কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে পর্ব-১৩+১৪

0
2571

কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৩.
তখন প্রকৃতির আবছা অন্ধকার গাঢ় হয়েছে। উঠানে নসিব টর্চ লাইট হাতে দাঁড়িয়ে ছিল। নৈঋতা-রৌদ্রুপকে দেখে একগাল হেসে এগিয়ে এল। রৌদ্রুপ তার পিঠ চাপড়ে বলল,
“কী খবর, নসিব? ভালো আছো তো?”
নসিব হাসিমুখেই উত্তর দিলো,
“আইজকের দিনেও কি খারাপ থাহা যায়, ভাইয়া?”
পরক্ষণেই নৈঋতার দিকে তাকিয়ে শুধাল,
“কেমন আছোস আপা?”
নৈঋতা রৌদ্রুপের আগের কথাটা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। বলল,
“ভালা আছি। আইজকা কী?”
নসিব তার প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে রৌদ্রুপকে বলল,
“ব্যাগটা আমার কাছে দেন, আমি ঘরে রাইখা আহি। আপনে আব্বা-আম্মার লগে দেহা কইরা আহেন।”
রৌদ্রুপের থেকে ব্যাগ নিয়ে নসিব রৌদ্রুপের জন্য বরাদ্দকৃত ঘরটার দিকে চলে গেল। নসিবের আচরণে নৈঋতা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। ঘরে গিয়ে সে যেন আকাশ থেকে পড়ল। সামসুদ্দীন বেপারী আর আফিয়া বেগম যেভাবে হাসিমুখে রৌদ্রুপের সাথে কথা বলছেন, তাতে নৈঋতা নিশ্চিত হলো যে তাদের আসার খবর আগে থেকেই সবাই জানত। নইলে হঠাৎ করে দেখলে তো অবাক হবার কথা ছিল। কিন্তু জানল কীভাবে? নিশ্চয়ই রৌদ্রুপ জানিয়েছে। তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার কথা বলার পরও আব্বা-আম্মা এত খুশি কীভাবে? নৈঋতার দাদিও ছিল এ ঘরে। সবার সাথেই একটু-আধটু কথা হলো রৌদ্রুপের। খুব বেশি কথা বলল না। নিজের ঘরে চলে গেল। সে চলে যেতেই আফিয়া বেগম নৈঋতাকে তাড়া দেখিয়ে বললেন,
“যা, হাতমুখ ধুইয়া আয়।”
নৈঋতা তাকে প্রশ্ন করল,
“তোমরা কি জানতা আমগো আওয়ার কতা?”
“ক্যান?” পালটা প্রশ্ন করলেন সামসুদ্দীন বেপারী।
“তোমাগো কতা হুইনা তো মনে হইতাছে আগে থিকাই জানতা। উনি ফোন কইরা কইছিল না কি?”
আফিয়া বেগম আবার তাড়া দেখিয়ে বললেন,
“হ। অহন ইসকাফ খুইলা ভালা কইরা হাতমুখ ধুইয়া আয়। কতা পরে কইস।‌ যা, যা।”
নৈঋতা একটু অবাক হলো। বিছানায় পা ঝুলিয়ে আরামসে বসে বলল,
“কেলান্ত লাগতাছে, মা। একটু পর যাই।”
আফিয়া বেগম নৈঋতার কথা শুনলেন না। জোর করে পাঠালেন হাত-মুখ ধুতে। নৈঋতা বাইরে থেকে হাত-মুখ ধুয়ে এসে দেখল আফিয়া বেগম সামসুদ্দীন বেপারীর সাথে ফিসফিস করে কোনো বিষয়ে কথা বলছেন। নৈঋতাকে দেখে তাকে কাছে ডাকলেন সামসুদ্দীন বেপারী। নৈঋতা মাথায় কাপড় টেনে এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়াল। সামসুদ্দীন বেপারী মেয়ের মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিয়ে ধরা গলায় বললেন,
“আম্মা গো, ছোডোকাল থিকা বাপের সংসারে অভাব আর কষ্ট ছাড়া কিছু পাওনায়। আমি বাপ হইয়া তোমারে সুখে রাখতে পারিনাই। পারলে আমারে মাপ কইরা দিয়ো।”
বাবার এহেন আচরণে নৈঋতা ভীষণ অবাক হলো। মায়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
“হঠাৎ এমন কতা কইতাছ ক্যান, আব্বা?”
সামসুদ্দীন বেপারী বেশ তৃপ্ত স্বরে বললেন,
“তোমারে নিয়া আমার চিন্তার শ্যাষ আছিল না। কয়েসের থিকা তোমারে কেমনে বাঁচামু, কেমনে ভালা একখান জামাই দেইখা বিয়া দিমু, এইসব নিয়া আমি সবসময় চিন্তায় থাকতাম। আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনাই যে, তোমার লাইগা আমি এমন রাজপুত্তুর পামু। আল্লায় মুখ তুইলা চাইছে, আমার ডাক হুনছে। তোমার লাইগা রাজপুত্তুর পাডাইছে। তুমি অনেক সুখে থাকবা, আম্মা। বাপের সংসারের সব কষ্ট জামাইর সংসারে গিয়া ভুইলা যাইবা।”
নৈঝতা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বাবার এসব কথার অর্থ বের করতে গিয়ে সে বুঝে নিল, তার জন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। পাত্র হয়তো বাবার পছন্দ হয়েছে, সেজন্যই এসব কথা বলছে। নৈঋতা আমতা-আমতা করে জিজ্ঞেস করল,
“কী অইছে, আব্বা?”
পাশ থেকে আফিয়া বেগম বললেন,
“তোর বাপে আসল কতাই কয়নায়। আমি কইতাছি। ওই রৌদ্র আছে না? বাজান তোরে বিয়া করতে চায়।”
নৈঋতা চমকে উঠে বলল,
“এইসব কী কও?”
“হ, ঠিকই কইছি। আইজকা সকালে তোর বাপেরে ফোন করছিল। কইল আমরা রাজি থাকলে হে তোরে আইজকাই বিয়া করব। তোর বাপে প্রথমে ওর বাপ-মার কতা জিগাইছিল। পরে কইল অহন ওর মায় বিয়া মানব না। কিন্তু বিয়া না করলে তোরে আবার গেরামে রাইখা যাইতে অইব। অয় চায় তোরে বিয়া কইরা আলাদা সংসার করতে, আর নসিবের লাইগাও কাম ঠিক করছে। নসিবেরেও তোগো লগে রাখব। ওর মায় মানব না হুইনা তোর বাপ রাজি হইতে চায়নায়। কিন্তু অর বাপ আছে না? দুলাভাইরে অয় রাজি করাইছে। দুলাভাই নিজে ফোন কইরা আগমো লগে কতাও কইছে। তোরে পোলার বউ করতে ওনার আপত্তি নাই।”
“খালু কেমনে রাজি হইল! আর উনি কইছে দেইখাই তোমরা রাজি হইয়া যাইবা? খালাম্মা ওনার মা। মায়ের অমতে উনি আমারে বিয়া করলে উনি নিজেও ভালো থাকব না।”
“বেশি বুঝিস না। এমন সুযোগ হাতছাড়া করা কি ঠিক হইব? তোর বাপেরে আমি বুঝাইছি। এই গেরামে থাকলে তোর জীবন কষ্টে-কষ্টে শ্যাষ হইয়া যাইব। এই অভাবের সংসার থিকা ভালা পোলা পামু কই তোর লাইগা? রাজপুত্তুর নিজেই তোরে বিয়া করতে চাইছে। তুই তো জানোস না, এই পোলা তোরে না জানাইয়া তোর বাপের লাইগা টেকাও পাডাইছে, যাতে আমগো কষ্ট না অয়। আবার আমগোরে কইছে তোরে যাতে না জানাই। এমন সোনার টুকরা পোলারে কেমনে ফিরাইয়া দেওয়া যায়? সব ভাইবাই তো তোর বাপ রাজি অইছে। অর মায় পরে মানবই। দুলাভাইর মতামত হইছে আগে দরকার। উনি তো নিজেই অনুমতি দিয়া দিছে। এইসব নিয়া আমগোরে চিন্তা করতে না কইছে। ওনাগো কতা মতো খালি কাজি আর হুজুররে ডাইকা আনছে নসিবে। ঘরেই চুপচাপ বিয়া হইব। হেরপর কাইলকা তোরে লইয়া আবার শহরে যাইবগা। বুঝছস?”
“না, না, মা। এইডা একদম ঠিক হয়নায়। উনি আমার জীবনের কতা ভাইবা এমন সিদ্ধান্ত নিলেও আমি এমন কাম করতে পারমু না।”
আফিয়া বেগম নিচু স্বরে ধমকে উঠলেন,
“সব ব্যবস্তা করা হইয়া গেছে। অতিরিক্ত পাকনামি করবি না। তোর কতা ভাইবা আমরা সবাই এমন সিদ্ধান্ত নিছি, অহন তুই নিজেই বাগড়া দেস? ভালা মাইনষের মতো চুপ থাকবি কইলাম। আর নইলে নিজে এমন জামাই খুঁইজা আনবি। এই আকালের সংসারে ভোগার শখ না থাকলে, আর কায়েসের থিকা দূরে থাকতে চাইলে আমি যা কইতাছি তা কর।”
নৈঋতা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একবার বাবার দিকে, তো একবার মায়ের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। দুজনের চোখেই জল। এদিকে নৈঋতা বলার মতো কোনো কথাই খুঁজে পাচ্ছে না। তাকে না জানিয়ে রৌদ্রুপ এতকিছু করে বসে আছে, এমনটা সে এখনও ভাবতে পারছে না। সারাটা রাস্তা একসঙ্গে এসেও তো সে কিছু আঁচ করতে পারল না। হঠাৎ নৈঋতার বিবেক বাঁধ সেধে দাঁড়াল। সে জানে রৌদ্রুপের পরিবার তার ওপর রেগে থাকলেও, তারা ছেলেকে খুব ভালোবাসে। রৌদ্রুপের পথ চেয়ে বসে থাকবে তার মা। অথচ রৌদ্রুপ তাকে নিয়ে আলাদা সংসার করতে চায়! এমনটা হলে তো তার পরিবারের মানুষগুলো মনে খুব কষ্ট পাবে। জেনেশুনে নৈঋতা কীভাবে পারবে রৌদ্রুপকে তার পরিবার থেকে আলাদা করতে? এমনটা সে কখনোই চায় না। কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে নৈঋতা বাবা-মায়ের সাথে এ বিষয়ে কথা না বাড়িয়ে সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিলো,
“আমি ওনার লগে একটু কতা কমু, আব্বা।”
সামসুদ্দীন বেপারীর আগে আফিয়া বেগম বলে উঠলেন,
“অহন আর কী কতা কইবি? ওই ঘরে কাজি আর হুজুরে বইয়া রইছে। তোরে লইয়া গেলেই বিয়া পড়াইব। আর কতা কওয়ার দরকার নাই।”
“আমার দরকার আছে, আম্মা। ওনারে একবার ডাইকা আনো।”
তাদের কথার মাঝেই নসিব ঘরে এল। তাড়া দেখিয়ে বলল,
“অহনও তোমরা কতা কইতাছ? কাজি সাবের কাম আছে। তাড়াতাড়ি যাইতে কইতাছে।”
সামসুদ্দীন বেপারী বললেন,
“তোর বইন তো রৌদ্রের লগে কতা কইতে চাইতাছে।”
নসিব ভ্রুকুটি করে নৈঋতার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আর কী কইবি আপা? ভাইয়া তোরে পছন্দ করে, তা তো মনে হয় তুই জানোস। আর ভাইয়া কেমন মানুষ, তা-ও জানোস। তোরে অনেক সুখে রাখব। যা কতা আছে, পরে কইস।”
নৈঋতা বিরক্ত হয়ে বলল,
“তুই আগে ওনারে ডাইকা আন। আমি বেশিক্ষণ কতা কমু না। বিয়ার পর কতা কইয়া কী করুম আমি? আমার অহন দরকার, অহনই কমু।”
আফিয়া বেগম রেগে গেলেন। কিন্তু সামসুদ্দীন বেপারী নসিবকে বললেন রৌদ্রুপকে উঠানে ডেকে আনতে। বাবার আদেশ পেয়ে নসিবও আর দ্বিরুক্তি করল না। মাথা দুলিয়ে চলে গেল রৌদ্রুপকে ডাকতে। নৈঋতা চাপা অস্থিরতা নিয়ে চৌকিতে পা ঝুলিয়ে বসে পড়ল। দুই মিনিটের মাথায় নসিব ফিরে এসে জানাল রৌদ্রুপ উঠানে অপেক্ষা করছে। নৈঋতা একবার বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রৌদ্রুপ উঠানের পাশের মাচায় বসে ছিল। অন্ধকারে চারপাশে চোখ বুলিয়ে রৌদ্রুপকে দেখে নৈঋতা এগিয়ে গেল। কিন্তু রৌদ্রুপের সামনে দাঁড়াতেই যেন সে সব কথা ভুলে গেল। বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করতে লাগল। কিছু বলতে না পেরে সে নত হয়ে দাঁড়িয়ে দুহাত কচলাচ্ছে। রৌদ্রুপ অন্ধকারে নৈঋতার মুখের অভিব্যক্তি বুঝার চেষ্টা করে বলল,
“বলো।”
নৈঋতা খানিক চমকে ছোট্ট একটা শব্দ করল,
“হুঁ?”
“বলো, কী বলতে ডেকেছ?”
নৈঋতা আমতা-আমতা করে বলল,
“এইসব কী করতাছেন আপনে?”
“কোনসব?”
“বিয়ার কতা কইতাছি।”
“আপত্তি আছে তোমার?”
“আমি চাই না আমার লাইগা আপনে নিজের পরিবারের লগে সম্পর্ক নষ্ট করেন। তারা অনেক কষ্ট পাইব, আর দোষ দিলে আমারেই দিবো।”
“দোষ তো তুমি করছ না। বাড়িতে থাকতেই আমি এ বিষয়ে বাবার সাথে কথা বলেছি। বাবা তোমার প্রতি হওয়া অন্যায়টা ভালো চোখে দেখেনি। তাই আমাকে অনুমতি দিয়েছে। আমরা তো লুকিয়ে বিয়ে করছি না। তোমার পরিবার আছে, আমার বাবার অনুমতি আছে।”
“খালাম্মার কতা ভাববেন না?”
“বাবা যখন রাজি, তখন মাকে মানিয়ে নেওয়া যাবেই। কিন্তু তুমি আমার কথা ভাববে না? তোমাকে হারিয়ে ফেলে আমি দিব্যি জীবনযাপন করতে পারব ভাবছো? প্রথমেই বলেছিলাম আমি এই হাত মৃ’ত্যুর আগ পর্যন্ত ছাড়ব না। তোমার বিপদের সময়ে আমি আমার প্রতিজ্ঞা কী করে ভুলে যাই? তুমি চাইলেও আমি তোমায় ছাড়ব না, নৈঋ। আমি আমার প্রতিজ্ঞাও রক্ষা করব, আর ভালোবাসাও।”
কথার মাঝেই নৈঋতার বাঁ হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিল রৌদ্রুপ। কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে হাতের আঙুলে কোনো বস্তুর স্পর্শ অনুভব করতেই নৈঋতা চমকে উঠল। কাঁপা গলায় শুধাল,
“কী করেন আপনে?”
আংটিটা ভালোভাবে পরিয়ে দিয়ে তাতে আলতো করে আঙুল বুলিয়ে রৌদ্রুপ বলল,
“এনগেজমেন্ট সারলাম।”
নৈঋতা এবার হতবাক হয়ে গেল। চমকটা সামলে খানিক বাদে ভার গলায় বলল,
“আপনে কোনো কতা বুঝতে চান না ক্যান?”
“বোঝার মতো যথেষ্ট জ্ঞান আমার আছে। অন্য কারো কথা নিয়ে ভেবে অযথা সময় নষ্ট করি না আমি। সারাটা রাস্তা তো আমাকে হারানোর ভয়ে আঁকুপাঁকু মন নিয়ে ছিলে। এখন কী হলো?”
“জেদ কইরেন না। দয়া কইরা আমার-”
“ঘরে মুরব্বি দুজন বসে আছে। তাদের তাড়া আছে। আর অপেক্ষা করানো ঠিক হবে না। যাও, আন্টি-আঙ্কেলের সাথে ও ঘরে এসো। আর যদি এরপরও তোমার মনে হয় বিয়েটা তুমি করবে না, তাহলে যা ভালো মনে হয় কোরো। আমি তোমায় ছাড়ব না এটা যেমন সত্যি, তেমনি আমি তোমায় জোরও করব না এটাও সত্যি,” নৈঋতার কথা শেষ করতে না দিয়ে বলে উঠল রৌদ্রুপ।
নৈঋতাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগই দিলো না। তাড়া দেখিয়ে ঘরে পাঠিয়ে দিলো। ঘরে গিয়ে নৈঋতা চুপ মে’রে রইল। তার নীরবতাকে সম্মতি ধরে নিয়ে আফিয়া বেগম তার মাথায় ভালোভাবে ওড়না টেনে ঘোমটা দিতে-দিতে বললেন,
“শাড়ি-টাড়ি কিনার সুযোগ পায়নায়। মন খারাপ করিস না, মা। বিয়ার পর দেখবি কত শাড়ি তোর আলমারিতে পইড়া থাকব।”
নৈঋতা আর টু শব্দটিও করল না। চুপচাপ বাবা-মায়ের সাথে রৌদ্রুপের ঘরে গেল। চৌকির একপাশে কাজি আর হুজুর বসে ছিলেন। রৌদ্রুপ দাঁড়িয়ে কথা বলছিল তাদের সাথে। নৈঋতাকে নিয়ে আসতেই রৌদ্রুপ আর নৈঋতাকে পাশাপাশি বসানো হলো। কাজি আর হুজুর এখান থেকে বেরিয়ে আবার অন্য কোথাও যাবেন বিয়ে পড়াতে। তারা সময় নষ্ট না করে বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন। কবুল বলার সময় নৈঋতার গলায় কান্নারা দলা পাকাল। সব কেমন স্বপ্নের মতো ঠেকল। কাঁপা-কাঁপা গলায় কোনোমতে সে কবুল বলল। রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করার সময় রৌদ্রুপ খেয়াল করল নৈঋতার হাত কাঁপছে। রৌদ্রুপ সবার অগোচরে মৃদু হাসল। মেয়েটা কিছুক্ষণ আগেও আপত্তি জানাতে চেয়েছিল, আর এখন উত্তেজনায় কাঁপছে। বিয়ে পড়ানো শেষ হলে কাজি আর হুজুর চলে গেলেন। তাড়া থাকায় তাদের আগেভাগেই খাওয়ানো হয়েছিল। সামসুদ্দীন বেপারী মেয়েকে জামাইয়ের হাতে তুলে দিতে গিয়ে রৌদ্রুপের হাত ধরে কেঁদে ফেললেন। পরক্ষণেই নৈঋতাসহ তার পুরো পরিবারের কান্না পর্ব শুরু হলো। তাদেরকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কোনোরকমে থামাল রৌদ্রুপ। আফিয়া বেগম জানতে চাইলেন রৌদ্রুপ এখনই রাতের খাবার খাবে কি না। রৌদ্রুপ জানাল এত তাড়াতাড়ি সে খাবে না। আফিয়া বেগম নিজেই গিয়ে নৈঋতা আর রৌদ্রুপের খাবার এ ঘরে নিয়ে এলেন। টেবিলে রেখে দিয়ে বললেন তাদের যখন ক্ষুধা পাবে, তখন খেয়ে নিতে। সামসুদ্দীন বেপারী ঘরে চলে গেছেন। নৈঋতার দাদি তাদের দোআ করতে গিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। রৌদ্রুপের এক হাত মুঠোয় নিয়ে কাঁপা গলায় অনেক কথা বললেন। তার মূল কথা, নৈঋতাকে যেন রৌদ্রুপ কখনও কষ্ট না দেয়। মেয়েটা যে জন্ম থেকে কষ্ট ছাড়া কিছুই পায়নি। দাদি শাশুড়ির হাত ধরে রৌদ্রুপ হাসিমুখে কথা দিলো। আশ্বস্ত করল সে নৈঋতাকে ভালো রাখবে। নসিব তার দাদিকে নিজের ঘরে ফিরিয়ে নিলে নৈঋতা আবার চুপটি মে’রে বিছানার কোণে বসে রইল। আফিয়া বেগম আবার নিঃশব্দে কাঁদলেন। তার ইচ্ছে করছে শাশুড়ির মতো হাউমাউ করে কাঁদতে। তার মেয়েটা এখনও ছোটো। বিয়ের দিন যে বিবাহিত জীবনের ব্যাপারে কেউ কিছু বুঝিয়ে-পড়িয়ে দিবে, এমন কেউও নেই তাদের। আফিয়া বেগম দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। রৌদ্রুপ আর নৈঋতাকে আবারও খাবারটা তাড়াতাড়ি খেয়ে নেওয়ার কথা বলে নিজেও ঘরে চললেন। তিনি চলে যাওয়ার পর রৌদ্রুপ দরজা আটকে বিছানার কোণে বসা তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর দিকে তাকাল। নৈঋতা আজ আর মাথা তুলে তাকাতে পারল না। কেন জানি তার খুব ভয় লাগছে। বুক কাঁপছে। হাঁটুর কাছের জামা খামচে ধরে রেখেছে সে। রৌদ্রুপকে তো ভয় পাবার কথা না তার। নৈঋতার কপোল বেয়ে এখনও অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। রৌদ্রুপের প্রতি নীরব অভিমানে পু’ড়ছে মেয়েটা। কিছু মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে নৈঋতার নীরবতা লক্ষ্য করে রৌদ্রুপ মৃদু হেসে এগিয়ে গেল। বিছানায় উঠে নৈঋতার মুখোমুখি পা ভাঁজ করে বসে গলা ঝেড়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করল; তবু নৈঋতা মাথা তুলল না।
“বউয়ের কি বরের প্রতি বড্ড বেশি অভিমান হয়েছে?”
রৌদ্রুপের কথা শুনেও না শোনার মতোই বসে রইল নৈঋতা। রৌদ্রুপ বার কয়েক এভাবেই নৈঋতাকে ডাকল। কিন্তু নৈঋতা যেন নিজের মাঝে পাথুরে মূর্তি ভর করিয়েছে। রৌদ্রুপ তার অভিমান টের পেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে হুট করে নৈঋতাকে পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে বলল,
“অভিমান জল করার টেকনিক আমার জানা আছে।”
নৈঋতা ভীষণভাবে চমকে উঠল। আমতা-আমতা করে মিনমিনে গলায় বলল,
“কী করেন? পইড়া যামু, নামান।”
“উঁহু, অভিমান না ভাঙা অবধি এভাবেই শূন্যে ভাসবে।”
নৈঋতা পড়ল বিপাকে। তার ভীষণ লজ্জা লাগছে। ভুল করেও সে রৌদ্রুপের মুখের দিকে তাকাল না। ওই চোখে চোখ পড়লে যে তার আর অভিমান বাঁচিয়ে রাখা চলবে না। তবু নৈঋতা জড়তা নিয়ে বার কয়েক বলল তাকে কোল থেকে নামাতে। রৌদ্রুপ শুনল না। বরঞ্চ সে মজা করে নৈঋতাকে কোল থেকে ফেলে দেওয়ার হু’মকি দিলো। হালকাভাবে দোলও দিতে লাগল। অগত্যা নৈঋতা বাধ্য হয়ে রৌদ্রুপের গলা আঁকড়ে ধরল। তার ছোট্ট পেলবের মতো শরীরটা রৌদ্রুপের কোলে ভয়ে সিটিয়ে রইল। যদিও সে জানে রৌদ্রুপ অযথাই ভয় দেখাচ্ছে, তবু তার ভয় লাগছে। তার ভীতু মুখটা দেখে রৌদ্রুপ শব্দ তুলে হাসতে-হাসতে কোল থেকে নামিয়ে দিলো। মাটিতে দাঁড়িয়ে নৈঋতা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। রৌদ্রুপ বলল,
“মিসেস নৈঋর অভিমান কমেছে?”
নৈঋতা নিরুত্তর থেকে নত হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে নখ খুঁটছে। তার অভিমান সত্যি-সত্যিই একটু ভেঙে গেছে। কিন্তু জড়তা আর লজ্জায় সে কথা বলতে পারছে না। রৌদ্রুপ তার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়ে দুহাতের মাঝে আদুরে মুখটা তুলে ধরল। নৈঋতা তবু তার চোখে চোখ রাখল না। রৌদ্রুপ নিচু স্বরে ডেকে বলল,
“নৈঋ, একবার তাকাবে আমার দিকে?”
এই অনুরোধের বিপক্ষে গিয়ে নৈঋতা এবার আর মুখ ফিরিয়ে নিতে পারল না। চোখ তুলে তাকাতেই রৌদ্রুপের গভীর দুটো চোখে তার দৃষ্টি আটকাল। রৌদ্রুপ বলল,
“তোমাকে আগে থেকে সবটা জানালে তুমি কোনোভাবেই রাজি হতে না, তা আমি জানতাম। কিন্তু তোমাকে আজীবনের জন্য ছেড়ে দেওয়া আমার পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। আমার ভালোবাসা এতটাও তুচ্ছ নয়। তোমাকে কষ্টে রেখে আমি নিজেও ভালো থাকতে পারতাম না। যা হবার হয়েছে, নৈঋ। আজ থেকে তুমি শুধুমাত্র আমাদের জীবন, নিজের সংসার আর পড়াশোনা নিয়ে ভাববে। আর কিচ্ছু নয়। বুঝেছ?”
নৈঋতার চোখের কার্নিশ বেয়ে আবারও দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। ভেজা কন্ঠে বলল,
“কেমনে কী কইরা ফালাইলেন আপনে! আমার অনেক চিন্তা হইতাছে।”
“সব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। আমি আছি তো।”
“যদি কোনো ঝামেলা হয়?”
“নতুন করে আর কিছু হওয়ার বাকি নেই। যা হওয়ার আগেই হয়ে গেছে। ওসব বাবা সামলে নিবে।”
“সত্যিই কি আমি এত ভাগ্যবতী? সব কেমন স্বপ্নের মতো লাগতাছে।”
রৌদ্রুপ নৈঋতার হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,
“আজ থেকে তোমার সব স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা তোমার স্বামীর দায়িত্ব, প্রেমবতী।”

কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৪.
নৈঋতার সাথে কিছু সময় বাক্যালাপের পর রৌদ্রুপ বিছানার ওপর নিজের ব্যাগটা খুলে ঘাঁটাঘাঁটি করল। তারপর ব্যাগ থেকে একটা টুকটুকে লাল শাড়ি বের করে নৈঋতার হাতে ধরিয়ে দিলো। সাথে ব্লাউজ, পেটিকোট সবই আছে। নৈঋতা অবাক হয়ে জানতে চাইল,
“এইসব আপনে কিনছেন?”
রৌদ্রুপ মাথা দুলিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, আসার আগেই বন্ধুকে দিয়ে কিনিয়ে রেখেছিলাম। বিয়ের দিন বউয়ের পরনে শাড়ি থাকবে না, এটা কি মানা যায়? তোমাকে লাল শাড়িতে দেখার অনেক ইচ্ছে আমার। তোমাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম, সেদিন তোমার পরনে একটা লাল থ্রি-পিস ছিল। কী স্নিগ্ধ লাগছিল তোমায়! ঘটা করে আমার সিঙ্গেল লাইফের পাট চুকিয়ে প্রেমেও পড়ে গিয়েছিলাম সেদিন।”
শেষের কথাটা বলে রৌদ্রুপ নিজেই হাসল।
“পরে নাও এগুলো।”
নৈঋতা ইতস্তত করে বলল,
“আমি ভালোমতো শাড়ি পরতে পারি না। আপনে আগে বাইর করলে তো মায় পরাইয়া দিত।”
“উঁহু, তুমি যেমন পারো তেমনই পরবে। আমিই তো দেখব, অন্য কেউ তো আর দেখবে না। তুমি অগোছালো রূপেও আমার চোখে পৃথিবীর সেরা সুন্দরী, মেয়ে।”
নৈঋতা মাথা নিচু করে বলল,
“আপনে বাইরে যান, আমার পরা শ্যাষ হইলে ডাকমু নে।”
নৈঋতার দিকে ঝুঁকে গিয়ে রৌদ্রুপ ঠাট্টার ছলে বলল,
“কেন? আমি কি পরপুরুষ?”
নৈঋতা লজ্জায় অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। রৌদ্রুপ হাসতে-হাসতে ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে গিয়ে বলল,
“দরজা আটকে নাও। আমি বাইরে আছি।”
নৈঋতা গিয়ে দরজা আটকে দিলো। তারপর শাড়ি হাতে নিয়ে ভাবতে লাগল কীভাবে-কীভাবে ভালোভাবে পরা যায়। রৌদ্রুপ তখন বাইরে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে ঘাঁটাঘাঁটি করছে। গ্রামে পৌঁছেই সে ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছিল। নোটিফিকেশনে দেখল তার বড়ো ভাই আর বন্ধু বেশ কয়েকবার ফোন করেছিল। বন্ধুর মেসেজ দেখে সে আগে বন্ধুকে ফোন করল। জানাল যে তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। কাল তারা ঢাকায় ফিরেই তার বন্ধুর বাড়িতে উঠবে। বন্ধুর সাথে অনেকটা সময় কথা বলে ফোন করল তিহানকে। রিং হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই তিহান ফোন রিসিভ করল। রৌদ্রুপ হ্যালো বলতেই তিহান ব্যস্ত হয়ে বলল,
“হ্যালো রৌদ্র। তুই কোথায় আছিস?”
“আমি গ্রামে আছি, ভাইয়া।”
“এতকিছু হয়ে গেল, একবার তো ফোন করে আমাকে জানাতে পারতি। আমি আজ একটু তাড়াতাড়ি অফিসে গেলাম, আর আজই এত ঝামেলা হতে হলো? সারাদিনে কেউ আমাকে কিছু জানায়নি। একটু আগে বাসায় এসে জানতে পারলাম তুই রাগ করে নৈঋতাকে নিয়ে চলে গিয়েছিস। আবার না কি বলে গেছিস তুই নৈঋতাকে বিয়ে করবি?”
রৌদ্রুপের এবার নিজেকে বড্ড অ’পরা’ধী মনে হলো। এত ঝামেলার মধ্যে বড়ো ভাইটাকে ফোন করে বলার কথা তার মাথাতেই ছিল না। এই মানুষটা যে সবার থেকে আলাদা। রৌদ্রুপকে বুঝার মতো এক ভরসার জায়গা। রৌদ্রুপ অপরাধীর মতো বলল,
“সরি ভাইয়া, রাগের মাথায় আমার আসলে একদমই খেয়াল ছিল না তোমাকে ফোন করার কথা। আজ বাড়িতে সবাই অনেক বাড়াবাড়ি করেছিল নৈঋতাকে নিয়ে। বাড়ি থেকে বের করে দিতে চেয়েছিল মেয়েটাকে।”
“আমি সব শুনেছি বাবার থেকে। এখন নৈঋতা কোথায়?”
“আমার সাথেই আছে।”
“আর বিয়ের ব্যাপারটা?”
“এই মুহূর্তে আমার কাছে এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আমি ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মা-বাবাকে জানিয়ে এসেছি। বাবা অনুমতি দিয়েছে, কিন্তু মা অনেক তেতো কথা শুনিয়েছে। তবু আমি জানিয়ে আসাটা প্রয়োজন বোধ করেছি, তাই জানিয়ে এসেছি।”
“বুঝেছি, এখন বিয়ে কি হয়ে গেছে?”
“হ্যাঁ, কিছুক্ষণ আগেই,” মিনমিনে গলায় বলল রৌদ্রুপ।
তিহান ক্ষণকাল চুপ মে’রে রইল। রৌদ্রুপের অনুশোচনা হলো। নিজের বোকামির জন্য মনে-মনে নিজেকে বকল। ভাইয়া নিশ্চয়ই কষ্ট পেয়েছে। তিহান বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া করল না। শান্ত কন্ঠে শুধু প্রশ্ন করল,
“ঢাকায় কবে ফিরছিস?”
“কাল।”
“কালই?”
“হ্যাঁ, অফিস আছে তো।”
“কোথায় উঠবি?”
“ফাহাদের বাড়ির দোতলা ভাড়া নিয়েছি। ওখানেই উঠব।”
“বাহ্! এটুকু সময়ের মধ্যে দেখছি সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছিস।”
রৌদ্রুপ নিরুত্তর রইল। পরক্ষণেই মিনমিনে গলায় বলল,
“তুমি অন্তত আমার ওপর রাগ কোরো না, ভাইয়া। তুমি তো আমায় বোঝো।”
“কোনো দরকার পড়লে বলিস। রাখছি,” বলেই অভিমানে ফোন কে’টে দিলো তিহান। রৌদ্রুপের নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। ভাইয়াকে একটাবার বলে আসার কথা তার মাথায় এল না কেন? ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল দরজা খোলা। নৈঋতার হয়তো শাড়ি পরা হয়ে গেছে। কখন দরজা খুলেছে তা সে টের পায়নি। সশব্দে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রৌদ্রুপ চা চালিয়ে গিয়ে ঘরে ঢুকল। নৈঋতা বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে চরম বিরক্তি নিয়ে শাড়ি টানাটানি করছিল। রৌদ্রুপকে দেখেই সে সটান দাঁড়িয়ে পড়ল। রৌদ্রুপ সরু চোখে নৈঋতার শাড়ি পরার ধরণ দেখল। গুছিয়ে কুঁচি দিতে পারেনি মেয়েটা। কোনোরকম পেঁচিয়ে পরেছে, তা-ও সেই আগেরবারের মতো হাত দিয়ে আঁচল চেপে ধরে রেখেছে। তবে শাড়িটায় বেশ মানিয়েছে তাকে। দরজা আটকে রৌদ্রুপ এগিয়ে গেল। নৈঋতা শাড়ি খামচে ধরে ধুকধুক বুকে এদিক-ওদিক চঞ্চল দৃষ্টি বিচরণ করছে। রৌদ্রুপ তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বলল,
“কী হয়েছে?”
নৈঋতা মাথা না তুলেই নিচু স্বরে বলল,
“সেফটিপিন আনেননায়?”
“সেফটিপিন দিয়ে কী হবে? এখন তো তোমার আঁচল সামলানোর মানুষ আছেই।”
নৈঋতা লজ্জায় আর দ্বিরুক্তি করতে পারল না। রৌদ্রুপ হাত এগিয়ে নৈঋতার চুলের খোঁপা খুলে ফেলল। মিশমিশে কালো লম্বা চুলগুলো পিঠময় ছড়িয়ে পড়ে নৈঋতার মুখের কাছেও আছড়ে পড়ল। সে আজ সেই প্রথমদিনের মতো জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রৌদ্রুপ মুচকি হেসে ব্যাগ থেকে একটা সেফটিপিন বের করে নৈঋতার কাঁধের কাছের শাড়িতে আটকে দিলো। নৈঋতা জড়োসড়ো হয়ে মাথা নত করে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। সেফটিপিন লাগিয়ে রৌদ্রুপ হঠাৎ খুব কাছে গিয়ে দুহাতে নৈঋতার মুখটা তুলে ধরল। লজ্জা আর সংকোচে নৈঋতা দৃষ্টি তুলল না। কেন জানি আজ ওই চোখে চোখ রাখার সাহস একদমই হচ্ছে না। বরঞ্চ সে শরীরে মৃদু কম্পন অনুভব করছে। গলাটাও শুকিয়ে আসছে। রৌদ্রুপ হুট করেই নৈঋতার থুতনিতে আঙুল ঠেকিয়ে কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে বসল। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নৈঋতা পরপর দুটো ঢোক গিলল। রৌদ্রুপ তাকে লক্ষ্য করে ভ্রুকুটি করে বলল,
“এই মেয়ে, এভাবে কাঁপছো কেন? আমি কি তোমাকে মে’রে ফেলছি?”
নৈঋতা হোঁচট খেল। তার লজ্জা আরও একধাপ বেড়ে গেল। এরপর রৌদ্রুপ একদম নীরব হয়ে গেল। চুপ মে’রে পলকহীন মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নৈঋতার মুখের দিকে। নৈঋতা এলোমেলো হয়ে গেল। এভাবে তাকিয়ে থেকে তাকে লজ্জায় মে’রে ফেলবে না কি? কী মুশকিল! রৌদ্রুপ নৈঋতার গালে আঙুল বুলিয়ে বলল,
“এই রাতকে সাক্ষী রেখে আমি তোমাকে নিজের করে নিলাম, মেঘবতী। আমার শেষ নিঃশ্বাস অবধি তোমাকে নিজের কাছে আগলে রাখব। এক বিন্দু দুঃখকেও আমি তোমায় ছুঁতে দেবো না। এই ঠোঁটের কোণের মিষ্টি হাসিটা দেখতে-দেখতে আমি গোটা জীবন পার করে দিবো। কাল থেকে আমরা আমাদের ছোট্ট চড়ুই পাখির সংসার সাজাব। প্রতিদিন খুব সকালে দুজন মিলে রাঁধব‌। খেয়েদেয়ে আমি অফিসে চলে যাব আর তুমি কলেজে। তুমি তো দুপুরেই ফিরবে, কিন্তু আমাকে তো রাতে ফিরতে হবে। মাঝের সময়টা তোমাকে একা থাকতে হবে। তোমার কি একা থাকলে মন খারাপ হবে?”
নৈঋতা ওপর-নিচে মাথা ঝাঁকাল। রৌদ্রুপ বলল,
“তোমার খারাপ লাগলে আমি কাজের ফাঁকে ফোন করে কথা বলব। তাহলে হবে না?”
নৈঋতা এবারেও হ্যাঁ-সূচক মাথা ঝাঁকাল। রৌদ্রুপ নিশ্চিন্তে আবারও বলল,
“রাতে আমি ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরে তোমার এই মায়াবী মুখটা দেখে সমস্ত ক্লান্তি ভুলে যাব, যেভাবে এতদিন ভুলে ছিলাম। দুপুরের খাবারটা যদিও আলাদা খেতে হবে। তবে সকালের আর রাতের খাবারটা আমরা একসঙ্গে খাব। তারপর গোটা রাত হবে একান্ত আমাদের। শোনো মেয়ে, তুমি কিন্তু ঘুমানোর জন্য আলাদা বালিশ পাবে না। এই যে আমার বুকের এপাশটা তোমার মাথা রাখার জন্য বরাদ্দ। ঠিক আছে?”
নৈঋতা নিঃশব্দে কাঁদছে। এ কান্না পাওয়ার আনন্দের। রৌদ্রুপ তার কান্না দেখে হেসে ফেলল। আলতো হাতে চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
“এই মেয়ে, কান্না বন্ধ। আমার কথা শেষ হয়নি তো। এখনই কেঁদে ভাসিয়ে দিলে কীভাবে বলব? যাইহোক, শোনো। ছুটির দিনগুলোতে আমরা দ্রুত সংসারের কাজকর্ম সেরে দুজন মিলে ঘুরতে বেরুব। উফ্, তুমি আমার প্ল্যান শুনে হাসার বদলে কাঁদছ? এসো তো, বসো এখানে।”
নৈঋতার হাত ধরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় বসাল রৌদ্রুপ। খাবারের প্লেট আর পানি নিয়ে এসে বিছানায় রেখে নিজেও উঠে বসল। ভাত মেখে নৈঋতার মুখের সামনে তুলে ধরলে নৈঋতা লজ্জা পেল। রৌদ্রুপ নৈঋতার মুখে ভাত পুরে দিয়ে বলল,
“লজ্জা পেতে হবে না, ম্যাম।‌ এখন থেকে বরের হাতে খাবার খাওয়ার অভ্যাস করুন। আপনার বর তার বউকে ভালবেসে মুখে তুলে খাওয়াবে, এটা ভালোবাসা প্রকাশের একটা ধরন। চাইলে আপনিও ট্রাই করতে পারেন।”
নৈঋতা মাথা নিচু করে লাজুক হাসছে। আজ জড়তা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছে। কিছুতেই রৌদ্রুপের সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারছে না। লজ্জায় চোখে চোখ রাখতে পারছে না। কী অদ্ভুত! নৈঋতার সাথে রৌদ্রুপ নিজেও খাচ্ছে। খেতে-খেতে রৌদ্রুপ নানা কথার পসরা সাজিয়ে বসল। সবই তাদের বিবাহিত জীবন নিয়ে। নৈঋতা আড়চোখে মানুষটার হাসিখুশি মুখটা দেখে বুকের ভেতর শান্তি অনুভব করল। তৃপ্তি পেল। পাওয়ার আনন্দ বুঝি এমনই হয়? খাওয়া শেষে রৌদ্রুপ গিয়ে জানালার কপাট খুলে রাতের আকাশের পানে তাকাল। আকাশে অজস্র তারকারাজিরা মেলা বসিয়েছে। চাঁদ হচ্ছে তাদের প্রধান। রৌদ্রুপ-নৈঋতার বিয়ের আনন্দে যেন তারা আকাশ জুড়ে আনন্দ মেলার আয়োজন করেছে। কী সুন্দর তাদের আয়োজন! রৌদ্রুপ গলা বাড়িয়ে ডাকল,
“নৈঋ?”
“হুঁ,” ছোট্ট শব্দে সাড়া নৈঋতার।
“এখানে এসো।”
নৈঋতা গুটি-গুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে রৌদ্রুপের পাশে দাঁড়াল। রৌদ্রুপ আকাশের দিকে ইশারা করে বলল,
“মনে হচ্ছে আজ প্রচুর বৃষ্টি হবে।”
নৈঋতা যেন আহাম্মক বনে গেল। কপালে ভাঁজ ফেলে জ্যোৎস্না রাতের ঝকঝকে আকাশের দিকে তাকাল। বোকা-বোকা ভঙ্গিতে বলল,
“আকাশে তো মেঘ নাই।”
“ওই আকাশের কথা বললাম না কি?”
“তাহলে?”
“মনের আকাশ। এই আকাশের মেঘ দেখা যায় না, মেঘবতী। অবশ্য আজ ওই আকাশে মেঘ থাকলে ভালোই হত। মেঘবতীকে নিয়ে বৃষ্টি বিলাস করে রাতটাকে আরও সুন্দর করতে পারতাম। যদিও বৃষ্টি তোমার পছন্দ না। কিন্তু আজকের রাতে আমি অনুরোধ করলে কি তুমি ফিরিয়ে দিতে?”
নৈঋতা কিছু মুহূর্ত চুপ থেকে না-বোধক মাথা নাড়ল। রৌদ্রুপ হাসিমুখে বলল,
“স্বয়ং মেঘবতী যখন আমার কাছে আছে, তখন আর চিন্তা কেন? আজ নিশ্চিত বৃষ্টি হবে, মেঘবতীর বৃষ্টিতে আমি ভিজব।”
নৈঋতা ক্ষণকাল চুপ মে’রে তাকিয়ে থেকে হয়তো রৌদ্রুপের ইঙ্গিতপূর্ণ কথাটা আঁচ করতে পারল। লজ্জায় তার গাল, কান গরম হয়ে উঠল। শাড়ির আঁচল মুঠোয় চেপে ধরে জড়োসড়ো ভঙ্গিমায় মাথা নত করল। রৌদ্রুপ নৈঋতার লাজুক মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে রইল, যেন ওই মুখে তার কত বছরের তৃষ্ণা! রৌদ্রুপের দৃষ্টিতে নৈঋতা আরও এলোমেলো হয়ে যায়। জানালার কাছ থেকে সরে যাওয়ারও সাহস পায় না সে। হুট করেই রৌদ্রুপ এক হাতে নৈঋতার কোমর জড়িয়ে খুব কাছে এনে গা ঘেঁষে দাঁড় করাল। নৈঋতা থতমত খেয়ে গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় হৃদপিন্ডে হাতুড়ি পেটা শুরু হলো। অজানা ভয়ে গলা আবারও শুকিয়ে গেল। নৈঋতার হাঁসফাঁস অবস্থা দেখে রৌদ্রুপ ঠোঁট টিপে হাসল। নৈঋতার লজ্জা আরেক ধাপ বাড়িয়ে দিয়ে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে মুগ্ধতামাখা স্বরে ফিসফিসিয়ে বলল,
“চলো মেঘবতী, দুজন মিলে বৃষ্টিতে ভিজি। আজ না হয় বিনা মেঘে আকাশে জ্যোৎস্না ছড়াক, জমিনে বৃষ্টি হোক। আমার মেঘবতীর প্রেমবর্ষণে আমি সিক্ত হই।”

পরদিন দুপুরের আগেই রৌদ্রুপ-নৈঋতা বিদায় নেয়। সঙ্গে নেয় নসিবকে। বিদায়ের মুহূর্তে সামসুদ্দীন বেপারী আর আফিয়া বেগম রৌদ্রুপ আর নৈঋতাকে ধরে হাউমাউ করে কাঁদলেন। এবার যে মেয়ের সঙ্গে ছেলেটাও দূরে চলে যাচ্ছে। রৌদ্রুপ তাদের আশ্বস্ত করে, তাদের দুই ছেলে-মেয়েকেই সে ভালো রাখবে। গতকাল ছিল ছুটির দিন। রৌদ্রুপ অফিস থেকে শুধু আজকের দিনের জন্য ছুটি নিতে পেরেছে। ঢাকায় ফিরে নতুন সংসার সাজিয়ে নেওয়ারও তো তাড়া আছে। সেজন্যই সে দেরি করতে চায়নি। শহরে ফিরে আসার জার্নিটা নৈঋতার একদমই ভালো কা’টেনি। কান্নাকাটি করার কারণে মাথা ধরে গেছে। ওদিকে ভালোভাবে ঘুমও হয়নি। গাড়িতে গোটা রাস্তা রৌদ্রুপের বুকে মাথা ঠেকিয়ে জেগে কা’টিয়েছে। তারা যখন রৌদ্রুপের বন্ধু ফাহাদের বাড়িতে পৌঁছাল, তখন রাত প্রায় আটটা। ফাহাদ নিজে ওদেরকে বাসায় উঠিয়ে দিয়ে গেল। সঙ্গে রাতের খাবারটাও দিয়ে গিয়েছে। দোতলার ঘরগুলো পুরো ফাঁকা। রৌদ্রুপ অবশ্য আস্তে-আস্তে সব ফার্নিচার আনার পরিকল্পনা করে রেখেছে। আপাতত সে ফাহাদকে দিয়ে দুই রুমে দুটো খাট, কাবার্ড আর টুকটাক কিছু জিনিসপত্র আনিয়ে রেখেছে। আজ দিনের বেলায় ফাহাদ এসব কিনে ঘরে সাজিয়ে রেখে গেছে। নসিবকে একটা রুমে যেয়ে ফ্রেশ হতে বলে রৌদ্রুপ অন্য রুমে ঢুকল। নৈঋতা তার পেছন-পেছন রুমে ঢুকেই বিছানা দেখে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। ক্লান্ত শরীরটা এখন বিছানায় এলিয়ে দেওয়া বড্ড জরুরি। নৈঋতা ধপ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই রৌদ্রুপ ব্যাগপত্র রেখে এগিয়ে গেল। বিছানায় এক পা তুলে বসে নৈঋতার কপালে হাত রেখে শুধাল,
“শরীর বেশি খারাপ লাগছে?”
নৈঋতার দুচোখ তখন ঘুমে টলমল। ছোটো-ছোটো চোখে চেয়ে সে অলস ভঙ্গিতে বলল,
“হুঁ, ঘুমাইতে হইব।”
“ঘুমিয়ো, কিন্তু তার আগে ফ্রেশ হয়ে ডিনার করতে হবে। নইলে এমনিতেও শরীর ভালো লাগবে না।”
নৈঋতা অসহায় মুখে বলল,
“আগে একটু ঘুমাই? ভাল্লাগতাছে না।”
“চোখে-মুখে পানির ঝাপটা দিলে ভালো লাগবে, ওঠো।”
অগত্যা নৈঋতা ঠোঁট উলটে রৌদ্রুপের সাহায্যে উঠে বসল। চোখে-মুখে তীব্র অনিচ্ছা নিয়ে ধীর পায়ে বাথরুমে চলে গেল। তার বাচ্চাদের মতো আচরণ দেখে রৌদ্রুপ আপন মনে হাসল। নৈঋতা ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখল নসিব এ ঘরে চলে এসেছে। রৌদ্রুপ নিজেই তাকে ডেকে এনেছে একসাথে খাবার খাওয়ার জন্য। নৈঋতা বেরোনোর সঙ্গে-সঙ্গেই রৌদ্রুপ গিয়ে চটপট ফ্রেশ হয়ে এল। গরম ভাত, সরষে ইলিশ আর মুরগির মাংস ভুনা দিয়ে তিনজন গল্পে-গল্পে খাবার খেল। ফ্রেশ হওয়ার পর নৈঋতার অনেকটা হালকা লাগছিল, তাই খেতেও সমস্যা হলো না। খাওয়ার মাঝে একটা কাণ্ড ঘটল। বরাবরের অভ্যাসবশত রৌদ্রুপ নিজের ভাগের পুরোটা খাবার শেষ না করে অবশিষ্ট কিছু খাবার প্লেটের একপাশে রেখে খাওয়া শেষ করল। নৈঋতাও অভ্যাসবশতই রৌদ্রুপের রেখে দেওয়া খাবার নিজের প্লেটে নিয়ে খেতে লাগল। নসিব এসব বিষয় জানে না বলে মাথা ঘামায়নি। নৈঋতাকে তার অবশিষ্ট খাবার খেতে দেখে রৌদ্রুপের টনক নড়ল। অভ্যাসবশত খাবারটুকু রেখে দিলেও, এতক্ষণে খেয়াল হলো এখন আর তারা নিজের বাড়িতে নেই যে, খাবার ভাগাভাগি করে খেতে হবে। নৈঋতা নিজেও হয়তো খেয়াল করেনি। দীর্ঘদিনের অভ্যাস দুজনের, ভুলবে কী করে? নিজেদের অদ্ভুত অভ্যাস খেয়াল করে রৌদ্রুপের চোখে চেয়ে নৈঋতাও মুচকি হাসল।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে