কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
১.
আষাঢ়ের আজ দ্বিতীয় দিন। তারই সুবাদে আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢাকা পড়ে আছে। যেন মেঘ প্রণয়ী আর আকাশ প্রণয়িনী। প্রণয়ী মেঘ তার প্রণয়িনী আকাশকে প্রণয়ের ঘন কালো চাদরে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। তাদের গভীর প্রণয়ের আজ অটুট বন্ধন হয়েছে। সন্ধ্যা হতে এখনও অনেক বাকি। অথচ আকাশের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এখনই সন্ধ্যা নেমে আসছে। মাথা তুলে দূর আকাশের কালো মেঘের ঘনত্ব লক্ষ্য করতে-করতে নৈঋতা খরগোশের গতিতে পা চালাচ্ছে। বারবার মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে তাকিয়ে সামনে পা ফেলতে গিয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা টুকরা ইটের সাথে বার কয়েক হোঁচটও খেয়েছে। তবু তার পা দমছে না, চলছে তো চলছেই। থেমে গেলে চলবে না। পটল কাকার দোকানে পৌঁছাতে এখনও প্রায় পাঁচ-ছয় মিনিটের পথ বাকি। নৈঋতা যতটা সম্ভব দ্রুত গতিতে হাঁটার চেষ্টা করছে। বিরক্তিতে তার কপালে হালকা ভাঁজ পড়ে আছে। এই সময় এতটা পথ হেঁটে পটল কাকার দোকানে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার ছিল না। মায়ের কথায় বাধ্য হয়ে যেতে হচ্ছে। আজ না কি বাড়িতে অতিথি আসবে। তা-ও যে সে অতিথি নয়, শহুরে অতিথি। মায়ের আদেশ, অতিথির আপ্যায়নে বিন্দুমাত্র ত্রুটি চলবে না। নৈঋতাদের বাড়িতে ইলেকট্রিসিটি নেই। হারিকেন আর মোমবাতির আলোতেই তারা অভ্যস্ত। তাদের দুটো হারিকেন। একটা নৈঋতার বাবা-মায়ের ঘরে, আরেকটা তার আর দাদির ঘরে। হারিকেনের তেল শেষ হয়ে গেলে মোমবাতিই সম্বল। এছাড়া বাড়তি হারিকেন নেই বলে তার ভাইয়ের ঘরে মোমবাতিই জ্বালানো হয়। গতকাল যে মোমবাতি শেষ হয়ে গেছে, তা কারোর খেয়াল ছিল না। কিছুক্ষণ আগে মোমবাতির প্যাকেট ফাঁকা দেখে মা তাকে ঠেলেঠুলে দোকানে পাঠিয়েছে। বাবা মাঠ থেকে ফেরেনি, ছোটো ভাই বাড়িতে ফিরবে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে। এমতাবস্থায় নৈঋতা ছাড়া আর কেউ নেই যে দোকানে গিয়ে মোমবাতি এনে দিবে। পটল কাকার দোকানের কাছাকাছি পৌঁছাতেই হঠাৎ আকাশ কাঁপিয়ে গগনবি’দারী শব্দ হলো। তার সঙ্গে শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি শুরু। দিকবিদিক ভুলে নৈঋতা এক ছুটে গিয়ে রাস্তার পাশের পুরোনো দোকানটার ছাউনির নিচে দাঁড়াল। ঝিরঝিরে বৃষ্টি হলেও সমস্যা থাকত না। এই ঝুম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দোকান পর্যন্ত গেলে সে ভিজে চুপচুপে হয়ে যাবে। গ্রামের বখাটে ছেলেপেলেগুলো এসময়ে দোকানে বসে থাকলে নির্ঘাত বাজে পরিস্থিতিতে পড়তে হবে। তাছাড়া এখন এই বৃষ্টির মধ্যে রাস্তাঘাট সম্পূর্ণ ফাঁকা। যদি কোনোভাবে কায়েস এই রাস্তায় আসে, তাহলে? আশ’ঙ্কায় পড়ে নৈঋতা বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করছে। বরাবরই মেঘলা দিন নৈঋতার খুব ভালো লাগে। কিন্তু বৃষ্টি তার একদমই পছন্দ না। মূলত বর্ষার সারা মাস জুড়ে বৃষ্টি হওয়ার দরুন গ্রামের মানুষ যে নাজেহাল অবস্থায় পড়ে যায়, সে কারণেই নৈঋতা বর্ষাবিমুখ। ছোটোবেলা থেকে সে দেখে এসেছে, প্রতিবছর অতিবৃষ্টিতে তার বাবার রাত-দিন পরিশ্রম করে ফলানো কত ফসল নষ্ট হয়ে যায়। তখন তাদের পারিবার খুবই নাজুক অবস্থায় পড়ে। তিনবেলা খাবার জোগাড় করাটাই তখন কঠিন হয়ে পড়ে! হঠাৎ নৈঋতার দৃষ্টি আটকাল রাস্তার বাঁকে। ঝুম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে এক আগন্তুক এদিকেই ছুটে আসছে। হাতে বেশ বড়োসড়ো একটা লাগেজ মনে হচ্ছে। লাগেজ বহন করে এত দ্রুত হাঁটতে গিয়ে তাকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। বৃষ্টির তোড়ে আগন্তুকের মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু অবয়ব দেখে বুঝা যাচ্ছে সে একজন পুরুষ। নৈঋতার ভাবনার মাঝেই আগন্তুক প্রায় কাছাকাছি এসে পড়েছে। এবার নৈঋতা আগন্তুকের মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেল। মোটামুটি লম্বা দেখতে মানুষটার উজ্জ্বল শ্যামলা মুখটায় বিন্দুমাত্র বিরক্তির ছাপ নেই। অথচ সে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে। বেশভূষা দেখে মনে হচ্ছে এই গ্রামের মানুষ না। লোকটা দোকানের ছাউনির নিচে এসে দাঁড়াতেই নৈঋতার আগ্রহী দৃষ্টির সাথে লোকটার বিস্মিত দৃষ্টি আদান-প্রদান হলো। আগন্তুক নিজের শরীরের চুপচুপে ভেজা খয়েরি রংয়ের শার্টটা থেকে পানি ঝাড়ার বৃথা চেষ্টা করতে-করতে, দৃষ্টিতে একরাশ বিস্ময় নিয়ে নৈঋতার মুখপানে চেয়ে আছে। লোকটাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে নৈঋতা তাড়িঘড়ি করে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। হঠাৎ তার টনক নড়ল। এই বৃষ্টির মধ্যে অচেনা এক পুরুষের সামনে দাঁড়িয়ে থাকাটা নিরাপদ মনে হচ্ছে না। এখন উপায়? বৃষ্টিতে ভিজেই পটল কাকার দোকানে যেতে হবে। চলে যাওয়ার জন্য সামনে দুপা এগোতেই আগন্তুক লোকটা বেশ নম্র কন্ঠে ডেকে উঠল,
“শোনো মেয়ে।”
নৈঋতা পা থামিয়ে ফিরে তাকাল। প্রত্যুত্তর না করে প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকাল। লোকটা নিজেই পুনরায় শুধাল,
“আমাকে একটু সাহায্য করতে পারবে?”
কথাটা শুনেও নৈঋতা কোনো উত্তর দিলো না। পুনরায় ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্রুত পায়ে দোকান থেকে সোজা রাস্তায় নেমে পড়ল। আর তারপর ঝুম বৃষ্টি উপেক্ষা করে ছুট লাগাল পটল কাকার দোকানের দিকে। পেছন থেকে আগন্তুক লোকটা বার কয়েক ‘এই যে মিস, শুনছো, একটু দাঁড়াও’ বলে ডাকাডাকি করার পরও সে একটিবার পেছন ফিরে তাকাল না। এ বয়সের পুরুষ মানুষদের নৈঋতা একদমই বিশ্বাস করতে পারে না। তার এমন অবিশ্বাস জন্মানোর কারণ এই গ্রামের বখাটে ছেলেগুলো। ফরসা চামড়ার মেয়েদের দেখলেই কেমন সুযোগের সন্ধানে থাকে! চারদিকে সজাগ দৃষ্টি রেখে নৈঋতা পটল কাকার দোকানে পৌঁছাল। ওড়না দিয়ে নিজের ভেজা শরীরটা ভালোভাবে ঢেকেঢুকে দোকানের ভেতরে উঁকি মে’রে দেখল পটল কাকা একটা গামছা গায়ে জড়িয়ে দুই হাঁটু মুড়ে ঘাপটি মে’রে বসে আছেন। নৈঋতা গলা বাড়িয়ে ডাকল,
“ও কাকা?”
পটল কাকা মাথা উঁচিয়ে নৈঋতাকে দেখলেন। এরপর একবার বাইরের পরিবেশটা নিরীক্ষণ করে চোখ বড়ো করে বললেন,
“কী রে রিতা? এই বৃষ্টির মইধ্যে ভিজ্জা-ভিজ্জা দোকানে আইছোস ক্যান?”
নৈঋতা উত্তর দিলো,
“মোমবাতি নিমু কাকা। মা কইছে আব্বা পরে টেকা দিয়া দিবো।”
“এমন কইরা-কইরা তো কম টেকা দেনা করল না তোর বাপ। গত এক মাসের দেনা রাইখা আবার সদাই নিতাছে। মুখের ওপর না-ও কইতে পারি না। আমি তো আর জমিদার না। এত সদাই বাকি দিলে আমার কত লোকসান হয় জানোস?”
নৈঋতা শুকনো মুখে বলল,
“হাতে টেকা হইলে পরে দিয়া দিবো নে কাকা।”
“এই এক কতা তো এক মাস ধইরা হুনতাছি। তোর বাপ টেকা দিবো কেমনে? কামাই-ই তো নাই। নেহাত আমি দেইখা অহনও সদাই দিতাছি। অন্য মাইনষে হইলে এতদিনে ঝামেলা বাঁধায়া দিত।”
নৈঋতার মনটা খারাপ হয়ে গেল। পটল কাকা ঠিকই বলেছেন। গত এক মাস ধরে তার বাবার জমিতে ভালো ফলন ভালো হয় না। আগে দুটো গোরু ছিল। একটা গাভী, আরেকটা ষাঁড়। গাভীটা প্রায় চার কেজির মতো দুধ দিত। দুধ বিক্রি করে সংসারের রোজকার বাজারটা মোটামুটি ভালোই চলছিল। কিন্তু গত দেড় মাস আগে গাভীটা হঠাৎ মা’রা গিয়েছিল। তারপর থেকেই নৈঋতাদের পরিবার বেশ অর্থ সংকটে পড়ে। পটল কাকা আপন মনে বিড়বিড় করতে-করতেই একটা মোমবাতির প্যাকেট এগিয়ে ধরলেন। নৈঋতা সেটা হাতে নিয়ে ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসির রেখা টেনে বলল,
“টেকা দিয়া দিতে কমু নে কাকা।”
পটল কাকা জানেন এটা সান্ত্বনা বাণী, তবু মাথা দুলিয়ে পুনরায় আগের জায়গায় ঘাপটি মে’রে বসে পড়লেন। নৈঋতা রাস্তায় নেমে এল। বৃষ্টি অনেকটা কমে এলেও, এবার সত্যি-সত্যিই সন্ধ্যা নেমে আসছে। মেঘলা আকাশের কারণে এমনিতেই চারদিক অন্ধকার হয়ে আছে। বাড়ি ফিরতে-ফিরতে নিশ্চিত মাগরিবের আজান হয়ে যাবে। না জানি ততক্ষণে কত অন্ধকার ঘনিয়ে আসবে! আশেপাশের কয়েকটা দোকানে শুধু দোকানদার ছাড়া বাড়তি একটা মানুষও নেই। রাস্তা তো পুরো ফাঁকা। ঝুম বৃষ্টি এখন ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে রূপ নিয়েছে। ইটের রাস্তায় কাদামাটির ঝামেলা নেই। তবে ইটের গুঁড়া বৃষ্টির পানিতে মিশে কর্দমাক্তের ন্যায় হয়ে আছে। নৈঋতা দৌড়ে আসার দরুন ভেজা ইটের গুঁড়ায় তার পরনের পাজামা আর জামার পেছনের নিচের অংশটুকু মাখামাখি হয়ে গেছে। সেদিকে বিশেষ খেয়াল না দিয়ে সে মোমবাতির প্যাকেটটা মুঠোয় আঁকড়ে ফাঁকা রাস্তা ধরে আবার ছুট লাগাল। আগের তুলনায় এবার সে আরও জোরে দৌড়াতে শুরু করেছে। আশপাশ জনমানবশূন্য হওয়ায় কোনো অসুবিধাও হলো না। নৈঋতা এখনও প্রত্যেকদিন নিয়ম করে মা-বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে গ্রামের ছোটো মাঠে গোল্লাছুট খেলতে যায়। তাই দ্রুত বেগে দৌড়েও সে হাঁপিয়ে পড়ল না। এই আবছা আলো থাকতে-থাকতে বাড়ি পৌঁছাতে পারলেই হলো। ছুটতে-ছুটতে বাড়ি পৌঁছাতেই মাগরিবের আজান শুরু হলো। নৈঋতা এক দৌড়ে ঘরে ঢুকেই মায়ের সম্মুখীন হলো। সঙ্গে-সঙ্গে আফিয়া বেগম প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
“মমবাতি আনছোস? পটল দেনার কতা কিছু কইছে?”
নৈঋতা মোমবাতির প্যাকেটটা বিছানায় রাখতে-রাখতে উত্তর দিলো,
“তা তো সবসময়ই কয়।”
আফিয়া বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। পরক্ষণেই খুঁটিতে ঝুলানো হারিকেনের টিমটিমে আলোয় মেয়ের পা থেকে মাথা চোখ বুলিয়ে বললেন,
“তুই তো দেহি পুরা ভিজ্জা গেছস। তাড়াতাড়ি কাপড় পালডা, ঠান্ডা লাইগা যাইব।”
নৈঋতা মাথা দুলিয়ে পাশের আলনা থেকে নিজের কালো রংয়ের সুতি থ্রি-পিসটা নিয়ে ভাইয়ের ঘরে চলে গেল। এক মাস আগে নৈঋতার বাবা তাকে দুটো সুতি থ্রি-পিস কিনে দিয়েছিল। একটা কালো রংয়ের, আরেকটা লাল। ভাগ্যিস তখন কিনে দিয়েছিল। সংসারের অবস্থা বেগতিক হওয়ার পর তো বাজার করা ছাড়া অন্য কিছু কেনাকা’টা করা কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপাতত এই দুটো থ্রি-পিসের সাথে পুরোনো দুটো জামা দিয়েই নৈঋতার চলে যায়। নৈঋতা কাপড় পালটে ভাইয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে মাকে দেখতে পেল না। দরজায় দাঁড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে উঁকি দিয়ে দেখল চুলায় আ’গুন জ্ব’লছে। বৃষ্টি একটু-একটু করে কমতে শুরু করেছে। নৈঋতা ঘর থেকে হারিকেনটা হাতে নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল। রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল,
“কী করতাছ মা?”
আফিয়া বেগম ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে উত্তর দিলেন,
“মেহমানের লাইগা রানতাছি।”
“আইছে না কি?”
“হ।”
“কহন আইলো?”
“তুই দোকানে যাওয়ার পরে। একটা মমবাতি জ্বা’লায়া মেহমানের ঘরে রাইখা আয়, তাড়াতাড়ি যা।”
“এ কী কও! মেহমান মাইনষেরে আন্ধারে রাইখা ঘরে হারিকেন রাইখা দিছো ক্যান?”
“আমগো ঘরেরডা দিয়া এতক্ষণ কাম করছি আমি। আন্ধারের মইধ্যে কাম করা যায়? আর তোর দাদি তো আন্ধারে থাকতেই পারে না। তার ঘরেরডা কেমনে আনতাম? আমি মেহমানরে কইছিলাম মমবাতি আনা পর্যন্ত এই ঘরে বইতে। সে কইল তার মোবাইলে আলো আছে। তুই দাঁড়ায়া থাকিস না। তাড়াতাড়ি গিয়া মমবাতি দিয়া আয়।”
নৈঋতা ঘরে ফিরে গেল। প্যাকেট খুলে একটা মোমবাতি বের করে দেশলাই দিয়ে আলো জ্বা’লাল। মোমবাতিটা হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে অতিথির ঘরের দিকে হাঁটা দিলো। তাদের বাড়িতে ছোটো আকারের তিনটা ঘর। উঠানের পশ্চিম দিকের ঘরটাতে দুই রুম। সেটাতে মা, বাবা আর ভাই থাকে। দক্ষিণ দিকের ঘরে থাকে নৈঋতা আর তার বৃদ্ধ দাদি। আর উত্তর দিকের সবচেয়ে পুরোনো ঘরটা অন্য সময় ফাঁকা থাকে। আপাতত এটাই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে অতিথির জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। অতিথির ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নৈঋতা দ্বিধায় পড়ে গেল। দরজা ভেতর থেকে আটকানো। এখন অতিথিকে সে কী বলে ডাকবে? অতিথি যে তার মায়ের এক চাচাতো বোনের ছেলে, তা সে জানে। সেই হিসেবে অতিথিকে ভাই ডাকা উচিত। কিন্তু নৈঋতার কেমন যেন দ্বিধা হচ্ছে। মিনিট দুয়েক নৈঋতা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগল। অতঃপর সাহস জুগিয়ে দরজায় টোকা দিলো। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ এল না। আবার টোকা দিলো। এবার ভেতর থেকে পুরুষালি ভারী কন্ঠস্বর ভেসে এল,
“কে?”
নৈঋতা উত্তর না দিয়ে পুনরায় টোকা দিলো। ক্ষণিক বাদেই ভেতর থেকে দরজা খুলে গেল। নৈঋতা সামনে তাকাতেই গম্ভীর দুটো অপরিচিত চোখের সাথে দৃষ্টি বিনিময় হলো। পরক্ষণেই মোমবাতির আলোয় স্পষ্ট দৃষ্টিতে তাকাতেই সে একটু থমকাল। লোকটাকে কেমন চেনা-চেনা লাগছে। মনে হচ্ছে কোথায় যেন দেখেছে। কথাটা মাথায় আসতেই মনে পড়ল, এ তো সেই লোকটা, যাকে বৃষ্টির মধ্যে ভিজে-ভিজে দোকানের ছাউনির নিচে দাঁড়াতে দেখেছিল। লোকটা তখন তাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইছিল। কিন্তু সে না শুনেই চলে গিয়েছিল। প্রথমবারের মতো এবারেও লোকটাকে তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে নৈঋতা এবার নিজেই অবাক হলো। প্রথম দেখাতে লোকটা এভাবে তার দিকে তাকিয়ে ছিল, এবারেও তাই। লোকটার এই অবাক দৃষ্টির কোনো কারণ খুঁজে পেল না সে। কিন্তু এমন দৃষ্টিতে বেশ লজ্জা পেল। মাথা নিচু করে হাতের মোমবাতিটা এগিয়ে ধরল। লোকটা তার হাত থেকে মোমবাতিটা নিতেই সে ততক্ষণাৎ চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াল। দু’পা এগোতেই প্রথমবারের মতোই পেছন থেকে লোকটা ডেকে উঠল,
“শোনো মেয়ে।”
নৈঋতা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই লোকটা প্রশ্ন করল,
“তুমি এ বাড়ির মেয়ে?”
নৈঋতা কেবল ওপর নিচে হ্যাঁ-সূচক মাথা দোলালো। মুখ দিয়ে টু শব্দটি উচ্চারণ করল না। তারপরই আবার এক ছুটে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। পেছন থেকে লোকটা কিছু বলতে চেয়েও পারল না। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল অপরিচিতা রমণীর হারিয়ে যাওয়া অন্ধকারের দিকে। কপালে কিঞ্চিত ভাঁজ ফেলে কিছু সময় ঘুটঘুটে অন্ধকারেই লক্ষ্যহীন চেয়ে রইল। অতঃপর ঠোঁট জোড়া ফাঁক করে শব্দহীন হেসে দরজা থেকে সরে এল। মোমবাতিটা ঠিক করে টেবিলে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই আবার হুট করে তার মুখটা একটু ভাবুক হয়ে এল। কিছু একটা ভেবে সে আপন মনে স্বগতোক্তি করল,
“মেয়েটা বাক প্রতিব’ন্ধী না কি?”
চলবে, ইন শা আল্লাহ্।