কালো মেঘ পর্ব :- ০১

0
3040

গল্প :- কালো মেঘ
পর্ব :- ০১
Writer :- Kabbo Ahammad

~”আপনার মেয়ে নুসরাতকে দিয়ে গেলাম আপনার কাছে! যেদিন তাকে একজন প্রকৃত মানুষের মতো মানুষ হিসেবে তৈরি করতে পারবেন, সেদিন আমার বাড়ি দিয়ে আসবেন! এর আগে যদি কখনও আপনার মেয়ে আমার বাসার ত্রি সীমানায় পা রাখে তাহলে তো জানেন আমি কী করতে পারি!
.
.
.
এক দমে কথা গুলো বলে কাব্য তার স্ত্রী নুসরাতকে শ্বশুরের কাছে রেখে, শ্বশুর বাড়ি ত্যাগ করলো। নুসরাতের বাবা জাফর মিয়া কথা গুলো দম বন্ধ করে শুনছিল। কারন তার জবাব দেবার মতো কোনও ভাষা জানা নেই।

-কাব্য চলে যাবার পরে জাফর মিয়া নুসরাতের সামনে এগিয়ে গেলো। ছলছল নয়নে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নুসরাতের ডান গালে একটা চর বসিয়ে দিলেন।
এই প্রথম আঁদরের মেয়ের গায়ে হাত তুললেন। নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলেন না। হাত কাঁপছে। বুক ফেটে কান্না পাচ্ছে। মন চাচ্ছে এই মুহূর্তে এই নিষ্ঠুর দুনিয়া ত্যাগ করতে। কখনও কল্পনাও করেনি তার আঁদরের মেয়ের গায়ে হাত তুলবেন। আজ এমন একটা দিন আসবে ভাবতেও পারেনি। সঙ্গে সঙ্গে নুসরাতের সামনে থেকে চলে গেলেন। বাসা থেকে বেরিয়ে সোজা দক্ষিণ পাড়ার কবরস্থান এর দিক এগিয়ে চললেন। যেখানে তার প্রিয় মানুষটি চিরনিদ্রায় আছেন। মন খারাপ করলে বা কষ্ট পেলে ছুটে চলে আসেন এই স্থানে। এখানে এসে প্রিয় মানুষটির কবরের পাশে কিছুক্ষণ সময় কাটালে মন ভালো হয়ে যায়।
.
.
.
-নুসরাতের বয়স যখন ছয় বছর তখনই এই মানুষটি স্বার্থপর এর মতো সবাইকে একা করে পরপারে পাড়ি জমান। জাফর মিয়া ছোটবেলা থেকে অনেক পরিশ্রম করে আসছেন। বাবা-মা মারা যাবার পর সংসার এর হাল তাকেই ধরতে হয়। কারণ সে ছিল সংসারের বড় সন্তান। হুট করেই একদিন ভালোবেসে ফেলে রহিমা খাতুন নামের একটা মেয়েকে। বিয়ে করে বেশ সুখেই কাটতে থাকে তার দিনগুলো। ভেবেছিল এই বুঝি তার দুঃখ কষ্ট মুছে গেলো। কিন্তু না! নুসরাতের জন্মের ছয় বছরের মাথায় রহিমা খাতুন ও তাকে নিঃস্ব করে চলে যান।
.
.
.
-কবর এর পাশে দাঁড়িয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন জাফর মিয়া। আজ তার মন চাচ্ছে কবরের ভিতরে থাকা মানুষটিকে টেনে উপড়ে তুলতে! মন চাচ্ছে নুসরাতের নামে বিচার দিতে। সে থাকলে হয়তো আজ নুসরাতের জন্য এত অপমান হতে হতো না। তারপর কবরের মাথার দিকে এসে হাটু গেড়ে বসে পড়লেন। চোখের পানি মুছতে মুছতে মিনমিন করে বলতে লাগলেন।

–“ভেবেছিলাম মেয়েটি তোমার মতোই হবে। তোমার মতো আদর্শবান হবে। তোমার মতো দয়ালু হবে। কিন্তু না! মেয়েটি সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়েছে। তাকে আমি পারিনি নিজের মতো করে মানুষ করতে। পারিনি তোমার চরিত্র তার ভিতর প্রবেশ করাতে। তবে ভেবো না যেন রহিমা, আমি তাকে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে তৈরি করতে দুর্বলতা দেখিয়েছি। আমি কিন্তু আমার সাধ্য অনুযায়ী তাকে মানুষ করতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু সবাই মনে করে আমি আমার মেয়ে নুসরাতকে শাসন করিনি। তাকে আমি স্বাধীনতা দিয়ে মাথায় তুলে রেখেছি।
হ্যাঁ স্বাধীনতা আমি দিয়েছি, তবে সেটা একজন আদর্শবান নারীর মতো করে। আচ্ছা রহিমা তোমার ও কি তাই মনে হয়? থাক বলতে হবে না! তুমি তো কথাই বলতে পারো না এই দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে।
.
.
.
জাফর মিয়া কথা গুলো বলে উঠে দাঁড়ালেন। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলেন কেউ তার পাগলামি দেখো ফেললো কিনা! সে তার মনের শূন্যতা পূরণ করতে এমন আচরণ করে রহিমা খাতুনের কবের পাশে বসে। এটা কেউ দেখলে নিশ্চিত তাকে পাগল বলবে এটা সে জানে। আজ একটু বেশিই কথা বলেছে রহিমা খাতুনের সঙ্গে। তাই চারপাশে একটু চোখ বুলিয়ে নিলো। আকাশে মেঘ জমেছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। হয়তো বৃষ্টি হবে। রহিমা খাতুন বেঁচে থাকতে তারা বৃষ্টিতে ভিজে অনেক স্মৃতি তিলে তিলে গড়ে তুলেছিল। রহিমা খাতুন মারা যাবার পর থেকে আর কোনোদিন জাফর মিয়া বৃষ্টির ছোঁয়া তার শরীরে স্পর্শ কারায় নি।
দূরে বেশ দূরের গাছপালা গুলো ঘোলা হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে কুয়াশাতে ঢেকে যাচ্ছে। জাফর মিয়া বুঝে ফেলেছে ওটা কুয়াশা না, ওটা বৃষ্টি তার দিকে ধেয়ে আসছে। কবর এর দিকে তাকিয়ে আবার বললেন।

–“বৃষ্টি আসছে রহিমা! আজ আর তোমাকে সময় দিতে পারবো না। ভালো থেকো।

কথাটা বলে একটা মুচকি হাসি দিলেন। মুখে হাসি থাকলেও অন্তরে তার কষ্ট দুঃখ জমাট বেঁধে আছে। রহিমা খাতুন বেঁচে থাকতে একদিন শুধু বলেছিল, কখনও বিদায় নেওয়ার সময় যেন হাসি মুখে বিদায় নেয়। সেই থেকে জাফর মিয়া বিদায় নেবার সময় হাসি মুখে বিদায় নেয়, শত কষ্ট দুঃখ থাকলেও।
.
.
.
ওদিকে নুসরাত রুমের দরজা লাগিয়ে বসে আছে। কিছুক্ষণ আগের ঘটনা তার কাছে স্বপ্ন মনে হচ্ছে।
যে বাবা কখনও তাকে একটা বেশি কথা পর্যন্ত বলে না সহজে, আজ সেই বাবা কিনা তাকে মারলো! কাব্য যখন তার বাবা’কে বেশি কথা বলছিল তখন তার মন চাচ্ছিল কাব্যর গালে টেনে একটা চর মারতে। কিন্তু তার বাবা সেখানে থাকার কারণে সে এই কাজটা করতে পারেনি। সে জানে স্বামী’র গায়ে হাত তোলা মহাপাপ। তবুও সে কখনও কাব্যকে ছাড় দিয়ে কথা বলে না। সে যখন রেগে যায় তখন আশপাশ তার খেয়াল থাকে না। নিজের এই রাগ বদমেজাজ তার কতটা ক্ষতি করছে সে জেনেও এই রাগ কনট্রোল করে না। কনট্রোল করে না বললে ভুল হবে, সে আগে অনেক বার চেষ্টা করেও ব্যর্থ! তাই এখন আর এসব নিয়ে ভাবে না। তার মাথায় এখন একটাই কথা ঘোরে, আর তা হলো তার বিরুদ্ধে কেউ গেলে তার প্রতিবাদ করতে হবে। তাতে যদি তার জীবন ও চলে যায় তুবও সে থেমে থাকবে না।
.
বাবা’কে করা অপমান আর সইতে পারছে না। মন না চাইলেও বারবার সেই দৃশ্যটা তার চোখে ভেসে উঠছে। তার মনে বারবার একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, কাব্য তার সম্পর্কে বাবা’র কাছে না বললেই পারতো।
কী দরকার ছিল একটা মেয়েকে তার বাবা’র কাছে দোষী করার। তাছাড়া সে তো তেমন দোষের কিছু করেছে বলে মনে পড়ছে না। আজ সকালবেলা তাকে যখন কাব্য এখানে নিয়ে আসে তখন কাব্যকে অনেকবার প্রশ্ন করেছিল, তাকে কেন তার বাবা’র বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু কাব্য কোনো উত্তর দেয়নি। অনেক ভেবেও এর উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না নুসরাত।

তখন হটাৎ তার মনে পড়লো গতকাল বিকেলবেলার কথা। নুসরাত গতকাল বিকেলবেলা রাসেলের সঙ্গে মার্কেটে গিয়েছিল! তাহলে কাব্য কি তাদেরকে একসাথে দেখে ফেলেছে নাকি? যদি এটাই কারণ হবে তাহলে কাব্য তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করতে পারতো। কিন্তু সেটা না করে তাকে তার বাবা’র বাড়িতে দিয়ে গেলো।
.
.
.
এদিকে কাব্য নুসরাতকে তার বাবা’র বাড়ি রেখে নিজের বড় বোন নাহিদার বাসায় চলে আসছে। নাহিদা কাব্যকে হঠাৎ দেখে বেশ চমকে যায়।

–“কিরে ভাই তুই হটাৎ করে এখানে.

–“এমনি। তোদের কথা খুব মনে পড়ছিল তাই চলে আসলাম।

নাহিদা তখন কাব্যকে পেয়ে বেশ খুশি হলো। কতদিন পর ভাইটাকে দেখেছে। তারপর কাব্যকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা লক করতে করতে বললো।

–“নুসরাত কোথায়? ওকে আনলি না যে?

কাব্য তখন একাট চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে বললো।

–“নুসরাত ওর বাবা’র বাড়ি আছে। ওর কথা বাদ দে।দুলাভাই কোথায়? আর আমার মিমি মামণি কোথায়?

–“তোর দুলাভাই ব্যবসার কাজে শহরের বাইরে আছে। আর মিমি তো স্কুলে।

কাব্য আসার সময় মিমির জন্য কিছু চকলেট কিনে নিয়ে আসছিল। সেগুলো পকেট থেকে বের করে টেবিলে উপর রাখতে রাখতে বললো।

–“মিমির জন্য চকলেট আনলাম। এগুলো ওকে দিস। আমি চলে গেলাম।

–“চলে যাবি মানে? মাত্র ই তো আসলি। তাছাড়া কতদিন পর আসলি, কয়দিন থাকবি তারপর যাবি।
(নাহিদা ভ্রু কঁচকে জিজ্ঞেস করলো)

কাব্য তখন বসা থেকে দাঁড়িয়ে বললো,

–“না আপা। আজ আর থাকতে পারছি না। অন্য একদিন এসে থাকবো।

নাহিদা তখন কাব্যর হাত টেনে আবার বসিয়ে দিল।

–“কোথাও যেতে পারবি না তুই। আগে কয়দিন এখানে বেরাবি তারপর। আর তাছাড়া নুসরাতও তো বাসায় নেই। একা একা বাসায় বসে কী করবি? তারচেয়ে বরং এখানে থাক, নুসরাত আসলে তখন চলে যাস।

–“কিন্তু আপা,,,

–“কোনো কিন্তু নেই। আমি তোর বড় বোন যা বললাম তাই!

আসলে কাব্যর মূল উদ্দেশ্য ই ছিল নাহিদা আপার এখানে থাকার। সেই কারণেই এখানে আসছে। কিন্তু অনেকদিন পরে এভাবে হুট করে এসে থাকাটা খারাপ দেখায়। তাছাড়া নাহিদা আপা তো অন্যের সংসার করে। এসব ভেবেই চলে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু নাহিদা আপার জোরাজুরি তে থাকতে হলো।
.
.
.
ওদিকে জাফর মিয়ার শরীর বৃষ্টির পানিতে ভিজে গেছে। সে এই পনেরো বছর থেকে বৃষ্টি এড়িয়ে আসছে, আজ সেই বৃষ্টি তাকে ভিজিয়ে দিলো। তার প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে নিজের উপরে। বাড়ির বারান্দাতে দাঁড়িয়ে শরীরের ভেজা শার্ট খুলতে লাগলেন, আর নুসরাতকে ডাকতে লাগলেন শরীর মোছার গামছা দিয়ে যাবার জন্য। বেশ কয়েকবার ডেকেও নুসরাতের সারা পেলেন না। তাই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরে, ভেজে অবস্থা ঘরে ঢুকলেন। কিন্তু রুমের সামনে গিয়ে দেখলেন দরজা ভিতর থেকে লক করা। তারপর দরজায় নক করতে লাগলেন আর নুসরাতের নাম নিয়ে জোরে জোরে ডাকছেন। তখন কোনো সারা না পেয়ে, এক পর্যায়ে রুমের দরজা জোরে ধাক্কা দিয়ে লক ভেঙে ফেললেন। তারপর রুমে ঢুকে যা দেখলেন তা সে কল্পনাও করতে পারেননি। নুসরাত গলায় ওড়না পেঁচিয়ে পাখার সাথে ঝুলে আছে! দৌঁড়ে গিয়ে নুসরাতের পা ধরে উঁচু করে রাখলেন। তার চিৎকার শুনে আশেপাশের সবাই চলে আসলো। নুসরাতকে নামিয়ে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া হলো।
.
.
চলবে……………♥

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে