#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-২০
ব্যস্ততা মানুষ কে সবকিছু ভুলিয়ে দেয়। আকাশীর ক্ষেত্রে ব্যাপার টা তাই হলো। আগে রাত জেগে নিজের জীবনের ভুল ভাবনা গুলো ভেবে সময় নষ্ট হতো। এখন রাত জেগে শাড়ির কাজ চলে। রঙ্গনার বিয়ের শাড়িগুলোর ডিজাইন, স্টুডেন্ট দের জন্য নোট তৈরী করা, নিজের পড়াশোনায় আকাশী মোহাম্মদপুরের ঝগড়াঝাটি মান অভিমানে পাতানো সংসার আর সেই মানুষ টাকে প্রায় ভুলতে চলল। শুভ কেমন আছে, কোথায় আছে এখন আর জানতেও ইচ্ছে করে না।
ওদিকে শুভকে মায়ের চাপে পড়ে জেসমিন খালার মেয়ে জেরিন কে বিয়ে করেছে। শুভ আসলে নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না যে ওর সাথে ঠিক কী ঘটতেছে! আকাশী চলে গেল রাগ করে, এরচেয়ে বেশী ঝগড়াঝাটি ভাংচুর হয়েছে এর আগে ওদের সংসারে। আকাশী নিজেও জেদ দেখিয়েছে। ঘন্টা দুয়েক পর আবার সব ঠিক হয়ে গেছে। আকাশী ভাত রেঁধে ডিম ভেজে শুভ কে নিয়ে থমথমে মুখে খেতে বসেছে। অথচ সেদিন তেমন কোনো ঝগড়াও না। স্রেফ কথা-কাটাকাটিই তো ছিলো। তবুও এমনভাবে চলে গেল যে একবার যোগাযোগের নাম পর্যন্ত করলো না।
জেরিনের পয়সা আছে ভালোই। পড়াশোনা এসএসসি পর্যন্ত। আগে গার্মেন্টসে চাকরি করতো এখন একটা প্লাস্টিক কোম্পানিতে চাকরি করছে। টাকা পয়সা ভালোই জমিয়েছে। শুভ কে পাঁচ লাখ দিবে ব্যবসার জন্য। শুভর মা মূলত এই লোভেই জেরিনের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে শুভর।
জেরিন ঘরে ঢুকেছে। শুভ আগে থেকেই ঘরে ছিলো। জেরিন কে দেখেই ওর মেজাজ টা খারাপ হয়ে গেল। এর আগে জেরিনের সঙ্গে দুই তিন বার দেখা হলেও তেমন কথাবার্তা হয় নি৷ শুভর তখনও ও’কে ভালো লাগতো না। বিবাহিত ছিলো তখনও এমন সব সস্তা রসিকতা করতো। শুভ ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে গেলে জেরিন পথ আটকালো। শুভ তাকালো জেরিনের দিকে। বাড়াবাড়ি রকমের সাজগোজ। কড়া লিপস্টিক ঠোঁটে, শাড়িটাও কেমন করে পড়েছে। সাজগোজে কমলতার পরিবর্তে উগ্র ভাব বেশী। শুভ হাত ছাড়িয়ে নিতে গেলে জেরিন বলল,
“তেজ একটু পর দেখাও। আগে আমার কিছু ক্লিয়ার কথা শুনবা। ”
শুভ আবারও হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলো। জেরিন জোর করে শুভ কে বসিয়ে দিয়ে গা ঘেঁষে বসে বলল,
“আগের বেডিরে ডিফোজ দেয়ার ব্যবস্থা করবা তাড়াতাড়ি। তারপর টাকা পাইবা। আর সেই বেডির লগে কথাবার্তা দেখা সাক্ষাৎ সব বন্ধ। ভুলেও এইসব করতে যাবা না। আমি কিন্তু সহজ জিনিস না। ”
শুভ আগুন দৃষ্টিতে তাকালো। জেরিন শব্দ করে হেসে বলল, পাঁচ লাখ টাকা দিয়া কিনলাম তোমারে। একটা দুইটা কথা তো শুনতেই হইবে।
শুভ বুঝতে পারলো সামনে আরও কঠিন এবং ভয়ংকর পরিস্থিতি আসতে যাচ্ছে।
***
রঙ্গনার গায়ে হলুদ আগামীকাল। আরও দুদিন আগে থেকেই বাড়িতে উৎসবের আমেজ তৈরী হয়েছে। মালেক মামার বউ এসেছেন মেয়েকে নিয়ে। মেয়ের নাম বর্ষা। বর্ষা কলেজে পড়ে। এই বাড়িতে এর আগে অনেকবার এসেছে। আগে তো একমাস দুইমাস থাকতোও এসে। লাস্টবার মায়ের বেঁফাস কথাবার্তার কারণে দাদু আসতে বারন করে দিলেন। বর্ষার আগে স্বপ্নীল কে ভালো লাগতো একটু একটু। ওর ঘরের আশেপাশে ঘুরঘুর করতো। ঘরে ঢোকার সাহস পেত না। একদিন গিয়েছিল ছুতোনাতায়। স্বপ্নীল তখন মুভি দেখতে দেখতে চিপস খাচ্ছিল। বর্ষা মিনিট দুয়েক ওখানে ছিলো। স্বপ্নীল এয়ারফোন খুলে ও’কে বলল,
“তুমি কিছু বলবে?”
বর্ষা মাথা নেড়ে না বলল। স্বপ্নীল অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বলল,
“তাহলে যাও এখান থেকে। ”
বর্ষা অভিমানে সেদিন অনেক কাঁদলো। এক তরফা প্রেম টা এগুতে পারলো না মায়ের কারনে। বর্ষার মা কঠিন গলায় বলল, সিধা বলদ পোলার সঙ্গে তোর বিয়ে আমি কোনোদিন দিমু না।
বর্ষা সুন্দর স্বপ্ন দেখা তবুও বন্ধ হলো না। একদিন এত বড় বাড়ির মালকিন ও হবে। দাদু তখন মরে যাবে। স্বপ্নীল চাকরি বাকরি নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। বাড়ি সামলাবে ও। স্বপ্নীলের মা মিউ মিউ করে ওর সঙ্গে কথা বলবে।
বর্ষার স্বপ্ন ভেঙে গেল স্বপ্নীলের বিয়ের খবর শুনে। দুদিন কান্নাকাটি করলো। ওর গায়ের রঙ ফর্সা। এখনই অনেক সম্বন্ধ আসে। ও রাজী হয় না৷ এমন বড় বাড়িওয়ালা কাউকে বিয়ে করতে ইচ্ছে করে।
বর্ষা শ্রাবণ্য কে দেখে মন ছোট করে থাকে। এতো সুন্দর একটা মেয়ে। পাতলা ঠোঁট, তারমধ্যে গোলাপি। মাথাভর্তি সিল্কি চুল। ও যদি এমন সুন্দর হতো তাহলে ওর নিশ্চয়ই স্বপ্নীলের সঙ্গে বিয়ে হতো।
বর্ষার মায়ের নাম বীনা। বীনা মেয়েকে নিয়ে পটুয়াখালী থাকেন। তার আসলে এই বাড়িতে থাকার ইচ্ছে। কিন্তু আফতাব চাচা তাকে পছন্দ করেন না। তিনি বলেন বীনা নাকি অনেক কথা বলেন। শুধু কথাই বলেন না এর কথা ওকে আর ওর কথা একে বলে ঝামেলা সৃষ্টি করেন। সে কারনে এতদিন এই বাড়িতে আসা বন্ধ ছিলো। আসল ঘটনা অন্য। আফতাব চাচা কোনো কারণে বুঝে গেছেন যে বর্ষার স্বপ্নীল কে পছন্দ।
বীনা এই বাড়িতে এসে মিশুক কে দেখে পছন্দ করে ফেললেন। কী সুন্দর চেহারা। বাপ, মায়ের একমাত্র ছেলে। বর্ষার সঙ্গে যদি বিয়ে হয়! কী ভালো মানাবে দুজন কে।
***
স্বপ্নীল অফিসে কিছু কার্ড নিয়ে গেল। শিলা বললেন নিয়ে যেতে। সবাই কে দিতে৷ শ্রাবণ্য বলল,
“সবাই কে দেবার দরকার নেই। অল্প কিছু মানুষ কে দিয়েন। যারা আপনাকে পছন্দ করে। ”
স্বপ্নীল দেখলো পুরো অফিসে তাকে মোটে তিনজন মানুষ পছন্দ করেন। প্রোজেক্ট ইন চার্জ শাকুর ভাই, কল সেন্টারের রিনা দিদি আর একাউন্ট ম্যানেজার আংকেল। শ্রাবণ্যর হিসাব অনুযায়ী এই তিনজন ছাড়া আর কাউকে দেয়া উচিত না। কিন্তু ম্যানেজার কে দিতে হবে। তাছাড়া অফিসের চেয়ারম্যান কে দেয়া দরকার।
তিনজন কে কার্ড দিতে গিয়ে স্বপ্নীল বিপদে পড়লো। বাকীরাও ছুটে এলো। ওর পাশের ডেস্কে একটা ছেলে বসে নাদিম নামে। সে সবাই কে ডেকে জড়ো করলো। শেষমেস দেখা গেল কার্ড যা এনেছে তা শেষ। ওর বোনের বিয়ে নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই। ঘন্টা খানেকের মধ্যে প্ল্যান পরিকল্পনা হয়েও গেল কে কে যাবে! খেয়েদেয়ে আসবে! অনেক দিন বিয়ের বাড়ির খাবার খায় না।
***
মিশুক চাচ্ছিলো না বিয়েতে থাকতে। কিন্তুও চলেও যাওয়া যায় না আসলে। ব্যাপার টা তখন অন্য গসিপে চলে যায়। যদিও ওর মনে হয় ও একটু বেশি কিছু ভাবছে। এসব গসিপ টসিপ আসলে কেউই করবে না। শিলা আন্টি, তুলি আপু গসিপের মানুষ না। রঙ্গনা ওকে পাত্তা যতটুকু দেয় সেটা কেবল পেয়িং গেস্ট হিসেবেই। দাদু সবসময়ের জন্যই কঠিন চোখে দেখেন।
শিলা আন্টি মিশুক কে বলেছিল বাড়িতে কার্ড পাঠানোর জন্য। মিশুকের আগ্রহ হয় নি।
গায়ে হলুদের আগের দিন বাড়িতে অনুষ্ঠান চলছে। পিঠে বানানো হচ্ছে নানানরকম। দাদী বলেছেন জামাইর সামনে অন্তত দশ রকমের পিঠে দিতে। সেটা বানানোর প্রস্তুতি চলছে। আকাশী আর শ্রাবণ্য মিলে মেহেদী পরানোর দায়িত্ব পালন করেছে। আকাশীর মনোযোগ মেহেদী পরানোর চেয়েও অন্যদিকে বেশী। কাল বাবা, মা’ও এখানে থাকবেন। ও কী করবে! সুযোগ বুঝে এখান থেকে বেরিয়ে যাবে!
***
বারোটা নাগাদ মিশুক বেরিয়ে এলো। গেটের সামনে বিশাল প্যান্ডেল করে হই হট্টগোল হচ্ছিলো। ও’কে যেতে দেখে শ্রাবণ্য বলল,
“এই যে ভাইয়া খাবার সময় আপনাকে দেখলাম না। খাওয়া হয় নি তাই তো। ”
মিশুক অস্থির হয়ে আছে। বেশী কথা বলার সময় নেই। ও বলল,
“শ্রাবণ্য আমি খাব না। আমাকে বাইরে যেতে হবে। ”
শ্রাবণ্য আবারও জিজ্ঞেস করলো, কোনো সমস্যা? ”
“হ্যাঁ, মানে আমার আপুর হাজবেন্ডের এক্সিডেন্ট হয়েছে। ঢাকায় আনা হচ্ছে। অবস্থা ক্রিটিকাল। ”
শ্রাবণ্য ছুটে গিয়ে খবর টা দিলো সবাই কে।
সেই রাতে সবকিছু বন্ধ রেখে তুলি, রঙ্গনা, শ্রাবণ্য, স্বপ্নীল, শিলা সবাই মিশুকের সঙ্গে হসপিটালে গেল।
মিশুকের দুলাভাই কে চৌদ্দব্যাগ রক্ত দেয়া হলো। সেই চৌদ্দ ব্যাগের দুই ব্যাগ রঙ্গনা আর স্বপ্নীলের। স্বপ্নীল রক্ত দিতে চায় নি। রক্ত দেবার পর বেচারা জ্ঞান হারালো। তবুও শ্রাবণ্য আর রঙ্গনার চাপে রক্ত দিতে হলো।
চলবে….
#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-২১
মিশুক দের ঢাকায় আত্মীয় স্বজন তেমন নেই। তবুও পরিচিত, অপরিচিত যারা ছিলো খবর পেয়ে ছুটে এলো। বাবা, মা আপু আর তার শ্বশুর বাড়ির লোকজন এলো। হাসপাতালের করিডোর, সিড়ি সব জায়গায় ই ওদের লোক। তবে এতো লোকের মধ্যে কাজের কাজ রঙতুলির লোকজনই করেছে। রঙ্গনা, তুলি আর শ্রাবণ্য মিলে আট ব্যাগ রক্ত যোগাড় করেছে। রঙ্গনা যেখানে যাদের পারছে ফোন করে নিয়ে আসছে।
সারারাত সবাই হসপিটালেই রইলো। বিয়ের কনে এমনভাবে হসপিটালে আছে ব্যাপার টা অনেকের ই নজরে পড়লো। বিষয়টিতে কেউ কেউ মুগ্ধও হলো। এরা আসলেই ভালো মানুষ, নাহলে বিয়ে বাড়ির আয়োজন ছেড়ে কেউ এভাবে এসে বসে থাকে!
মিশুক ভীষণ নার্ভাস। জীবনে এই পরিস্থিতিতে প্রথম। এক মুহুর্তের জন্য মনে হচ্ছিলো সবকিছু যেন শেষ হয়ে যাচ্ছে। আপুর মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। বাচ্চাটা বুঝতে পারছে না যে ওর বাবার সঙ্গে ঠিক কী হচ্ছে!
সকাল এগারো টার দিকে পেশেন্ট কে কেবিনে দেয়া হলে সবাই নিশ্চিন্ত হলো। সকাল হতেই অনেকে চলে গেছেন। তাদের থেকেও অবশ্য তেমন লাভ কিছু নেই। কিন্তু রঙ্গনা রা ছিলো। মিশুক শিলাকে বলল,
“আন্টি এবার আপনারা চলে যান। বাড়ির দিক টা দেখতে হবে তো। ”
শিলা রাজী হলেন। তিনি মিশুকের বাবা মা’কেও জোর করে নিয়ে গেলেন। তারা অনেক মুষড়ে পড়েছে। একটু রেস্টের দরকার।
মিশুক রঙ্গনাকেও বলল চলে যেতে। রঙ্গনা চলে যাবার আগে মিশুক কে বলল,
“তুমি ঠিক আছ?”
মিশুক তখনও ক্লান্ত বিধ্বস্ত। তবুও হাসার চেষ্টা করে বলল,
“এখন ঠিক আছি। ”
রঙ্গনা স্মিত হাসলো। আজ মেয়েটার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান। দুহাত ভর্তি মেহেদী পরেছে। পরিস্থিতি অন্যরকম না হলে মিশুক আজ ও’কে বলতো, রঙ্গনা তোমাকে রঙধনুর মতো সুন্দর লাগছে।
রঙ্গনা বলল,
“এখন যাই। কিছু দরকার হলে ফোন কোরো। ”
মিশুক স্মিত হেসে মাথা নাড়লো। রঙ্গনা কয়েক পা হেটে এগিয়ে যেতেই মিশুক ডাকলো,
“রঙ্গনা!’
রঙ্গনা পিছু ফিরে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো। মিশুক বলল,
“বেস্ট অফ লাক।”
রঙ্গনা হেসে বলল,
“থ্যাংক ইউ। ”
তুলি থেকে গেল হসপিটালে। মিশুকের বাবা, মা না আসা পর্যন্ত থাকবে। বাড়ি থেকে খাবার দাবার পাঠানো হয়েছে কিছু। মিশুক আর ওর বোন কিছুই মুখে তুলে নি।
***
রঙ্গনা বাড়ি ফিরে ঘুমালো। সারা রাত নির্ঘুম কেটেছে। রাফাতের সঙ্গে ওর কথা হয়েছে। সবকিছু বলেছে, সেই সঙ্গে এটাও বলেছে যে গায়ে হলুদের যে নাচ গানের প্ল্যান ছিলো সেটা বাদ। একটা মানুষ প্রায় মরতে বসেছে, হসপিটালে তার অবস্থা দেখে এখন নাচানাচি, আনন্দ কোনো কিছুর ম্যুড নেই। রাফাত সানন্দে মেনে নিয়েছে।
বাড়িতে সাউন্ড বক্স কাল রাত থেকে বন্ধ। হলুদ নিয়ে ওই বাড়ি থেকে বিকেলে আসবে। সেসবের আয়োজন চলছে। মিশুকের বাবা, মা ফ্রেশ হয়ে হসপিটালে গেলেন। জোর করে তাদের একটু খাওয়ানো হলো। তারা হসপিটালে যাবার পর তুলি এলো। বাড়িতে কাজ আছে এখনো, সেগুলো সামলাতে হবে।
***
স্বপ্নীল রক্ত দিলো প্রথমবার। অল্পতেই নার্ভাস হয়ে গেছিল। নি:শ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হলো। অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায় ওর নিজের ই লজ্জা লাগছিল। রঙ্গনা কঠিন গলায় বলল,
“এরপর থেকে তিন মাস পর পর রক্ত দিবি তুই। নাহলে খবর আছে। ”
স্বপ্নীল ভীষণ লজ্জা পেল। বাড়ি ফেরার আগে মিশুক কে সরি বলে এসেছে। মিশুক বুঝতে না পেরে বলল,
“সরি কেন স্বপ্নীল?”
স্বপ্নীল লজ্জায় আর বলতে পারে নি যে ও অজ্ঞান হয়ে গেছিল সেজন্য সরি বলছে।
ফেরার সময় স্বপ্নীল শ্রাবণ্যকে বলল, বাসায় যেন কাউকে না বলে যে ও রক্ত দিতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে। শ্রাবণ্য ভুলে আবারও হেসে ফেলল। বলল, আচ্ছা কাউকে বলব না।
***
আকাশীর সঙ্গে বাবা মায়ের দেখা হলো তিন বছরেরও বেশী সময়ের পর। দেখা হবার পরের ঘটনাটা খানিকটা নাটুকে হতে পারতো। মা এতদিন পর মেয়েকে দেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছেন। বাবা আদ্র চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়েছেন। সেসব কিছুই হলো না। মা তাকালেন শক্ত চোখে। যেই চোখের ভাষা আকাশী সহজেই পড়ে ফেলল। মানে ও এখানে কেন আছে! বাবা ওর দিকে তাকালেন না। তিনি দাদুর সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত। দাদু খেয়াল করলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, মুনসুর তোমার বড় মেয়ের সঙ্গে কথা বলো। সব জায়গায় জেদ খাটে না। তুমি ব্যবসায়ী মানুষ, তাই বলে সব জায়গায় শক্ত হবা এটার কোনো মানে নাই। ছেলে মেয়েদের ক্ষেত্রে তোমার আরও নরম হওয়া দরকার।
বাবা সেকথা বুঝলেন কিনা বোঝা গেল না। আকাশীও খুব একটা সামনে পড়ছে না। রেহানার খুব বিরক্ত লাগলো মেয়েকে দেখে। কী বেহায়া মেয়ে! লজ্জা থাকলে ওর কী এখানে আসা উচিত। দশজনের সঙ্গে দেখা হবে, নানান প্রশ্ন করবে। সেই প্রশ্নগুলোর জবাব দিতে গিয়েও বাবা মা’কে বিব্রত হতে হবে। এইটুক জ্ঞান মেয়ের থাকবে না।
***
রঙ্গনা ঘুম থেকে উঠে জানালো পার্লারে যাবে না। আকাশীর কাছ থেকে সাজবে। তাও বাড়াবাড়ি রকমের সাজের দরকার নাই। কোনোরকম সাজিয়ে দিলে হবে। আকাশী খুশি মনেই দায়িত্ব নিলো। শ্রাবণ্যও সঙ্গে আছে। রঙ্গনার কথা শোনা হলো না। হলুদের সাজ যেমন হয় তেমন ই হলো।
রাফাত দের বাড়ির লোকজন আসলো বিকেল শুরু হবার পর। এদের যে লোকজনের জ্ঞান নেই সেটা আবারও বোঝা গেল। পঞ্চাশের মতো মানুষ এসেছে। রাফাতের খালা আজও এসে পান সুপুরির বক্স নিয়ে বসলেন। রাফাতের মা এসেছেন আজ। তিনি একটু বিরক্ত। এসে দেখলেন বাড়িতে গান, বাজনার আয়োজন নেই, হৈ হুল্লোড় নেই।
মামী আজও খুব সেজে এসেছেন। কোমড়ে বিছা পরতেও ভুল করেন নি। তার মুখের অতিরিক্ত মেকাপের জন্য তাকানো যাচ্ছে না৷ শ্রাবণ্য আকাশীর কানে কানে বলল, বিয়ে আর বউভাতে কীরকম সাজবে সেটার অপেক্ষায় আছি।
উনি এসে আজও বললেন, রঞ্জনা মেকাপ কোন পার্লার দিয়া করছ ভালো হয় নাই।
রঙ্গনা হেসে বলল, মামী আসলে আমার চেহারা ভালো না। চেহারা ভালো হইলে মেকাপ ভালো হইতো।
শ্রাবণ্য এখানেও ভুল করে হেসে ফেলল।
স্বপ্নীল এবার খুব সচেতন। রাফাত দের বাড়ি থেকে আসা ছেলেগুলোর দিকে খুব নজর রাখছে। ছেলেগুলো আজ অতি সাবধানী। ওদের অন্য প্ল্যান আছে সেটা পরশুর জন্য তোলা। আপাতত ভালো মানুষের অভিনয় চালিয়ে যেতে হবে।
রাফাতের মা, খালা, মামী কারোরই গায়ে হলুদের আয়োজন পছন্দ হয় নি। পেয়িং গেস্ট এর ফ্যামিলি ক্রাইসিসে এদের কেন এতো শোকতাপ সেটা নিয়ে খানিকক্ষণ গুজগুজ করলো। তার উপর রঙ্গনার অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি তাদের পছন্দ হচ্ছে না। এতো খরচ করে বিয়ে করার কোনো মানে আছে। বিয়েতে বিশ হাজারের লেহেঙ্গাও তার পছন্দ না, পঞ্চান্ন হাজারে লেহেঙ্গা কিনতে হলো। গোল্ড প্লেটের গয়নার দামও লাখের উপর। ওই টাকায় সোনার গয়না হয়ে যেত এক ভরি আন্দাজ। তারপর বউভাতের জন্য কাস্টমাইজড শাড়ি। সেটার খরচও পয়ত্রিশ হাজারের উপরে। মানে এতো পয়সা খরচের মানে হয়! পঞ্চান্ন হাজারের লেহেঙ্গা তো তুই একদিন ই পরবি। এমন ভারী লেহেঙ্গা পরে কোথায় যাবি এরপর। তাছাড়া এতো খরচ করে বিয়ের ই বা কী আছে! বিয়েশাদি তে আল্লাহর রহমত টাই আসল। দুটো পয়সা থাকলে সেটা ব্যাংকে জমাবি। বলে কিনা বিয়েতে শখ পূরণ করবে! এতো শখ ই বা কিসের!
রাফাতের মা বিরক্ত রীতিমতো। বান্ডেল বান্ডেল টাকা গচ্ছা যাচ্ছে। এই বাড়ি থেকে ফার্নিচার কিছু এখনো যায় নি। আগ বাড়িয়ে কিছু বলাও যায় না। মেয়ে মুখরা আছে ভালোই। তাছাড়া এখন মনে হচ্ছে বিয়েতে রাজী হয়ে ভুল করেছে। এই মেয়ে গত দুই সপ্তাহে রীতিমতো মাথায় উঠে নেচেছে বিয়ের শপিং নিয়ে। বাড়ি থেকে গয়নাগাটি, ফার্নিচার কেমন কী যাবে কে জানে! সোসাইটিতে মান থাকবে তো। গুলনাহার ভাবীর ছেলের বিয়েতে একটা ফ্ল্যাট দিয়েছে একদম গুছিয়ে। গা ভর্তি গয়না, গাড়িও নাকি দিবে।
এই বিয়েতে রাজী হবার কারণ ছিলো দুটো। একটা ছেলের পছন্দ। বদমায়েশের বাচ্চা কোনো মেয়েকে পছন্দ করে উঠতে পারছিল না। গাছ বাওয়া মেয়ে পছন্দ হলো। দ্বিতীয় কারণ পরিবার। মা উচ্চশিক্ষিত। কলেজের প্রিন্সিপাল। বাবার সম্পদও কম নয়। ভালুকায় বিশাল সম্পত্তি আছে মায়ের। তাছাড়া সোসাইটিতে চালানো যাবে। মেয়েও যথেষ্ট স্মার্ট। এখন মনে হচ্ছে একটু বেশি প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে।
রাফাতের মামী মায়ের কানে বিষ ঢালার দায়িত্বটুকু পালন করলেন। বললেন,
“আপা মেয়ের কথাবার্তা দেখছেন! একদম মানুষ রে গোনায় ধরে না। রাফাত রে কী দেখাইয়া ভুলাইছে। এখন পা আসমানে তুলে হাটে। বাড়ির লোকজনও কেমন। কে না কে মরছে, তাদের আত্মীয়ও না, অথচ নাটক করতেছে। দুই আনার দাম আমাদের দিতাছে না। ”
রাফাতের মা চুপ করে রইলেন। এই বিষয় নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে। এখন বাকী নাটকটুকু হজম করে নিক।
***
গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান হলো নির্বিঘ্নে। রাফাত দের বাড়ি থেকে আসা মহিলাদের আচরণ সন্দেহজনক মনে হলো শিলার। এদের মুখে হাসি নেই। একটু পর পর নিচু গলায় ফিসফাস করছে। শিলার হঠাৎ ভয় হলো। বিয়ে ঠিক হবার পর ভেঙে গেলে সমস্যা নেই। কিন্তু গায়ে হলুদের পর ঝামেলা হলে….! এই ভয়টা যেন অমূলক ই হয়। রঙ্গনা বিয়ে নিয়ে এতো খুশি! এই খুশিটুকু যেন থাকে।
***
পরদিন রাফাতের গায়ে হলুদে ওরা গেল।শ্রাবণ্য, তুলি, স্বপ্নীল, রিন্টি মন্টি। সব আয়োজন ঠিকঠাক থাকলেও ওদের আচরণ টা খটকা লাগার মতো। একটু কেমন যেন। শরবতে ট্যাঙের পরিবর্তে হলুদ মরিচ দিলো। এমন রসিকতা নাকি হয়েই থাকে বিয়ে বাড়িতে। খাবার খেতে বসার পর প্রত্যেকের মুখে স্নো স্প্রে করলো। পুরোপুরি হেনস্তা করলো। তুলি প্রথমে কিছু না বললেও পরে কড়া গলায় বলল, এসব ঠিক কী হচ্ছে? আর আপনারা বড় রাও মনে হচ্ছে ব্যাপার টা খুব এনজয় করছেন?
রাফাত এসে কাজিন দের ধমকাধমকি করলো ভীষণ। মামী এসে বললেন, বিয়ে বাড়িতে তো এসব হরহামেশাই হয়। আমার বিয়ে হইছিল মাঘ মাসে। বিয়ের পর দিন আমার চাচাতো দেবর কোলে করে পুকুরে ফালায়ে দিছিল। আমরা তো এমন মাইন্ড করিনি। এখন সবেতে বাড়াবাড়ি।
তুলি আর কিছু বলল না। রাফাত কেও বলে আসলো যে এই বিষয়ে রঙ্গনাকে কিছু না জানাতে। রঙ্গনার অল্পে মেজাজ গরম হয়। কালকের দিন টা দেখা যাবে ম্যুড অফ করে থাকবে।
***
রঙ্গনা হসপিটালে এসেছে। সঙ্গে আকাশী। মিশুকের সঙ্গে চোখাচোখি হলো। বিয়ের সময় মেয়েদের স্নিগ্ধ লাগে। রঙ্গনাকেও আজ সুন্দর লাগছে। একদম অন্যরকম। ও অবশ্য বেশীক্ষন থাকলো না। চলে এলো। বাসায় আসার পর দেখলো শ্রাবণ্যরা চলে এসেছে। রিন্টি, মন্টিকে সারা রাস্তা মুখস্থ করিয়ে এনেছে যেন বাসায় এসে কিছু না বলে। ওরা রঙ্গনাকে দেখেই সব ঘটনা গড়গড় করে বলে দিলো।
রঙ্গনা রাগের পরিবর্তে মন খারাপ করলো। ওই বাড়ির মানুষজন অন্যরকম। সেটা ওর মাথা ব্যথার বিষয় না। রাফাত আগেই বলেছে কারোর সঙ্গে ককম্প্রোমাইজ করে থাকতে হবে না। ওরা থাকবে ওদের মতো। তাই এখন এগুলো দেখেও না দেখার ভান করে যেন থাকে। কিন্তু সব ব্যাপারে অন্ধ সেজে থাকার ভান করা যায় না। এইসব ছোট ছোট খারাপ লাগা গুলো মনে থেকে যায়।
****
শিলা যে ভয়টা পাচ্ছিলেন সেটাই হলো। বরযাত্রী আসবে সন্ধ্যার দিকে। রঙ্গনার ঘুম ভাঙলো দশটায়। খেয়েই পার্লারে যাবে। আকাশী সব গুছিয়ে রেখেছে। রঙ্গনা ঘুম থেকে উঠে ফোন টা হাতে নিয়ে রাফাত কে ফোন করলো। প্রতিদিন ও একবার ফোন করে, রিসিভ না হলে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিয়ে রাখে। আজ ব্যতিক্রম হলো। রঙ্গনা ফোন করে পেল না। অল্পতে ও অস্থির হয় না, কিন্তু আজ বিশ মিনিটেও না পেয়ে অস্থির হলো। বাড়ি ভরা আত্মীয় স্বজন। ও গিয়ে মা’কে ব্যাপার টা জানালো। শিলা আগে থেকেই ভয়ে ছিলেন। তবুও নার্ভাসনেস মেয়েকে বুঝতে দিলেন না। বললেন,
“এতো অস্থির কেন হচ্ছিস? ওর মা’কে একবার ফোন করে দেখ। ”
“তুমি করো মা। ”
শিলা আর প্রশ্ন করলেন না মেয়েকে। নিজে ফোন করলেন। রাফাতের মা ফোন ধরে স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
“হ্যালো কে?”
শিলা মৃদু হেসে বললেন,
“কী আশ্চর্য! আমার ফোন নম্বর টি আপনার ফোনে সেভ করা না।”
ফোনের ওপাশে থতমত খায় রাফাতের মা। বলেন,
“আরে আপা কাজের বাড়ি। খেয়াল করি নাই তো। ”
“রাফাত কোথায়? ও’কে তো পাওয়া যাচ্ছে না ফোনে।”
“কই যেন গেল সকালে উঠে। বলল বারোটার দিকে আসবে। ”
শিলা নিশ্চিন্ত হলেন। এতক্ষন তার মনের মধ্যে কী চলছিল সেটা কেবল তিনি ছাড়া আর উপরওয়ালাই জানতেন। রঙ্গনা পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো। শিলা বললেন,
“চিন্তা করিস না তো। তুই যা এখন। ও নাকি কোন কাজে বেরিয়েছে। পরে ফোন করবে। ”
রঙ্গনা পার্লারে গেল। ওর টেনশন দূর হচ্ছে না। রাফাতের সঙ্গে কথা না বলা অবধি শান্তি পাবে না। কোনো কারণ ছাড়াই ওর ভীষণ অস্থির লাগতে শুরু করলো।
***
রাফাতের মা, মামী আর খালা ছাড়া আর কেউই জানেন না যে কোথায় আছে ও। এইটুকু রিস্ক তাদের নেয়ার দরকার ছিলো। বিয়ে ভাঙলে তাদের ছেলের তেমন কিছু হবে না। ছেলেদের এসবে কিছু হয় না। বউ বাচ্চা থাকা পুরুষও হাসতে খেলতে একাধিক বিয়ে করতে পারে। ঝামেলা হয় মেয়েদের। খুব ই দিল দরদিয়া পরিবার। কে না কে মরছে তাতে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান বন্ধ রাখছে। এখন সবাই কান্নাকাটি করুক গলাগলি করে। ঠাস ঠাস কথা বলা মেয়েটার গলা দিয়ে কেমন আওয়াজ বের হয় সেটাও দেখা যাবে। রাফাত কে কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ দেয়া হইছে। আজ সারাদিনে, রাতে ঘুম ভাঙবে না। বেহুশ হয়ে ঘুমাবে। ঘুমাক বেচারা। কোথায় আছে কেউ জানেও না। মামীর বাসায় নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। বিয়েশাদির ঝামেলায় ওদিকে কেউ যাবেও না। এখন ঘরের ব্যটাগুলোকে ম্যানেজ করতে হবে। এদের বোধ কম আবেগ বেশী। এইগুলারে ম্যানেজ করতে হবে।
চলবে….