলেও শাহানা খানম ইতোমধ্যেই ছেলেকে বাড়ি ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য ম’রিয়া হয়ে উঠেছেন। কিন্তু নিদ্রা আর শশী নানাভাবে তার কানে বি’ষ ঢালে। তাদের আসল সমস্যা হচ্ছে নৈঋতা। নৈঋতা আবার এসে এ বাড়িতে আসন গেড়ে বসবে, এটা তারা মানতে নারাজ। তিহান রৌদ্রুপকে জানিয়েছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ফিরে যেতে। অবশ্য রৌদ্রুপ এখনও এ বিষয়ে তেমন কিছু জানায়নি। নসিবের জন্য তার চিন্তা হয়। নৈঋতাকে নিয়েই সবার যা সমস্যা, এই ছেলেটাকে তো আরও আগে বাড়িতে জায়গা দিবে না। নসিব জানিয়েছে সে একা থাকতে পারবে। খাওয়া-দাওয়া হোটেলে করবে বা সময় পেলে নিজেই রান্না করে নিবে। তার কাজ নিয়ে সে বেশ আছে। প্রতি মাসে বাবা-মায়ের জন্য টাকা পাঠিয়ে নিজের হাতখরচাও ভালোভাবেই চলে যায়। তবুও রৌদ্রুপ যখন সম্ভব হয় নৈঋতার বাবা-মায়ের একার সংসারের জন্য কিছু খরচ পাঠিয়ে দেয়। ছয় মাসে দুবার নসিব আর নৈঋতাকে নিয়ে সে গ্রামে ঘুরে এসেছে। অবশ্য অল্প সময়ের জন্যই। ছেলে-মেয়ের সুখ দেখে সামসুদ্দীন বেপারী আর আফিয়া বেগম বেজায় খুশি। অনেক ভেবেচিন্তে নসিব আর নৈঋতার সাথে কথা বলে রৌদ্রুপ সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই মাসটা শেষ হলেই তারা ভাড়া বাসা ছেড়ে দিবে। নসিবকে তার কর্মস্থলের কাছাকাছি বাসা ভাড়া করে দিবে। আর নৈঋতাকে নিয়ে রৌদ্রুপ নিজের বাড়ি ফিরে যাবে। মন কষাকষিতে বহুদিন কে’টেছে। যতই হোক, নিজের পরিবার ছেড়ে তো বেশিদিন এভাবে থাকা যায় না। দূরে বসে মায়ের আহাজারি শুনে খারাপ লাগে তার। ফিরে গেলে ধীরে-ধীরে নৈঋতাকেও হয়তো সবাই মেনে নিবে। রৌদ্রুপের এই পরিকল্পনার পর আরও দুমাস পার হলেও, তাদের বাড়ি ফেরা আর হয়ে ওঠে না। কেন জানি নৈঋতাকে নিয়ে তার খুব চিন্তা হয়, শ’ঙ্কা হয়। আবার পরিবারের জন্যও মন আঁকুপাঁকু করে। নৈঋতা অবশ্য সবসময়ই চায় রৌদ্রুপ বাড়ি ফিরুক। সে যতটা সম্ভব রৌদ্রুপকে বুঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু রৌদ্রুপ বাড়ি ফেরার আগেই এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে গেল। হুট করেই একদিন তার কাছে নিদ্রার ফোন এল। রৌদ্রুপ বেশ অবাক হলো। কারণ সে বাড়ি ছেড়ে চলে আসার পর নিদ্রা ভুল করেও কোনোদিন তাকে ফোন করেনি। বরং সে ফোন করলেও দু-একটা কথা বলেই লাইন কে’টে দিয়েছে বা তুলির কাছে দিয়ে দিয়েছে। বিস্ময় রেখে রৌদ্রুপ ফোন রিসিভ করতেই নিদ্রার ম’রা কান্না শুনতে পেল। কান্নার তোড়ে সে কথাই বলতে পারছে না। রৌদ্রুপ খানিক বিচলিত হয়ে পড়ল। বারবার নিদ্রাকে প্রশ্ন করে চলল সে কেন কাঁদছে। বাড়িতে কোনো সমস্যা হয়েছে কি না। নিদ্রা নিজের কান্না সামলে অনেক কষ্টে দুটো বাক্য ব্যয়ে সক্ষম হলো।
“বাবা আর তিহান হসপিটালে ভর্তি। তুমি তাড়াতাড়ি এসো।”
রৌদ্রুপ কিছু সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। ওপাশে নিদ্রার কান্নার গতি আরও বেড়েছে। রৌদ্রুপ কাঁপা গলায় দু-একটা প্রশ্ন করলেও নিদ্রা উত্তর দিতে পারছে না। শেষে রৌদ্রুপ লাইন কে’টে শশীকে ফোন করল। নিদ্রার মতো শশীও কাঁদছে। রৌদ্রুপের অস্থিরতা টের পেয়ে শশী নিজেকে সামলাল। জানাল, সরফরাজ চৌধুরী আর তিহান একসঙ্গে অফিস থেকে ফেরার পথে আচমকা একটা ট্রাকের সাথে তাদের প্রাইভেট কারের সংঘর্ষ হয়। প্রাইভেট কার ছিটকে গিয়ে উলটে পড়েছিল। তাদের দুজনের অবস্থাই নাজুক। শশীর থেকে রৌদ্রুপ হাসপাতালের নাম জেনে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়েছে। নৈঋতাকে ফোন করে জানাবে ভেবেও জানায়নি। মেয়েটা এখন বাসায় একা আছে। এসব শুনলে একা-একা অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করবে। হসপিটালে পৌঁছে রৌদ্রুপের গোটা পৃথিবীটাই দুলে উঠল। শশী বুকে আছড়ে পড়ে আ’র্ত’@৳*নাদ করে প্রথমেই জানাল তাদের বাবা আর নেই। মিনিট দশেক আগে চলে গেছেন তাদের পিতৃহীন করে। তার আ’ঘা’তটা মাথায় বেশি লেগেছিল। শরীরটাও বিভিন্ন স্থানে থেঁতলে গেছে। তিহানের অবস্থাও খুব বেশি ভালো না। সে এক পা হারিয়েছে। পা হারানো তিহান বাবার মৃ’ত্যু সংবাদ এখনও জানে না। শাহানা খানম এত শো’ক সহ্য করতে পারেননি। ছেলের পা হারানোর সংবাদ পেয়েও মনকে শান্ত রেখেছিলেন। ভেবে নিয়েছিলেন পা-ই তো হারিয়েছে, সন্তান তো হারায়নি। কিন্তু স্বামীর মৃ’ত্যু সংবাদ শুনেই তিনি পা’গলপ্রায় হয়ে পড়েছিলেন। কয়েক মুহূর্ত পা’গলের মতো কেঁদে শেষে অচেতন হয়ে পড়েছিলেন। নিদ্রা আর শশী নিজেদের সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছিল। নিদ্রার বাবার বাড়ি থেকেও লোক এসেছে। নিদ্রাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্ত করে তিহানের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। এই মুহূর্তে তার তিহানের কাছে থাকাটা জরুরি। সেই সাথে তাকে সাবধান করে দিয়েছে, যাতে তিহানকে এখনই সরফরাজ চৌধুরীর মৃ’ত্যু সংবাদ না জানায়। ছেলেটা পা হারিয়ে যতটা ভেঙে পড়েছে, এই সংবাদ পেলে সহ্য করতে পারবে না। রৌদ্রুপ আঁচ করল, জীবনের প্রথম এমন দিশেহারা পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে। সময় নিয়ে সে যথাসম্ভব নিজেকে সামলে নিয়েছে। হসপিটালের সব ঝামেলা চুকিয়ে নিদ্রার ভাই আর নিদ্রাকে তিহানের কাছে রেখে, বাকিদের সাহায্যে সে বাবার লা’শ নিয়ে বাড়ি ফিরে গেল। ছোট্ট তুলিকে তার নানাবাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। আত্মীয়-স্বজন সবাইকে শো’ক সংবাদ জানানো হয়েছে। কাছের আত্মীয়রা সবাই এসেছে। দূরের আত্মীয়রা রওয়ানা দিয়েছে। বাড়িতে কান্নাকাটির রোল পড়ে গেছে। সবদিক সামলাতে রৌদ্রুপকে তার মামাতো, চাচাতো ভাইয়েরা সাহায্য করছে। আগামীকাল সকালে সরফরাজ চৌধুরীর দাফন হবে। রাত বাড়ছে। নৈঋতা এরমধ্যে কয়েকবার ফোন করেছিল। রৌদ্রুপ একবার রিসিভ করে বলেছিল ফিরতে দেরি হবে। তারপর কথা বলতে ইচ্ছে করেনি বলে আর রিসিভ করেনি। মা-বোনকে সামলাতে গিয়েই তার সময় থমকে যায়‌। এদিকের সব ব্যবস্থা করে রৌদ্রুপ সবাইকে বলে বাড়ি থেকে বের হতে পারল রাত দুইটায়। কাল সকাল-সকাল নৈঋতাকে সঙ্গে নিয়ে আসবে সে। বাসায় ফিরে নৈঋতাকে জাগাতে চায়নি সে। নিজের কাছে রাখা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। কিন্তু প্রথমেই চোখে পড়ল সোফায় বসে নৈঋতাকে ঝিমাচ্ছে। মেয়েটা ড্রয়িংরুমে বসে তার অপেক্ষা করছিল বুঝতে পেরে রৌদ্রুপের খারাপ লাগল। ঘুমে চোখ লেগে আসছে তার। দরজা লাগানোর শব্দ পেয়েই নৈঋতার ঘুম ভেঙে গেছে। রৌদ্রুপের ক্লান্ত, মলিন মুখটা দেখে নৈঋতা দ্রুত এগিয়ে এসে বলল,
“আপনে আইছেন? হঠাৎ এত বেশি কাম পড়ল ক্যামনে? আপনের কি শইল খারাপ লাগতাছে?”
রৌদ্রুপ মাথা দুলিয়ে না-বোধক উত্তর দিলো। নৈঋতার কপালে চুমু খেয়ে বলল,
“ঘুমিয়ে পড়তে বলেছিলাম না তোমায়? শুধু-শুধু এত রাত পর্যন্ত জেগে ছিলে কেন?”
“আপনে ফোন ধরতাছিলেন না ক্যান? আমার অনেক চিন্তা হইতাছিল।”
“অনেক ব্যস্ত ছিলাম। নসিব ঘুমিয়ে পড়েছে?”
নৈঋতা ওপর-নিচে মাথা ঝাঁকাল। বলল,
“যান, জামা-কাপড় ছাড়েন। আমি তরকারি গরম করতাছি।”
রৌদ্রুপ রুমের দিকে পা বাড়িয়ে বলল,
“খাব না। তুমি খেয়ে এসো।”
“ক্যান খাইবেন না?”
“ইচ্ছে করছে না।”
নৈঋতা নিশ্চিত হলো রৌদ্রুপের শরীর খারাপ। সুস্থ থাকলে সে সবসময় বাসায় ফিরে রাতের খাবার খায়। ক্ষুধা সে একদম সহ্য করতে পারে না। নৈঋতা তার জন্য অপেক্ষা করে থাকে বলে বাইরেও খায় না। কিন্তু আজ কী? অগত্যা নৈঋতা রৌদ্রুপের পেছন-পেছন রুমে চলে এল। রৌদ্রুপ হাতঘড়ি খুলছিল। নৈঋতা গিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে কপাল, গাল, গলায় হাত ছুঁয়ে তাপমাত্রা পরীক্ষা করতে লাগল। রৌদ্রুপ নৈঋতার মনের সন্দেহ আঁচ পেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“আমি ঠিক আছি। চিন্তা কোরো না। যাও খেয়ে এসো তাড়াতাড়ি। বেশি রাত হয়ে গেছে।”
“তাইলে আপনে খাইবেন না ক্যান?”
“ইচ্ছে করছে না, নৈঋ। জোর কোরো না প্লিজ। খেয়ে নাও তুমি।”
“সত্যিই শরীর ভালো?”
“হ্যাঁ।”
“বাইরে কিছু খাইছিলেন?”
“না।”
“তাইলে ক্ষুধা লাগেনায়?”
“না।”
তোয়ালে হাতে নিয়ে রৌদ্রুপ বাথরুমে ঢুকে গেল। কিছু একটা হয়েছে তা নৈঋতা আঁচ পাচ্ছে। রৌদ্রুপ হয়তো সময় হলে বলবে ভেবে খেতে চলে গেল। মানুষটাকে ছাড়া খেতে ইচ্ছে করছে না।‌ প্রতিদিনের অভ্যসবশত খাবারটুকু যে পাবে না। কিন্তু পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা। কোনোরকমে খাওয়া শেষ করে সে রুমে ছুটল। ততক্ষণে রৌদ্রুপ শুয়ে পড়েছে। চোখের ওপর হাত ঠেকিয়ে সটান শুয়ে আছে সে। নৈঋতা পাশে শোয়ার পরও রৌদ্রুপের মাঝে কোনো হেলদোল দেখা গেল না। অথচ প্রতিদিন তাকে বুকে না নেওয়া অবধি চোখ বন্ধ হয় না রৌদ্রুপের। আজ এমন কী হলো যে, মানুষটাকে এমন ছন্নছাড়া লাগছে? মিনিট দুয়েক পরও যখন রৌদ্রুপের সাড়া পাওয়া গেল না, তখন নৈঋতা নিজেই এগিয়ে গিয়ে রৌদ্রুপের বুকের কাছ ঘেঁষে শুয়ে পড়ল। বুকের কাছের টি-শার্টে আস্তে করে টান দিয়ে ডেকে বলল,
“হুনছেন? ঘুমাই পড়ছেন?”
ডাকার সঙ্গে-সঙ্গেই রৌদ্রুপ হাত সরিয়ে তাকাল।
“আপনের কী হইছে কইবেন না আমারে?” মন খারাপ করে বলল নৈঋতা।
রৌদ্রুপ এবারেও উত্তর দিলো না। নৈঋতাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বুক ফুলিয়ে বড়ো করে দম নিল। ব্যথিত গলায় বলল,
“বাবা নেই, নৈঝ। চলে গেছে আমাদের ছেড়ে।”
নৈঋতা চকিতে ঝট করে মাথা তুলে অবাক দৃষ্টিতে রৌদ্রুপের মুখের দিকে তাকাল। প্রশ্ন করল,
“কই গেছে?”
“আল্লাহর কাছে।”
নৈঋতা যেন আচমকা এক ঝটকা খেল। হতবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল রৌদ্রুপের ছলছল চোখ জোড়ার দিকে। আলগোছে শোয়া থেকে উঠে বসল। জানতে চাইল কীভাবে কী হয়েছে। রৌদ্রুপ সবটা খুলে বলল। ততক্ষণে নৈঋতার দুচোখ অশ্রু বিসর্জন দিতে শুরু করেছে। সরফরাজ চৌধুরী তাকে অপছন্দ করেননি। কোনোদিন কোনো কটুক্তিও শোনাননি। হুট করে তার এভাবে চলে যাওয়া, আর তিহানের পা হারানোর সংবাদ তাকে বেশ কষ্ট দিলো। তিহান সবসময় তাকে ছোটো বোনের মতো স্নেহ করে। রৌদ্রুপের জন্যও তার কষ্ট হচ্ছে। মানুষটা সারাদিন ধরে মুখ বুজে সবদিক সামাল দিলেও, ভেতরের আ’র্ত’নাদ প্রকাশ করতে পারেনি। নীরবে পু’ড়েছে। অথচ এখন তার চোখ ভর্তি জল। সারাদিনের চাপা কষ্ট প্রকাশ পাচ্ছে অনায়াসেই। এই মেয়েটার সামনে পাথর হয়ে থাকতে পারছে না সে। নৈঋতা ঝুঁকে পড়ে রৌদ্রুপের চোখের কোণের পানি মুছতে-মুছতে ধরা গলায় বলল,
“আইচ্ছা? বাবা কি আমগো থিকা মনে কষ্ট পাইছিল? আমরা তো মাফ চাইতে পারলাম না। আমগো ওপর রাগ নিয়া চইলা গেল?”
“না, নৈঋ। বাবা আমাদের ওপর কখনোই রেগে ছিল না। বিয়েটা করার আগে তো আমি তার অনুমতি নিয়েছিলাম। একটু অসন্তুষ্ট হলেও সে তখন অনুমতি দিয়েছিল। বাবা তো সবসময়ই চাইত আমরা বাড়ি ফিরে যাই, কিন্তু আমাদের আর ফেরা হলো না। যখন ফিরব, তখন সে দেখবেও না।”
নৈঋতা অশ্রুসিক্ত নয়নে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রৌদ্রুপের মুখের দিকে। স্পষ্ট দেখল মানুষটার চোখের টলমলে অশ্রু এতক্ষণে বাঁধ ভেঙে চোখের কোণ ঘেঁষে গড়িয়ে পড়ল। এই প্রথম সে এই শক্তপোক্ত মনের মানুষটাকে কাঁদতে দেখছে। হয়তো চিৎকার করে কাঁদতে চাইছে, কিন্তু ছেলে বলে পারছে না। এসব ভেবে নৈঋতার প্রচন্ড খারাপ লাগছে। ক্ষণকাল চুপ থেকে সে ব্যথিত কন্ঠে বলল,
“আপনের অনেক কষ্ট লাগতাছে, না?
রৌদ্রুপ এ প্রশ্নের উত্তর দিলো না। অন্য কথা বলল,
“জানো নৈঋ? বাবা খুব চাপা স্বভাবের মানুষ ছিল। সবাই ভাবে বাবার চেয়ে আম্মা আমাদের বেশি ভালোবাসে। কিন্তু আমি জানি, আম্মার চেয়েও বেশি ভালবাসত বাবা। শুধু সে মনের অনুভূতিগুলো খুব সহজে প্রকাশ করতে পারত‌ না। কিছু ভালোবাসা অপ্রকাশিতই সুন্দর। আর তার মধ্যে বাবাদের ভালোবাসা অন্যতম।”
নৈঋতা রৌদ্রুপের গালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মানুষটার ভেতরের চাপা আ’র্ত’নাদ তার নিজের কান্নাও থামাতে দিচ্ছে না। রৌদ্রুপ একটু থেমে পুনরায় বলতে লাগল,
“আমার আজকের অবস্থানের জন্য বাবার ভূমিকা অনেক বেশি। সবচেয়ে বেশি বলা চলে। সে সবসময় আমায় অনুপ্রেরণা জোগাত। বলত, নিজের স্বপ্ন, কল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করার চেষ্টা যে করে, সে-ই সফল হয়। স্বপ্ন ছুঁয়ে দেখার অনুভূতিটা কেমন হবে, সেটা চোখ বন্ধ করে অনুভব করো তো রৌদ্র। দেখবে, তোমার ইচ্ছাশক্তি আর ধৈর্যশক্তি দ্বিগুণ বেড়ে যাবে। আমি সেটাই করতাম। আশ্চর্যজনকভাবে বাবার কথা মিলে যেত। পড়াশোনার প্রতি সমস্ত অলসতা কে’টে যেত। চুপ থেকেও মানুষটা সবসময় আমাকে সমর্থন করত। অথচ তার শেষ সময়টায় আমি তার পাশে থাকতে পারিনি। শেষবারের মতো একবার কথা বলতে পারিনি।”
আবারও রৌদ্রুপের চোখের পানি গড়াল। নৈঋতা প্রসঙ্গ পালটে প্রশ্ন করল,
“কাইলকা সকালে আমারে নিবেন?”
রৌদ্রুপ হ্যাঁ-বোধক মাথা ঝাঁকাল।
“জানাজা কহন হইব?”
“সকাল আটটায়।”
“তাইলে তো সকাল-সকাল যাইতে হইব। আর কাইন্দেন না, থামেন। আপনে কাঁনলে আমারও কান্না পায়। বাবার লাইগা দোআ করেন আল্লাহর কাছে। দেহি, চোখ মোছেন।”
নৈঋতা নিজেই ওড়না দিয়ে রৌদ্রুপের চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
“ঘুমানের চেষ্টা করেন। নইলে তো আপনের মাথা ব্যথা করব। ঘুমান, চুলে বিলি কা’ইটা দিই।”
নৈঋতা রৌদ্রুপের চুলের ফাঁকে আঙুল ঢুকিয়ে বিলি কা’টতে লাগল। রৌদ্রুপ নৈঋতার মুখটা একহাতে আগলে ধরে কপালে কপাল ঠেকাল। চোখ বন্ধ করে চুপচাপ পড়ে রইল‌। নৈঋতা নড়েচড়ে উঠতেই রৌদ্রুপ মিইয়ে পড়া অসহায় কন্ঠে বলল,
“আমার বুকের ভেতর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, নৈঋ। একটু শান্তি দাও।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৬.
নৈঋতা আর নসিবকে নিয়ে রৌদ্রুপ যখন বাড়ি ফিরল, তখন সকাল সাড়ে ছয়টা। লা’শের খাটিয়ার পাশেই শাহানা খানম অশ্রুসিক্ত চোখে পাথুরে মূর্তির ন্যায় ঠাঁয় বসে আছেন, যেন আশপাশের কোনো খেয়াল তার নেই। শশী বিলাপ করছে। সরফরাজ চৌধুরীর লা’শের ওপর আছড়ে পড়ে গুনগুনিয়ে কেঁদে চলেছে একটি অপরিচিতা মেয়ে। মেয়েটির মুখ দেখা যাচ্ছে না। চারপাশে ‘রৌদ্র এসেছে’ গুঞ্জন কানে আসতেই মেয়েটি মুখ তুলল। ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে ঘুরে দাঁড়াল। সরাসরি তাকাল রৌদ্রুপের দিকে। চোখাচোখি হতেই রৌদ্রুপ এক মুহুর্ত দেরি না করে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। কিন্তু মেয়েটি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইল। পুরো ব্যাপারটা নৈঋতার দৃষ্টিগোচর হলো। সাদা থ্রি-পিস পরিহিতা মেয়েটি নিঃসন্দেহে একটু বেশিই সুন্দরী। কান্নার কারণে তার ফরসা মুখটা গোলাপী বর্ণ ধারণ করেছে। রৌদ্রুপ নৈঋতাকে নিয়ে এগিয়ে গেল সরফরাজ চৌধুরীর লা’শের খাটিয়ার কাছে। এতক্ষণে অপরিচিতা মেয়েটি নৈঋতাকে খেয়াল করল। ঝাপসা চোখে দেখল নৈঋতা কাঁদছে, আর রৌদ্রুপ তাকে একহাতে আগলে রেখেছে। তারপর আর কিছু মনে নেই মেয়েটার। ওখানেই মূর্ছা গেছে সে। জ্ঞান ফিরলে সে নিজেকে সেই অতি পরিচিত ঘরটায় দেখতে পেল। সেই ঘর, সেই বিছানা, সেই বালিশ। মেয়েকে চোখ খুলতে দেখে শিয়রের পাশে বসে থাকা শাড়ি পরিহিতা অর্ধ বয়স্ক মহিলা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। ঝুঁকে পড়ে ডাকলেন,
“শ্রাবণী? এখন কেমন লাগছে, মা? শরীর খারাপ লাগছে?”
শ্রাবণী মাথা দুলিয়ে ‘না’ জানাল। মায়ের সাহায্যে উঠে বসে সারা ঘরে আরও একবার চোখ বুলাল। ভাঙা গলায় শুধাল,
“কয়টা বাজে, আম্মু?”
“সাড়ে সাতটা। তুই বোস, আমি একটু খাবার নিয়ে আসি। কাল থেকে না খেয়ে আছিস।”
“তুমিও তো খাওনি। তোমার ভাইয়ের জন্য তোমার দুঃখ লাগে, আমার মামার জন্য কি আমার দুঃখ লাগে না? সে আমার দ্বিতীয় বাবা ছিল। আমি তার মেয়ের থেকে কম ছিলাম না, মা। আমি তাকে শেষ একবার ডাকতেও পারলাম না।”
বলতে-বলতেই শ্রাবণী আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আলেয়া বেগমও চোখের পানি ফেললেন। বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়িয়ে বললেন,
“এখন আর বাইরে যাস না। এক্ষুনি আসছি আমি।”
শ্রাবণী কান্নার মাঝপথেই তাচ্ছিল্য হাসল। বলল,
“চিন্তা কোরো না, আম্মু। যে মায়া ত্যাগ করে আজও বেঁচে আছি, তা আর ফিরে পাওয়ার বিন্দুমাত্র আশা আমার নেই। দেখলে তো সে কতটা ভালো আছে। সে পারলে আমি কেন পারব না?”
আলেয়া বেগম মাথা নিচু করে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে-মুছতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মায়ের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে শ্রাবণী পুনর্বার হাসল। সে জানে, তার কথা শুনতে চায়নি বলেই পালিয়ে গেছে মা। সকাল দশটায় সরফরাজ চৌধুরীর জা’নাজা অনুষ্ঠিত হলো। লা’শের খাটিয়া কাঁধে তোলার সময় আর বাবাকে ক’বরে শোয়ানোর সময় রৌদ্রুপ খুব করে এক শূন্যতা অনুভব করল। বাবার সাথে-সাথে বড়ো ভাইটার শূন্যতা। বাবার বড়ো ছেলেটা জানলও না সে পিতৃহীন হয়ে গেছে। তার বাবা তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। অথচ এই একই সময়ে সে হাসপাতালের বেডে শুয়ে ছটফট করছে। মনটা ভীষণ আঁকুপাঁকু করছে তার। কোনোভাবেই শান্ত হচ্ছে না। বারবার নিদ্রাকে প্রশ্ন করে চলেছে, বাকিরা তার কাছে আসছে না কেন। স্বামীর অবস্থা দেখে নিদ্রার কাছে চোখের পানি আড়াল করাও কষ্টকর হয়ে পড়েছে। শ্বশুরের শেষ মুহূর্তেও সে বাড়ি ফিরতে পারেনি। তবু সে তিহানকে মিথ্যে বুঝাচ্ছে, “বাকিরা বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছে। বাবা
অল্পতেই বেঁচে গেছেন। রৌদ্রুপ আবার আসবে।”
এই খাপছাড়া উত্তর কেন জানি তিহানের বিশ্বাস হচ্ছে না। তার মন বলছে, কিছু একটা খারাপ হয়েছে, যা তার কাছে লুকানো হচ্ছে। নিদ্রার কাছে সন্তোষজনক জবাব না পেয়ে তিহান রৌদ্রুপের আসার অপেক্ষায় আছে। রৌদ্র নিশ্চয়ই তাকে মিথ্যে বলবে না। রৌদ্রুপ এল সন্ধ্যায়। কিন্তু সে এসেই ডাক্তারের সাথে কথা বলতে চলে গেল। তিহান তখন ঘুমে। নিদ্রার কাছে ভাইয়ের অস্থিরতার কথা শুনে রৌদ্রুপের বুকটা ঝাঁঝরা হয়ে গেল। ভাই তার অপেক্ষায় আছে জেনেও সে ভাইকে জাগিয়ে তুলল না। ওই কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারবে না সে। তাইতো দরজার কাছ থেকেই ভাইয়ের ঘুমন্ত মুখটা দেখে দ্রুত সরে পড়েছে। তিহানের পায়ের অবস্থা খুব বেশি ভালো না। তাকে আরও কদিন হসপিটালে থাকতে হবে। রৌদ্রুপ নিদ্রাকে বলে দিলো সে যতক্ষণ থাকবে, ততক্ষণ তিহানকে না জাগাতে।

রৌদ্রুপ বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় নৈঋতাকে ঘরে বসিয়ে রেখে বলে গেছে, সে যেন বাইরে বেশি ঘুরঘুর না করে। আত্মীয়-স্বজন সবার কৌতূহল তার দিকে। তাদের আদরের রৌদ্র একা বিয়ে করেছে বলে কেউই তেমন সন্তুষ্ট ছিল না। নৈঋতাকে দেখে কেউ রূপের প্রশংসা করেছে। আবার কেউবা মুখের ওপর বলে দিয়েছে, ‘রৌদ্র খাঁটি সোনা চিনল না। শেষে কি না তামা কুড়িয়ে আনল!’ নৈঋতা অবশ্য চুপ থেকে সবার কথা শুনেছে। এসে হতে শশী বা শাহানা খানম তার সাথে একটা কথাও বলেননি। সে যেচে পড়ে কাছে গিয়ে বসেছিল বেশ কয়েকবার। দূরেও ঠেলে দেয়নি কেউ। ইতোমধ্যে নিজের পরিবার নিয়ে হাজারটা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে নৈঋতাকে। এ কারণেই রৌদ্রুপ তাকে বাইরে বেরোতে বারণ করে গেছে। একা-একা নৈঋতা খুব বিরক্ত হচ্ছে। নসিবটাও আশেপাশে নেই। বিরক্তিগুলো বিস্ময়ে রূপান্তর করে হুট করেই আগমন ঘটল সকালের সেই অপরিচিতা মেয়েটির। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেই সে বলে উঠল,
“কিছু মনে কোরো না। তোমার বর বাইরে গেছে বলে নক না করেই চলে এলাম। ফ্রি আছো? গল্প করতাম আরকি। একা-একা বোর হচ্ছিলাম।”
নিসঙ্কোচ স্বীকারোক্তি। নৈঋতা বিস্ময় চেপে রেখে বলল,
“জি, আসুন না। বসুন।”
মেয়েটা নৈঋতার মুখোমুখি বসে পড়ল। কেমন করে যেন তাকিয়ে রইল নৈঋতার দিকে। নৈঋতা খানিক ইতস্তত বোধ করল। প্রশ্ন করল,
“আপনাকে তো এর আগে কখনও দেখলাম না এ বাড়িতে।”
মেয়েটা উত্তর দিলো,
“দুবছর ধরে আসি না যে। দেখবে কীভাবে?”
“কেন?”
“সেসব তোমার না জানলেও চলবে। যাইহোক, আমি শ্রাবণী। সরফরাজ চৌধুরী আমার মামা।”
নৈঋতা একটু বেশিই অবাক হলো। রৌদ্রুপের কোনো ফুপু আছে বলে তার জানা ছিল না। এতদিন সে জানত রৌদ্রুপের বাবার শুধু ছোটো আরেক ভাই আছে। নিশ্চিত হওয়ার জন্য নৈঋতা প্রশ্ন করল,
“আপন মামা?”
“হ্যাঁ।”
নৈঋতা বিস্ময় চেপে রাখতে পারল না। বলল,
“আমি জানতাম না ওনার কোনো ফুপু আছে।”
শ্রাবণী বোধ হয় প্রসঙ্গ পালটানোর চেষ্টা করল। নৈঋতার মুখটা আলতো ছুঁয়ে দিয়ে বলল,
“তুমি খুব মিষ্টি একটা মেয়ে। রৌদ্র ভাই জিতেছে বলতে হবে।”
নৈঋতা লজ্জায় পড়ে গেল। শ্রাবণী শুধাল,
“তুমি কেমন আছো, নৈঋতা?”
কেমন যেন শোনাল এই প্রশ্নটা। এতক্ষণ বাদে হঠাৎ এমন প্রশ্নে নৈঋতা আরেক দফা অবাক হলো। উত্তর দিলো,
“আলহামদুলিল্লাহ্, ভালো আছি।”
“সবসময় খুব ভালো থেকো, ভালো রেখো। আজকাল সত্যিকারের ভালবাসা দুর্লভ হয়ে গেছে। তুমি সেই দুর্লভ জিনিসটা নিজের করে পেয়েছ। শেষ পর্যন্ত ধরে রেখো। তুমি খুব ভাগ্যবতী। তাইতো রৌদ্র ভাইকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছ। যাকে চেয়েছি, তাকেই পেয়েছি, এমন ভাগ্য সবার হয় না। আমিও চেয়েছিলাম কাউকে, কিন্তু সবার ভাগ্যে তো আর পাওয়া হয়ে ওঠে না।”
শ্রাবণীর এই কয়েক লাইন বাক্য ব্যয়ের মধ্যে নৈঋতা কয়েক হাজার ডেল ব্যথা আঁচ পেল। সরল মনেই জানতে চাইল,
“কেন পাননি?”
“সে চায়নি তাই।”
“আটকে রাখতে চাননি?”
“চেয়েছিলাম, কিন্তু সে আমার ভালোবাসায় আ’ঘা’ত করেছিল।”
“কীভাবে সহ্য করেছিলেন?”
“কাছের মানুষদের আ’ঘা’তগুলো সবসময় অন্তর্ভেদী হয়। তারটাও সেরকমই ছিল। বাবা-মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আমাকে সহ্য করতে হয়েছিল। প্রথম দিকে ভেঙে পড়েছিলাম, খুব পা’গলামি করেছিলাম। কিন্তু তা কা’টিয়ে উঠতে খুব বেশি সময় লাগেনি।”
“তাকে মনে পড়ে না এখন আর?”
“পড়ে তো, খুব মনে পড়ে। একটা সময় আমি ভাবতাম, প্রেম হচ্ছে ‘আমার তোমাকে চাই’ টাইপ। আর ভালোবাসা হচ্ছে ‘তোমাকে ছাড়া আমার চলবেই না’ টাইপ। আমি তাকে ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু এখন তাকে ছাড়াই আমার দিব্যি চলে যাচ্ছে।”
“জীবনটা কি একটা সুযোগ পাওয়ার অধিকার রাখে না? নতুন করে শুরু করতে পারতেন।”
এ পর্যায়ে এসে শ্রাবণী হাসল। কতশত চাপা আর্তনাদ সেই মনকাড়া মুচকি হাসির রেখাটিতে। মেঝেতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে সে বলল,
“জানো তো? ভালোবাসার শুরু থেকেই আমি এক মূলমন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলাম। ‘আমি যাকে অন্তরের অন্তস্তল থেকে ভালোবাসব, কেবল তাতেই আসক্ত থাকব।’ আজও আমি সেই আসক্তি থেকে বেরোতে পারিনি। তবে খুব শীঘ্রই বেরুব। নিজের জন্য নয়, পরিবারের জন্য। বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে আমি। আমাকে নিয়ে তাদের হাজারটা স্বপ্ন আছে। একমাত্র মেয়ে হয়ে তাদের স্বপ্ন আমি কীভাবে ভাঙি? আমি জানি তারা কখনও কোনো সিদ্ধান্ত আমার ওপর চাপিয়ে দিবে না। অপেক্ষায় আছে কবে আমি স্বেচ্ছায় সিদ্ধান্ত জানাব। আমি নিজেকে প্রস্তুত করছি। অতীতটাকে হয়তো মুছে ফেলতে পারব না, কিন্তু বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে তো পারব। কোন বাবা-মা চায় তাদের সন্তান খারাপ থাকুক? দেখো, আমিও ভালো থাকব, খুব ভালো থাকব। তাকে ছাড়াই ভালো থাকব।”
নৈঋতা মুগ্ধ হয়ে শ্রাবণীর কথা শুনল। কী সুন্দর করে কথা বলে মেয়েটা! কী মনোরম তার হাসি! বাইরে থেকে দেখলে কে বলবে এই মেয়ের ভেতরটা ভেঙেচুরে একাকার হয়ে আছে? নৈঋতা নিজের মনের কথাটা প্রকাশ করে ফেলল,
“আপনি খুব সুন্দর করে কথা বলেন, আপু। ওনার মতো।”
শ্রাবণী ঠোঁট এলিয়ে হাসল। বলল,
“তোমার উনি আমার চেয়েও সুন্দর করে কথা বলেন। তুমিও তার মতো মিষ্টভাষী। যাইহোক, তুমি আমার কথায় কিছু মনে করছ না তো?”
“না।”
“মিষ্টি মেয়ে। তুমি কিছু খেয়েছ?”
নৈঋতা মাথা ঝাঁকাল। উত্তর দিলো,
“উনি বেরোনোর আগে খেয়েছি।”
“উনি দেখছি তোমাকে খুব আগলে রাখে। গুড, এভাবেই ভালোবাসায় থাকো সবসময়।”
নৈঋতার খুব জানতে ইচ্ছে করল, শ্রাবণীর অতীতের সেই মানুষটা কে, যাকে সে আজও এতটা ভালোবাসে? কিন্তু কোনো এক জড়তার কারণে জানা হলো না। মুখ ফসকে বেরিয়ে এল অন্য প্রশ্ন,
“আপনি কেমন আছেন, আপু?”
শ্রাবণী তখন চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছে। নৈঋতার প্রশ্ন শুনে কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হেসে বলল,
“আমার তো মনে হয় এই ‘ভালো নেই’ এর পৃথিবীতে আমি একাই বুঝি ভালো আছি। আমাকে রোজ ভালো থাকতে হয়। নিজের জন্য, পরিবারের জন্য। তোমার সংসার জীবনের জন্য শুভ কামনা রইল। পরে আবার কথা হবে। আসছি।”
নৈঋতাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই শ্রাবণী দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নৈঋতার কেন জানি মনে হলো শ্রাবণী নিজের চোখের পানি আড়াল করতে একপ্রকার পালিয়ে গেল। চোখের কোণের পানি মুছতে-মুছতে কয়েক পা যেতেই শ্রাবণী থমকে দাঁড়াল। অতি পরিচিত সেই মুখটাও কিছু সময়ের জন্য থমকাল। শ্রাবণীর চোখ দুটো পুনরায় হঠাৎ জ্ব’লে উঠল। কিন্তু সে খুব দ্রুতই নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করল। হাসার চেষ্টা করে বলল,
“পৃথিবীতে কিসের সংখ্যা বেশি, রৌদ্র ভাই? রাগ, অভিমান, হাসি, কান্না, না কি দীর্ঘশ্বাস?”
রৌদ্রুপের স্থির দৃষ্টি তখন তার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির ওপর নিবদ্ধ। শ্রাবণী পরপর দ্বিতীয় তি’রটিও ছুঁ’ড়ে মা’রল,
“কথা বলবে না? ঠিক আছে, বোলো না। বিশ্বাস করো, আগের মতো আজ আর ভালোবাসার দাবি নিয়ে আসিনি আমি। আমি জানি সেই অধিকার আর আমার নেই। তবে আমি আজও বেহায়াই রয়ে গেছি, সেজন্যই মুখ ফিরিয়ে নিতে পারিনি। তোমার বউটা খুব মিষ্টি দেখতে। বুঝলাম, খুব ভালোবাসো বউকে। সবার কপাল তো আর আমার মতো না। তোমার জন্য একটা খুশির খবর আছে। আমি খুব শীঘ্রই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে চলেছি। বউকে নিয়ে অবশ্যই আমার বিয়েতে অ্যাটেন্ড করবে। কত এক্সপেক্টেশন তো ধুলায় গড়াল। তোমার থেকে শেষ এটুকুই এক্সপেক্টেশন আমার। রাখা, না রাখা তোমার মর্জি। জোর করার সাধ্য তো আমার কোনোকালেই ছিল না।”
রৌদ্রুপ না চোখ ফিরিয়ে তাকাল, না প্রত্যুত্তর করল। উস-খুস মন নিয়ে সে দ্রুত শ্রাবণীকে পাশ কা’টিয়ে রুমের দিকে এগিয়ে গেল। দরজায় দাঁড়ানো নৈঋতাকেও পাশ কা’টিয়ে সোজা ভেতরে ঢুকে পড়ল। নৈঋতা অবাক চোখে দেখল এতক্ষণ ধরে নিজেকে সামলে রাখা মেয়েটা টলমলে পায়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। তবে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামা আর হলো না। ধপ করে সেখানেই বসে পড়ল। মাথা নিচু করে দুহাতে চুল টেনে ধরে চাপা সুরে হুঁ-হুঁ করে কেঁদে উঠল। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই কোত্থেকে শশী ছুটে এল। শ্রাবণীর কান্না থামানোর চেষ্টায় ব্যস্ত সে। চেঁচিয়ে ফুপুকেও ডাকল। শ্রাবণীর পিঠে অনবরত হাত বুলিয়ে প্রশ্ন করল,
“কাঁদছ কেন, আপু? রৌদ্র ভাইয়া কিছু বলেছে তোমায়?”
নৈঋতা আলগোছে দরজার কাছ থেকে সরে গেল। দরজা আটকে চুপটি মে’রে বসে রইল খাটের কোণে। রৌদ্রুপ বাথরুম থেকে বেরিয়ে নৈঋতাকে এভাবে বসে থাকতে দেখেও কোনো প্রশ্ন করল না। তোয়ালেতে মুখ মুছতে-মুছতে তিহানের অবস্থার কথা বলতে লাগল। নৈঋতা চুপচাপ সবটা শুনল। গায়ে টি-শার্ট চাপিয়ে রৌদ্রুপ নৈঋতাকে বলল,
“খালামনি নিচে গিয়ে ডিনার করতে বলেছে। চলো।”
নৈঋতা বিনা বাক্যে রৌদ্রুপের সাথে নিচে গেল। শাহানা খানমকে তার বোন একটু খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন। তিনি কিছুই মুখে তুলছেন না, একটু পরপরই কাঁদছেন। রৌদ্রুপ আর নৈঋতাকে খাবার দেওয়া হলেও, রৌদ্রুপ নিজের খাবার রেখে মায়ের কাছে গেল। শাহানা খানম ছেলেকে কাছে পেয়েই জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। রৌদ্রুপ তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নানান কথা বলে বুঝানোর চেষ্টা করল। নৈঋতা নিজেও কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। রৌদ্রুপ শাহানা খানমের চোখের পানি মুছে দিয়ে খাবার মুখে তোলার জন্য অনুরোধ করল। নৈঋতা রৌদ্রুপের খালামনির থেকে প্লেট চেয়ে এনে ভয়ে-ভয়ে নিচু স্বরে অনুরোধ করল,
“মা, আমি খাইয়ে দিই?”
শাহানা খানম মুখ তুলে তাকিয়ে যেন কিছুটা থমকালেন। তবে কোনো প্রতিক্রিয়া না করে চোখ নামিয়ে নিলেন। নৈঋতা দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে পুনরায় বলল,
“এভাবে না খেয়ে থাকলে আপনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন। বড়ো ভাইয়া ফিরে এসে বাবাকে পাবে না, তার ওপর আবার আপনাকেও অসুস্থ দেখলে উনি খুব কষ্ট পাবেন। একটু খান না, মা।”
রৌদ্রুপের আত্মীয়-স্বজন কয়েকজন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। নৈঋতার মিষ্টি কথায় কেউ-কেউ সন্তুষ্ট হলেন। শাহানা খানমকে বললেন নৈঋতার অনুরোধ রাখতে। শাহানা খানমকে চুপ মে’রে বসে থাকতে দেখে নৈঋতার মন খারাপ হলো। সে ভাবল শাহানা খানম তাকে পুত্রবধূ মানতে নারাজ বলেই তার হাতে খেতে চাইছেন না। কিন্তু রৌদ্রুপ হঠাৎ তাকে বলল,
“খাইয়ে দাও।”
তার কথায় নৈঋতা সাহস জুগিয়ে এক লোকমা ভাত তুলে শাহানা খানমের মুখের কাছে ধরল। মৃদু স্বরে খেতে অনুরোধ করল। অবচেতন মন জানান দিলো শাহানা খানম কিছুতেই তার হাতে খাবার খাবেন না। কিন্তু তাকেসহ উপস্থিত সবাইকে অবাক করে দিয়ে শাহানা খানম নৈঋতার হাতের খাবার মুখে তুললেন। খুশিতে নৈঋতার কান্না পেল। রৌদ্রুপের ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিত হাসি ফুটল। নৈঋতা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে শাহানা খানমকে খাওয়াচ্ছে। শশী এসে এ দৃশ্য দেখে বিস্ময়ে হা হয়ে গেল। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে সে একবার মায়ের দিকে, আরেকবার নৈঋতার দিকে তাকাচ্ছে। রৌদ্রুপ তাকে কাছে ডেকে খেতে বসতে বলল। শশী যেন মনে-মনে খুব খুশি হলো। কতদিন পর রৌদ্র ভাইয়া তার সাথে আদুরে গলায় কথা বলেছে! শাহানা খানম পুরোটা খাবার খেলেন না। কিছুটা খেয়েই পানি খেয়ে চুপচাপ উঠে চলে গেলেন। রৌদ্রুপ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বড়োরা সামনে থাকায় আজ আর রৌদ্রুপের খাবারের শেষাংশ ভাগ্যে জোটেনি নৈঋতার। কোনোমতে আগেভাগেই খাওয়া সমাপ্ত করে সে ওপরে চলে এসেছে। রৌদ্রুপ এল অনেকটা সময় পর। এসে দেখল নৈঋতা বিপরীত দিকে মুখ করে শুয়ে আছে। ঘুমায়নি যে তা তার নড়চড়ই বলে দিচ্ছে। অথচ সে এসেছে টের পেয়েও ফিরেও তাকাচ্ছে না।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে