কুয়াশার মতো পর্ব-০৬

0
634

#কুয়াশার_মতো
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৬

সন্ধ্যা সাতটার দিকে ওসি সাহেব এলেন। সঙ্গে দুজন কনস্টেবল। বিল্ডিংয়ের সবাই এক জায়গায় বসে আছে। শুনেছি পো’স্ট’ম’র্টে’ম রিপোর্ট এসেছে। ওসি সাহেব গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

” চৈতীর আত্মীয়দের মধ্যে কে কে আছেন?”

রাতুল সোহাগের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। এগিয়ে গিয়ে বললো,

” আমি রাতুল। চৈতীর স্বামী, ওর পরিবারের বেশিরভাগ লোক এখানে উপস্থিত আছে। ”

” খু”নের দিন রাতে কোথায় ছিলেন ?”

“গতকাল দেশে ফিরেছি। বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম। ”

” উনার সাথে কেউ ছিল না?”

” না। সবাই ওর মৃ’ত্যুর খবর শুনে এসেছে। ”

” আপনাদের বৈবাহিক সম্পর্ক কেমন?”

” জ্বি, ‘

” স্পষ্ট ভাষায় প্রশ্ন করেছি, না বোঝার মতো কিছু নেই। এতোদিন পর দেশে ফিরে বউয়ের সাথে দেখা না করেই গ্রামে চলে গেলেন। ব্যাপারটা রহস্যময়। ”

” বৈবাহিক সম্পর্ক বেশ ভালো ছিল। কখনো তেমন মনোমালিন্য হয়নি। ”

” আপনার কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, তবুও আপাতত মেনে নিচ্ছি। বিল্ডিংয়ের সবার ধারণা সোহাগ সাহেবের সঙ্গে চৈতী দেবী সম্পর্কে জড়িয়ে ছিলেন। এ ব্যাপারে আপনার কি মত?”

” সোহাগ আমার স্কুল জীবনের বন্ধু। সে-ই সুবাদে চৈতীর খোঁজ-খবর রাখতো। এ থেকে বেশি কিছু আমার জানা নেই। বলতে পারবো না। ”

” আপনার ফ্লাইটের টিকিট, ভিসা এসব কাগজপত্র দেখতে হবে। সময় করে থা’নায় আসবেন। ”

” আপনি কি আমাকে স’ন্দে’হ করছেন? ”

” আমি সবাইকে স’ন্দেহ করি। পো”স্ট”ম”র্টে”ম রিপোর্ট অনুযায়ী চৈতীকে শ্বাসরুদ্ধ করে মা’রা হয়েছে। হ”ত্যায় আগে ধ’র্ষ’ণ করা হয়েছে।”

” আমি চৈতীর স্বামী। আমি কেন ধ’র্ষ’ণ করতে যাবো? ”

” দোষী ধরা পর্যন্ত সকলেই স’ন্দে’হের তালিকায়। আপনার পরিবর্তে সোহাগ সাহেবও হতে পারে। ”

সোহাগ কিছু বললো না। ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। ওসি সাহেব আড়চোখে সোহাগের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ” আপনি পিয়াসী? সোহাগ সাহেবের স্ত্রী?’

“জ্বি। বলুন, কি জানতে চান?”

” চৈতীর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিলো? কোন ঝগড়া বিবাদ নেই তো?’

” প্রথম দিকে ভালো বন্ধুত্ব ছিল। বেশিরভাগ সময় দু’জনে গল্প করে কাটাতাম। আস্তে আস্তে চৈতীর সঙ্গে সোহাগের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। এ কারণে শেষ দিকে বন্ধুত্বের সম্পর্কে তিক্ততা ছড়িয়ে গেছিল। চৈতীকে একদম সহ্য হতো না। এমন কি হ’ত্যার রাতে ওর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল। ”

” আপনি খুব স্পষ্টভাষী। ঝগড়ার কারন কি ছিল?”

” চৈতী আমার ননদের জন্য খাবার নিয়ে এসেছিল। ”

” আপনার ননদ এখন কোথায়?”

” ও হ”ত্যার দিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে গেছে। ”

” যদি আপনাকে খু’নি হিসাবে সাবস্ত করি তাহলে?”

” তাহলে বলবো আমার সাথে অ”ন্যায় করা হয়েছে। বিনাদোষে ফাঁ’সিয়ে দিয়েছেন। ”

ওসি সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। এমন উত্তর উনি আশা করেনি, হয়তো হিসাব মেলাতে পারছে না। কনস্টেবল দু’জনকে ডেকে আমাদের ঘরের তল্লাশি নিতে পাঠালেন। সোহাগ ওদের সঙ্গে গেল। বাড়িওয়ালা উত্তেজিত হয়ে আছে, তার বাড়িতে এসব খু’ন-খারাবি! ওসি সাহেবকে দ্রুত তদন্ত করতে অনুরোধ করছে। যে করে হোক খু”নিকে ধরতে হবে। ওসি সাহেব উনার উপর বিরক্ত হয়ে গেছে। বাড়িওয়ালা বয়স্ক লোক। বয়স ৬০ পেরিয়ে গেছে। নিয়মিত শরীরচর্চা করার ফলে চেহারায় বয়সের ছাপ পড়েনি। দুই ছেলে-মেয়ে, ছেলে-মেয়ে দূরে দূরে থাকে। বউ মা’রা গেছে বেশ কয়েক বছর আগে। ছেলে মেয়ে তেমন খোঁজ নেয় না। অবশ্য উনার টাকা-পয়সার প্রয়োজন পড়ে না। বাড়িভাড়া দিয়ে একজনের সংসার দিব্যি চলে যায়।

বাড়িওয়ালা ছুটে গিয়ে ওসি সাহেবের জন্য চা নিয়ে এলেন। চা দেওয়ার সময় কানে কানে কিছু বললো । উনার কথায় ওসি সাহেব মাথা নাড়ালেন। ব্যস্ত গলায় বললেন, ” হ”ত্যার রাতে পিয়াসী ঘরে কাউকে যেতে দেখেছিলেন আপনারা?”

বেশিরভাগ লোক না সূচক মাথা নাড়তে লাগলো। মোমেনার মা কপাল কুঁচকে কিছু চিন্তা করছে। কয়েক মুহূর্ত পরে চিৎকার করে বলে উঠলো,

” হ্যাঁ দেখেছিলাম। রাত নয়টার দিকে সোহাগ দাদাবাবু চৈতী ভাবির ঘরের দিকে যাচ্ছিলেন। ”

” আপনি কি সোহাগকে ওর ঘরে ঢুকতে দেখেছেন? তাছাড়া আমাদের ফ্লাট পাশাপাশি, কি দেখতে কি দেখেছেন ঠিক নেই। ”

” আপনার স্বামী নিরপরাধ? ‘

” এখানে নিরপরাধের বিষয় নয়। সোহাগ আর যা-ই করুক কাউকে হ”ত্যা করতে পারে না। তেলাপোকা মা”র”তে যার হাত কাপে সে কি করে মানুষ খু’ন করতে পারে?”

ওসি সাহেবের চোখ দু’টো জ্বলজ্বল করে উঠলো। মুচকি হেসে বললো, ” ধন্যবাদ। দারুণ কথা বললেন। ”

হতভম্ব হয়ে উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। কনস্টেবল দু’জন ফিরে এসেছে। ওসি সাহেব ওদের নিয়ে ফিরে গেল। যাওয়ার আগে কাল সকালে রাতুল আর সোহাগকে কাল থা’নায় যেতে বললেন।

চৈতীর আত্মীয়-স্বজন যারা এসেছিল কেউ ফিরে যায়নি। এ বাড়ির ফাঁকা ফ্লাটে থাকছে। দিন গুনে ভাড়া পরিশোধ করতে হবে। বাড়িওয়ালা দু’জন লোক দিয়ে ফ্লাট পরিষ্কার করে দিয়েছে। বাড়তি কিছু রোজগার হলে মন্দ কি! সোহাগ রাতুলকে আমাদের ফ্লাটে থাকতে বলে ছিল। কিন্তু সে মা’য়ের সাথে থাকছে। বৃদ্ধ মহিলা এ বয়সে এসব ঝামেলা নিতে পারছেন না।

রাত এগারোটা, খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ। সোহাগ রাতুলের সাথে গল্প করছে, এখনও বিছানায় আসেনি। আধশোয়া হয়ে চোখ বন্ধ করে আছি।

” ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?”

” না জেগে আছি। রাতুল চলে গেছে?”

” হ্যাঁ, ওর মা কল দিয়েছে। ”

” তোমার সাথে কিছু কথা আছে। বিশ্বাস করা উচিত কি-না বুঝতে পারছি না, তবুও বলতে হচ্ছে। ”

” কি কথা?”

” আমায় কি’ড’ন্যা’প হয়েছিল, বাবার বাড়ি যাওয়ার সময় কয়েকজন লোক ধরে নিয়ে গেছিল। কপাল গুনে ফিরে এসেছি। ”

” কখন? তুমি তো কিছু বলোনি। ”

” সময় পেলাম কখন? এসে থেকেই চৈতীর বিষয় নিয়ে ঝামেলা লেগে আছে।”

” কি হয়েছিল? ”

সোহাগ উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যেন খুব মজার কিছু শুনবে। ওকে বিশ্বাস করে ভুল করছি কিনা বুঝে উঠতে পারছি না। তবে বলতে হবে। চৈতীর খু’নে সোহাগের হাত আছে কি-না বুঝতে হবে।

” কি ভাবছো? ”

” কিছু না।’

” চুপচাপ যে। ”

দ্বিধা দন্দ কাটিয়ে সবকিছু খুলে বললাম। সোহাগ কপাল কুঁচকে দেওয়ালের তাকিয়ে আছে, ওকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে। বিমর্ষ গলায় বললো, ” কি’ড’ন্যা’পের ব্যাপারটা এতো সহজ নয়। বিষয়টা খুব সহজ করে দেখছো। এর পেছনে অনেক বড় পরিকল্পনা আছে। ”

” তুমি কি করে বুঝলে?”

” এমন কাহিনী নাটক-সিনামায় হয়। ওঁরা তোমাকেই ধরতে এসেছিল, পরে ছেড়ে দিয়েছে। ”

” এতে ওঁদের কি লাভ? ওরা তো টাকাও পায়নি। ”

” ওদেরকেও বোকা বানিয়েছে। যে পরিকল্পনা করেছে সে খুব শান্ত মস্তিষ্কের, অনেকদিন ধরে পরিকল্পনা করেছে। ”

” তোমায় বিশ্বাস করতে পারি?”

” হ্যাঁ। আজীবন একসাথে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, হালাল সম্পর্ক এতো নড়বড়ে হওয়া উচিত নয়। ”

ওর কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে৷ কিন্তু চৈতীর সঙ্গে ওর ঘনিষ্ঠতা মেনে নিতে পারছি না। আজ চৈতী নেই বলে এ পরিবর্তন নয় তো?

” সবকিছু ঠিক আছে। তবে চৈতীর সাথে ঘনিষ্ঠতা নিজ চোখে দেখেছি। ”

” এর পিছনে অনেক বড় কারণ আছে। এখানে আমার কোন উদ্দেশ্য ছিল না। এক কাপ চা বানিয়ে আনবে? মাথা ধরছে। ”

রান্নাঘরে চা বানাচ্ছি। আমারও মাথা যন্ত্রণা করছে। নানান চিন্তায় পা’গ’ল পা’গ’ল অবস্থা। গোলমরিচ, লবঙ্গ দিয়ে দু’কাপ চা বানালাম। সোহাগ শোবার ঘরে অপেক্ষা করছে।
দু’জনে মুখোমুখি বসে আছি। সোহাগ ধীরস্থির ভাবে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। যেমন করে সাবধানী বিড়াল দুধের বাটিতে চুমুক দেয়।

” তুমি চৈতীর সাথে ঘনিষ্ঠতা নিয়ে বলছিলে না?”

” হ্যাঁ। কিছু ভুল বলেছি নাকি?”

” না। তুমি ভুল বলোনি। আমি নিজেই চৈতীর সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছি। কেন জানো?”

” জানতে চাই। ”

“রাতুলের কথায়!”

” মানে! রাতুল কেন তার বউয়ের সাথে তোমায় ঘনিষ্ঠ হতে বলবে? ”

” পরীক্ষা করতে।”

” কি বলতে চাইছো? ‘

” চৈতী বেশ কিছুদিন ধরে রাতুলকে এড়িয়ে যাচ্ছিলো। কেমন খাপছাড়া ভাব, ঠিকমতো কথা বলছে না, ফোন দিলে ধরছে না। ”

” তারপর?”

” মাস দুয়েক আগে অফিসে বসে আছি। অচেনা নম্বর থেকে কল এলো। কথা বলে জানলাম রাতুল। বছর খানেক ওর সাথে যোগাযোগ ছিল না, কাজের চাপে সবাই ব্যস্ত হয়ে গিয়েছি। তোমার মনে পড়ে যখন প্রথম এ বাসায় আসি চৈতীর সাথে পরিচিত হয়েছিলাম। চৈতী ওর স্বামীর সাথে কথা বলিয়ে দিয়েছিল।”

” হ্যাঁ মনে আছে। তারপর?”

” সেদিন রাতুল আমায় ওদের সমস্যার ব্যাপারে বললো। আমার সাহায্য চাইলো, চৈতীর সাথে বন্ধুত্ব করে জানতে হবে ওর কারো সাথে সম্পর্ক আছে কিনা। ”

” তুমি রাজি হয়ে গেলে?”

” হ্যাঁ। অনেক অনুরোধ করছিলো। বুঝতেই পারছো প্রবাসে থাকে, আজকাল কত ঘটনা ঘটছে। তাছাড়া রাতুলের সমস্ত সম্পত্তি চৈতীর নামে, একবার ধোঁকা দিলে পথের ফকির হয়ে যাবে। সবকিছু মিলিয়ে রাজি হয়ে গেছিলাম। ”

” আমাকে বলে নিলে কি সমস্যা হতো?”

” তোমাকে সবকিছু বলতে চেয়েছি কিন্তু সময় হয়ে ওঠেনি। ”

” অযুহাত দিতে হবে না। তারপর? ”

” চৈতীর সাথে কথা বলে বুঝলাম ওর কোন ছেলের সাথে সম্পর্ক নেই। রাতুলের সাথে অন্য ব্যাপার নিয়ে ঝামেলা হয়েছে। ”

” কি ব্যাপার?”

” তা বলতে পারবো না। চৈতী কখনও এ ব্যাপারে বলতে চায়নি। তাছাড়া কিছুদিন ধরে চৈতীর হাবভাব বদলে গিয়েছিল।”

” আচ্ছা বুঝলাম। এখন তুমি কি বোঝাতে চাইছো?’

” আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। চৈতীর সাথে বন্ধুত্ব করতে গিয়ে ভালোবাসার মানুষকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। অন্য কারো সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে তুমি কেমন রিয়াকশন করো দেখতে ইচ্ছে করছিলো। এটা অন্যায় করেছি, এজন্য আমি লজ্জিত। ”

প্রতিত্তোরে কিছু বললাম না। সোহাগের কথা সত্য হলে রাতুল ছেলেটার সমস্যা আছে। রাতুলের সাথে কথা বলতে হবে, সোহাগের কথার সত্যতা যাচাই করা জরুরি। বিনাবাক্য বিশ্বাস করতে পারছি না।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে