#কিশোরী_কন্যার_প্রেমে
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_৪
.
আজও নীরদকে দেখা যাচ্ছে, গলির মাথায় দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সাথে ক্যারাম খেলছে। অর্ঘমা সাইকেল নিয়ে আসার সময় একবার চোখাচোখি হলো নীরদের সাথে। প্রতিদিনের মতো আজও দোকান থেকে কতগুলো সেন্টার ফ্রুট কিনে ব্যাগে ভরলো। নীরদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সেন্টার ফ্রুটস সমেত একটা পলিথিন তার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে গেল। দু’হাতে পলিথিন ক্যাচ ধরে অর্ঘমার দিকে তাকিয়ে হাসল নীরদ। অর্ঘমাও পাল্টা হেসে কিছু না বলে চলে গেল।
নীরদের বন্ধুরা অবাক হলো না এসব দেখে। কারণ প্রায় প্রতিদিনই তাদের এসব দেখতে হয়। অর্ঘমা কোচিংয়ে যাওয়ার সময় যেদিনই নীরদকে দেখতে পাবে সেদিনই কিছু না কিছু নীরদকে দিয়ে যাবে। যেমন গতকাল আইসক্রিম দিয়ে গিয়েছিল। এর আগের দিন একটা ডিউয়ের বোতল দিয়ে গিয়েছিল। আবার নীরদও মাঝে মাঝে অর্ঘমাকে এসব দিয়ে থাকে। নীরদের বন্ধুদের ভেতরে থাকা আসিফ বলল,
-“এসব কী ভাই? তোরা প্রেম করস না, কিছু না তবুও এসব কী?”
আরেক বন্ধু বলল,
-“ঠিক। প্রেম করলে তাও মানা যেত। কিন্তু প্রেম না করলে এসব আদান-প্রদান কেন চলে তোদের ভেতরে?”
আসিফ সন্দিহান গলায় জিজ্ঞেস করল,
-“সত্যি করে বলতো, তোদের ভেতরে কিছু চলছে না তো?”
-“চললে তোরা জানতি না মনে হয়?”
নীরদের উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারল না কেউই। আসিফ ভাবুক সুরে বলল,
-“অর্ঘমাকে দেখলে মনে হয় ও তোকে পছন্দ করে।”
জবাব দিল না নীরদ। হাসিমুখে একটা সেন্টার ফ্রুটের প্যাকেট খুলে মুখে দিল। বাকি সেন্টার ফ্রুটগুলো পলিথিন থেকে বের করে প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে রাখল। বন্ধুরা অসন্তুষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার দিকে। আসিফ কিছু একটা ভেবে জিজ্ঞেস করল,
-“তোর খবর বল। তুই বাই এনি চান্স অর্ঘমাকে পছন্দ করিস না তো?”
-“এমনটা মনে হওয়ার কারণ?”
-“তোর ভাবসাব দেখলে আমার তাই মনে হয়।”
-“এত ভেবে কী করবি? ভাবনা বাদ দিয়ে ক্যারামে মনোযোগ দে। লাস্টে পড়ে আছিস। তুই তো হারবি।”
-“আগেই ভবিষ্যৎ বাণী করস কেন? আমি হারি কিনা জিতি তুই শুধু দেখ।”
আসিফ পুরো দমে ক্যারামে মনোযোগ দিল। এমনকি সব বন্ধুরা ক্যারামে মনোযোগ দিল। নীরদ তা দেখে হাসল। চুলগুলো হাত দিয়ে একটু ঠিক করে সে নিজেও ক্যারামে মনোযোগ দিল।
স্কুল ছুটির পর নিধির সাথে গল্প করতে করতে বের হলো অর্ঘমা। স্কুলের গেট পেরোতেই মুখোমুখি হলো শাকিলের। মাঝে কয়েকটা মাস ছেলেটা গায়েব ছিল। অর্ঘমা ভেবেছিল ছেলেটা অবশেষে তার পিছু ছেড়েছে। কিন্তু আজ হঠাৎ এভাবে উদয় হওয়ার মানে কি! শাকিলকে বেশ পরিবর্তন লাগছে। বেশভূষা, হাবভাবেও পরিবর্তন হয়েছে কিছুটা। শাকিল গলা ঝেড়ে জিজ্ঞেস করল,
-“মিস করেছো আমাকে এই ক’দিন?”
অবাক হলো অর্ঘমা। মিস! সে কেন এই ছেলেকে মিস করতে যাবে? মাথাটা গেল নাকি ছেলেটার! অবাকতার রেশ টেনেই অর্ঘমা বলল,
-“আপনাকে মিস করব কেন? কোন দুঃখে মিস করব? বরং আপনি এতদিন না আসায় আমি শান্তিতে ছিলাম। এই যে আজ হঠাৎ আবার আপনি আমার সামনে আসলেন, এখন বিরক্ত হচ্ছি।”
-“আমি আসলে চাকরির জন্য পড়াশোনা করছিলাম।”
-“তো! আমাকে কেন বলছেন এসব?”
-“আসলে আমার চাকরি হয়ে গেছে।”
-“কংগ্রাচুলেশন। এবার অন্তত চাকরির টানে পড়ে আপনি আমার পিছন ছাড়বেন।”
-“তুমি জানো আমি তোমাকে পছন্দ করি। তবুও এমন কর কেন আমার সাথে?”
-“কারণ আমি আপনাকে পছন্দ করি না। আর জোর করে কাউকে পছন্দ করা যায় না।”
-“আমি আমার পরিবারে তোমার কথা বলেছি। তারা সবাই তোমাকে দেখতে চান। তাই আমি চাইছি তোমার পরিবারকে প্রস্তাব দিতে।”
-“হোয়াট! আর ইউ আউট অফ ইওর মাইন্ড? যেখানে আমি আপনাকে পছন্দই করি না সেখানে প্রস্তাব দেওয়ার কথা আসছে কোথা থেকে?”
-“একসাথে থাকতে থাকতে একসময় না একসময় পছন্দ হয়েই যাবে। আমি শুধু তোমাকে জানাতে এসেছিলাম ব্যাপারটা। তোমার কথা এতদিন শুনেছি। এখন আমি আমার মনের কথা শুনব। তাছাড়া তোমার পরিবারের আপত্তি করার কোনো কারণ নেই। আমি পড়াশোনা জানা ছেলে। ভালো চাকরি করছি। আর সবথেকে বড় কথা হলো আমি একমাত্র ছেলে। আমার এক বোন আছে। তার বিয়ে হয়ে গেলে পুরো বাসায় তোমার রাজত্ব চলবে। এছাড়াও টাকাপয়সা মোটামুটি ভালোই আছে আমাদের।”
-“পৃথিবীতে মেয়ের নিশ্চয়ই অভাব পড়েনি! তাহলে আপনি হাত ধুয়ে আমার পেছনেই কেন পড়ে আছেন? আমার আপনাকে একটুও পছন্দ না। তাছাড়া আমি অন্য একজনকে পছন্দ করি।”
চোখমুখের পরিবর্তন ঘটল শাকিলের। চোখ ভরতি রাগ নিয়ে বলল,
-“আমি তোকে পছন্দ করেছি মানেই তুই আমার। কোন শু*** বাচ্চাকে পছন্দ করিস তুই? তাকে একবার সামনে পেলে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবো মাটিতে। এতদিন ভালোভাবে বলেছি গায়ে লাগেনি। এখন থেকে আর ভালোভাবে বলব না। আগামীকাল আমার পরিবার নিয়ে যাব তোদের বাসায়। তোর বাপ-মাকে বলে দিবি, যদি নিজেদের ভালো চায় তাহলে যেন বিয়েতে কোনো বাগড়া না দেয়। নাহলে এই শাকিলের জঘন্য রূপটা তারা দেখতে বাধ্য হবে।”
অর্ঘমা হতবিহ্বল নয়নে তাকিয়ে রইল। শাকিলের এমন রূপ বদল তার ঠিক হজম হচ্ছে না।
বাসায় ফিরেই ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল অর্ঘমা। তার কানে এখনো শাকিলের বলা কথাগুলো বাজছে। আজকে শাকিলের বলা কথার ধরনই বুঝিয়ে দিয়েছে ও কেমন ধরনের ছেলে। এমন একটা জঘন্য ছেলের নজরেই কেন পড়তে হলো তাকে? ভীষণ কান্না পাচ্ছে অর্ঘমার। আজকে শাকিলের ধমকিতে যে সে ভয় পেয়েছে তা আর বলার বাকি রাখে না। অভ্র বাসায় নেই এই মুহূর্তে। এমনকি তার বাবা-মাও বাসায় নেই। বাসায় একা থেকে সে অভ্যস্ত। কিন্তু আজ কেন যেন খুব ভয় করছে অর্ঘমার। কাঁদতে কাঁদতেই ফোন নিয়ে অভ্রর নম্বরে কল দিল। ওপাশ থেকে কল রিসিভ হতেই অর্ঘমা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। তার কান্নার আওয়াজ শুনে উত্তেজিত হয়ে পড়ল অভ্র।
-“হ্যালো অর্ঘ! অর্ঘ কী হয়েছে, কাঁদছিস কেন? হ্যালো! অর্ঘমা! কথা বল। কোথায় তুই? কী হয়েছে?”
-“বা..বাসায় এসো ভা..ভাইয়া।”
তৎক্ষনাৎ কল কেটে গেল। অর্ঘমা দু’হাতে মুখ চেপে ধরে কাঁদতে লাগল।
মিনিট দশেক পেরোতেই বাসায় এসে হাজির হলো অভ্র। বেল না বাজিয়ে চাবি দিয়েই দরজা খুলল। তাদের বাসার প্রত্যেকের কাছে এক সেট করে চাবি আছে। অনেক সময় বাসায় কেউ না থাকলে তখন এই চাবি কাজে লাগে। আজ অর্ঘমা বাসায় থাকলেও তার কান্নামাখা কণ্ঠস্বরটা শুনে অভ্রর মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে গেছে। বিন্দুমাত্র অপেক্ষা করার আগ্রহ তার মধ্যে নেই, দেখেই বোঝা যাচ্ছে। দরজা খুলেই হনহনিয়ে অর্ঘমার রুমের দিকে গেল। রুমে ঢুকেই দেখল দু’হাতের মাঝে মুখ লুকিয়ে কাঁদছে অর্ঘমা। অভ্র প্রথমে তার মাথায় হাত রাখল। হঠাৎ কারো আভাস পেয়ে অর্ঘমা চমকে উঠল। পরক্ষণেই ভাইকে দেখে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। এই মুহূর্তে কোনো প্রশ্ন করল না অভ্র। অর্ঘমা কিছুটা শান্ত হতেই অভ্র শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল,
-“কী হয়েছে? কে কি বলেছে ফুল ডিটেইলসে বলবি।”
অভ্রর শান্ত ভঙ্গিই অর্ঘমাকে জানান দিচ্ছে সে ঠিক কতটা রেগে আছে। রেগে থাকার কারণটা অর্ঘমার চোখের পানি। অর্ঘমা ভাইয়ের দিকে তাকাতেই তার চোখ গেল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নীরদের দিকে। নীরদকে এখানে দেখে বেশ অবাক হলো অর্ঘমা। তার অবাক দৃষ্টি অনুসরণ করে পেছনে তাকাল অভ্র। নীরদকে দেখে মনে পড়ল, সে নীরদের সাথেই ছিল বাইরে। তখন অর্ঘমার ফোন পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে চলে আসার সময় নীরদও এসেছে তার সাথে। বোনের চিন্তায় নীরদকে বেমালুম ভুলে বসেছিল অভ্র।
নীরদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অর্ঘমার দিকে। এতক্ষণ যাবত সে শুধু অপেক্ষা করছে অর্ঘমার কান্নার কারণ জানার জন্য। কি এমন হয়েছে যার জন্য এভাবে কান্না করছিল মেয়েটা? অভ্র হয়তো নীরদের চোখের ভাষা পড়তে পারল। তাই অর্ঘমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-“বল।”
নীরদকে সামনে দেখে অর্ঘমা কিছুটা ইতস্তত করছে দেখে অভ্র বলল,
-“বলতে পারিস। কিচ্ছু হবে না।”
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আজকের ঘটনা সম্পূর্ণ খুলে বলল অর্ঘমা। নীরদ সামনে আছে বলে শুধু নিজের পছন্দের ব্যাপারটা চেপে গেল। সবটা শুনে অভ্র, নীরদ দু’জনেই বেশ ক্ষেপে গেল। অভ্র রেগে বলল,
-“ওই শালার কলিজা কত বড় আমিও দেখব। ও কার বোনের দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছে জানে না। এর শেষ আমি দেখে ছাড়ব। আর তুই! আগামীকাল থেকে আমি তোকে স্কুলে দিয়ে আসব আবার আমিই তোকে নিয়ে আসব। মনে থাকবে?’
-“হু।”
-“এখন কান্না বন্ধ করে গিয়ে চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে আয়। খাবার টেবিলে তোর জন্য অপেক্ষা করছি আমি।”
অর্ঘমা মাথা নাড়িয়ে উঠে গেল। অভ্র আর নীরদ রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
খাবার টেবিলে গিয়ে দেখতে পেল নীরদ আর অভ্র কি নিয়ে যেন আলোচনা করছে। অর্ঘমা চেয়ার টেনে ভাইয়ের পাশে বসে পরল। অভ্র তিন প্লেটে খাবার বেড়ে যার যার দিকে এগিয়ে দিল। নীরদ চলে যেতে চেয়েছিল কিন্তু অভ্র তাকে যেতে দেয়নি। অর্ঘমা চুপচাপ বসে কোনোমতে একটু খেয়ে উঠে রুমে চলে গেল। অভ্র আর নীরদ নিজেদের মধ্যে কথা বলে সব গুছিয়ে নিল।
চলবে…