#কুয়াশায় ঘেরা আঁধার
#লেখনীতে-জেনিফা চৌধুরী
#পর্ব-ছয়
–“প্লিজ আমাকে আমার সন্তান ফিরিয়ে দাও। আমি আর কোনো দিন মা হতে চাইনা। কিন্তু আমার সন্তান কে ফিরিয়ে দাও প্লিজ নিহান”
নুহা ঘুম থেকে জেগেই নিহান কে দেখে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে এই কথা গুলো বললো। নিহান নুহাকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না। নুহা বার বার চিৎকার করে কাঁদতে উপরোক্ত কথা গুলো বলছিলো। নিহান নুহাকে শান্ত করার জন্য নুহার গাল চেপে ধরে জোরে চেচিয়ে বলতে লাগলো…..
–“নেই আমাদের সন্তান। ও চলে গেছে আমাদের ছেড়ে। শুনেছো তুমি ও আকাশের তারা হয়ে গেছে। আমার ফুল ফুটে উঠার আগেই ঝড়ে পড়ে গেছে। বাস্তবতা কঠিন নুহা। কেনো মানতে পারছো না। আমাদের সন্তান নেই৷
বলেই নুহাকে শক্ত করে বুকে চেপে ধরে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলতে লাগলো নিহান। নুহা শান্ত হয়ে নিহানের বুকে লেগে আছে। মেয়েটার চোখ দুটো স্থির। মোটা মোটা জল গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। চোখের পাতা গুলো পানিতে ভিজে একাকার। নাকের মাথা টকটকে লাল হয়ে আছে। চোখ দুটো ফুলে লাল হয়ে টইটুম্বুর হয়ে আছে। মুখটা শুকিয়ে আছে। নাহ! প্রানবন্তর মেয়েটাকে কেউ এই অবস্থায় সহ্য করতে পারবে না। নিহানের কথা গুলো শুনে নুহা শান্ত হয়ে গেলো অদ্ভুত ভাবে। আবরার এসে নিহানের কাঁধে হাত রাখতেই নিহান অসহায় দৃষ্টি আবরারের দিকে তাকিয়ে নুহার দিকে ইশারা করলো। হঠাৎ করেই নিহানের সেদিনের বলা কথাগুলো নুহার মনে উঠতেই নুহা এক ঝটকায় নিহানের থেকে দূরে গিয়ে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো নিহানের দিকে। নিহান অবাক চাহনী দিতেই নুহা গড়গড় করে বলতে লাগলো…..
—তুমি কেনো এসেছো? ওহ বুঝেছি তোমার সরি সরি তোমাদের জীবন থেকে কালো ছায়া দূর হয়ে গেছে নাকি সেটা দেখতে এসেছো। তাহলে কান খুলে শুনে রাখো মিস্টার রায়মান খান নিহান তোমার জীবন থেকে সরে গেছে তোমার পথে কাটা। খুশি তো এইবার। হ্যাঁ, তোমার তো মহা খুশি হওয়ার কথা। আমার সন্তান কে তো তুমি পৃথিবীর আলো দেখাতে চাও নি। আজ দেখো তোমার সেই আশা পূরন হয়েছে। দেখেনি আমার সন্তান এই পৃথিবীর আলো। শুনেছো এইবার বেড়িয়ে যাও আমার চোখের সামনে থেকে। তোমাকে দেখতে আমার ঘৃনা হচ্ছে। যাও। আমার চোখের সামনে থেকে যাও প্লিজ। তোমাকে সহ্য করতে পারছিনা আমি।
বলেই নুহা হাতে স্যালাইন টা টেনে খুলে ফেললো। সাথে সাথে রক্ত বেড়ুতে লাগলো। নুহা পাগলের মতো করতে লাগলো। আবরার নুহাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। নিহান মাথা নিচু করে বসে আছে। সত্যিই আজ নুহার দিকে তাকানোর মুখ নেই ওর। কি বলবে ও? আবরার নুহাকে শান্ত করতে না পেরে জোরে থা/প্পড় মে/রে বসলো নুহার গালে। তারপর নুহার দুই বাহু চে’পে ধরে বলতে লাগলো…….
—পা’গল হয়ে গেছিস তুই? যেই ছেলেটা তোর ভালোর জন্য নিজের জীবন, নিজের ক্যারিয়ার সব বিসর্জন দিলো তাকে তুই এইসব বলছিস। শুধু মাত্র নিহানের মুখের কথায় বিশ্বাস করে এইসব বলছিস। একবার ও কি ভেবে দেখেছিস যেই ছেলেটা তোকে পা’গলের মতো ভালোবাসে সে হঠাৎ কেনো বদলে গেলো? একবার ও ভেবে দেখেছিলে যেই পরিবারের মানুষ গুলো তোকে মেয়ের মতো ভালোবাসতো সেই পরিবারের মানুষগুলো কেনো বদলে গেলো? না ভেবে দেখিস নি। তাহলে কিসের ভিত্তিতে তুই এইসব কথা বলেছিস। এন্সার মি?
আবরারের কথা শুনে নুহা ছলছল চোখে আবরারের দিকে শীতল চাহনী নিক্ষেপ করলো। নিহান এখনো মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলছে। আবরার খানিক থেমে একটা বড় করে নিশ্বাস ছাড়লো। একটা চেয়ার টেনে নুহার সামনে বসে বলতে শুরু করলো…..
–“নিহানের গানের জগতে এত নাম ডাকের পেছনে তৃধার হাত রয়েছে। তৃধা আমাদের ব্যাচের সেটা তোর অজানা নয়। সেই কলেজ লাইফ থেকেই তৃধা নিহানকে পছন্দ করতো। কিন্তু নিহানের কাছে কোনো দিন প্রকাশ করেনি। তাই নিহান এই ব্যাপারে কিছুই জানতো না। নিহানের গানের ক্যারিয়ার শুরু হলো সেক্ষেত্রে তৃধা বিভিন্ন ভাবে নিহান কে সাহায্য করেছে৷ নিহানের গানের গলা মা’রাত্মক তাই রাতারাতি ওর গান সবার মন কেড়ে নিলো। এভাবেই পেরিয়ে যায় সময়। নিহানের সাথে তোর যখন বিয়ে হলো তৃধা তখন বিদেশে ছিলো। আর একবছর পর এসে যখন শুনে তোদের বিয়ে হয়ে গেছে তখনি ওর আসল চেহারাটা বেরিয়ে আসে। সাত দিন আগে আলিশাকে তৃধা কিডন্যাপ করে।”
কথাটা শুনতেই নুহা অবাক চোখে আবরারের দিক তাকিয়ে বললো…..
–কিন্তু মা তো বলেছিলো আলিশা ওর মামা বাড়ি আছে।
আবরার একটু দম নিয়ে বলে উঠলো…..
—“তৃধা আলিশাকে কিডন্যাপ করে ট’র্চার করেছে”
কথাটা বলতেই আবরারের দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। তাও নিজেকে সামলে বলতে লাগলো….
—আলিশা কোথায় আছে? কেমন আছে আমরা কেউ কিছু জানিনা। অনেক ভাবে খোঁজার চেষ্টা করেছি। পুলিশের সাহায্য নিয়েছিলাম সেই নিউজ টা তৃধা জানতে পেরে আলিশাকে টর্চার করেছে। এর পর থেকে আর কারোর সাহায্য নেওয়ার চেষ্টা করিনি। নিহান দের সমস্ত সম্পত্তি তৃধা হাতিয়ে নিয়েছিলো।তোদের প্রত্যেকের রুমে সিক্রেট ক্যামেরা লাগানো ছিলো। তোদের সব গতিবিধির উপর তৃধার নজর ছিলো। নিহান কে হু/মকি দেওয়া হয়েছিলো যদি তোকে ডির্ভোস না দেয় তাহলে তোকে আর তোর বাবা-মা কে সবার ক্ষ’তি করবে ও? নিহানের হাতে কিছু ছিলো না বিশ্বাস কর। নিহান নিরুপায় ছিলো।তৃধা সেক্রেটারি কে নিহান আটকে রেখেছিলো কিন্তু সেটাও তৃধা জেনে যায়। নিহান যা যা স্টেপ নিতো তৃধা সবটা আগের থেকেই জেনে যেতো যার কারনে নিহান একবার ও সফল হয়নি কোনো কাজে। বাধ্য হয়ে তৃধার কথা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিলো না ওর। কাকিমা ও নিরুপায় নিজের মেয়েকে বাঁচানোর জন্য তৃধার সব কথা মুখ বুঝে মেনে নিয়েছে। তোর সাথে খা’রাপ ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছে। একবার ভাব কাকিমার জায়গায় যদি তোর মা থাকতো তাহলে নিশ্চয়ই একি কাজ করতো। নিহানের বাড়ি থাকলে তোর ক্ষতি হয়ে যেতো ভেবেই নিহান তোকে দূরে পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো কি করে? স্মৃতির সাথে ওর প্রাক্তনের ঘনিষ্ট ভিডিও গুলো স্মৃতির প্রাক্তন তৃধার হাতে তুলে দিয়েছিলো। তৃধা নিহান কে সেগুলো দিয়েও ব্লাকমেইল করছে। এখন তুই বল নিহান কাকে বাঁচাবে? তোকে,আলিশাকে,নাকি স্মৃতিকে?”
আবরারের কথা শুনে নুহা স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। ওর চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। আবরার একটু থেমে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই নুহা বলে উঠলো……
—নিহান তুমি একটা জিনিস ভুলে গেছো?
নিহান এত ক্ষন পর মাথা তুলে তাকালো নুহার দিকে। নুহা নিহানের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো……
—আমি আলিশাকে খুঁজে বের করার উপায় পেয়ে গেছি?
আবরার জোরেই বলে উঠলো…..
—কি করে? তাড়াতাড়ি বল?
নুহা একটু আস্তে চারদিকে একবার চোখ বুলাতেই দরজার দিকে নজর দিয়ে একটু জোরে বললো…..
—আলিশার হাতে একটা ঘড়ি আছে। নিহান আলিশার ঘড়িতে ওর নিরাপত্তার কথা ভেবে একটা হিডেন স্পাই ক্যামেরা লাগিয়ে দিয়েছিলো। নিহান হয়তো এত কিছুর মধ্যে ভুলে গেছে।
নুহার কথা শুনতেই নিহান বড় বড় চোখ করে নুহার দিকে তাকালো। নিহান কিছু বলতে যাবে তার আগেই নুহা নিহান কে থামিয়ে দিয়ে পুর্নরায় বলে উঠলো…..
—-আমরা তো সেটা দিয়ে ওর লোকেশন ট্রাক করতে পারি।
আবরার নুহার কথা শুনে জোরে বলে উঠলো….
—ড্যাম ইট। এই কথাটা তো তুই আমাকে আগে বলবি তো।
নিহান বোবা চাহনি নিক্ষেপ করে আছে। কারন এইরকম কোনো ঘড়ি কখনোই আলিশাকে ও দেয়নি? তাহলে নুহা কেনো মিথ্যা বললো?
#চলবে