কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব-০২

0
3022

#কুয়াশা_মিলিয়ে_যায়_রোদ্দুরে
#পর্ব_২
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা

বিকালে বিশুদ্ধ বাতাস গায়ে লাগানোর আশা নিয়ে ছাদে উঠতেই শুনতে পাই তুরাব কাউকে কলে বলছে,

“শোনো তিন্নি তুমি হেরে গিয়েছ। তুমি নাকি কখনো হারতে শেখোনি? আজ দেখ তুমি আমার কাছে হেরে গেলে। তোর ফুপাতো বোনকে ব্যবহার করে তোমাকে হারিয়ে দিলাম আমি। কীভাবে জানো? তুমি আমাকে স্পর্শ করার জন্য অপেক্ষা করেছ। কিন্তু আমায় ছুঁতে পারোনি। আর তোমার বোন কোনো অপেক্ষা ছাড়ায় আমাকে কাছে পেয়েছে। কতটা কাছে পেয়েছে জানো? স্বামী-স্ত্রী যতটা কাছে আসতে পারে ঠিক ততটাই কাছে এসেছি আমরা দু’জন। আজ কোথায় গেল তোমার জেতার অহংকার? ফয়সাল নিশ্চয়ই আমার মতো সবদিক দিয়ে সেরা নয়। তুমি অপরূপ সুন্দর হয়েও আমার মতো সেরা একজনকে পেলে না। আর তোমার বোন তোমার মতো আহামরি সুন্দর না হয়েও আমাকে পেয়ে গেল। তবে কী জানো তিন্নি? তোমার থেকে কুয়াশা অনেক ভালো। ওর সাথে এতদিন ভালোবাসার নাটক করলেও এটুকু বুঝেছি যে তুমি ওর মতো সবদিক দিয়ে সুন্দর নও। অন্তত ওর মন তোমার থেকে অনেক সুন্দর। তাহলে আমার প্রাক্তন প্রেমিকা তার প্রাক্তন প্রেমিক এবং ফুপাতো বোনের কাছে হেরে গেল। শেষ হাসি আমিই হাসলাম হাহাহাহাহ!”

আরো অনেক কথা হয় ওদের মধ্যে। আপু ওকে কি বলেছে সেটা আমি জানি না। কিন্তু আমি তুরাবের প্রতিটা কথা শুনে চমকে গিয়েছি। ওকে মন থেকে বিয়ে না করলেও প্রায় আট মাস একসাথে থাকার পর আমার মনের কোণে কিছুটা হলেও সুপ্ত অনুভূতি তৈরি হয়েছে ওর জন্য। ভেবেছিলাম আমি ওকে একটু হলেও পাল্টাতে পেরেছি। আফসোস! সে একটুও পাল্টায়নি। কিন্তু একটা কথা মানতেই হবে। তুরাব অভিনয়ের দিক থেকে অসাধারণ একজন। অভিনয়কে নিজের কর্মক্ষেত্র বানাতে পারলে অভিনেতা হিসেবে নিজের যোগ্যতা ভালোভাবেই প্রমাণ করতে পারবে সে।

কুয়াশার কথা শুনে মলি কিংবা মিসেস নাহার কেউই বুঝে উঠতে পারে না যে কিভাবে কুয়াশাকে স্বান্তনা দেবে। মলি কুয়াশার পাশে বসে ওর হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,

“কলি কষ্ট পাবি না একদম। তুই না মলির কলি। তোকে তো ভেঙে পড়া মানায় না দোস্ত।”

কুয়াশার চোখ বেয়ে টুপটুপ করে পানি পড়ে। কয়েকবার লম্বা শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করে সে। অতঃপর হেসে বলে,

“আমি কষ্ট পাব না। তবে এত বড়ো ধাক্কা মেনে নিতে সময় তো লাগবে। কিছুটা সময় দরকার আমার। চিন্তার কিছু নেই। আমি নিজেকে ঠিক সামলে নিব। আমি একটু ঘরে যাচ্ছি।”

কথাটা বলে কুয়াশা নিজের ঘরে চলে যায়। এখন রাত প্রায় নয়টা। কুয়াশার বাবা আর ভাইয়ের বাড়িতে আসার সময় হয়ে গিয়েছে। মিসেস নাহার মলিকে আজ রাতে কুয়াশার সাথে থাকার জন্য অনুরোধ করে রান্নাঘরে চলে যায় খাবার তৈরি করার জন্য। মেয়ের এমন অবস্থায় তার কোনোকিছুই ভালো লাগছে না। একমাত্র মেয়ের সামান্য কষ্ট হলেও তার বুকের ভেতর ব্যাথা শুরু হয়ে যায়। সেখানে এত বড়ো সত্যি মেনে নেওয়া কষ্টসাধ্য ব্যাপারই বটে!

কুয়াশা বিছানায় শুয়ে আছে। মলি কুয়াশার মা থা র পাশে বসে আলতো হাতে চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। এমন সময় কুয়াশার ফোন বেজে ওঠে। ফোন হাতে নিয়ে দেখে স্ক্রিনে নাম ভেসে উঠেছে,

“তিন্নিপু”

কুয়াশা ফোন হাতে নিয়ে উঠে বসে কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তিন্নি চিৎকার করে বলে,

“লজ্জা করল না তোর এসব করতে? নিজের আপুর সাথে এমন বিশ্বাসঘাতকতা কীভাবে করলি তুই?”

কুয়াশা কিছু বুঝতে না পেরে পাল্টা প্রশ্ন করে,

“কী বলছ কী এসব তুমি?”

“একদম না বোঝার ভান করবি না কুয়াশা। বিয়ের দিনই তোকে আমি বলেছিলাম তুরাবের কাছে না যেতে। অথচ তোরা এতটা কাছাকাছি চলে গেলি যে,,,”

“থাক আপু তোমাকে আর কিছু বলতে হবে না। বুঝেছি আমি তুমি আসলে কি বলতে চাও। কিন্তু তোমার কথা কেন রাখব আমি? নিজে তো ঠিকই প্রাক্তনকে ভুলে প্রাক্তনের বন্ধুর সাথে সংসার করছ। শুনলাম তুমি নাকি আবার মা হতে যাচ্ছ। এতকিছুর পরেও প্রাক্তনের দিকে চোখ দিতে লজ্জা করে না তোমার? তাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য আমাকে ব্যবহার করলে তুমি। কেন বলো তো? আমি তোমার আপন বোন নই বলে এত বড়ো চক্রান্ত করলে? আরে তোমার যদি নিজের প্রাক্তনের উপর এত রাগ তাহলে আমাকে আগেই সব বলে দিতে পারতে। বিয়ের আগে এসব বললে আমি তুরাবকে বিয়েই করতাম না।”

“এজন্যই তো বলিনি। তোর তো সবার সামনে ভালো সাজতে হবে। একদম নিষ্পাপ মেয়ে সেজে ঘুরে বেরাস। আমি যদি আগেই সব বলে দিতাম তাহলে তুই তুরাবকে বিয়ে করতি না। আর আমার পরিকল্পনা ভেস্তে যেত।”

“বাহ আপু বাহ! কতটা স্বার্থপর তুমি এটা ভাবতেই লজ্জা করছে আমার। আর কী বললে? আমি নিষ্পাপ হয়ে ঘুরে বেড়াই? সত্যি বলতে আমার নিষ্পাপ সাজতে হয় না। আমি এমনিতেই কারোর ক্ষতি চাই না। কিংবা নিজের চরিত্রকে নিলামে তুলি না তোমার মতো। তাই আমি বরাবরই এমন। নাটক করে ভালো সাজার প্রয়োজন হয় না আমার।”

“মুখ সামলে কথা বল কুয়াশা। তোর মতো বোনের প্রাক্তনের সাথে ঘনিষ্ঠ হইনি আমি।”

“বিয়ে করা বরের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়েছি আপু। তোমার মতো একসাথে দুইজনের সাথে সম্পর্ক চালাইনি আমি। আগে নিজেকে দেখ। তারপর আমাকে এসব বলতে আসবে। যার নিজের চরিত্র ঠিক নেই সে আমাকে এসব বলার অধিকার রাখে না।”

“কুয়াশা!”

“চিৎকার করে লাভ নেই। সত্যি মেনে নিতে কবে শিখবে? তোমার জন্য আমার জীবনে অশান্তি নেমে এসেছে। তোমার কথা শুনে তুরাবকে বিয়ে না করলে আজ আমি খুব সুখে থাকতে পারতাম। আমার সাথে যা করেছ তারপর তোমার সাথে কথা বলার ইচ্ছা বা রুচি কোনোটাই আমার নেই। তুমি আমার সুখ সহ্য করতে না পারলেও আমি বরাবরই চাই, ভালো থাকো তুমি। অনেক সুখী হও নিজের বিবাহিত জীবনে। আর কখনো আমাদের কথা না হলেই ভালো হয়।”

কথাগুলো বলে ফোন রেখে দিয়ে কুয়াশা মলির কাঁধে মা থা রাখে। খারাপ সময়গুলোতে মায়ের পাশাপাশি এই মেয়েটা ছায়ার মতো তার সাথে থাকে।

“মলি জানিস, আমি তিন্নি আপুকে নিজের বোনের চোখে দেখতাম। কখনো ওর খারাপ চাইনি। ওর যেকোনো বিপদে নিজের সমস্যা হলেও ওর পাশে থেকেছি। আর সেই বোন আমার সাথে কী করল? তুরাব একা আমাকে কষ্ট দিলে মেনে নিতাম। এত বেশি কষ্ট হতো না যতটা এখন হচ্ছে। আপন মানুষের থেকে পাওয়া আঘাত হয়তো এমনই হয়। যে আঘাত একজনকে ভেঙে দেয়।”

মলি কিছু বলে না। এই অবস্থায় প্রিয় বান্ধবীকে শান্ত করার উপায় তার জানা নেই। তবুও কিছু একটা ভেবে কুয়াশাকে জিজ্ঞাসা করে,

“আচ্ছা তুই তুরাব ভাইয়ার সাথে সম্পর্ক রাখবি নাকি রাখবি না?”

কুয়াশা শান্ত কণ্ঠে জবাব দেয়,

“এত জঘন্য একজনের সাথে এক ছাদের নিচে থাকা কী সম্ভব?”

“এজন্যই প্রশ্নটা করলাম। তুই এখন কী করতে চাচ্ছিস? তুরাব ভাইয়াকে ডিভোর্স দিবি?”

মলির কথায় কুয়াশা হাসতে হাসতে বিছানায় শুয়ে পড়ে। যেন মলি খুব মজার কিছু বলেছে।

“কী হলো? তুই হাসছিস কেন? এমন কঠিন পরিস্থিতিতেও তোর হাসি পাচ্ছে?”

“হাসির মতো কথা বললে হাসব না? আমি কোন দুঃখে ওকে ডিভোর্স দিতে যাব? আমি তো তুরাবকে ডিভোর্স দিব না।”

“তুই ওর সাথে থাকবি না। তাহলে এই সম্পর্ক রেখে কী করবি?”

“ওকে ডিভোর্স দিয়ে মুক্ত করে দিব? আমি গুমরে গুমরে শেষ হয়ে যাব আর সে মুক্ত পাখির ন্যায় আকাশে উড়বে? আমি এটা কখনোই হতে দিব না মলি, কখনোই না!”

চলবে??

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে