গল্পঃ কুড়িয়ে পাওয়া ডায়েরি
পর্বঃ০৫
নিঝুম জামান (ছদ্মনাম)
ছেলেটা উজ্জ্বল শ্যামবর্নের, হাসি দিলে একগালে টোল পড়ে যা দেখে আমি প্রথম দিনেই পুরো ফিদা হয়ে গেছি।
আজকেও বইয়ের ফাঁকে একটু তার দিকে তাকালাম। সেও আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিল।চোখে চোখ পড়ায় আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম। লজ্জায় আমি তাড়াতাড়ি সেখান থেকে উঠে চলে আসলাম। তারপর হোস্টেলের রুমে এসে ফেসবুকে ঢুকে দেখলাম ছেলেটা আমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে। আমি অবাক হলাম ছেলেটা আমার নাম জানলো কিভাবে? তবে আমি খুশি মনে হয়ে একসেপ্ট করে ফেললাম।ছেলেটার নাম তামিম হাসান। পদার্থবিজ্ঞানের চতুর্থ বর্ষে পড়ে।দেখে যথেষ্ট নম্র-ভদ্র মনে হয়। কিছুক্ষন পর তামিম নামের ছেলেটা আমাকে ম্যাসেজ দিল,
— কেমন আছো?
আমি রিপ্লাই দেওয়ার আগেই সে আবার ম্যাসেজ দিল, ” প্রতিদিন তুমি আমাকে বইয়ের ফাঁকে লুকিয়ে দেখো কেনো?”
তার ম্যাসেজটা পড়ে আমি ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেলাম। আমি তাকে লিখলাম, “কই না তো”
–” আর মিথ্যা বলতে হবে না,আমি খেয়াল করে দেখেছি। আজকেও তো আমার দিকে তাকিয়ে ছিলে..
তার ম্যাসেজের ধরন দেখে মনে হচ্ছে তার সাথে আমার কতদিনের পরিচয়? আমি তাকে “সরি,আর আপনার দিকে তাকাবো না” লিখে সেন্ড করলাম।
–আর এই সামান্য ব্যাপারে সরি বলতে হবে না,আমি জাস্ট মজা করলাম।কালকে থেকে আর লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে হবে না।আমাকে সরাসরি দেখো।
ম্যাসেজটা দেখে আমি একটা হাসির ইমোজি পাঠালাম।এভাবেই আমাদের পরিচয় হলো। প্রথম দিকে টুকটাক কথাবার্তা হতো, ধীরে ধীরে আমাদের
সম্পর্কটা বন্ধুত্বের চাইতেও বেশি হয়ে উঠল। দুজন দুজনের চোখের ভাষা বুঝলেও কখনোই কারো ভালোবাসি কথাটি বলা হয়ে ওঠে নি। আমার পরিবারের কথা,আমার স্বপ্নের কথা জানতো তাই আমার স্বপ্ন পূরনের জন্য
আমাকে পড়াশোনার ব্যাপারে অনেক হেল্প করতো। তবে তামিমের সাথে আমার সম্পর্ক শুরু হওয়ার পর থেকে আমি পড়াশোনায় তেমন মনোযোগী হতে পারতাম না।সারাক্ষণ আমার কল্পনায় তামিম থাকতো। কিন্তু তামিম আমায় সবসময় বলতো,
কল্পনায় কখনো জীবন চলে না আমাকে জীবনে সফল হতেে হলে অনেক পরিশ্রমী হতে হবে। নিজের যোগ্যতায় সমাজে মাথা উচু করে বাঁচতে হবে। ওর
আমি কথাগুলো শুনতাম ঠিকই মানার চেষ্টা করতাম না। চোখে তখন হাজারো রঙিন স্বপ্ন দেখতাম।
.
.
.
দিন যতোই যাচ্ছে আমাদের বন্ধুত্ব ততই গভীর হচ্ছে। আমার একদিন মনে হলো আমার কালো অতীত সম্পর্কে তামিমকে কিছু বলা উচিত। কারন কাউকে কখনো ঠকাতে চাই না।আমি ওর সাথে দেখা করে আমার জীবনের কালো অধ্যায় সব খুলে বললাম। তামিম মাথা নিচু করে সবকিছু শুনলো তারপর হাত দুটো ধরে বলল,
–আমি জানি নীলা একটা মেয়ের ধর্ষিতা হওয়ার পেছনে তার কোনো দোষ থাকেনা তোমারও নেই।কিন্তু আমরা,আমাদের সমাজের মানুষগুলো অসহায় মেয়েটাকেই সব দোষ দিয়ে থাকি।
যাইহোক, আমি তোমার অতীত নিয়ে মাথা ঘামাতে চাই না।আমি এখন যেমন তোমার পাশে আছি ভবিষ্যতেও তেমন তোমার পাশে থাকতে চাই।”
তামিমের কথাগুলো শুনে আমার খুব ভালো লেগেছিল। মনে হচ্ছিল আমি ভুল মানুষকে ভালোবাসি নি।
তবে আমার মনের কথা ধারণাটা ভুল প্রমানিত হয়েছিল তার দুইদিন পরে। সেদিন আমার ফাস্ট ইয়ারের ফাইনাল রেজাল্ট দিয়েছিল। রেজাল্ট দেখে আমি নিজেই প্রচন্ড শকড হয়েছিলাম।আমার দুই সাবজেক্টে ফেল আসে। আমার যেহেতু দুনিয়ায় আপনজন বলতে কেউ ছিল না,তাই তামিমের কাছেই আমি আপনজন ভেবে সব শেয়ার করতাম।
তামিমকে ফোনে আমার রেজাল্টের কথা বলতেই ও ক্ষেপে যায়।আর ফোনেই আমাকে বলতে থাকে,
–আমি জানতাম নীলা এমন কিছুই হবে…
আমি বেশ কিছুদিন ধরে তোমাকে খেয়াল করছি যে তুমি আমার প্রতি দিনকে দিন দূর্বল হয়ে পড়ছো।পড়াশোনা ঠিকমতো করো না। শোনো নীলা…
আমি কিন্তু তোমার প্রতি দূর্বল নই।আমি তোমাকে ভার্সিটির জুনিয়র বোন হিসেবে, বন্ধু হিসেবে এতোদিন ভেবেছি এছাড়া অন্য কিছু নয়।
আমি ওর কথা শুনে অবাকের চরম পর্যায়ে পৌছালাম। হয়ত ও আমাকে কখনো মুখে বলে নি আমাকে ভালোবাসে কিন্তু আমার প্রতি ওর কেয়ারিং দেখে বুঝতে পারতাম যে ও আমাকে ভালোবাসে।আমি তামিমকে সরাসরি বললাম,
–তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না?
— এখানে আমার ভালোবাসা না বাসার কথা বলছি না।আমি বলেছি তুমি আমার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ছো, যা তোমার লেখাপড়ার ওপর খারাপ প্রভাব ফেলছে। ভালোমতো পড়াশোনা করো।
তামিম আরো কিছু বলতে চাইছিল তার আগেই আমি রাগে ফোনটা কেটে দিলাম। অবশ্য আমি বেশ ভালোই বুঝতে পারছি যে আমি যে ধর্ষিতা মেয়ে,সেই কারনেই ও আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
দোষটা আমারই,আমিই আমার অতীত ভুলে ওকে ভালোবেসে ফেলেছি।আমি যে কারো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না।ভেবেই আমি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। আমার ভালোবাসা হওয়ার আগেই শেষ হয়ে গেল।
নিজেকে সব ধরনের পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করলাম।
অনার্সের পড়ার পাশাপাশি বিসিএসের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলাম।
এর মাঝে অবশ্য খবর পেয়েছি তামিম স্কলারশিপ পেয়ে বিদেশে চলে গিয়েছে।ওর সাথে এখন আর কোন যোগাযোগ নেই। যাওয়ার আগে আমাকে ফোন দিয়ে সরাসরি দেখা করতে চেয়েছিল, আমিই যাই নি। মাঝে মাঝে ফেসবুকে ওর বিভিন্ন পোস্ট দেখি।একবার ব্লক করতে চেয়েও করতে পারি নি।ওর কারনেই মূলত এখন আর ফেসবুকে অ্যাক্টিভ থাকি না। বলা যায় ফেসবুকই চালাই না।
……
আজকে আমি ভালো ভীষণ খুশি। আমাদের অনার্স থার্ড ইয়ারের রেজাল্ট দিয়েছে। আমার সিজিপিএ 3.90 আউট অফ 4
কি যে খুশি লাগছে! মাকে ভীষণ মনে পড়ছিল।
মা জানলে অনেক খুশি হতেন।
.
.
.
.
জীবনে দুঃখের পর সুখ আসে।আমার জীবনেও দুঃখের সময় পার করে আজ সুখের সন্ধান পাচ্ছি। প্রায় চার বছর পর আজকে ডায়েরি লিখতে বসেছি।আজ আমার জীবনের অনেক আনন্দের একটা দিন। আমি আজকে আমার কর্মক্ষেত্রে প্রথম জয়েন করেছি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে। আমার এতোদিনের কষ্ট সার্থক হয়েছে। খুব মিস করছি মা আর ছোট ভাইকে।রাজু বেঁচে থাকলে এখন নিশ্চয় অনার্সে পড়তো। ভাইটা আমার কাছে অনেক কিছু আবদার করতো,বলতো- ” আপু তুমি যখন চাকরী করবা, তখন আমার ইচ্ছে মতো অনেক কিছু কিনব।”
আফসোস! চাকরী করছি মাস শেষে ভালো একটা টাকাও পাবো কিন্তু কিনে দেওয়ার মতো কোন মানুষ নেই। জীবনে বড় কিছু অর্জন করে প্রিয়জনদের তার আনন্দ ভাগ করতে না পারলে ভীষণ কষ্ট হয়।
ভাবছি আমার প্রথম বেতনের টাকা দিয়ে কিছু দরিদ্র শিশুকে জামা-কাপড় কিনে দিব।
.
.
অনেকদিন পর আজকে মামাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। পৃথিবীতে আপনজন বলতে এরাই আছে। ঝুমা আপুর বিয়ে হয়েছে অনেক বড় ঘরে। তার একটা ছেলে হয়েছে।
মামারা তাদের বাড়িতে যাওয়ায় ভীষণ খুশি হয়েছেন। মামা বাড়িতে থাকার ইচ্ছে ছিলো না।দুই মামা জোর করে দুইদিন তাদের বাড়িতে রাখলো।
খুব মজা হলো এই দুইদিন।ঝুমা আপু, দুলাভাই,ছোট মামি,মামাতো ভাই মাহবুব সবাই মিলে সারারাত আড্ডা দিলাম।
.
.
বেশ কয়েকদিন ছুটি থাকায় ঝুমা আপুদের সাথে আমি সিলেটে ঘুরতে আসলাম। ঘুরতে এসে এতো বড় যে সারপ্রাইজ পাবো কখনো ভাবতে পারি নি।
আমি কখনোই কল্পনা করিনি সিলেটে এসে যে তামিমের দেখা পাবো…
#চলবে