কুয়াশার আড়ালে সূর্য
২.
সারাবেলা মনমরা দিন অতিবাহিত হয়েছে কুয়াশার। রুম থেকে বের হয়নি। তিন বেলার আহার দাদী এসে খাইয়ে দিয়েছে জোরপূর্বক। ছোট ভাই কয়েকবার ডেকেছে বাহিরে যাওয়া জন্য। ডেকেছিল চম্পা খাতুন। তবে কেন জানি বাবার সম্মুখে যেতে অনিচ্ছুক সে। কাল বাবার এরূপ হৃদয়বিদারক কথাগুলো তাকে ভেতর থেকে দুমড়ে মুচড়ে আরো ভেঙে দিয়েছে। মায়ের চেয়েও যে বাবাকে সে এত ভালোবাসতো, শ্রদ্ধা সম্মান করতো। তার কাছেই সে আজ বোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর চেয়ে কষ্টের মুহূর্ত আর কী হতে পারে সন্তানের? দাদী বহুবার বুঝিয়েছে। সান্ত্বনা দিয়েছে, তবে তার মনে যে বিক্ষিপ্ত ঝড় বইছে থামার উপায়ন্তর নেই।
দুপুরের দিকে আব্দুল আহাদ উদয়কে নিয়ে বাড়িতে এলেন। ভালো শার্ট-প্যান্ট পড়িয়ে পরিপাটি ভাবে উদয়কে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে এসছেন। তবে উদয়কে দেখতে এখনো খ্যাত ছেলের মতোই লাগছে। চা-নাস্তা দেবার পর চম্পা খাতুন স্বামীর পাশে বসলেন। উদয়কে দেখে তার বড্ড মায়া হলো। আব্দুল আহাদের সঙ্গে বিয়ে না দিয়ে যদি সত্যি সত্যি সহজ সরল এই ছেলেটির সঙ্গেই হতো, তাহলে হয়তো মেয়েটা সুখে থাকতো। নৈঃশব্দে প্রশ্বাস নিলেন তিনি।
‘বাবা উদয় এ বিয়েতে রাজি আছে। আপনি বললে রাতেই বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারি।’
তিনি জবাব না দিয়ে উদয়কে আপাদমস্তক মেপে নিয়ে বলল,
‘গ্রামের বাড়ি কোথায় তোমার?’
‘মুন্সিগঞ্জ। বাপ-মায় কেউ বাঁইচা নাই। ছোট একটা বোইন ছিল। পানিতে পইড়া মইরা গেছে।’ গড়গড় করে বলে থামল উদয়।
‘আগে বিয়ে হয়েছে?’
‘না।’
‘তোমার বাবাকে জানিয়ে দেও। সন্ধ্যার পর বিয়ে হবে ওদের।’
‘জি বাবা।’
চম্পা খাতুনের মন অস্থির হয়ে পড়লো। শুঁকনো মুখে স্বামীর পানে চেয়ে রইলো। তবে তার নজর তখনো ছিল প্রখর শক্তপোক্ত। কেমন নির্দয়বান লোক হলে এমন হারাম কাজ করতে পারে নিজের মেয়ের সাথে। উঠে চলে গেলেন সে।
আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে উদয়কে নিয়ে বেরিয়ে এলো। বিয়ের বিষয়টি পুরোপুরি ভাবে গোপনে রাখবে।
রিকশায় যাওয়ার পথে উদয় আব্দুল আহাদের নিকট প্রশ্ন রাখে,
‘হিল্লা বিয়া মানে কী ছোট সাহেব?’
‘কুয়াশা আমার স্ত্রী ছিল। এক বছর আগে আমি ওঁকে তালাক দিয়েছি। এখন পুনরায় কুয়াশাকে বিয়ে করতে চাই। এজন্য ইসলামের বিধান মেনে কুয়াশার সঙ্গে একজন ছেলের সাথে বিয়ে দিতে হবে। তার সাথে এক রাত থাকার পরদিন তালাক দেওয়ার পর আমি ওঁকে পুনরায় বিয়ে করতে পারব।’
‘এইডা তো আগে হুনি নাই। সত্য এইডা করা লাগবো?’
‘হুম। তবে খবরদার! তুই কিন্তু ওঁকে স্পর্শ করবি না। বিয়ের পর আমি ওঁকে কখনোই স্পর্শ করিনি।’
‘কেন?’
‘কারণ আমি ইরিনাকে ভালোবাসতাম। ওর প্রতি আমার কোনো আকর্ষণ ছিল না। কিন্তু কুয়াশা ইরিনার চেয়ে বেশি সুন্দরী ছিল।’
উদয় চুপ থেকে কয়েকটা গালি ছুড়লো তার নিকট। ফের বলল,
‘আপনি কী কুয়াশারে ভালোবাসেন?’
‘হ্যাঁ।’
তার কথায় সন্দিহান নয়নে তাকালো উদয়। তবে সেটি বুঝতে দিলো না। আরো বিভিন্ন প্রশ্নের মাধ্যমে বাড়ির সামনে এসে রিকশা দাঁড়ালো। দু’জনে একত্রে ভেতরে এসে ওসমান মিয়াকে বিয়ের বিষয়টি জানালো। তিনি ছেলেকে আদেশ দিলেন,
‘জালাল উদ্দীন কাজিকে খবর দে।’
‘বড়ো সাহেব আমার চেনা পরিচিত একজন কাজি আছে। সে কম খরচে বিয়া পড়ায়। যদি কম তারে খবর দেই। চিন্তা কইরেন না সে বিয়ার খবরটা গোপন রাখবো।’ উদয় অকপটে বলল কথাগুলো। ওসমান মিয়া কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
‘কোথায় থাকে? তাকে নিয়ে আয় যা।’
‘টাকা দেন কিছু। সে উত্তরায় থাহে।’
তিনি কিছু টাকা দিয়ে উদয়কে পাঠিয়ে দিলো। আব্দুল আহাদ বেরিয়ে এলো উদয়ের জন্য নতুন পাঞ্জাবি, পায়জামা কিনতে। শত হলেও বিয়ের ব্যাপার।
_
‘আমি যে তোমার বিয়ে ঠিক করেছি এ বিষয়ে তোমার কোনো মতামত আছে?’ সোজাসাপ্টা ভাবে আব্দুল হাকিম সাহেব মেয়ের উদ্দেশ্যে জানতে চাইলেন। রুম বসে উদয়ের কণ্ঠ শুনে মনমানসিকতা পুরোপুরি ভাবে ভেঙে যায়। একটি সহজ সরল ছেলে যদি তার জীবন সঙ্গী হতো আপত্তি ছিল না। কিন্তু দিন শেষে সেই মিথ্যে বিয়ের বন্ধনে বাঁধতে হবে। যেখানে মিলবে না এক টুকরো শাম্তি। গলার স্বর অতি স্বাভাবিক করে নরম স্বরে কুয়াশা বলল,
‘নেই।’
‘রাজি আছো?’
কুয়াশা মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো। মেয়ের সম্মতি পেয়ে তিনি গর্বিত গলায় স্ত্রীর পানে চেয়ে বললেন,
‘দেখো, আমি বলেছিলাম না। মেয়ে আমার রাজি হবেই।’
‘নিজ স্বার্থে আপনি যেটা করছেন আল্লাহ আপনাকে কখনো মাফ করবে না।’
স্ত্রীর কথায় তিনি রেগে কর্কশ গলায় বললেন,
‘ফালতু কথা বলবে না। আমি যা করছি ভালোর জন্যই করছি। তুমি না বুঝলেও আমার মেয়ে ঠিক বুঝেছে।’
বাবার কথাটা শুনে ধীরে পায়ে রুমে চলে এলে কুয়াশা। ভেতর থেকে সাদিনা বিবি তেড়েফুঁড়ে এসো বললেন,
‘খুব বুঝেছে তোর মেয়ে। এমন বিয়ে না দিয়ে গাঙ্গে ভাসিয়ে দে মেয়েকে।’
‘মা তুমিও তোমার বউমার দলে যোগদান করেছো।’
‘বেশ করেছি। তুই যে আমার ছেলে ভাবতেই বুক ফেঁটে যাচ্ছে আমার। বউমা ওরে আর কিছু বলবা না। আমার নাতনির যদি এবার কোনো ক্ষতি হয়। তোকে আমি নিজে জেলের ভাত খাওয়াবো কথাটা মনে রাখিস।’ বলেই রাগে গজগজ করে ভেতরে চলে গেলেন। বয়স হলেও চোটপাট এখনো দমেনি তার। তিনি এক কথার মানুষ। মায়ের এরূপ কথায় তার রাগ অধিক বেড়ে গেলো। তবে সে কিছুতেই দমবে না। তার সিদ্ধান্তেই অটল থাকবে।
নীল আকাশের মাঝে হঠাৎ দূরন্ত থেকে এক ফালি মেঘ জড়ো হয়েছে। কিছুক্ষণের মাঝেই ছেঁয়ে গেছে পুরো আকাশ। এ বুঝি বৃষ্টি বর্ষিত হবে সারা ভুবন জুড়ে। মেঘলাচ্ছন্ন আকাশের রং দেখতে দেখতে সময় অতিবাহিত হলো। মসজিদের মাইকে মোয়াজ্জেম দের সুরেলা কণ্ঠে আজানের ধ্বনি শোনাচ্ছে।
কুয়াশা বেলকনি থেকে সরে মাগরিবের নামাজ পড়ে নিলো। তারপর আলমারি থেকে মায়ের প্রিয় কাতানের লাল রঙের শাড়ি পড়ে সাজতে বসেছে। এ বিয়েতে এখন আর তার আফসোস নেই। ভাগ্য পুরোপুরি রবের হাতে সঁপে দিয়েছে। সে যেভাবে চাইবে, নৈঃশব্দে মেনে নিবে। চম্পা খাতুন ও সাদিনা বিবি রুমে এসে মেয়েকে এত সাজগোছ করতে দেখে অবাক হলেন না। চোখের সামনে মেয়ের ধ্বংসের লীলা দেখে বুক ফেটে কান্না আসছে তার। তবে মুখ ফুটে বলার শক্তি তার নেই।
ভেজা নয়নে প্রস্থান করলেন চম্পা।
‘দাদী আমাকে আলতা পরিয়ে দিবে?’
‘আমি দেই?’ পিছন থেকে আলিফ কথাটা বলে বোনের নিকটে এগিয়ে এলো। ছোট ভাইয়ের দয়ালু পনা দেখে মৃদু হাসলো কুয়াশা। পা ও আলতা এগিয়ে দিলো ভাইয়ের নিকট। বোনের পা তার ঊরুর ওপরে উঠিয়ে সযত্নে বেশ চমৎকার ভাবে আলতা পড়িয়ে দিচ্ছে।
‘আগে কোনো মেয়েকে দিয়েছিলি নাকি, এত সুন্দর করে দিচ্ছিস যে?’ বোনের প্রশ্ন শুনে আলিফ করুন নয়নে তাকায়।
অষ্টম শ্রেণীতে থাকাকালীন যেমন খুশি তেমন সাজে আলিফকে বউ সাজিয়ে দিয়েছিল। তখন যে কুয়াশা সুন্দর ভাবে আলতা পড়িয়ে দিয়েছিল সেটা এখনো মনে আছে আলিফের। অবশ্য এখন সে দশম শ্রেণীর ছাত্র। সেই দিনের কথা প্রায় দু বছর আগের। ডিপ্রেশনে সময় কাটাতে কাটাতে অনেক মেমোরি তার বোন ভুলে গিয়েছে। সে বিষয়টি এড়িয়ে যায়। আলতা পড়ানো শেষে বোনের পা সহ দু’টি ছবি তুলে নেয়। ছবিগুলো কুয়াশা দেখবে এমতাবস্থায় কলিং বেল বেজে উঠে। সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশার বুকে মোচড় দিয়ে উঠল। অসংখ্য ভয়ের আশংকা জড়ো হয় বক্ষে। হঠাৎ তার এরূপ হবার কারণ বেমালুম।
কাজিকে নিয়ে সবাই উপস্থিত। উদয়কে হালকা খয়েরী রঙের পাঞ্জাবি পড়ানো হয়েছে। আব্দুল আহাদ নিজেও নেভি ব্লু রঙের পাঞ্জাবি পড়েছে। সবার সাথে অল্পস্বল্প বাক্যবিনিময় শেষে কুয়াশাকে আনা হয় বাহিরে।
এতদিন বাদে বউ সাজে কুয়াশাকে দেখে আব্দুল আহাদ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তবে আগের মতো চেহারার লাবন্য কেন যেন দেখতে পাচ্ছে না। উদয়ের আদলে মত্তনয়না স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। কুয়াশাকে তার ভীষণ রকম পছন্দ হয়েছে। তার চাহনি পলকহীন থাকলেও কুয়াশা একবারও তাকায়নি তার পানে। উদয় খেয়াল করে কুয়াশার আদলে উদাসীনতা ভাব। যেটা চেহারার উজ্জ্বলতা ক্ষণে ক্ষণে মিশিয়ে দিচ্ছে ক্রমাগত।
চলবে?
®সুমাইয়া মনিক