#কান্তা_মনি
#পর্ব_১৬
#লেখনীতে_আফিয়া_অন্ত্রীশা
-তোকে একটা কথা বলতে চাই মা। অনেক গুরুত্বপূর্ণ। হয়ত না বললে অনেক বড় ভুল হয়ে যাবে।(বেগম নূর জাহান)
পুরো কথা বলার আগেই পেছন থেকে কারও কন্ঠ শুনে থেমে যান বেগম নূর জাহান।
-কি গুরুত্বপূর্ণ কথা ভাবিজান? (মেহেরুন্নেছা)
আচমকা মেহেরুন্নেছার কন্ঠ পেয়ে কান্তা মনি ঘাড় ঘুরিয়ে মেহেরুন্নেছার দিকে তাকায়।
-তেমন কিছুইনা মেহেরুন। (নূর জাহান)
-বললে গুরুত্বপূর্ণ আবার বল তেমন কিছুনা ! নাকি আমাকে বলা যাবে না ভাবিজান? (মেহেরুন্নেছা)
-আরে আমি ওকে ওর এই সময়ের সাবধানতা অবলম্বন করার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চাচ্ছিলাম। যেগুলো না বললে ভুল হবে। এই আরকি। (বেগম নূর জাহান)
-ওহ আচ্ছা। তা বউ-শাশুড়ির মধ্যে এত সখ্যতা কিভাবে হলো হঠাত? (হেসে দিয়ে বলে উঠলেন মেহেরুন্নেছা)
-ওই কোনো এক ভাবে। মানুষের চোখ কখন খুলে যায় কেউ বলতে পারে? কাছের মানুষেরা ঠকিয়ে আমাকে মানুষ চেনা শিখিয়ে দিয়েছে। (বেগম নূর জাহান)
-মানে? কে ঠকিয়েছে তোমাকে ভাবিজান? (মেহেরুন্নেছা)
-আরে এমনিই একটু ঠাট্টা করলাম। তোর হাতের বেগুনি খেতে ইচ্ছে করছে মেহেরুন। বানাবি? (বেগম নূর জাহান)
-আরে কেন বানাবোনা। এখনই যাচ্ছি আমি। (মুচকি হেসে বলে ওঠেন মেহেরুন্নেছা)
মেহেরুন্নেছা কক্ষ হতে বের হয়ে যেতেই বেগম নূর জাহান কান্তা মনির দিকে তাকান।
-কান্তা মনি! (বেগম নূর জাহান)
-জ্বি আম্মা। (কান্তা মনি)
-আমার ছেলেটার প্রাণের ঝুঁকির রয়েছে রে মা। তুই আমার ছেলেটার খেয়াল রাখবি মা। আমারও কখনো কিছু হয়ে যেতে পারে। আপনজনেরাই বারংবার আঘাত করবে। কিন্তু টিকে থাকতে শিখতে হবে। আজ আমার চোখ না খুললে হয়ত আমার সব থেকে প্রিয় জিনিসটা আমার দোষেই হারিয়ে যেত। মেহরিনকে নিয়াজের ধারে কাছেও ঘেষতে দিবিনা। (বেগম নূর জাহান)
-বিশাল ষড়যন্ত্র হচ্ছে আম্মা। আমি আগেই আচ করতে পেরেছি। কিন্তু আমার হাতে যথেষ্ট প্রমাণ না এলে কিভাবে আমি ওনাকে সব খুলে বলব? কখন কি ঘটে যায় আমার খুব ভয় হয় আম্মা। কিন্তু হাতেনাতে না ধরে কিছুই করে উঠতে পারছিনা। ওনাকে যতদ্রুত সম্ভব সব জানাতে হবে। আম্মা আপনি আমার পাশে থাকবেন তো? (কান্তা মনি)
-তা আর বলতে? (বেগম নূর জাহান)
-ভাবিজান কি করো? (হেতিজা)
-এইতো আমার হেতিজা বুবুর বানানো আচার খাচ্ছি। (কান্তা মনি)
কান্তা মনির পাশে হেতিজা ধপ করে বসে পড়ে। কান্তা মনির পেটে কাছে কান এনে হেতিজা বলে ওঠে,
-এই যে একটু তাড়াতাড়ি বের হয়ে আসুন তো। আপনার ফুফুমনির যে তর সয় না। আপনার ছোট ছোট হাত-পা গুলো নাড়িয়ে নাড়িয়ে খেলা করা দেখব। ফুফুমনি আপনাকে অনেক ভালোবাসবে। খাইয়ে দেবে। গোসল করিয়ে দেবে। ঘুম পাড়িয়ে দেবে। ঘুরতে নিয়ে যাবে। আম্মাজানকে একদম কষ্ট দেবে না বুঝেছেন?
কান্তা মনি ফিক করে হেসে ফেলে।
-এই যে হেতিজা বুবু! ইনি আসতে এখনো অনেক দেরি আছে। এত দ্রুত ধৈর্য্য হারালে চলবে? (কান্তা মনি)
হেতিজা ঠিক হয়ে বসে কান্তা মনির গাল টেনে দিয়ে বলে ওঠে,
-আমার ভাবিজান এত সুন্দর। না জানি আমার ভাতিজা/ভাতিজিটা কত সুন্দর হবে। ইশ আমার তো এখনই মন চাইছে যদি এখনই ইনি বের হয়ে এসে আমার কোলে ঝাপিয়ে পড়ত।
কান্তা মনি হেতিজার কথা শুনে হেসে কুটি কুটি হয়ে যায়।
-হাসো হাসো। বেশি করে হাসো। (ভেংচি কেটে বলে ওঠে হেতিজা)
-এত হাসাহাসি কিসের তোমাদের? (যোহরা)
-আরে যোহরা বুবু ভেতরে আসো। (কান্তা মনি)
-আসছে ঝামেলার বস্তা। (বিরবির করে বলে ওঠে হেতিজা)
-দেখি কি খাচ্ছো তুমি! ওমা আচার? কে বানিয়েছে এটা? জানো আচার আমার অনেক প্রিয়। আমি নিয়ে নেই এটা? (যোহরা)
-হুম অবশ্যই। নাও। (মুখে স্বভাব সুলভ হাসি ফুটিয়ে বলে ওঠে কান্তা মনি)
-দাড়া যোহরা। এই আচার আমি ভাবিজানের জন্য বানিয়েছি। ভাবিজানের জন্য কেন বানিয়েছি তা তো তোর অজানা নয়। এটা এদিকে দে। নিজে বানিয়ে খা পারলে। (হেতিজা যোহরার হাত থেকে আচারের জারটি ছো মেরে নিয়ে নেয়)
-হেতিজা! তুই! (যোহরা)
-আমি কি? (ভ্রু কুচকে বলে ওঠে হেতিজা)
-তোকে দেখে নেবো আমি। (বলেই হনহন করে কক্ষ হতে বেরিয়ে যায় যোহরা)
-এটা কি করলে তুমি? (কান্তা মনি)
-তুমি থামো। এতো মায়া দেখানো লাগবেনা তোমার বুঝেছো? (হেতিজা)
জানালার পাশে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কান্তা মনি। শীতের সকালে সূর্যের মিষ্টি রোদ শরীরে এবং মনে অদ্ভুত এক অনুভূতির সৃষ্টি করে। গাছের ডালে বসে থাকা একজোড়া দোয়েলের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কান্তা মনি। হঠাত বাইরে নিচের দিকে চোখ যায় কান্তা মনির। আহসান মির্জা আর শাহ সুলতান মির্জা হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কি যেন বলাবলি করছে। হঠাত শাহ সুলতান মির্জার হাতে কাপড়ে পেচানো কিছু একটা তুলে দেয় আহসান মির্জা। ভ্রু কুচকে আসে কান্তা মনির।
হঠাত পেছন থেকে বলিষ্ঠ একজোড়া হাত কান্তা মনির কোমর আকড়ে ধরতেই কেপে উঠে পেছনে ফিরে তাকায় সে।
-ওহ আপনি? (চোখ বন্ধ করে একটা দম নেয় কান্তা মনি)
-আমি ছাড়া আর কে হবে হুম? (কান্তা মনির কাধের ওপর থুতনি ঠেকিয়ে বলে ওঠে নিয়াজ মির্জা)
-না হঠাত এভাবে ধরায় একটু ভয় পেয়েছিলাম। (কান্তা মনি)
-তোমার চোখ-মুখ এমন শুকনো শুকনো লাগছে কেন? কিছু খাওনি? কি নিয়ে দুশ্চিন্তা করছো তুমি? আমাকে সত্যি সত্যি বল। (কান্তা মনিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলে হন্তদন্ত কন্ঠে বলে ওঠে জমিদার নিয়াজ মির্জা)
-আরে বাবা কিছুই হয়নি আমার। আব্বার জন্য মন কেমন করছিল। আব্বার কবরটা অনেক দিন দেখিনা। কালকে একটু যেতে মন চাইছে। যাব? (কান্তা মনি)
জমিদার নিয়াজ মির্জা পালঙ্কের ওপর এসে বসে পড়ে।
-আমি তো কাল অনেক ব্যস্ত থাকব। জমিদারি দায়িত্ব যে। আমি হেতিজাকে বলব তোমাকে নিয়ে যাবে। ঠিক আছে। (নিয়াজ মির্জা)
জমিদার নিয়াজ মির্জার কথার উত্তরে মাথা কাত করে ‘হ্যা’ সূচক ইঙ্গিত দেয়। নিয়াজের মুখপানে তাকিয়ে মুখটা মলিন হয়ে যায় কান্তা মনি। মানুষটা কি কষ্ট করছে দিন-রাত। কান্তির ছাপ যে ভিষণ ভাবে জেঁকে বসেছে জমিদার নিয়াজ মির্জার চোখে-মুখে। কান্তা মনি চৌপায়ার ওপর থেকে পানপাত্রে পানি ঢেলে নিয়াজ মির্জার সামনে ধরে।
কান্তা মনিকে টেনে নিজের পাশে বসিয়ে ঢক ঢক করে পানিটুকু খেয়ে নেয় নিয়াজ মির্জা।
-শুনলাম আম্মাজানের মনও নাকি চুরি করে নিয়েছো হুম? (জমিদার নিয়াজ মির্জা)
মুচকি হাসে কান্তা মনি।
-হুম। আম্মা আমাকে মেনে নিয়েছেন। (খুশির ঝলক ফুটে ওঠে কান্তা মনির চোখে-মুখে)
নিয়াজ কান্তা মনিকে টেনে বুকের মাঝে মিশিয়ে নেয়।
রমিজ হাওলাদারের কবর থেকে কিছুটা দূরে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কান্তা মনি। হাত উঠিয়ে আল্লাহর দরবারে তার প্রিয় আব্বার জন্য প্রাণভরে দোয়া করে কিছু দূর এগিয়ে গিয়ে তার আম্মার কবরের দিকে যায়। আম্মার জন্য প্রাণ ভরে দোয়া করে হেতিজাকে নিয়ে হাওলাদার বাড়িরে সামনে গিয়ে দাঁড়ায় কান্তা মনি। রাহেলাকে তার ভাইজান নিয়ে গেছেন বেশ কয়েক মাস হয়েছে।
সরদার বাড়ির সামনে থেকে অতিক্রম হওয়ার সময়ই দাঁড়িয়ে পড়ে কান্তা মনি আর হেতিজা। কান্তা মনি ঘোড়ার গাড়ি বিদায় দিয়েছে সেই হাওলাদার বাড়ির সামনে এসে নেমেই। মেহরিন আর মারজান সরদারকে সরদার বাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটা ঝোপের পেছনে হেতিজাকে নিয়ে লুকিয়ে পড়ে কান্তা মনি।
-আব্বা ওই কান্তার আব্বা তো বড় একটা প্রমাণ ছিল আমাদের বিরুদ্ধে। না জানি সরিয়ে না দিলে কি হতো। কেউ বুঝতেও পারল না রমিজ হাওলাদারের হত্যা এই সরদার বাড়িতেই হয়েছে। হাহাহা। (হাসতে হাসতে বলে ওঠে মেহরিন)
-আস্তে কথা বল মেহরিন। কথা কিছু হাওয়ায় ভাসে। তাই সাবধান। এখন পরিকল্পনা মোতাবেক এগোতে হবে। লক্ষ্য পূরণ হলেই কেল্লাফতে। (মারজান সরদার)
কান্তা মনির চোখ ইতোমধ্যে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। ক্রোধের আগুনে জ্বলে উঠে হাত মুঠো পাকিয়ে নেয় কান্তা মনি। হেতিজা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
চলবে…