কুহেলিকা পর্ব-২৩

0
564

#কুহেলিকা (পর্ব-২৩)
#লেখক_আকাশ_মাহমুদ

আকাশ কিছু বলে শেষ করার আগেই দিশা ফোন রেখে দিয়ে চলে গেছে দরজার কে এসেছে দেখার জন্য। এদিকে আকাশের গলা পুরোপুরি শুঁকিয়ে গেছে। বুকের ভিতরে ধুপধুপ করছে তার। কারন আকাশ আগ থেকেই আন্দাজ করে নিয়েছে ঘরের দরজায় কে এসে দাঁড়িয়ে আছে। থরথর করে কাঁপছে আকাশের শরীর। কি করবে দিশেহারা হয়ে গেছে আকাশ। চেহারার ধরণ পুরোপুরি পাল্টে গেছে। মাথায় যেনো কিছুই কাজ করছে না। আকাশের ঘাবড়ে যাওয়া চেহারাটা দেখে প্রভা আকাশকে প্রশ্ন করে,

–‘কি হয়েছে আকাশ তুমি এমন ঘাবড়ে আছো কেন? দিশা কি বলেছে তোমায়? আর তুমি কথা বলে শেষ করার আগেই দিশা ফোন কেন রেখে দিয়েছে?’

–‘বাড়ির দরজায় নাকি বেশ কিছুক্ষণ ধরে কেউ একজন কলিংবেল বাজাচ্ছে। দিশা আমার পুরো কথাটা না শুনে আমার সাথে পরে কথা বলছি বলে দরজায় কে এসেছে দেখতে চলে গেছে।’

–‘আকাশ তোমার এক্ষুনি একবার বাসায় যাওয়া উচিৎ। দিশাকে তোমার একা ফেলে রেখে আসা ঠিক হয়নি। কখন ফারহান নামক শয়তানটা তার কোনো ক্ষতি করে দেয়। আর তাছাড়া তোমার বাসার কলিংবেল বাজাচ্ছে কেউ একজন বেশ কিছু সময় ধরে। আল্লাহ না করুক সে যদি ফারহান হয়, তাহলে কিন্তু দিশার জন্য বিপদ আছে। তাই প্লিজ তুমি একবার বাসায় গিয়ে দেখে এসো দিশা কি অবস্থায় আছে।’

–‘হুম আমি এক্ষুনি বাসায় যাবো। কারন আমি যেটা কল্পনা করছি সেটা যদি হয়, তাহলে বিশাল বড় ক্ষতি হয়ে যাবে আমার।’

–‘ঠিক আছে যাও। তবে আমায় কি তোমার সঙ্গে নিয়ে যাবে?’

–‘বেঈমানের সঙ্গে চলালল করা বহু আগেই বাদ দিয়ে দিয়েছি আমি। আমি কাউকেই আমার সঙ্গে নিব না।’

–‘ঠিক আছে তুমি একাই যাও। আমি রিক্সায় করে তোমার বাড়ি আসছি। আসলে দিশার জন্য কিছু উপহার নিয়ে এসেছি সঙ্গে করে। সেসব উপহার দিশাকে দিতেই তোমার বাড়ি যেতে চেয়েছি। তবে সমস্যা নেই। তুমি চলে যাও তোমার মতন। আমি রিক্সায় করে আসছি।’

আকাশ আর কথা না বাড়িয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে গাড়ি নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। আকাশের ভিতরটা উতাল-পাতাল করছে। প্রভার বলা কথা গুলো যদি সত্যি হয়, আর সেই অনুপাতে যদি ফারহান আমার বাসায় যায়, তাহলে নিশ্চিত জানো/য়ার টা আমার দিশার কোনো বড় ধরনের ক্ষতি করবে। আকাশ গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে তার নিজের পুরোনো নাম্বারে বেশ কয়বার ফোন করে, কিন্তু দিশা ফোন রিসিভ করে না। আকাশের ভয়টা আরো বেড়ে যায়। দ্রুত গাড়ি ড্রাইভ করে বাসায় গিয়ে পৌঁছায়। বাসায় পৌঁছে গাড়ি থেকে নেমে বাসায় প্রবেশ করবে সেই সময় দেখতে পায় বাসার দরজা খোলা। আকাশের মনে আতঙ্ক লেগে যায় ব্যাপার দেখে। কারন ঘরের দরজা ভালো করে লাগিয়ে রাখার কথা ছিল দিশার। সেখানে বাড়ির দরজা খোলা। আকাশের মনে কু ডাকতে আরম্ভ করে। দিশাকে দেখার জন্য ভিতরটা মরিয়া হয়ে উঠে আকাশের। তাড়াতাড়ি বাসার ভিতরে ঢুকে পড়ে দিশাকে দেখার জন্য আকাশ। এরপর বাসায় ঢুকে কয়েক কদম সামনে এগোতেই দেখে দিশা রক্তাক্ত অবস্থায় ফ্লোরের উপরে পড়ে আছে। পুরো ফ্লোর রক্তে লাল হয়ে আছে। আর দিশা নিরব হয়ে ফ্লোরের উপরে শুয়ে আছে। দিশার এই ভয়ানক অবস্থা দেখে আকাশ বিকট আওয়াজে একটা চিৎকার দিয়ে উঠে। মনে মনে সে যেটা নিয়ে ভয় পাচ্ছিলো সেটাই হয়েছে। আকাশ দৌড়ে দিশার কাছে যায়। দিশার কাছে গিয়ে দেখে দিশার গলায় কেউ ছুরি দিয়ে আঘাত মেরেছে। দিশার গলা থেকে গলগল করে রক্ত পড়ছে। আকাশের সারা শরীর কাটা দিয়ে উঠে দিশার অবস্থা দেখে। দিশার পাশে বসে কোনো রকমে সে দিশার মাথা উঠিয়ে নিজের কোলে রাখে। এরপর কাঁদতে কাঁদতে দিশাকে ডাকতে থাকে,

–‘দিশা এই দিশা? কথা বলো প্লিজ। তুমি কেন আমার পুরো কথাটা না শুনে দরজা খুলতে গেলে?

দিশা আকাশের কথার কোনো জওয়াব দেয় না। আকাশ দিশার থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে দিশার শরীর ঝাঁকিয়ে তাকে ডাকতে আরম্ভ করে।
এবার দিশা রেসপন্স করে উঠে। আকাশ দিশার রেসপন্স পেয়ে দিশাকে বলে,

–‘কেন তুমি তখন আমার পুরো কথাটা শুনলে না দিশা? তখন যদি আমার কথাটা শুনতে তাহলে কখনোই আর এমনটা হতো না।’

দিশা আকাশের কথা শুনে ছোট্ট আওয়াজে বলে,

–‘আমার কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে। তবে তার থেকেও বেশি কষ্ট হচ্ছে আমার নসিব দেখে। আসলে আমার নসিবেই ছিল এমনটা। আমার কপালে নেই আপনার সাথে সারাজীবন কাটানো। সেজন্য হুট করেই আমার সাথে এমনটা ঘটে গেছে। আমি সব সময় আপনার কথা শুনি। কিন্তু কলিংবেলের আওয়াজে বিরক্ত হয়ে ভাবলাম আগে কে এসেছে সেটা দেখে আসি। পরে না হয় আপনার সাথে কথা বলবো। এই প্রথম নিজের চিন্তা-ভাবনায় কিছু করার চেষ্টা করেছি, এবং প্রথম বারেই নিজের মৃত্যুকে দাওয়াত করে নিয়ে এসেছি। আসলে জানেন আমার কপালটাই খারাপ। কখনো মন থেকে কোনো কিছু চেয়েও সেটা আমি পাইনি। তবে আপনাকে ভাগ্য করে নিজের কাছে পেয়েছিলাম। আমার সব সময় ভয় হতো আপনাকে নিয়ে। আপনি না জানি কখন আমার থেকে দূরে সরে যান। কিন্তু দেখেন উপর ওয়ালার কি নির্মম পরিহাস আমি নিজেই আপনার থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। আমিই ভয় পেতাম আপনাকে নিয়ে, এখন উল্টো আমিই চলে যাচ্ছি আপনাকে একা রেখে।’

–‘দিশা তোমার কিচ্ছু হবে না। আমি তোমাকে নিয়ে হসপিটাল যাচ্ছি। প্লিজ তুমি অশুভ কথাবার্তা বলিও না। দেখবে তুমি ঠিক হয়ে যাবে।’

–‘প্লিজ আপনি আমার জন্য দৌড়ঝাঁপ করিয়েন না। আমার চলে যাওয়ার সময় এসে গেছে। আমি সব কিছুকে অনুভব করতে পারছি। আপনি প্লিজ আমার জন্য তাড়াহুড়ো করবেন না।’

–‘দিশা তোমার কাছে অনুরোধ তুমি উল্টো-পাল্টা কথা বলিও না। তোমার কিচ্ছু হবে না বললাম তো।’

–‘আকাশ সাহেব আমার আফসোস থেকে যাবে আপনার জন্য। অবশ্য এখনো আফসোস হচ্ছে। তবে সব চাইতে বড় আফসোসটা তখন হবে, যখন আপনি আমাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার তাড়নায় অবিলম্বে থাকবেন, আর অন্য দিকে আমার প্রাণটা চলে যাবে। দেখুন আমি আপনার বুকে মাথা রেখে মরতে চাই। আমি শেষ সময় টুকু আপনার সাথে কথা বলে কাটাতে চাই। আমি জানি আমার হাতে আর বেশি সময় নেই। না হয়তো আমি আপনাকে বাঁধা দিতাম না। আমারো তো ইচ্ছে ছিলো আপনার সাথে সারাটা জীবন কাটানোর। তাহলে আমিই কেন আপনাকে বারন করছি একবার বুঝার চেষ্টা করুন।’

–‘দিশা আমি হাল ছাড়বো না। তোমার সমস্ত ইচ্ছেই আমি পূরণ করবো। তোমার মাথা নিজের বুকে নিয়ে তোমার সাথে ইচ্ছে মতন কথা বলবো। কিন্তু আমি হাল ছাড়বো না কখনোই। কারন তোমাকে নিয়ে আমি সারাজীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখেছি। দিশা তোমাকে আজ সকালে বলেছিলাম তোমার জন্য একটা গিফট আছে। সেই গিফটা কি তুমি কি জানো?’

–‘না জানি না।’

–‘দিশা আমি তোমাকে বিয়ে করে নিজের বউ বানাবো বলে ঠিক করেছি। দিশা আমি তোমার সাথে মরণ পর্যন্ত থাকতে চাই। তুমি সব সময় মনে মনে আমাকে নিয়ে একটা ভয় পাও। আমি কখন না জানি তোমায় ছেড়ে দেই। দিশা আমি তোমার সেই ভয়টা মনের ভিতর থেকে সারাজীবনের জন্য দূর করতে চেয়েছিলাম। আমি তো এতো সহজে হাল ছাড়বো না। প্রভাকে ভালোবেসে জীবনের সব চাইতে বড় শিক্ষাটা পেয়েছি। সে ভালোবাসার নাম করে হৃদয়ে জায়গা বানিয়ে আমাকে পুরো নিস্তেজ বানিয়ে দিয়েছে। শেষ হয়ে যেতে ধরেছিলাম আমি। তবে তুমি সঠিক সময়ে এসে আমায় নিজের কাছে টেনে নিয়েছো। আর আমিও সঠিক সময়ে তোমার দেখা পেয়েছি। আমার বেঁচে থাকার অনেক বড় একটা মাধ্যম তুমি। আমি তো হাত-পা গুটিয়ে কখনোই বসে থাকবো না দিশা। তোমাকে আমি হসপিটালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তুলবো।’

আকাশের মুখে বিয়ের কথা শুনে দিশার মুখের কোণে হাসি ফুটে উঠে। এখন তারো খুব করে বাঁচতে ইচ্ছে করছে। তার প্রিয় মানুষটা তাকে নিজেই সারাজীবনের জন্য আপন করে নেওয়ার কথা বলছে। মুখ ফুটে এবার দিশা নিজেই আকাশকে বলে উঠে,

–‘আমি বাঁচতে চাই আকাশ সাহেব। আমি আপনার সাথে আরো বহু বছর কাটাতে চাই। আপনি আপনার মতো করে শেষ চেষ্টা করে দেখুন। তবে আমার মনে হয় না আমাকে আপনি বাঁচাতে পারবেন। কারন আপনার প্রাক্তনের যার সাথে অবৈধ সম্পর্ক ছিল, সে শুধু আমায় গলায় নয়, আমার পেটেও ছুরি দিয়ে আঘাত করেছে। আমার শাড়ীর কারনে হয়তো আপনি মর্মাঘাত গুলো দেখতে পাচ্ছেন না। তবে আমার শাড়ী উল্টোলেই আমার সমস্ত মর্মাঘাত দেখতে পাবেন। আর তাছাড়া পেটের উপরের অংশের শাড়ীতে দেখুন রক্ত লেগে আছে। আকাশ সাহেব আমার শরীরের অবস্থা দেখে আমি কোনো ভাবেই ভরসা পাচ্ছি না আমি বাঁচবো। তবে আমি বাঁচতে চাই। আমায় বাঁচিয়ে নিন প্লিজ।’

–‘তোমার কিচ্ছু হবে না। তুমি আমার উপরে ভরসা রাখো দিশা।’

দিশা আবারো মুচকি একটা হাসি দিয়ে চুপ হয়ে যায়। অপরদিকে আকাশ দিশাকে কোলে উঠিয়ে নিয়ে গাড়ির সামনে এসে হাজির হয়। ঠিক সেই সময় প্রভা রিক্সা থেকে নেমে আকাশের বাসায় আসে। প্রভা এসে দিশাকে রক্তাক্ত অবস্থায় আকাশের কোলে দেখতে পেয়ে চমকে উঠে। প্রভার বেশ খারাপ লাগছে দিশার জন্য। গুটিগুটি পায়ে হেঁটে আকাশের কাছে এসে কিছুটা সময় দিশার দিকে তাকিয়ে থাকে। দিশার গলার কাটা জায়গাটা দেখে প্রভার শরীর কেঁপে উঠে। বেশ রাগ হচ্ছে ফারহানের উপরে তার। ইচ্ছে করছে ফারহানকে জলজ্যান্ত পুড়িয়ে মারতে। তবে সেটা তার পক্ষে সম্ভব না। ফারহানের শক্তির সাথে সে হয়তো কখনোই পেরে উঠবে না। তবে ফারহানকে তো এভাবে ছাড়া যাবে না। সেজন্য প্রভা আকাশকে বলে,

–‘শয়তানটা অলরেডি তোমার প্রভার গায়ে আঘাত ও করে বসেছে। আকাশ তুমি ঐ জানোয়ার টাকে ছাড়বে না। সে আমাকে তোমার থেকে দূরে সরিয়েছে। এখন এসে প্রভার সাথে এমন জঘন্য কাজটা করেছে। তুমি তাকে একেবারে শেষ করে দিবে। দরকার হয় আমি তোমার সঙ্গ দিব। সে যেনো কোনো ভাবেই বাঁচতে না পারে। ওর পাপের সাজা ওকে পেতেই হবে।’

প্রভার কথা শুনে আকাশ দিশাকে বলে,

–‘আমার দিশার কিছু হলে ফারহানকে মেরে তার শরীরের কয়েক হাজার টুকরো করবো আমি। এরপর সমস্ত টুকরো বস্তা ভরে নিয়ে গিয়ে শহরের কুকুরকে খেতে দিব। তবে সেসব কিছু পরে। আগে এখন তুই আমার দিশাকে বাঁচাতে সাহায্য কর। তুই তো গাড়ি ড্রাইভ করতে পারিস। তুই আমার গাড়িটা ড্রাইভ করে হসপিটালে নিয়ে চল। আর আমি দিশাকে নিয়ে পাশের সিটে বসছি। মেয়েটাকে সামলে রাখা প্রয়োজন।’

–‘ঠিক আছে।’

আকাশের কথা মতন প্রভা গাড়ি ড্রাইভ করছে। আর আকাশ পাশের সিটে বসে দিশাকে জড়িয়ে ধরে তার মাথাটা নিজের বুকের সাথে লাগিয়ে রেখেছে। আকাশের চোখের কোণ বেয়ে টুপটুপ করে পানি পড়ছে। অপরদিকে দিশা চুপচাপ এক নজরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। কোনো সাড়াশব্দ নেই দিশার। এভাবে কিছুটা সময় যেতেই প্রভা আর আকাশ মিলে দিশাকে পাশের একটা হসপিটালে নিয়ে যায়। হসপিটালে পৌঁছে আকাশ দিশাকে কোলে করে গাড়ি থেকে নামিয়ে নিয়ে হসপিটালের একটা স্ট্রেচারে শুইয়ে দিয়ে ডাক্তারকে ডেকে আনতে চলে যায়। কিছু সময় পর আকাশ ডক্টরকে নিয়ে ফিরে আসে। ডক্টর এসেই সর্বপ্রথম দিশার হাতের পালস চেক করে। এরপর দিশার নিশ্বাস চলছে কিনা সেটা জানার জন্য দিশার নাকের কাছে হাত নিয়ে গিয়ে চেক করার পর মলিন সুরে আকাশকে বলে,

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে