কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব-০৭

0
1733

#কুয়াশা_মিলিয়ে_যায়_রোদ্দুরে
#পর্ব_৭
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা

“আপনি কী এখানে প্র্যাকটিস করতে এসেছেন?”

আচানক কোনো ছেলের কন্ঠ শুনে পেছন ফিরে তাকায় কুয়াশা। তার সামনে একটা ছেলে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। কুয়াশা মা থা নেড়ে বোঝায়, হ্যা! ছেলেটা আবারো বলে,

“আমিও রাজিব স্যারের কাছে প্র্যাকটিস করতে এসেছি।”

“আমি কী আপনার কাছে জানতে চেয়েছি কিছু?”

কুয়াশার এমন কথায় ছেলেটা হেসে উত্তর দেয়,

“মেয়েরা তো জানতে চায় না। কিন্তু ছেলেরা জানতে চায়।”

“মানে?”

“মানে আপনার নাম কী?”

“সেটা জেনে আপনি কী করবেন হ্যা?”

“একসাথে কাজ করতে এসেছি আর নাম জানতে হবে না?”

“না, জানতে হবে না।”

“আচ্ছা আমার নাম সাফওয়ান। আমি ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করেছি।”

“খুব ভালো করেছেন। এখন আমি কী করতে পারি?”

“একা একা বসে থেকে খুব বিরক্ত লাগছিল। তাই ভাবলাম আপনার সাথে একটু পরিচিত হই।”

“একটু পরিচিত হবেন? মানে পুরোপুরি না। একটু?”

“হ্যা। আপাতত নামটুকু বললেই খুশি হব।”

কুয়াশা সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,

“কুয়াশা।”

“কুয়াশা! কি সুন্দর নাম!”

আর কিছু বলার আগেই ঢাকার সনামধন্য একজন উকিল মিস্টার রাজিব হাসান নিজের ঘরে প্রবেশ করেন। কুয়াশা আর সাফওয়ান উঠে দাঁড়িয়ে তাকে সালাম দেয়।

“আসসালামু আলাইকুম স্যার।”

“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। বসো তোমরা।”

অতঃপর তিনজনই নিজেদের চেয়ারে বসে। রাজিব হাসান বলে,

“তোমরা আমার কাছে এসেছ কাজ শেখার জন্য।”

“জি স্যার।”

“আগামী ছয় মাস তোমরা আমার সাথে থাকবে। এই ছয় মাস নিজেদের সমস্ত মনোযোগ কাজে দিতে হবে। উকিল হওয়া যতটা সহজ মনে হয়, ততটা সহজ নয় এই পেশা। সৎ পথে থেকে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য নিজেদের আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে। কি পারবে তো?”

“নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।”

কুয়াশার সাথে সাথে সাফওয়ানও একই সুরে বলে,

“অবশ্যই পারব স্যার।”

রাজিব হাসান তাদের দু’জনকে সবকিছু বুঝিয়ে দিতে দিতে দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় হয়ে যায়। অনেক্ক্ষণ যাবত কোনো কিছু না খাওয়ার ফলে কুয়াশার এখন প্রচুর ক্ষুধা লেগেছে। সে বাইরে বের হয়ে এদিক-সেদিক তাকিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে চলে যায়। ফাঁকা জায়গা পেয়ে সেখানে বসার একটু পরেই সাফওয়ান এসে হাজির। কুয়াশা আপনমনে বিরবির করে বলে,

“এই ছেলে আমার পেছনে এমন আঠার মতো লেগে আছে কেন! কি যে বিরক্ত লাগছে আমার। এমন গায়ে পড়া স্বভাবের ছেলে দেখলে ঠাস করে দুইটা লাগিয়ে দিতে ইচ্ছা করে।”

নিজের মনে কথাটা বলে এবার সাফওয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“আচ্ছা আপনার সমস্যা কী? আমার পেছন পেছন এখানে চলে এসেছেন কেন? আর কোনো জায়গা নেই নাকি?”

“আরে আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন? আমি তো খাবার খেতে এসেছি এখানে।”

“তো আরো অনেক ফাঁকা জায়গা আছে। সেখানে গিয়ে বসুন।”

“এখানে তো আর কোনো ফাঁকা জায়গা নেই। আপনিই চারপাশে তাকিয়ে দেখুন।”

কুয়াশা এবার চারপাশে তাকিয়ে খেয়াল করে দেখে সত্যিই বাকি জায়গাগুলোতে মানুষ আছে। একমাত্র কুয়াশার পাশের চেয়ার ফাঁকা। কুয়াশা সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,

“বসুন।”

সাফওয়ান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চেয়ারে বসে। সে ভেবেছিল কুয়াশা তাকে বসতেই দিবে না। কিছুক্ষণ পর ওয়েটার মেনু কার্ড দিয়ে যায় তাদেরকে। সাফওয়ান জিজ্ঞেস করে,

“কী খাবেন?”

“আমাকে মেনু কার্ড দিন। আমি দেখে নিচ্ছি।”

অগত্যা সাফওয়ান কুয়াশার হাতে মেনু কার্ড দিয়ে দেয়। কুয়াশা নিজের জন্য একটা হোয়াইট সস পাস্তা এবং একটা সাব স্যান্ডউইচ অর্ডার করে। সাফওয়ান একটা প্ল্যাটার অর্ডার করে। ওয়েটার যাওয়ার সময় বলে যায় খাবার আসতে বিশ মিনিটের মতো সময় লাগবে।

কুয়াশা চুপচাপ বসে ছিল। এমন সময় তার ফোনে কল আসে। রায়াদ কল দিয়েছে। কুয়াশা ফোন নিয়ে একপাশে এসে কল রিসিভ করে।

“বলুন কেন কল দিয়েছেন?”

“কুয়াশা আমি কালকের ব্যবহারের জন্য দুঃখিত। আসলে ওই সময় আমার মা থ ঠিক ছিল না।”

“আমি কিছু মনে করিনি। দুই বছর এসব সহ্য করতে করতে অভ্যস্ত তো এখন আমি।”

“এবারের মতো মাফ করে দাও আমাকে।”

“হ্যা, আমি তো দয়ার সাগর নিয়ে বসে আছি। সবাই আমাকে কষ্ট দিবে। তারপর মাফ চাইবে। আর আমি আমার দয়ার সাগর থেকে কিছুটা দয়া তুলে তার হাতে দিয়ে বলব, যাও তোমাকে দয়া করে মাফ করে দিলাম।”

“এভাবে বলছ কেন?”

“তো আর কীভাবে বলব?”

“আচ্ছা শোনো আমি দেখা করতে চাই তোমার সাথে।”

“একদম না।”

“জরুরি কথা আছে তোমার সাথে।”

“যা জরুরি কথা আছে সেটা ফোনেই বলুন। নয়তো বলতে হবে না।”

“আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই কুয়াশা।”

“লজ্জা করে না আপনার? একজন বিবাহিত মেয়েকে এসব কথা বলছেন।”

“তুমি তো তুরাবের কাছে ভালো নেই।”

“কে বলেছে আপনাকে এই কথা? আমি আমার স্বামীর সাথে খুব ভালো আছি। আপনারও তো বিয়ের বয়স হলো। এবার নিজেও বিয়ে করুন। আর বউ নিয়ে সুখে থাকুন। অন্যের বউয়ের দিকে নজর দিয়ে নিজের চরিত্র খারাপ কেন করছেন?”

“তুমি ভেবে বলছ তো এসব?”

“অবশ্যই ভেবেই বলছি। আমি আপনার মতো যখন যা মুখে আসে তখন সেটাই দুম করে কাউকে বলি না। যে ছেলে সম্পর্কে থাকাকালীন আমাকে অপমান, মানসিক অশান্তি, কষ্ট, চোখের পানি, এসব ছাড়া কিচ্ছু দেয়নি সেই ছেলেকে আমি কোন দুঃখে বিয়ে করব?”

“ভেবেছিলাম তোমাকে আরো একটা সুযোগ দিয়ে একসাথে থাকব। কিন্তু তুমি তো এসব চাও না। বোনের প্রাক্তন এত সুখ দিল যে আমাকে এখন তিক্ত লাগছে?”

“ভদ্রভাবে কথা বলুন। অবশ্য আপনার মতো লাগামহীন ছেলের কাছে ভদ্রতা আশা করা বোকামি। শুনুন, আমি নিজেকে শেষ করে দিলেও কখনো আপনার কাছে যাব না। আপনার মতো মানুষের সাথে থাকা যায় না। অন্তত আপনার থেকে তুরাব অনেক ভালো। মেয়েদের সম্মান করতে জানে। আপনি তো সেটাও জানেন না।”

“মুখ সামলে কথা বলো কুয়াশা।”

“সত্যি কথা গায়ে লাগছে খুব তাইনা? আপনি আর কখনো আমাকে কল দিবেন না। ভুলে যান আমাকে। আর যত দ্রুত সম্ভব বিয়ে করে নিন। ওহ্ ভালো কথা, বউকে সম্মান এবং ভালোবাসা দিয়ে যত্ন করে রাখবেন কেমন? আমাকে তো অসম্মান আর অবহেলা ছাড়া কিছু দিতে পারেননি। তাকে ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখবেন আশা করি। ভালো থাকবেন।”

বরাবরের মতোই রায়াদকে কিছু বলতে না দিয়ে কুয়াশা কল কেটে দিয়ে নাম্বার ব্লক করে দেয়। এই অশান্তি আর ভালো লাগছে না তার। সব অশান্তি যেন তার জীবনে এসে ভীড় করেছে।

“বোনের প্রাক্তনকে বিয়ে করে আমার জীবন অর্ধেক শেষ। এখন নিজের প্রাক্তনকে বিয়ে করলে আমার পুরো জীবনটাই শেষ হয়ে যাবে। এক ভুল বারবার আমি কখনোই করব না।”

কথা বলা শেষ করে নিজের চেয়ারে বসার পর সাফওয়ান বলল,

“ভালোবাসার মানুষ কল দিয়েছিল নাকি?”

“এটা জানা কী আপনার খুব জরুরি?”

“সেটা কখন বললাম আমি?”

“ভালোবাসার মানুষ থাকলে তো কল দিবে।”

“আপনার কেউ নেই? এটা তো বিশ্বাস করার মতো কথা হতে পারে না।”

“আপনি বিশ্বাস করবেন নাকি করবেন না এটা আপনার ব্যাপার। এখন আপনার এই বকবক একটু থামান।”

“বিরক্ত হচ্ছেন?”

“জি বিরক্ত হচ্ছি আমি।”

“আমি কথা বলতে ভালোবাসি। অনেক্ক্ষণ কথা না বলে চুপচাপ বসে থাকতে পারি না আমি।”

এই কথাটা শুনে কুয়াশার মন খারাপ হয়ে যায়। একটা সময় সে নিজেও প্রচুর কথা বলত। কথা বলতে বলতে সবাইকে পাগল বানিয়ে ফেলত। অথচ পরিস্থিতির চাপে আজ সে নিশ্চুপ।

কুয়াশা সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,

“কথা বলতে ভালোবাসেন আপনি?”

“হ্যা ভীষণ।”

“কথা বলা মানুষগুলো হঠাৎ করে চুপচাপ হয়ে গেলে একদম ভালো লাগে না। আপনি কথা বলুন। আমার কোনো সমস্যা নেই।”

যে মেয়েটা একটু আগেই চুপ থাকতে বলছিল তার মুখে এমন কথা শুনে খানিকটা অবাক হলেও কথা বলার অনুমতি পেয়ে খুশি হয়ে যায় সাফওয়ান। কুয়াশা তার মুখে এমন হাসি দেখে নিজেও মুচকি হাসে।

চলবে??

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে