#কান্তা_মনি
#পর্ব_১৯
#লেখনীতে_আফিয়া_অন্ত্রীশা
কনে সাজে অপরূপ লাগছে হেতিজাকে। মেয়ের থুতনি ধরে শাহ জাহাঙ্গীর মির্জা “মা শা আল্লাহ” বলে তার কপালে একটা চুমু এঁকে দেন। মেয়েকে বুকে আগলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন। আব্বা-আম্মা, প্রিয় ভাই-ভাবি আপনজনদের ছেড়ে চলে যাবে ভেবেই বুকটা দুমড়ে-মুচড়ে আচ্ছে হেতিজার। মেয়েদের জীবন আসলেই কত অদ্ভুত!
বিয়ের কার্যক্রম শেষ। এখন যে বিদায়ের পালা। নূর জাহানকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কান্না করতে লাগল হেতিজা। ভালোবাসার মানুষোটাকে নিজের করে পেলেও এই মায়ার টান যে সহজে কোনো মেয়েই ছাড়তে পারেনা। শত সংগ্রাম করে তাকে মানিয়ে নিতে হয় নতুন পরিবেশে।
-ভাবিজান আমার ভাইজানকে তুমি দেখে রেখো। যাই করো আমার ভাইজি/ভাইপো আর তোমার যেন কোনো ক্ষতি না হয়। (কান্তা মনিকে জাপটে ধরে কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে ওঠে হেতিজা)
কান্তা মনির চোখের কোণ বেয়ে এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে।
জমিদার বাড়িতে আনন্দের মাঝেও ছোট-খাটো একটা শোকও নেমে এসেছে। সারা বাড়ি দাপিয়ে বেড়ানো মেয়েটা আজ সকলকে ছেড়ে শ্ত মায়া জমিয়ে রেখে শশুড়বাড়িতে চলে গেল। মেয়েদের জীবনটাই তো এমন।
-আম্মা আসব? (কান্তা মনি)
-হুম আয় মা। (বেগম নূর জাহান)
-আম্মা! (কান্তা মনি)
-কিছু বলবি? (বেগম নূর জাহান)
-না মানে । হুম আম্মা আমি একটা কথা জানতে চাই। (কান্তা মনি)
-কি কোথা বল? (বেগম নূর জাহান)
-আচ্ছা আম্মা নুরুল ফুপা আর মুঞ্জিলা চাচীজানের সাথে কি ঘটেছিল? কেন মুঞ্জিলা চাচীজান সবসময় ভয় পায়? আর আমার মনে হয় না জ্বীনের আচড়ে মুঞ্জিলার মাথায় সমস্যা হয়েছে। কোনো একটা ঘটনা নিষচয়ই ঘটেছিল। আমাকে বলেন আম্মা দোহায় লাগে। (কান্তা মনি)
কান্তা মনির এহেন প্রশ্নে মুখখানা ফ্যাকাশে হয়ে যায় বেগম নূর জাহানের।
-হ হঠাত এমন কথা জানতে চাচ্ছিস যে? (বেগম নূর জাহান)
-বলেন না আম্মা। (কান্তা মনি)
-আমি কিছুই জানিনা।(বেগম নূর জাহান)
-আম্মা আপনি জানেন সবই। এবাড়ির প্রায়ই বড়রা সবাই ই জানে। কিন্তু কেউই বলবেনা আমাকে। একমাত্র আপনিই ভরসাআ। বলুন না আম্মা। এই কথাটা না জানলে হয়ত বড্ড ভুল হবে আম্মা। আর ভুলের ফলে কি হতে পারে তা আপনিও নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। (কান্তা মনি)
-হুম । বস একটু। (বলেই বেগম নূর জাহান পালঙ্ক থেকে উঠে দ্বার খুলে আশপাশ পর্যবেক্ষণ করে দ্বার বন্ধ করে দিয়ে পুনরায় পালঙ্কের ওপর এসে বসলেন।
-মুঞ্জিলাকে আমি সবসময় আমার ছোট বোনের মতোই দেখে আসছি। মুঞ্জিলা ছিল গ্রামের সেরা সুন্দরী। আর নুরুল মানে মেহেরুন্নেছার স্বামী হচ্ছে মুঞ্জিলার মামাতো ভাই। যতটুক জানি নুরুল নাকি মুঞ্জিলাকে তার বিয়ের অনেক বছর আগে থেকেই ভালোবাসতো। কিন্তু নুরুল তা আর প্রকাশ করতে পারেনি। মুঞ্জিলাকে সুলতান প্রথম দেখেই পাগল হয়ে গেছিল বিয়ে করার জন্য। পরে তো আমি আর তোমার তোমাদের আব্বাজান গিয়ে মুঞ্জিলাকে দেখেশুনে পছন্দ করে রেখে আসি সুলতানের জন্য। বিয়ের আগেরদিন নাকি মুঞ্জিলার বিয়ের কোথা শুনে নুরুল ছুটে আসছিল। উন্মাদ হয়ে গেছিল নাকি। মুঞ্জিলাকে বারবার ভালোবাসার কোথা বললেও নাকি ফিরেও তাকায়নি। পরে নুরুলের সাথে মেহেরুনেচ্ছার বিয়ে হয়। নুরুল আর মেহেরুন্নেছার সংসারে নাকি বনিবনা হচ্ছিল না। পরে নওশাদের জন্ম হয়। একদিন নাকি সুলতান নুরুল আর মুঞ্জিলাকে কথা বলতে শুনে নিয়েছিল। কথাটা এমন ছিল, “আপনার বিয়ে হয়েছে নুরুল ভাই,একটা ছেলেও আছে। আপনি কিভাবে আমাকে ভালোবাসার কথা বলেন”? সুলতান মুঞ্জিলাকে সবসময় চোখে চোখে রাখতো। নুরুলের সাথে কথা বলতে দেখে মুঞ্জিলাকে অনেক কক্ষে নিয়ে অনেক মারধর করে সুলতান। মুঞ্জিলার একটা কথাও শোনেনি সে। তারপর থেকে একটু কিছুতেই মুঞ্জিলাকে মারধর করতো সুলতান। এমনি কি বড় ছেলেটাও পর্যন্ত নিজের মার গায়ে হাত তুলতো। সুলতানের কান ভারী করা হইছিল। নুরুলের সাথে নাকি মুঞ্জিলার খারাপ সম্পর্ক আছে। পরে মুঞ্জিলার কপালে নেমে আসে ঘোর আধার। এক রাতে মুঞ্জিলা নুরুলকে ডেকে এনে কান্না করে অনুরোধ করে সবাইকে বলতে বলে যে তাদের মাঝে কোনো প্রকার সম্পর্কই নেই। কিন্তু কে জানতো এই ডেকে কথা বলাটাই ওদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে? কে যেন এই দৃশ্য দেখে তোমাদের আব্বাজান আর চাচাজানের কানে দেয় যে,মুঞ্জিলা আর নুরুল নাকি পালিয়ে যাচ্ছে। তোমাদের আব্বাজান আর চাচাজান তরোয়াল নিয়ে হনহন করে বেরিয়ে যায়। দুজনকে একজায়গায় পেয়ে আরও নিশ্চিত হয়ে যায়। সেখানেই নুরুলকে হত্যা সুলতান। এর পরে মেহেরুন্নেছা আর নওশাদকে নুরুলদের বাড়ি থেকে বের করে দেয়। আমার কোথা একটাই কেন নুরুল বিয়ের পরে সমস্ত ভালোবাসা তার স্ত্রীকে সপে দিতে পারলো না? কেন নুরুল পরের স্ত্রীর কাছে বারবার ভালোবাসা প্রকাশ করতে গেল? তার এই একটা ভুলের জন্য নিজেকে তো মাশুল দিতেই হলো সাথে সাথে আরও তিনটে জীবনকেও বেচে থেকেও মরার মতো বাচতে হয়েছে। মুঞ্জিলার প্রতি অত্যাচার আরও বেড়ে যায়। মুঞ্জিলা আমাকে কান্না করে করে সব খুলে বলে। কিন্তু আমি কিছুই করতে পারিনি। নিরব হয়ে থাকতাম। শেষ পর্যায়ে এত অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে মেয়েটা পাগল হয়ে গেল। গ্রামের কেউ এখনো জানেনা যে নুরুলকে হত্যা করা হয়েছিল। এমন কি জমিদারবাড়ির বড়রা ছাড়াও কেউ জানেনা নুরুলের হত্যার কথা। সকলকে বলা হয় জ্বীনের আচড়ে মুঞ্জিলা পাগল হয়ে গেছে। (বলেই বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন বেগম নূর জাহান)
কান্তা মনির মাথাটা যেন ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে। কি নির্মম ঘটনা! বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় কান্তা মনি।
টলতে টলতে নিজের কক্ষে প্রবেশ করে কান্তা মনি। পালঙ্কের পর এসে ধপ করে বসে পড়ে। কিছুক্ষণ পরেই জমিদার নিয়াজ মির্জা গটগট পায়ে কক্ষে প্রবেশ করে। কান্তা মনিকে চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখে তার পাশে গিয়ে বসে নিয়াজ মির্জা।
-কি হয়ে কান্তা মনি? তোমার মুখটা এমন ফ্যাকাশে লাগছে কেন? (নিয়াজ মির্জা)
কান্তা মনি নিশ্চুপ হয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে আছে।
-কান্তা মনি আমি কিছু বলছি! (জমিদার নিয়াজ মির্জা)
-হুম! (ধ্যান ভাঙ্গে কান্তা মনির)
-তোমার মুখটা এমন ফ্যাকাশে লাগছে কেন? কিছু হয়েছে? (জমিদার নিয়াজ মির্জা)
-না কিছু হয়নি। এমনিই শরীরটা ভালো লাগছে না। (কান্তা মনি)
-কি বলছো? বেশি খারাপ লাগছে। শুয়ে পড়। বিশ্রাম নাও তো একটু। (জমিদার নিয়াজ মির্জা)
-হুম। আপনাকে না একটা কথা বলার আছে। (কান্তা মনি)
-কি কথা? (জমিদার নিয়াজ মির্জা)
-আপনি একটু সাবধানে থাকবেন। আমার না খুব ভয় লাগছে। (ভীতু চোখে তাকায় কান্তা মনি)
-আমার কান্তা মনিকে আমি আগেও বলেছি আমি তাকে সাহসী রূপে দেখতে চাই। ভীতু রূপে তাকে মানায় না। কি হয়েছে এবার আমাকে বল? (জমিদার নিয়াজ মির্জা)
নওশাদের কথা কি সে নিয়াজকে বলবে? নাকি বলবেনা? দ্বিধা-সংকোচ নিয়ে মনের সাথে এক দফা যুদ্ধ করে যাচ্ছে কান্তা মনি।
কান্তা মনি কিছু একটা বলতে নিতেই নওশাদ কক্ষের দ্বারে কড়া নাড়ে। কক্ষে হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করে ।
-ভাইজান এখনো প্রস্তুত হওনি? তাড়াতাড়ি নৌকা কিন্তু হাজির নদীর ঘাটে। আব্বা দ্রুত বলেছে নিচে নামতে। (নওশাদ)
-আসছি। তুই যা। (জমিদার নিয়াজ মির্জা)
নওশাদ বেরিয়ে যেতে জমিদার নিয়াজ মির্জা বলে ওঠে,
-কি? বল কি বলতে নিয়েছিলে?
-ক কিছু না। আপনি কোথায় যাবেন? (কান্তা মনি)
-ওহ হ্যা তোমাকে তো বলতে ভুলেই গেছি। শহর থেকে চিঠি এসেছে। আজকেই শহরে যেতে হবে। ব্যবসার জন্য কি একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক আছে। তাই দুদিনের জন্য শহরে যেতে হচ্ছে। (জামা-কাপড় ও গুরুত্বপূর্ণ কাগজ-পত্র সুটকেসের ভেতর রাখতে রাখতে বলে ওঠে জমিদার নিয়াজ মির্জা)
দুদিনের কথা শুনেই বুকটা কেপে ওঠে কান্তা মনি। ভয়টা যেন দুই গুণ বেড়ে গেছে।
-আমার কেন জানিনা খুব ভয় লাগছে। না গেলে হয় না? (কান্তা মনি)
-অনেক গুরুত্বপূর্ণ যেতেই হবে। (জমিদার নিয়াজ মির্জা)
-কে কে যাচ্ছে ? (কান্তা মনি)
-চাচাজান,নওশাদ,আহসান আর আমি। (জমিদার নিয়াজ মির্জা)
কান্তা মনির সারা শরীরে একটা শিহরণ বয়ে যায়। বুকের ভেতর ধুকপুকটা যেন আরও বেড়ে গেছে। জাপটে জড়িয়ে ধরে নিয়াজকে। মনে মনে ভাবতে থাকে ,”সে কি বড় ভুল করছে নিয়াজকে কিছু জানিয়ে”?
ভাবনার মাঝেই নিয়াজ কান্তা মনিকে ছাড়িয়ে তার কপালে একটা চুমু একে দিয়ে একটু কুজো হয়ে কান্তা মনির পেটে একটা গাঢ় চুমু খেয়ে বলে ওঠে,
-আম্মাকে একদম জ্বালাবেনা ঠিক আছে? আর আব্বাজানের জন্য অনেক অনেক দোয়া করবে যেন সহিহ সালামত ফিরতে পারে।
কান্তা মনি নিয়াজ মির্জার দু হাত নিজের দু হাতের মুঠোয় চুমু খায়।
-সাবধানে যাবেন। চোখ খোলার রেখে চলা-ফেরা করবেন। আম্মাজানের সাথে দেখা করে যাবেন। (বলেই কান্তা মনি চোখের পানি ছেড়ে দেয়)
-তুমি নিজের খেয়াল রেখো আর আম্মার সাথে সাথে থেকো। ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়া করো। আসি। (কান্তা মনির চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলে ওঠে জমিদার নিয়াজ মির্জা)
জমিদার নিয়াজ মির্জা চলে যেতেই জায়নামাজ বিছিয়ে বসে পড়ে কান্তা মনি। আল্লাহর কাছে যে তার অনেক অনেক সাহায্য চাই। দু হাত মেলে দিয়ে আজ আল্লাহর কাছে অনেক অনেক দোয়া চাইবে সে।
সময় যেন কাটতেই চাইছেনা। দুই দিন যে কান্তা মনির কাছে দুই বছরের ন্যায় মনে হয়েছে। আকাশটা যেন আজ গুমোট বেধে আছে। কতশত অভিমান নিয়ে যেন সে তার বুকে কালো মেঘকে নিজ আগ্রহে আপন করে নিয়েছে।
সিংহদ্বার দিয়ে একে একে ভেজা শরীরে শাহ সুলতান মির্জা,শাহ আহসান মির্জা ওঃ নওশাদ প্রবেশ করেছে। কিন্তু কান্তা মনির চোখ যেন অন্য কাউকে খুজে চলেছে। কিন্তু তার যে কোনো দেখাই নেই। না পেরে কান্তা মনি বাকি তিনজনের মুখপানে চায়। আজকের আকাশের ন্যায় যেন তাদের মুখেও কালো মেঘের আধার এসে জমা হয়েছে।
-উনি কোথায়? (কান্তা মনি)
কান্তা মনির কথা শুনে তিনজনেই মাথা নিচু করে নেয়।
কান্তা মনির বুকটা কেন যেন ছ্যাত করে ওঠে।
-কি হলো বলুন উনি কোথায়।
-ফেরার পথে নৌকায় দস্যুরা আক্রমণ করে। দস্যুরা অপহরণ করে নিয়েছে নিয়াজকে। আমরা কোনো মতে প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরেছি। দুজন রক্ষী সেখানেই হত্যা হয়েছে। (শাহ আহসান মির্জা)
কান্তা মনি ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ে।
চলবে…
#কান্তা_মনি
#পর্ব_২০
#লেখনীতে_আফিয়া_অন্ত্রীশা
-উনি কোথায়? (কান্তা মনি)
কান্তা মনির কথা শুনে তিনজনেই মাথা নিচু করে নেয়।
কান্তা মনির বুকটা কেন যেন ছ্যাত করে ওঠে।
-কি হলো বলুন উনি কোথায়।
-ফেরার পথে নৌকায় দস্যুরা আক্রমণ করে। দস্যুরা অপহরণ করে নিয়েছে নিয়াজকে। আমরা কোনো মতে প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরেছি। দুজন রক্ষী সেখানেই হত্যা হয়েছে। (শাহ আহসান মির্জা)
কান্তা মনি ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ে।
রেহানা দৌড়ে গিয়ে কান্তা মনিকে ধরে নেয়। বেগম নূর জাহান ধপ করে পাশের গদিতে বসে পড়েন। মেহেরুন্নেছা ফটাফট গিয়ে বেগম নূর জাহানকে দু হাতে আগলে নেন।
কান্তা মনি টলমল চোখে শাহ সুলতান মির্জার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
-চাচাজান! আপনি কিভাবে পারলেন ওনাকে একা বিপদে ফেলে রেখে চলে আসতে! বলুন কিভাবে পারলেন? (চিতকার করে বলে ওঠে)
শাহ সুলতান মির্জা ধীরে মাথাটা নুয়ে নেয়।
-কি হলো বলুন? কিভাবে পারলেন ওনাকে একা বিপদে ফেলে রেখে চলে আসতে? বলুন? বলছেন না কেন? আহসান ভাইজান আপনি কেন আসলেন? আমার ওনাকে কেন একা রেখে চলে এলেন? বলছেন না কেন? (চিৎকার করে মেঝেতে দুহাত মুঠো পাকিয়ে আঘাত করতে শুরু করে কান্তা মনি)
কান্তা মনির চিৎকার শুনে কক্ষ হতে শাহ জাহাঙ্গীর মির্জা বেরিয়ে আসেন। সকলের ফ্যাকাশে মুখ দেখে কিছুটা ভড়কে যান জাহাঙ্গীর মির্জা)
-কি হয়েছে এখানে এত চিৎকার-চেচামেচি কেন হচ্ছে? (শাহ জাহাঙ্গীর মির্জা)
শাহ জাহাঙ্গীর মির্জাকে দেখে বেগম নূর জাহান কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
-কি হয়েছে নূর জাহান? তোমরা এভাবে কান্না করছো কেন? (শাহ জাহাঙ্গীর মির্জা)
-শুনছেন? আমাদের পুত্রকে নাকি দস্যুরা অপহরণ করে নিয়েছে। আমার পুত্রকে আমার কাছে যেভাবে পারেন এনে দিন আপনি। আমার পুত্রের যেন কিছু না। আমার পুত্রে একটু ক্ষতি হলে কিন্তু আমি কাউকে ছাড়ব না। (বেগম নূর জাহান)
-সুলতান? কি হয়েছিল? কিভাবে হলো এসব? আমার অমন বাঘের মতোন পুত্রকে কাবু করল কিভাবে? তোমরা কি করতে ছিলে সেখানে? (হুংকার দিয়ে বলে উঠেন শাহ জাহাঙ্গীর মির্জা)
শাহ সুলতান মির্জা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে সব খুলে বলেন। শাহ জাহাঙ্গীর মির্জা সব শুনে ধপ করে গদিতে বসে পড়েন। চোখ বেয়ে যেন এখনই টুপ করে একফোটা জল গড়িয়ে পড়বে।
-সব মিথ্যা। সব মিথ্যা বলছে এরা। এরাই আমার ওনাকে সরিয়ে নিয়েছে। আমার ওনার কোনো ক্ষতি করেনিতো এরা? (মেঝে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে ওঠে কান্তা মনি)
-কি বলছো এসব তুমি কান্তা মনি? (শাহ সুলতান মির্জা)
কান্তা মনি গটগট পায়ে তেড়ে গিয়ে নওশাদের গলার কাছের জামার অংশটুকু খামছে ধরে বলে ওঠে,
-তুই বল কি করেছিস তোরা ওনার সাথে। বল? কেন এমন করলি? কোথায় রেখেছিস ওনাকে তোরা? কোনো ক্ষতি করিসনি তো? (কান্না করতে করতে)
-কান্তা মনি তুমি কি বলছো এসব? মাথা ঠিক আছে তোমার? (মেহেরুন্নেছা)
-আমি ঠিকই বলছি আর আমার মাথাও ঠিক আছে। ফুফুজান আপনি আপনার পুত্রের চরিত্র সম্পর্কে অবশ্যই জানেন। আর সে আমাকে যেভাবে হুমকি দিয়ে আসছে তার দ্বারাও এমন কিছু করা অসম্ভব কিছুনা। আর আহসান ভাইজান আর চাচজান আমার সন্দেহের তালিকায় সবসময় আছেন তাদের কার্যক্রমের দ্বারা। (কান্তা মনি)
-কান্তা মনি উল্টোপাল্টা বকো না। তুমি কক্ষে চলো। আসো। (কান্তা মনিকে হাত ধরে টেনে কক্ষে নিয়ে আসেন মেহেরুন্নেছা)
-ফুফুমনি আপনি আমার কথা কেন বিশ্বাস করছেন না? ওনার কোনো একটা ক্ষতি করে ফেলে ওরা মিলে। (কান্তা মনি)
-থামো কান্তা মনি। ওদের তিনজনের কোনো হাত নেই এতে। এই বাড়ির কোনো কর্মচারী আছে এত হাত। তারা সকল খবর দস্যুদের কাছে দেয়। আমার সন্দেহের তালিকায় কিছু মানুষ আছে। (মেহেরুন্নেছা)
কান্তা মনি বুঝে নিয়েছে মেহেরুন্নেছাকে কিছু বলে লাভ হবেনা। প্রিয় মানুষদের প্রতিটা মানুষ অন্ধ বিশ্বাস করে। আর কথা না বাড়িয়ে কান্তা মনি চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে ধপ করে পালঙ্কে বসে পড়ে।
-ফুফুমনি আমি কি করব? আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে যে। (কান্তা মনি)
-কাঁদিস নারে মা। জাহাঙ্গীর ভাইজান কিছু একটা করবে নিশ্চয়ই। কোনো ক্ষতি না হোক ওর। কি এমন উদ্দেশ্যে এমনটা করল দস্যুরা? (কান্না করতে করতে বলে ওঠেন মেহেরুন্নেছা)
শাহ জাহাঙ্গীর মির্জা তো চিন্তিত ভঙ্গিতে সেই যে মাথা নুয়ে রেখেছেন তা তোলার আর নাম নেই। সকলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে বৈঠকখানায়। বেগম নূর জাহান তো বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন। ছেলের অনুপস্থিতিতে সে একদম ভেঙ্গে পড়েছেন।
কান্না করতে করতে দূর্বল শরীরে কখন যে কান্তা মনি ঘুমিয়ে পড়েছিল তা ঠিক খেয়াল নেই তার। পিটপিট করে চোখ খুলতেই নওশাদকে তার মুখের সামনে ঝুঁকে থাকতে দেখে আঁতকে ওঠে কান্তা মনি। ঝটপট করে শোয়া থেকে উঠে বসে কান্তা মনি।
-এ কি উঠলে কেন? তুমি অনেক ক্লান্ত পাখি। এখন যত পারো একটু বিশ্রাম নাও আর প্রাণ ভরে নিশ্বাস নাও। কেননা একটু পর তোমাকে যা শোনাবো তোমার কি হাল হবে আমি জানিনা। (বলেই বাকা হাসি দেয় নওশাদ)
মুহূর্তের মধ্যে শরীরের কম্পন থেমে যায় কান্তা মনির। থমকে যায় সে। সে যা ভাবছে কোনো ভাবেকি তাই শোনাতে যাচ্ছে নওশাদ তাকে? চোখ যেন ঝাপসা হয়ে আসছে কান্তা মনির।
-অপেক্ষা না করাই। চলো কিছুটা সময় পেছনে যাওয়া যাক। (নওশাদ)
শহরের সকল কাজ শেষ করে দুদিনের দিনই গ্রামের পথে রওনা হয় জমিদার নিয়াজ মির্জা ,শাহ সুলতান মির্জা, শাহ আহসান মির্জা, নওশাদ আর তাদের অন্যান্য সঙ্গীরা।
নৌকা চলছে তার আপন গতিতে। ঢেউয়ের তালে তালে মাঝে মাঝে নৌকাখানা দুলে উঠছে। মৃদু বাতাস মনে এক অন্যরকম ভালো লাগার সৃষ্টি করছে। এখানে যদি কান্তা মনি থাকতো তাহলে কতো ভালোই না হতো!
-নিয়াজ ভাইজান? (নওশাদ)
হঠাত নওশাদের ডাকে প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্য উপভোগের ঘোর থেকে বেরিয়ে আসে জমিদার নিয়াজ মির্জা।
-হুম বল নওশাদ? (জমিদার নিয়াজ মির্জা)
-জানো গ্রামে লুটপাট কারা করিয়েছিল? (নওশাদ)
-না। এখনো বের করতে পারিনি। তবে তদন্ত চলছে এখনো। (জমিদার নিয়াজ মির্জা)
-থাক অত কষ্ট করতে হবে না। আমিই বলে দিচ্ছি। আমরাই ষড়যন্ত্র করেছিলাম। আর লুটপাটের সময় আমি নিজেই সেখানে উপস্থিত ছিলাম। (বলেই বাকা আসে নওশাদ)
নৌকা নদীর পাড় ঘেষে আপন গতিতে বয়ে চলেছে। নিয়াজ এখনো স্তম্ভিত হয়ে নওশাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
-কেন করলি এমনটা? (শান্ত কন্ঠে বলে ওঠে জমিদার নিয়াজ মির্জা)
-যাতে প্রজারা শাহ জাহাঙ্গীর মির্জার ওপর ক্ষেপে গিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করে । আর আমরা সেই সুযোগটা ব্যবহার করে জমিদারী হাতাতে পারি। কিন্তু না তুই তো পুরো পরিকল্পনায় পানি ঢেলে দিলি। (শাহ সুলতান মির্জা)
নিয়াজ অবাক চোখে তার চাচাজানের দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাত নৌকার পাশে এসে আরেকটা নৌকা এসে থামে। নৌকায় মৃদু কম্পনের সৃষ্টি হতেই পাশ ফিরে তাকায় নিয়াজ মির্জা। বিপরীত নৌকাটা থেকে মারজান সরদার নিয়াজদের নৌকায় উঠে পড়ে। নিয়াজ যেন অবাকের ওপর অবাক হয়ে চলেছে।
-আরে নিয়াজ এতো দ্রুত অবাক হলে হবে না। এখনো আরও অবাক হওয়ার আছে। তুমি যে আমাকে সন্দেহ করে পাইকদেরকে আমার ওপর আর সরদার বাড়ির ওপর নজর রাখতে বলেছিলে তা কিন্তু আমার কর্ণগোচর হতে সময় লাগে নি। এক একজনকে মেরে মেরে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমার বন্ধুটাও কত সরল মনে তার এই বন্ধুকে বিশ্বাস করে এসেছে এখন পর্যন্ত। এই মারজান সরদার এতোটা কাচা নয় পরিকল্পনায়। গুপ্তচর পাঠিয়ে সবসময় কড়া নজর রেখেছি তোমার ওপর আর জমিদার বাড়ির ওপর। তোমাকে তো আমার মেয়ের জামাই বানাতে চেয়েছিলাম। মেহরিনের সাথে তোমার বিয়ের পর তুমি জমিদারী দায়িত্ব পেলে মেহরিনকে দিয়ে তোমাকে মেরে ফেলে জমিদারী হাতিয়ে নেব কিন্তু না সেই পরিকল্পনায়ও পানি ঢেলে দিলে তুমি। শেষমেষ আজকের দিনের জন্য পরিকল্পনা করি আমরা সবাই মিলে। কিন্তু তোমার বেগম তো ভারী শেয়ানা। টের পেয়ে গেছে কিছু একটা ষড়যন্ত্র চলছে। কিন্তু মনের সাথে যুদ্ধ করতে করতেই দেরি করে ফেলল আজকের দিনে। (বলেই অট্টোহাসিতে ফেটে পড়ে মারজান সরদার)
নিয়াজের মুখ থেকে যেন কোনো বুলিই ফুটতে চাইছেনা। সে তো এমনদিনকে কখনো আশাই করেনি।
নওশাদ ধীরপায়ে হেটে এসে নিয়াজের পাশ ঘেষে বসে তার কাধে হাত রাখে।
-কি আগুনের গোলা বিয়ে করেছিসরে ভাই? একদম চোখই ফেরানো যায় না। যেমন রূপ তেমন তার তেজ। তোর অগোচরে কতবার হাত বাড়ানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু নাগাল পাইনা কি করব বল? কি বিচক্ষণ বাবা! কতকিছু জেনে নিয়েছে আমাদের সম্পর্কে,যা তুই তোর বাপ ও এত বছরে কিছু বুঝতেই পারিসনি। বেচারির একটা কাজ আমার খুব ভালো লেগেছে,কিছুই তোকে একটাবার বলেনি সে। আর বলবেই বা কি করে যতোবার বলতে নিয়েছে এই নওশাদ হাজির। (অট্টোহাসিতে ফেটে পড়ে নওশাদ)
রাগে জমিদার নিয়াজ মির্জার চোখ লাল বর্ণ ধারণ করে।
-চুপ একদম চুপ। কান্তা মনিকে নিয়ে আর একটা কথা বললে একদম তোর জিহ্বা টেনে ছিড়ে ফেলব আমি। বিশ্বাস ঘাতক। (হুংকার দিয়ে বলে ওঠে জমিদার নিয়াজ মির্জা)
সকলে হোহো করে হেসে ওঠে। হঠাত পিঠে ঘ্যাচ করে কিছু গেথে গেছে অনুভব করতে পিছনে ফিরে পিঠের দিকে তাকায় নিয়াজ মির্জা। নওশাদ তার হাতে থাকা ছুরি নিয়াজের পিঠে গেথে দিয়ে ধরে আছে। ছুরিটা আবার ঘ্যাত করে বের করে নেয় নওশাদ।
নিয়াজ মির্জার চোখ বেয়ে টুপ করে জল গড়িয়ে পড়ে।
-কেন সবসময় সব দায়িত্ব তোকে পেতে হবে? (বলেই পেটে তরোয়াল ঢুকিয়ে দেয় শাহ আহসান মির্জা)
ব্যথায় আর্তনাদ করে ওঠে নিয়াজ। চোখ বেয়ে অঝোরে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।
-কেন সবসময় শুনতে হয়? নিয়াজকে অনুসরণ কর, নিয়াজকে অনুসরণ কর। (বলেই হাতে থাকা ছুরিটা পুনরায় নিয়াজের পিটে গেথে দেয় নওশাদ)
-তোমাকে না সরালে জমিদারী হাতানো বড্ড মুশকি নিয়াজ। (বাকা হাসি দিয়ে পেটে গেথে যাওয়া তরোয়াল ঘ্যাচ করে বের করে নিয়ে পুনরায় গেথে দেয় মারজান সরদার)
নিয়াজ ঝুল সামলাতে না পেরে মেঝেতে দু হাত দিয়ে ভর দেয়। নাক-মুখ থেকে অঝোরে রক্ত বের হচ্ছে। শরীর রক্তে মাখামাখি। সে যে এখনো নির্বাক হয়ে নিভু নিভু চোখে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। নৌকায় থাকা দুজন রক্ষী এহেন কান্ড দেখে তাদের জমিদারকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসতেই তাদেরকে হত্যা করে নদীতে তাদের নিথর দেহ ছুড়ে ফেলে শাহ আহসান মির্জা।
জমিদারী হাতানোর লোভে এতো কিছু? একটাবার বললে তো সে নিজেই তার ভাইদেরকে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে প্রস্তুত ছিল। তার আপন মানুষগুলোই তো ইতিহাসের নামকরা বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরকেও হার মানিয়ে দিল।
-আমাদের কি জমিদারী দায়িত্ব পাওয়ার কোনো অধিকার নেই? আব্বা ভাইজানকে দায়িত্ব দিয়েছিল আমি মেনে নিয়েছিলাম। আমি বঞ্চিত হলেও আমার সন্তানেরা কি দোষ করেছে? তাদেরও তো কম যোগ্যতা নেই। তোকে সরিয়ে দেওয়া খুব জরুরি।
কথাগুলো বলেই নিয়াজের গলায় তরোয়াল চালিয়ে দেয় শাহ সুলতান মির্জা।
নদীর বুকেই লুটিয়ে পড়ে নিয়াজ। মুখে ফুটে ওঠে এক তাচ্ছিল্যের হাসি।
চলবে…
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন)