কুয়াশার আড়ালে সূর্য
৪.
পিনপতন নীরবতায় আব্দুল হাকিম সাহেব পুনরায় চ্যাঁচিয়ে উঠলেন উদয়ের উদ্দেশ্যে। তার হাতের ল্যাপটপ ও ব্যাগগুলো সোফায় রেখে প্রথমে নিজেকে ধাতস্থ করল। ফের স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
‘আমিই সূর্য এহসান। পদ্মা টেক্সটাইল গ্রুপ অফ কোম্পানির মালিক শফিকুল ইসলামের দ্বিতীয় পুত্র।’
অপ্রত্যাশিত জবাব কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই, দু-দফায় আব্দুল হাকিম সহ বাকিরাও হতবিহ্বল! বিস্মিত হয়ে ভেতর থেকে কুয়াশাও বেরিয়ে এসেছে। সপ্রশ্ন সূচক দৃষ্টি নিবদ্ধ সবার সূর্যের ওপর। সে সবার চাহনি উপেক্ষা করে দৃঢ় গলায় বলল,
‘মিথ্যে পরিচয় দিয়েছি। এজন্য ক্ষমা চাচ্ছি।’
আব্দুল আহাদ এক প্রকার তেড়ে এসে সূর্যের কলার হাত রাখতে চাইলে ঠেলে সরিয়ে দেয় সে। সে ক্ষিপ্ত কণ্ঠে শুধায়,
‘কী উদ্দেশ্য ছিল তোর? কেন করলি?’
‘উদ্দেশ্য একটাই, কুয়াশা।’ বলতে বলতে শাহাদাত আঙুল তাক করে কুয়াশাকে দেখায়।
‘কুয়াশা আমার স্ত্রী।’ খেঁকিয়ে বলল।
‘ছিল। এখন নেই। কুয়াশা সম্পূর্ণ হারাম আপনার জন্য। কারণ সে এখন আমার অর্ধাঙ্গিনী।’
‘তুই কথার খেলাফত করছিস।’ ওসমান মিয়া উগ্র কণ্ঠে বলল।
‘নেক কাজ করতে যদি অসৎ কথার খেলাফত করতে হয়। তাহলে আমি এই ভুল শতবার করব।’
‘এটা কথা ছিল না। তুমি তোমার কথা রাখো।’ আব্দুল হাকিম গম্ভীর গলায় বললেন।
‘বিয়ের এক বছর হতে না হতেই মেয়ে ডিভোর্সের তালিকায় যুক্ত হয় বাড়ি ফিরবে, কথা কিন্তু সেটাও ছিল না আব্বু।’ সূর্য এক প্রকার কর্কশ গলায় বলল।
তিনি যেন সূর্যের কথা শুনে কিছুটা দমে গেল। পরপরই ফের বলল,
‘এত বড়ো ঘরের পুত্র তুমি। তবুও আমার ডিভোর্সি মেয়েকেই কেন বিয়ে করতে হলো তোমার?’
সূর্য দৃষ্টি নিচু করে কুয়াশায় ঘেরা এক সকালের কথা ভাবে। পরক্ষণে সরস গলায় বলে,
‘ভালোবাসি।’
‘ও মিথ্যে বলছে বাবা।’ গমগমে গলায় বলল আব্দুল আহাদ।
‘আমার আব্বা চাইলে এরকম বাড়ি কিনতে পারে মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে। টাকা-পয়সার প্রতি লোভ আমার নেই। আমার শুধু কুয়াশাকে প্রয়োজন। ব্যস, ও এখন আমার।’
‘আমি তোমার সাথে কুয়াশার হিল্লা বিয়ে দিয়েছি। এ বিয়ে আমি কিছুতেই মেনে নিবো না। আমার মেয়ে কুয়াশাও মানবে না।’
‘আমার মেয়ে, আমার মেয়ে বলে হাতের পুতুল বানিয়ে ফেলেছেন ওঁকে। এখন ও আমার অর্ধাঙ্গিনী। অধিকার আপনার থেকে কোনো অংশে কম নয় আমার। আর কী বললেন হিল্লা বিয়ে সম্পর্কে। তালাক এবং তাৎক্ষণিক-দ্বিতীয় বিয়ে (হিল্লা বিয়ে) সম্পূর্ণ কুরআন বিরোধী। কুরআন মোতাবেক কোন নারীকে বিয়েতে বাধ্য করার অধিকার কারো নেই। সেই সময়ে নারীকে এ অসাধারণ অধিকার দিয়েছে কুরআন। হিল্লা বিবাহ স্ত্রীকে দিয়ে জোরপূর্বক এক ধরণের বেশ্যাবৃত্তি, যা সম্পূর্ণ হারাম। এই হারাম কাজে যারা জড়িত থাকবে হোক সে মসজিদের ইমাম, অবশ্যই সে জাহান্নামী হবে। নবী করিম (সাঃ) হিল্লা বিয়ে সম্পর্কে বলেছেন, ইসলামের ইতিহাসে হিল্লা বিবাহের কোন ঠাই নেই। নবীজি (সাঃ) হিল্লা বিবাহকে শুধু ঘৃনাই করতেন না, হিল্লাকারীদের উপর লানত করতেন। এ বিয়ে একটা কুসংস্কার। ওনি যদি কুয়াশাকে ভালোবেসে বিয়ে করতেন মাঝখানে আমি আসতাম না। কিন্তু তারা আপনার সম্পদের লোভে বিয়ে করছে কুয়াশাকে। একবারও মাথায় আসলো না হঠাৎ কেন আপনার মেয়েকেই পুনরায় বিয়ে করতে চেয়েছে।’ সূর্য বাক্য সম্পূর্ণ করে থামলো। ফের বলল,
‘কুয়াশাকে বিয়ের করার পরও বড়ো লোকের মেয়ের পিছনে ছুটেছে। যখন মেয়েটা জানতে পারলো তারা প্রতারক প্রস্থান করল। আব্বাসকে সরিয়েছি আমি। প্রথম থেকেই আপনাদের ওপর নজরদারি করেছি। গাড়ির ড্রাইভার থেকে শুরু করে সবক্ষেত্রে আমার নজর ছিল আপনাদের ওপর। কোর্ট ম্যারেজ হয়েছে আমাদের। সে কোনো কাজি নয়, উকিল ছিল। মেনে নেন, নয়তো প্রমাণ সহ পুলিশের হাতে তুলে দিবো আপনাদের।’
এবার তারা দমে গেল। মুখ শুঁকিয়ে এলো তাদের। সূর্য আব্দুল আহাদের কাঁধে হাত রেখে বলল,
‘সব পরিবেশে মানিয়ে চলার অভিজ্ঞতা আমার আছে। ন্যাচারাল জিনিসের প্রতি ঝোঁক আমার অধিক পরিমাণ বেশি৷ কুয়াশা সাধারণের তুলনায় অসাধারণ একজন মেয়ে।তুমি সত্যিই খাঁটি হিরাকে হারিয়ে ফেলেছো।’ আব্দুল আহাদ নির্বাক চোখে চেয়ে রইলো সূর্যের পানে।
এবার সূর্য আব্দুল হাকিমের দিকে এগিয়ে এসে কোমল গলায় শুধায়,
‘আপনি বাবা হিসেবে পারফেক্ট না। নিজের মেয়ের চোখের ভাষা বোঝার ক্ষমতা আপনার নেই। অথচ, মানসম্মানের চিন্তায় বিভোর। আমি কুয়াশাকে নিয়ে চলে যাব। দেখতে হবে না ডিভোর্সি মেয়েকে।’
কুয়াশা ফুঁপিয়ে উঠলো। চোখের পানি আড়াল করার জন্য রুমে চলে এলো। সাদিনা বিবি গর্বিত বুক নিয়ে সূর্যের মাথায় হাত বুলালো। এবং কর্কশ গলায় তাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার নির্দেশ দিলেন। তার ছেলের পানে ক্ষোভ নিয়ে তাকালে সেও প্রস্থান করে। সূর্য মৃদু হাসি প্রধান করে রুমে ফিরে সেগুলো নিয়ে। কুয়াশাকে কাঁদতে দেখে একা ছেড়ে দেয়। মন হালকা করার উপায় কাঁদা। এজন্য সে কুয়াশাকে নিষেধ করে না। তার সামনে একটি ব্যাগ রেখে বাথরুম চলে এলো। মিনিট কয়েক পর সম্পূর্ণ রেডি হয়ে বের হয়। শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে কুয়াশাকে তাড়া দিয়ে বলল,
‘বাকি কান্না যাবার সময় কেঁদো। আপাতত রেডি হয়ে নেও দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
কুয়াশা কপাল কুঁচকিয়ে সূর্যের পানে তাকালো। থমকালো সে। ইন করা খয়েরী রঙের শার্ট ও কালো রঙের প্যান্ট শ্যামলা গায়ে বেশ চমৎকার মানিয়েছি। জেল দেওয়া উষ্ণ ভেজা চুলগুলো পরিপাটি ভাবে আঁচড়ানো। এক দু’টি ছোট চুল কপালে উঁকি দিচ্ছে। সূর্যের সুদর্শন শোভাময়তা আদলে তাকিয়ে হারিয়ে গেল সে। কাল যাকে কুৎসিত রূপে দেখেছে আজ তার এত মনোমুগ্ধকর আদল দেখে বিমোহিত!
‘এই যে ধ্যানমগ্ন রমণী।’ হাতে তালি দিয়ে চৈতন্য ফিরালো কুয়াশার। কিঞ্চিৎ লজ্জা বোধ দিয়ে নজর সরিয়ে নিলো। সে ফের বলল,
‘রেডি হয়ে নেও জলদি।’ বলতে বলতে ফোন হাতে বারান্দার দিকে অগ্রসর হলো সূর্য। তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে ব্যাগ হাতে নিলো। সব কিছু কেমন স্বপ্নের মতো লাগছে। আসলেই কী সব বাস্তব নাকি স্বপ্ন? তার ভাগ্যের মোড় এভাবে ঘুরে যাবে কে-ই বা জানতো। তবে কী জীবন থেকে কালো ছায়ার বিনাশ ঘটেছে? কুয়াশার আড়ালে সূর্যের প্রণয়ে সত্যিই কী সে সুখী হবে? একান্তই প্রশ্নগুলো করে বড়ো নিশ্বাস ত্যাগ করল।
খয়েরী রঙের কাতান শাড়ি পড়ে চোখে হালকা কাজল ও সল্প লাল-খয়েরী মিলিত লিপস্টিক দিয়ে নিজেকে সাজিয়েছে কুয়াশা। বারান্দায় এসে সূর্যের পিঠের পানে তাকালো। দৃষ্টি তার ফোনের স্ক্রীনে নিবদ্ধ। কুয়াশা মুখ খুলে কিছু বলতে উদ্যোত হতেই সূর্য না তাকিয়ে দ্রুত বলল,
‘রেডি?’
কুয়াশা থতমত চেহারায় ছোট্ট করে ‘হ্যাঁ’ বলল। ঘুরে কুয়াশার পানে তাকিয়ে সূর্য যেন বিমূঢ়তা জড়িয়ে গেছে। সূর্যের দৃষ্টিপাতে নজর সরিয়ে নিলো সে। সূর্য স্বাভাবিক হয়ে এগিয়ে গেল ভেতরে। যেতে যেতে বলল,
‘চলো বাহিরে। বিদায় নিতে হবে সবার থেকে।’
চলবে?
®সুমাইয়া মনি