কুয়াশায় ঘেরা আঁধার পর্ব -০৪

0
1103

#কুয়াশায় ঘেরা আঁধার
#লেখনীতে-জেনিফা চৌধুরী
#পর্ব-চার

–আমার মেয়েটাকে এইভাবে বেঁধে রেখেছো কেনো? তুমি তো বলেছিলে ও ভালো আছে ওর গায়ে কোনো আচঁড় লাগবে না। তাহলে ওর এই অবস্থা কেনো। উওর দাও তৃধা। আমার ধৈর্যের পরিক্ষা নিও না। এক থা’প্পড়ে তোমার গালের সব কয়টা দাত ফে’লে দিব। ভুলে যেওনা আমি কে?

নিজের মেয়েকে হাত পা বাধা অবস্থায় চেয়ারে পড়ে থাকতে দেখে সিনথিয়া বেগম তৃধার দিকে রাগী চাহনী নিক্ষেপ করে উপরোক্ত কথা গুলো বলে উঠলো। সিনথিয়া বেগমের কথা শুনে তৃধা একটু বাঁকা হেসে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে উঠলো….

—কুল, কুল শাশুড়ী আম্মু কুল। এত হাইপার হলে কি চলে বলুন তো? বয়স হয়েছে তো আপনার। কখন বিপি হাই হয়ে কোন অঘটন ঘটে যায় বলা যায় নাকি।

বলেই মোবাইল টা অফ করে সিনথিয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে চোখ মা/রতেই সিনথিয়া বেগমের শরীরের সমস্ত অঙ্গ প্রতঙ্গ জ্বলে উঠলো। সিনথিয়া বেগম রেগে তৃধার দিকে আঙ্গুল উঠিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই তৃধা সিনথিয়া বেগমের হাত মুচড়ে ধরে দাতে দাত চেপে বললো….

—মাই ডিয়ার শাশুড়ী আম্মু ভুলে যাবেন না আমি কে? আর এই মুহূর্তে আপনার প্রানের টুকরো একমাত্র মেয়ে আলিশা আমার খাঁচায় বন্দী। আমার একটা মাত্র ইশারা ওকে দুনিয়া থেকে চিরদিনের জন্য উপরে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সো, আমার সাথে একদম চালাকি করতে আসবেন না।

বলেই ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো সিনথিয়া বেগম কে। সিনথিয়া বেগম দাতে দাত চেপে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তৃধার দিকে। তৃধা কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে আবার পেছনে ফিরে শান্ত কন্ঠে বললো….

–যেদিন নুহা নামক কালো ছায়া আমাদের জীবন থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় হবে সেদিন আপনি আপনার মেয়েকে পেয়ে যাবেন। টেনশন করবেন না আমার একমাত্র ননদিনীকে মা/রব না।

বলেই হাসতে হাসতে চলে গেলো। সিনথিয়া বেগম কাঁদতে কাঁদতে চেয়ারে বসে পড়লো। আড়াল থেকে কেউ একজন সিনথিয়া বেগমের কান্না দেখে বিজয়ের হাসি হাসলো। তার বলে উঠলো….

–সবে তো কান্না শুরু তোমাদের। সামনে আরো কত কান্না বাকি।

বলেই হাসতে হাসতে ভেতরে চলে গেলো। পর্দাটা নড়ে উঠতেই সিনথিয়া বেগমের চোখ গেলো সেদিকে। আড়ালে কেউ একজন দাড়িয়ে ছিলো? কিন্তু কে ছিলো? তৃধা তো তখন বাইরে বেরিয়ে গেলো।
____________________________________________
–তোদের নিয়ে হয়নি মানে কি?

আবরারের প্রশ্নে নিহান হাসলো। তারপর শান্ত কন্ঠে জবাব দিলো…..

—রায়মান খান নিহান এতটাও বোকা না।

নিহানের কথা শুনে আবরার একটু নড়ে চড়ে বসলো। কিছু একটা রহস্যের ঘ্রান পাওয়া যাচ্ছে। আবরার কিছু বলতে যাবে তার আগেই পাশের থেকে ইমন অধৈর্য কন্ঠে বললো…..

–তোদের বিয়ে তো নুহা দাড়িয়ে থেকে দিলো। তাহলে বিয়ে হয়নি কথাটা বললি কেনো?

নিহান একটা পেপার বের করে ওদের সামনে ধরতেই দেখলো এটা একটা সম্পত্তির দলিল। আবরার কিছু বুঝতে না পেরে প্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে নিহানের দিকে তাকাতেই নিহান একটু জোরে নিশ্বাস ছাড়লো তারপর বলতে লাগলো…..

–” আমাদের রুমে একটা সিক্রেট ক্যামেরা লাগানো ছিলো সেদিন রাতে যদি আমি নুহাকে ওইসব কথা না বলতাম তাহলে তৃধা নুহার সাথে সাথে আলিশাকে ও মে/রে ফেলতো। আমি হাজার চেষ্টা করেও ওদের বাঁচাতে পারতাম না। আমার হাতে কিছু ছিলো না। আমি একটা ফাঁদে আটকে পড়েছি। এমন একটা পরিস্থিতি মুহূর্তেই তৈরি হলো যে তৃধাকে বিয়ে করা ছাড়া আমার হাতে কোনো অপশন ছিলো না। আমি যখন জানতে পারলাম নুহা মা আর আমি বাবা হতে চলেছি তখন আমার খুশির থেকে ভয় বেশি হচ্ছিলো। একদিকে বোন আরেক দিকে আমার সন্তান, আমার ভালোবাসা,অন্যদিকে আমার কষ্ট করে অর্জন করা নাম, খ্যাতি । ভালোবাসার মানুষ টাকে ধরে রাখতে চাইলে আমার বোন আর আমার নাম, খ্যাতি,জনপ্রিয়তা হারাতে হতো। আর বোন নাম,খ্যাতি, ধরে রাখতে চাইলে ভালোবাসার মানুষটাকে হারাতে হতো। আমি তখন সত্যিই হেল্পলেস হয়ে গিয়েছিলাম কি করে এই জাল থেকে বের হবো খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তৃধা আমাদের সমস্ত সম্পত্তি নিজের নামের করে নিয়েছিলো আমার মাকে ঠকিয়ে। তাই আমি ও সামান্য একটু বুদ্ধি খাটিয়ে রেজিস্ট্রি পেপারের জায়গায় সম্পত্তির দলিলে সিগন্যাচ করিয়ে নিয়েছি। তৃধা আমাকে বিয়ে করার খুশিতে এতই মত্ত ছিলো যে ও একবার চোখ বুলিয়েও দেখেনি এটা কিসের পেপার। এতে আমার কাজটা আরো সোজা হয়ে গেছে। আমাদের যেহেতু রেজিস্ট্রি হয়নি সেহেতু বিয়ে হবে কি করে?
আজ থেকে তৃধার সমস্ত গুটি চাল দিব আমি। যেই ভালোবাসার লোভে তৃধা এইসব করছে সেই ভালোবাসা দিয়েই বাজিমাত করব আমি”

নিহানের কথা গুলো আবরার আর ইমন খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো। নিহান থামতেই আবরার কষ্টার্জিত কন্ঠে বললো…..

—আলিশা কেমন আছে নিহান? কোথায় আছে?

আবরারের প্রশ্ন শুনতেই নিহান আর ইমন দুজনেই ওর দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। আবরারের চোখে পানি টলমল করছে। নিহান আবরারের কাঁধে হাত রেখে মুখে হাসির রেখা টেনে বলে উঠলো…..

— আই হোপ আলিশা ভালো আছে। সুরক্ষিত আছে। তৃধা ওর ক্ষতি করার মতো ভুল কাজ করবে না। খুব শিঘ্রই আমি আমার বোন কে খুঁজে বের করব।

বলেই আবরার কে জড়িয়ে ধরলো।
____________________________________________
নুহা আর ওর মা ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে রাস্তায় দাড়িয়ে ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করছিলো। রাস্তার পাশে আইসক্রিম দেখে নুহা খেতে ইচ্ছে করছে। রোদের মধ্যে দাড়িয়ে থেকে গলা টাও শুকিয়ে আসচ্ছে। নুহা ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে একদম শান্ত কন্ঠে বললো…..

–মামনি একটা আইসক্রিম কিনে দাও না।

নুহা এমন ভাবে বললো যে নুহার মা আশা খানম একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো….

–রোদের মধ্যে তোর আর সামনে যাওয়া লাগ বেনা তুই এখানে দাড়া আমি নিয়ে আসচ্ছি গিয়ে। রাস্তার ধারে যাবি না কিন্তু একদম।

নুহা ও বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়াতেই আশা খানম আইসক্রিম কিনতে চলে গেলো। মাতৃকালীন সময়ে মেয়েদের আরো বেশি সুন্দর লাগে। কালো জর্জেটের শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে কালো ব্লাউজ। নুহার চুল গুলো বেশ লম্বা হাটুর দুই-তিন ইঞ্চি উপর অব্দি আর সিল্কি। চুল গুলো বেনুনী করে সামনে এক সাইডে এনে রেখেছে। রোদের মধ্যে দাড়িয়ে থাকায় ফর্সা মুখ টা লাল বর্ন ধারন করেছে। গরম লাগায় নুহা শাড়ির আচল টা কাঁধে উঠিয়ে নিয়ে ফাইল দিয়ে বাতাস করতে লাগলো। নুহার ফোন টা বেজে উঠতেই নুহা এক রাশ বিরক্তি নিয়ে ফোন টা রিসিভ করে বললো….

–সন্দেশের বা’চ্চা ফোন করার আর টাইম পাস না। আমি রোদের মধ্যে দাড়িয়ে ঘেমে একাকার হয়ে আছি কোথায় গাড়ি নিয়ে আসবি তা না করে ফোন দিয়ে জ্বালাচ্ছিস।

নুহার কথা শুনে আবরার রাগী গলায় ওপাশ থেকে বলে উঠলো……..

—বরফি তুই একা কেনো বেড়িয়েছিস এই অবস্থায়। আমাকে একবার কল করতে পারতিস। তুই কোথায় আছিস তাড়াতাড়ি বল আমি এক্ষুনি আছি একদম ওই জায়গা থেকে নড়বি না।

নুহার ভীষন খারাপ লাগছে। তাই নুহা বেশি কথা না বলে আবরার কে ঠিকানা টা দিতেই আবরার ফোন রেখে দিলো। নুহা ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো দোকানে ভীড় থাকায় ওর মা এখনো আইসক্রিম কিনতে পারেনি। আর এদিকে একটাও ট্যাক্সি বা রিকসা কিছুই পাচ্ছে না। নুহার মুখে বিরক্তির চিহ্ন স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। নুহার থেকে একটু একটা প্রাইভেট কার থামানো। নুহার কেনো যেনো মনে হচ্ছে প্রাইভেট কারে থাকা ব্যাক্তিটার নজর নুহার দিকে। কিন্তু সে ছেলে নাকি মেয়ে দূর থেকে বুঝতে পারছে না ও। নুহার ফুটপাত থেকে রাস্তার ধারে নামলো ট্যাক্সির খোঁজে। কয়েক পা এগুতেই পেছন থেকে থেমে থাকা প্রাইভেট কারটা এসে নুহাকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে চলে গেলো। নুহা মুখ থুবড়ে রাস্তায় পড়তেই নুহার থেকে খানিক টা দূরে গিয়ে প্রাইভেট কার টা থামতেই ভেতর থেকে জানালা দিয়ে তৃধা মুখ বের করে নুহাকে এক নজর থেকে মুচকি হেসে বলে উঠলো…..

—দ্যা গেম ইজ ফিনিশ……..

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে