#কান্তা_মনি
#পর্ব_১৭
#লেখনীতে_আফিয়া_অন্ত্রীশা
কান্তা মনির চোখ ইতোমধ্যে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। ক্রোধের আগুনে জ্বলে উঠে হাত মুঠো পাকিয়ে নেয় কান্তা মনি। হেতিজা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
-ভাবিজান! (কথাটা বলেই তার হাত দিয়ে কান্তা মনিকে মৃদু ধাক্কা দেয়)
হেতিজার কন্ঠ পেয়ে কান্তা মনি পাশ ফিরে তাকায়। কান্তা মনির রক্ত বর্ণের আখির তীক্ষ্ণ চাহনীতে আতকে ওঠে হেতিজা।
-ভাবিজান তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? ভাবিজান দ্রুত ফিরে চলো। দেরি হয়ে যাচ্ছে। (হেতিজা)
মারজান সরদার আর মেহরিন সেখান থেকে সরে যেতেই কান্তা মনিকে টেনে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হয় হেতিজা। মারজান সরদার ও মেহরিনের মধ্যকার কথোপকথন কানে আসার পর থেকেই বুকটা চূড়মার হয়ে যাচ্ছে হেতিজার। একজন মেয়ে কিভাবে পারে তার বাবার হত্যাকারীদের মুখেই তার বাবার সেই হত্যার কথার শুনে সহ্য করে নিতে?
পালঙ্কের এক কোণে নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে কান্তা মনি। চোখে ছিটেফোটা অশ্রুর হদীস না মিললেও কিছুক্ষণ বাদে বাদে ফুফিয়ে উঠছে সে।
-ভাবিজান এভাবে ভেঙ্গে পড় না। কত কষ্টে নিজেকে শক্ত করে নিয়েছিলে তা আমি জানি। আমি তোমার সাথে আছি ভাবিজান। আমি ভাইজানকে সব বলব। ভাইজানই ওই সরদার বাড়ির লোকজনদের ব্যবস্থা করবে। (হেতিজা_
-না হেতিজা। এর পেছনে শুধু সরদার বাড়ি না আরও কিছু মানুষ আছে তাদের সাথে। আমার আব্বাকে মারা তাদেরর উদ্দেশ্য ছিল না। আমার আব্বা তাদের কোনো উদ্দেশ্যের পথে কাটা হয়ে দাড়িয়েছিল তাই তাকে সরিয়ে দিয়েছে। (ঠোট কামড়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করে কান্তা মনি)
-বিষয়টা বড্ড ভাব্বার বিষয়। (আচ্ছা আমরা এখন কিছুই ভাইজানকে বলব না। (হেতিজা)
-হুম। হেতিজা বুবু বড় ষড়যন্ত্র চলছে। আমি এর মূলটা বের করতে চাই। কি এমন উদ্দেশ্য এদের যে যার জন্য আমার নিরীহ আব্বাজানের প্রাণটা কেড়ে নিল এই নরপশুগুলো। হেতিজা বুবু তুমি মানতে চাইবে কিনা জানিনা কিন্তু এই বাড়িরই কিছু মানষ আমাদের অতি আপনজনেরাই এতে জড়িয়ে আছে। আমি সন্দেহের তালিকায় যাদের নাম রেখেছি অন্তত এখন তোমাকেও তাদের নাম বলতে চাচ্ছিনা। আমার আরও অনেক কিছু বের করতে হবে। থাকবে তো আমাকে পাশে। (কান্তা মনি)
জমিদার বাড়িরই কিছু লোকজন জড়িয়ে আছে শুনে বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে হেতিজার। হাত-পা শিরিশির করে ওঠে তার।
হেতিজার বাহুতে মৃদু ধাক্কা দিয়ে কান্তা মনি তীক্ষ্ণ নজর নিক্ষেপ করে বলে ওঠে,
-কি থাকবে তো আমার পাশে? সবকিছুতে সাহায্য করবে তো?
হুশ ফিরতেই হালকা নড়েচড়ে ওঠে হেতিজা।
-হুম থাকব অবশ্যই থাকব। (চোখে পানি টলমল করছে হাতিজার)
-আমাকে একটু সুযোগ বুঝে মাঝে মাঝে বাড়ির থেকে বের হওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। কি পারবেনা হেতিজা বুবু? (আবেগি সুরে বলে ওঠে কান্তা মনি)
-হুম অবশ্যই পারব ভাবিজান। (মুচকি হাসে হেতিজা)
কান্তা মনি হেতিজাকে জাপড়ে জড়িয়ে ধরে।
-কিন্তু ভাবিজান তোমার শরীরের অবস্থাও তো ভালো না। সেদিকেও তো খেয়াল দিতে হবে। খামখেয়ালিপনা করবেনা কিন্তু হুম? আমার কোথা শুনতে হবে। ঠিক আছে? (হেতিজা)
-হুম ঠিক আছে। (কান্তা মনি)
কেটে গেছে প্রায় এক মাস। দিন যত যাচ্ছে কান্তা মনির যত্ন নেওয়া যেন ততো বেড়ে যাচ্ছে। ভোরের হালকা স্নিগ্ধ আলো চোখে-মুখে এসে পড়তেই ঘুম ভেঙ্গে যায় কান্তা মনির। শোয়া থেকে উঠে বসে পাশ ফিরতেই অবাক হয়ে যায় কান্তা মনি। জায়নামাজের পাটিতে বসে অশ্রু বিসর্জন দিতে ব্যস্ত জমিদার নিয়াজ মির্জা। একটু কান খাড়া করতেই কান্তা মনির বুকটা ধক করে ওঠে। তার জন্যই যে দোয়া চেয়ে আল্লাহর দরবারে হাত উঠিয়েছে নিয়াজ। চোখ ভিজে আসে কান্তা মনির। নিয়াজ মোনাজাত শেষ করে জায়নামাজ ভাজ দিতে দিতে মৃদু স্বরে কান্তা মনি ডাকতেই কান্তা মনির হুশ ফেরে। দ্রুত পায়ে ওযু করে এসে নামাজ পড়ে নেয় কান্তা মনি।
নামাজ শেষে ভোরের রূপটা এক পলক দেখার জন্য জানালার নিকটে গিয়ে দাঁড়ায় কান্তা মনি।
-কি করেন আমার বেগম। (দুহাতে পেছন থেকে কান্তা মনিকে আগলে নেয় জমিদার নিয়াজ মির্জা)
-এইতো নতুন এক ভোরের রূপের দর্শণ করছি। (মুচকি হেসে জবাব দেয় কান্তা মনি)
কান্তা মনিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয় নিয়াজ মির্জা।
-ঘুমাও না কেন ঠিকঠাক? অনেক দিক ধরে লক্ষ্য করছি রাতটা শুধু এপাশ ওপাশ করেই কাটিয়ে দাও। কখনো কখনো চোখের পানি বিসর্জন দাও। আচ্ছা কি হয়েছে। কিসের জন্য কষ্ট পাচ্ছো তুমি? আমাকে বল? তোমার এটুকু জানার হক তো আমার আছে কান্তা মনি। তবে কিসের এত সংকোচ তোমার? তুমি জানো আমি তোমার দিকেই তাকিয়ে রাত কাটিয়ে দেই। তুমি ঘুমাও না। কেন ঘুমাতে পারো না সে কারণটা ভাবতে ভাবতে আমিও ঘুমাতে পারিনা। (জমিদার নিয়াজ মির্জা)
বড়সড় একটা শ্বাস ফেলে কান্তা মনি।
-কোনো কারণে যদি চিন্তিত থেকে থাকি তবে অনুগ্রহপূর্বক এখন আমাকে তা বলার জন্য বাধ্য করবেন না। আমি স্ময় হলেই বলে দেব আপনাকে। শুধু আপনাকে আমার পাশে চাই। আমাকে কখনো ভুল বুঝবেন না। একটাবারের জন্য হলেও আমাকে জিজ্ঞাসা করে নেবেন। (কান্তা মনি)
-আচ্ছা আম্র বেগম। আপনার পাশে আপনার স্বামী সবসময় আছে। কিন্তু আপনাকে ঠিকঠাক ঘুমাতে হবে। নিজের যত্ন নিতে হবে। (জমিদার নিয়াজ মির্জা)
-আচ্ছা আমার জনাব বুঝেছি। (মুচকি হাসে কান্তা মনি। এই হাসিটায়ও যেন আগের মতো কোনো চঞ্চলতা নেই)
-আজকে সকালের নাস্তার পর তোমাকে নিয়ে বের হবো। গ্রাম দর্শনে যাব আমরা। একটু পর একটা বিচার বৈঠক বসবে। সেখানে যেতে হবে এখন। তুমি আম্মার কাছে যাও। আমি চলে আসব দ্রুত। (জমিদার নিয়াজ মির্জা)
-আচ্ছা ঠিকা আছে। (মুচকি হাসে কান্তা মনি)
নিয়াজ তৈরি হয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যেতেই কান্তা মনি কক্ষে কিছুক্ষণ পায়চারী করে বেগম নূর জাহানের কক্ষের দিকে পা বাড়ায়
-আসসালামু আলাইকুম আম্মা। ভেতরে আসব? (কান্তা মনি)
-ওয়া অলাইকুমুস সালাম । ভেতরে আয় মা। (বেগম নূর জাহান)
ভেতরে প্রবেশ করতেই মেহেরুন্নেছাকে দেখে মুখে স্বভাব সুলভ হাসি ফুটিয়ে তোলে কান্তা মনি। এই মানুষটিকে দেখলে আপনাআপনি মুখে হাসি ফুটে ওঠে। অদ্ভুত এক শক্তি আছে তার মাঝে মানুষের মন জয়া করে নেওয়ার।
পালঙ্কের ওপর এদিক ওদিক নতুন নতুন রঙ –বেরঙের কাথা ছড়িয়ে থাকতে দেখে কৌতুহল জাগে কান্তা মনির মনে। মেহেরুন্নেছা ও বেগম নূর জাহান দুজনেই কাঁথা সেলাই করতে ব্যস্ত।
-আম্মা এত কাঁথা কার জন্য? (কান্তা মনি)
-বুঝতেছোনা? যে আসতে চলেছে তার জন্য। (মুচকি হেসে বলে ওঠেন বেগম নূর জাহান)
-আম্মা তাই বলে এত আগে থেকে? (অবাকের সূরে বলে ওঠে কান্তা মনি)
-তোমাকে এত কোথা বলতে হবে না তো। তুমি আমার পাশে বসে দেখো কাঁথা সেলাই করে কিভাবে। (বেগম নূর জাহান)
শাড়িটা ঠিকঠাক করে নিয়ে শালটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে পেছন ফিরতেই থমকে যায় কান্তা মনি।
-আ আপনি এখানে? অনুমতি না নিয়ে একজন পরনারীর কক্ষে প্রবেশ করলেন কোন সাহসে? (কান্তা মনি)
আচমকা কান্তা মনির গাল চেপে ধরে তেড়ে আসে নওশাদ।
-চুপ একদম কথা বলবিনা। বড্ড বেশি বাড় বেড়েছে তোর তাইনা? আমাদের পেছনে লোক লাগিয়েছিস? জেনে গিয়েছিস অনেক কিছু তাহলে তাইনা? কি ভাবিস ধরতে পারব না আমাদের পেছনে লোক লাগিয়েছিস। হুম? যতটা ভেবেছিলাম তুই তার থেকেও ওপরে আছিস। বেশি বাড়িস না এমন কলঙ্ক লাগিয়ে দেব কপালে যে জীবনেও তা ছাড়াতে পারবিনা। (ত্যাড়া কন্ঠে বলে ওঠে নওশাদ)
গাল থেকে নওশাদের হাতটা ছিটকে সরিয়ে দেয় কান্তা মনি।
-তোকে আগেও সতর্ক করেছি। শুনলিনা তুই। অনেক কিছুই জেনে নিয়েছি। তোদের সময় ঘনিয়ে এসেছে বুঝেনে। কারণটা ঝাপসা স্পষ্ট। কিন্তু ভাবিস না। ওটাও খুব শীঘ্রয়ই জেনে নেব। কে কে জড়িত আছিস ষড়যন্ত্রে তাও জানি আমি।
কান্তা মনির কথা শুনে তার চুলে মুঠি ধরে হ্যাঁচকা টান মারে নওশাদ। ‘আহ’ শব্দ করে উঠে নিজেকে ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে কান্তা মনি।
-বেশি বাড়িস নারে পাখি।
নওশাদের কথার মাঝেই কক্ষে হেতিজা প্রবেশ করে। হেতিজাকে দেখে কান্তা মনিকে ঝটকা মেরে ছেড়ে দিয়ে হনহন করে কক্ষ হতে বেরিয়ে যায় নওশাদ।
হেতিজা অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে কান্তা মনির দিকে।
-ভাবিমনি! তার মানে নওশাদ ভাইজানও তোমার সন্দেহের তালিকাভুক্ত তাইনা? (হেতিজা)
চলবে…
#কান্তা_মনি
#পর্ব_১৮
#লেখনীতে_আফিয়া_অন্ত্রীশা
কান্তা মনির কথা শুনে তার চুলে মুঠি ধরে হ্যাঁচকা টান মারে নওশাদ। ‘আহ’ শব্দ করে উঠে নিজেকে ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে কান্তা মনি।
-বেশি বাড়িস নারে পাখি।
নওশাদের কথার মাঝেই কক্ষে হেতিজা প্রবেশ করে। হেতিজাকে দেখে কান্তা মনিকে ঝটকা মেরে ছেড়ে দিয়ে হনহন করে কক্ষ হতে বেরিয়ে যায় নওশাদ।
হেতিজা অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে কান্তা মনির দিকে।
-ভাবিমনি! তার মানে নওশাদ ভাইজানও তোমার সন্দেহের তালিকাভুক্ত তাইনা? (হেতিজা)
টলমল চোখে মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যা’ সূচক ইঙ্গিত দেয় কান্তা মনি।
-আজকের মতো আগেও দুইবার বার এমন ব্যবহার করেছে নওশাদ। প্রথমদিন আমাকে খুব বাজেভাবে স্পর্শ করেছিল। আমি এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জানতে পেরেছি আর লোক লাগিয়েছি তা জানতে পেরে গেছে নওশাদ। আজ এসেছিল হুমকি দিতে। (কান্তা মনি)
কান্তা মনির কথা শুনেই দু কদম পেছনে সরে যায় হেতিজা। না জানি তার আর কোন কোন আপনজন জড়িয়ে আছে ঘৃণ্য এই ষড়যন্ত্রে। আর নওশাদের এমন কান্ডের কথা শুনে যেন হেতিজা স্তম্ভিত। মানুষের বাইরের রূপ দেখে তার ভেতরের রূপটা সম্পর্কে জানা বড্ড মুশকিল।
-আজ আমি ফুফুমনিকে সব বলবই। (হেতিজা)
-না না হেতিজা বুবু। ফুফুমনিকে কিছু বল না। অনেক কষ্ট পাবে মানুষটা। (অনুরোধের সুরে বলে ওঠে কান্তা মনি)
-তোমার এই এত মায়ার জন্য যেন পস্তাতে না হয় ভাবিজান। তুমি ভাইজানকে কিছু বলছো না। এটা কিন্তু তুমি বড্ড ভুল করছো। আবার আজ নওশাদ ভাইজানের এই কাজের কথা তুমি ফুফুমনিকে বলতে মানা করছো? (হেতিজা)
-কিরে কে কি বলতে মানা করছে আমাকে? (হাস্যজ্জ্বল মুখ করে কক্ষে প্রবেশ করেন মেহেরুন্নেছা)
-ক কিছু না ফুফুমনি। (কান্তা মনি)
-ভাবিজান কিছু বলবে না ফুফমনি। আমি বলছি। নওশাদ ভাইজান আজকে নিয়ে পরপর তিনবার ভাবিজানের সাথে আপত্তিকর ব্যবহার করেছে ফুফুমনি। বড় ভাইয়ের বেগমকে কেউ বাজেভাবে স্পর্শ করতে পারে ফুফুমনি? (হেতিজা)
অবাকের শীর্ষ পর্যায়ে পৌছে গেছেন মেহেরুন্নেছা।
-কি বলছিস এগুলো? (মেহেরুন্নেছা)
-যা বলছি সত্যি বলছি ফুফুমনি। (হেতিজা)
-কান্তা মনি হেতিজা যা বলছে সব সত্যি? তুমি যা বলবে নির্দ্বিধায় বলবে। (মেহেরুন্নেছা)
-হুম সত্যি। (মাথা নুয়ে নিয়ে বলে ওঠে কান্তা মনি)
মেহেরুন্নেছার কক্ষে এক কোণে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কান্তা মনি আর হেতিজা। মেহেরুন্নেছা রাগান্বিত চোখে তার পুত্র নওশাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
-আম্মা ওরা মিথ্যা বলছে। তুমি তোমার ছেলেকে অবিশ্বাস করবে? (নওশাদ)
নওশাদ কোথা শেষ করতেই তার গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দেন মেহেরুন্নেছা। চড়ের শব্দ যেন বন্ধ কক্ষের দেয়ালে দেয়ালে গিয়ে বাড়ি খাচ্ছে। নওশাদ গালে হাত দিয়ে কান্তা মনির দিকে কটমট চোখে এক পলক তাকিয়ে পুনরায় মেহেরুন্নেছার দিকে তাকায়।
-ছি তুই আমার পুত্র হয়ে এমন কাজ করলি নওশাদ? কেন আমাকে এত বড় শাস্তি দিলিরে নওশাদ? আমি তো তোকে নিয়েই বেচে আছি এই দুনিয়ায়। তোর জন্য বেচে আছি। আর তুই? (চোখ থেকে এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে মেহেরুন্নেছার)
-আম্মা! ও আম্মা আর হবে না আম্মা। আমাকে ক্ষমা করে দাও আম্মা। (নওশাদ)
-এক মুহূর্ত তুই এখানে দাড়াবিনা আমার সামনে। বের হয়ে যা আমার সামনে থেকে। (মেহেরুন্নেছা)
নওশাদ কক্ষ ছেড়ে বের হয়ে যেতেই মেহেরুন্নেছা কান্তা মনির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
-মা বিশ্বাস করো তোমার সামনে দাড়াতেও আমার লজ্জা লাগছে। আমি কি ছেলে বানিয়ে হাতে ধরে! আমার তো মরে যেতে ইচ্ছা করছে। (কান্না করতে করতে বলে ওঠে মেহেরুন্নেছা)
-আরে ফুফুমনি আপনি এমন কথা কেন বলছেন? আপনি কান্না করবেন না দোহায় লাগে। আপনাকে তো আমার মায়ের মতো দেখি আমি। (কান্তা মনি)
-এই কথা যদি নিয়াজের কানে যায় তাহলে তো নওশাদকে একদম জানে মেরে ফেলবে ও। কিন্তু এমন ছেলের মরে যাওয়াই উচিত। (শাড়ির আচলে মুখ চেপে ধরে কান্না কান্না করতে করতে বলেন মেহেরুন্নেছা)
-না ফুফুমনি আমি তাকে কিছুই বলব না। নওশাদ না সুধরালে আমি উনাকে বলতে বাধ্য হবো। (কান্তা মনি)
-অপরাধীকে দেয়া এই দ্বিতীয় সুযোগটাই যেন তোমার জীবনের কাল না হয়ে দাঁড়ায় এই কামনা করি। (বিরবির করে কথাটা বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হেতিজা)
গ্রাম দর্শনে বেরিয়ে সারা গ্রামে প্রজাদের ঘরে ঘরে কিছু নতুন জামা-কাপড় পৌছে দিয়েছে জমিদার নিয়াজ মির্জা আর কান্তা মনি। মনটা যেন আজ খুশিতে ভরে গেছে কান্তা মনির। অসহায় মানুষগুলো নতুন নতুন জামা-কাপড় পেয়ে কি খুশিটাই না হয়েছে। ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর মুখে হাসি দেখে কলিজা ঠান্ডা হয়ে গেছে কান্তা মনির।
ঘোড়ার গাড়ি থেকে নেমে ধীর পায়ে মুঞ্জিলার ভাইয়ের বাড়ির দিকে এগিয়ে চলেছে কান্তা মনি ও জমিদার নিয়াজ মির্জা। বাড়ির বাইরে এবং ভেতরে মানুষে গিজগিজ করছে। এত মানুষের ভীড় দেখে কিছুটা ভ্রু কুচকে আসে কান্তা মনির সাথে বুকটা ধক করে ওঠে কোনো এক অপ্রত্যাশিত ভয়ে।
বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে মুঞ্জিলার (শাহ সুলতান মির্জার বেগম) ভাবি রশিদা কান্না করছেন আর মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছেন দেখে বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে কান্তা মনির। নিয়াজ আস্তে করে কান্তা মনির ঘাড়ে হাত রাখেন তাকে শান্ত করার জন্য।
যে ভয়টা কান্তা মনি পেয়েছিল তাই হয়েছে। সে খবরদারির জন্য যে লোককে বলেছিল সে মুঞ্জিলার ভাই আশরাফ। নওশাদ যে জেনে গিয়েছিল আশরাফ তাদের সকল খবরাবর কান্তা মনিকে দিচ্ছে। এমনিই মানুষটার আগে থেকে প্রাণের ঝুঁকি থাকা সত্বেও কান্তা মনিকে মেয়ে ডেকে সে দায়িত্বটা নেয়। যার ফলস্বরূপ আজ ওই পশুগুলো এই মানুষটাকে বাচতে দেয়নি। চোখ ফেটে কান্না আসছে কান্তা মনির। কিন্তু না তাকে একদম কান্না করা যাবেনা। ওই নরপশুদের একজনকেও বাচতে দেবে না সে।
রশিদা বেগম স্বামীর লাশের পাশে পাথরের ন্যায় বসে আছে। কান্তা মনি আর নিয়াজ মুঞ্জিলার কক্ষের দিকে অগ্রসর হয়।
-চাচীজান? (জমিদার নিয়াজ মির্জা)
মুঞ্জিলা ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে নিয়াজ মির্জার দিকে। কিছুক্ষণ বাদেই চিৎকার করে ওঠেন মুঞ্জিলা।
-নুরুলের সাথে আমার কোনো খারাপ সম্পর্ক নাই বিশ্বাস করেন। আমার কোনো খারাপ সম্পর্ক নাই নুরুলের সাথে। (হাত-পা এলোপাথারি ছুওতে ছুড়তে বলে ওঠে মুঞ্জিলা)
-কি বলছেন এসব চাচীজান? চাচীজান ভালো করে তাকিয়ে দেখেন আমাদের। (কান্তা মনি)
-দয়া করে ওকে মারবেন না। ছেড়ে দেন নুরুলকে মরে যাবে তো। আমাকে মেরে ফেলেন কিন্তু ওকে মারবেন না। (মুঞ্জিলা)
নিয়াজ মির্জা এবং কান্তা মনি অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকায়।
নিশ্চয়ই এমন কিছু হয়েছিল যার আঘাতটা এখন পর্যন্ত ভুলতে পারেনি মুঞ্জিলা। আর মুঞ্জিলার মুখে নুরুলের নাম শুনে বেশ অবাক হয় নিয়াজ। কারণ নুরুল যে মেহেরুন্নেছার স্বামী। সে বেশ কয়েক বছর আগেই মারা গেছেন। কান্তা মনি শপথ নিয়েছে কি এমন ঘটনা ঘটেছিল মুঞ্জিলা আর নুরুলের সাথে তা সে বের করেই ছাড়বে সে।
জমিদার বাড়িতে বিয়ের সকল আয়োজনের তোড়জোড় চলছে। জমিদারের একমাত্র বোনের বিয়ে ব্লে কোথা! পুরো গ্রামবাসীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বিয়েতে। খুশিতে যেন হেতিজার চোখের কোণে চিকচিক করছে সুখের অশ্রু।
বোনের বিয়েতে কোনো কমতি রাখতে দিচ্ছে না জমিদার নিয়াজ মির্জা। বোনের সুখের জন্য যেন ভাই নিজের জীবনটাও ত্যাগ করে দিতে পারে। ভাইয়েরা আসলেই এমন হয়!
কনে সাজে অপরূপ লাগছে হেতিজাকে। মেয়ের থুতনি ধরে শাহ জাহাঙ্গীর মির্জা “মা শা আল্লাহ” বলে তার কপালে একটা চুমু এঁকে দেন। মেয়েকে বুকে আগলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন। আব্বা-আম্মা, প্রিয় ভাই-ভাবি আপনজনদের ছেড়ে চলে যাবে ভেবেই বুকটা দুমড়ে-মুচড়ে আচ্ছে হেতিজার। মেয়েদের জীবন আসলেই কত অদ্ভুত!
চলবে…