#কান্তা_মনি
#পর্ব_১৫
#লেখনীতে_আফিয়া_অন্ত্রীশা
একা মেয়ে তাও এমন ঘুটঘুটে অন্ধকারে নিজের সন্দেহের কারনটিকে তদন্ত করা জন্য বেরিয়েছে। মনে যেন বিন্দুমাত্র ভাবনারা এসে টোকা দিচ্ছে না যে কোনো বিপদ হবে নাতো?
নওশাদের পিছু নিতে নিতে সরদার বাড়ির নিকটে এসে থামল কান্তা মনি। মাথায় এবার যেন প্রশ্নের পাহাড় জমেছে।
পাহারাদারকে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কিছু একটা বলল নওশাদ। সঙ্গে সঙ্গে পাহারাদার বাড়ির ভেতর গিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে আবার ফিরে এসে নওশাদকে মুখ নাড়িয়ে কি একটা যেন বলল তা কান্তা মনির কর্ণগোচর হলো না।
কিছুক্ষণ বাদেই মারজান সরদার সিংহদ্বার পেড়িয়ে বাইরে এলেন। দুজনের মধ্যের কথোপথন কান্তা মনির কান পর্যন্ত না এলেও কিছু একটা যে ঘাপলা আছে তা আর বুঝতে বাকি নেই তার। কান্তা মনি এবার ভেবেই নিয়েছে, কি হতে চলেছে তাকে তা বের করতেই হবে। যত ঝড়-ঝাপটা আসুক সে হার মানবেনা। তাকে বের করতে হবে তার আব্বাজানের মৃত্যুর রহস্য। তাকে যে বের করতে হবে আসলে কি চলছে এখানে। একটা শ্বাস ফেলে পুনরায় তাদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই ভ্রু কুচকে আসে কান্তা মনির। তার বেশ সামনেই দু’জনের জায়গায় তিনজনকে দেখতে পাচ্ছে সে। একজন মারজান সরদার, একজন নওশাদ। তাহলে আর একজন কে? গঠন দেখেতো মহিলা মনে হচ্ছে। তবে কে এই মহিলা? মাথা যেন এত ভাবনায় ভাবনায় ঝিম ধরে যাচ্ছে কান্তা মনির।
হঠাত সময়ের কথা মনে হতেই জোর পায়ে স্থান ত্যাগ করে জমিদার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয় কান্তা মনি। চারদিকে বিরাজমান অন্ধকারে যেন কিছুটা ভয় ভয় লাগছে। তার যে মনেই ছিল না যে অন্ধকারকে সে ঠিক কতটা ভয় পায়। নিজের প্রতি এতটাই তার আত্মবিশ্বাস যে এমন আকাশ বেয়ে নামা ঘোর অন্ধকারও তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি! আসলেই আত্মবিশ্বাস একটা মানুষকে ঠিক কতটা শক্তিশালী করে তুলতে পারে সবকিছুর উর্ধ্বে। অবাক হচ্ছে কান্তা মনি। হাতের তালু দিয়ে কপালের বিন্দু বিন্দু ঘামকে মুছে নিয়ে সামনে এগোয় কান্তা মনি।
কক্ষে এসে ধপ করে পালঙ্কের ওপর বসে পড়ে কান্তা মনি। হঠাত চোখ আচমকা তার পেটের দিকে যায়। সে কি ভুলেই গিয়েছিল যে তার মাঝে আরও একটা প্রাণ বেড়ে উঠছে? এই অন্ধকারে যদি কোথাও হোচট খেয়ে পড়ে যেত! তাহলে কি হতো ভেবেই বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে কান্তা মনির। পেটে হাত বুলিয়ে বড় একটা নিশ্বাস নেয় কান্তা মনি। পানি তৃষ্ণা পেয়েছে অনুভব করায় চৌপায়ার ওপর তাকাতে নিতেই হঠাত থমকে যায় কান্তা মনি। জমিদার নিয়াজ মির্জা পানপাত্র ধরে আছে তার মুখের সামনে। নিয়াজ যে এতক্ষণ কক্ষেই ছিল তা সে একটা বার ও লক্ষ্য করে দেখেনি?
-আ আপনি কখন এলেন? (কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠল কান্তা মনি)
-আগে পানিটুকু খেয়ে নাও। (পানপাত্রটি কান্তা মনির হাতে ধরিয়ে দিয়ে তার পাশে বসে পড়ে জমিদার নিয়াজ মির্জা)
ঢকঢক করে পানিটুকু খেয়ে নেয় কান্তা মনি। শাড়ির আচল টেনে মুখটা মুছে নিয়ে কাঁপা কাঁপা চোখে জমিদার নিয়াজ মির্জার দিকে তাকায় কান্তা মনি।
-কোথায় গিয়েছিলে তুমি? (কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে ওঠে জমিদার নিয়াজ মির্জা)
শুকনো ঢোক গিলে কান্তা মনি বলে ওঠে,
-আসলে একটু ফুফুমনির কক্ষে গিয়েছিলাম। কিন্তু ফুফুমনি তখন ঘুমিয়ে ছিলেন। তাই একটু বাইরে বেরিয়েছিলাম। বেশিদূর না। বাড়ির পাশটায় ছিলাম। (কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে ওঠে কান্তা মনি)
ক্ষেপে যায় জমিদার নিয়াজ মির্জা।
-আমি তোমাকে বলেছিলাম না! এই নিয়াজ মির্জার কোমলতা দেখেছো তুমি কিন্তু কঠোরতা দেখোনি। কোন সাহসে তুমি সিড়ি বেয়ে নিচে নেমেছো? আর এই সন্ধ্যা রাতে বাইরেই বা কার কাছে শুনে বেরিয়েছো? আমি তোমাকে বলেছি আমার কাছ থেকে না শুনে কখনো সিড়ি বেয়ে নিচে নামবেনা। এত দুঃসাহস দেখালে কিভাবে তুমি? (রাগে চোখ লাল হয়ে গেছে জমিদার নিয়াজ মির্জার)
ভয়ে কুকড়ে ওঠে কান্তা মনি। শাড়ির আচল খামচে ধরে ঠোট চেপে কান্না থামানোর চেষ্টা করে কান্তা মনি। আসলেই সে কিছুই চিন্তা না করে বেরিয়ে গেলো কিভাবে? আর নিয়াজও এত দ্রুত কিভাবে এলো। তার তো আসতে অনেক রাত হবে বলেছিল। তাহলে?
-কি হলো? কি বলছি কানে যাচ্ছেনা? (কান্তা মনির দিকে দুই কদম এগিয়ে গিয়ে বলে উঠল জমিদার নিয়াজ মির্জা)
ভয়ে পিছাতে পিছাতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় কান্তা মনির।
-আ আসলে সারাদিন কক্ষে থাকতে থাকতে এক ঘেয়েমি লাগছিল। তাই আরকি একটু বেরিয়েছিলাম। দোহায় লাগে রাগ করবেন না। (কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠল কান্তা মনি)
চোখ বন্ধ করে একটা বড়সড় স্বাস ফেলে জমিদার নিয়াজ মির্জা। হাত দিয়ে চুলগুলো ঠিক করে নিয়ে কান্তা মনির দিকে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। কান্তা মনির হাত টেনে তাকে নিজের কাছে নিয়ে এসে জমিদার নিয়াজ মির্জা বলে উঠল,
-কান্তা মনি তুমি বোঝো না? আমার তো ভয় হয় প্রতিনিয়ত তোমাকে নিয়ে। নিজের বিষয়ে একটু সাবধানতা অবলম্বন করো। আমিতো সব সময় থাকব না। তোমাকে চোখে চোখে কে রাখবে? তুমি কি জানো তোমার আমার এমন কি জমিদার বাড়ির সকলের প্রাণের ঝুঁকি রয়েছে? আমার কোনো কথার অমান্য করোনা কখনো। আমি যে তোমাকে আসক্ত। তোমার ভালোবাসায় আসক্ত। আমার প্রাণপ্রিয় বেগম অফুরন্ত ভালোবাসার সাগরে সর্বদা ভাসিয়ে রাখতে চাই তোমাকে। (জমিদার নিয়াজ মির্জা)
চোখ খিচে বন্ধ করে জমিদার নিয়াজ মির্জার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে কান্তা মনি।
-এতো ভালোবাসেন? আমিতো এতো ভালোবাসার যোগ্য না। টিকবে তো আমার কপালে এই ভালোবাসা? এই অভাগীর কপালে যে সুখ বেশি দিন দীর্ঘস্থায়ী হয়না। আমি তো আপনার ভালোবাসায় পাগল হয়ে যাব। আল্লাহর আছে কাছে লাখো কোটি শুকরিয়া আপনার মতো একজন স্বামী আমাকে দিয়েছেন। (কান্তা মনি)
আচমকা নিয়াজের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে টুকুস করে নিয়াজের গালে চুমু খায় কান্তা মনি। নিয়াজ গালে হাত দিয়ে মুচকে হেসে দেয়। কান্তা মনির কোমরা আকড়ে ধরে বলে ওঠে,
-তা দোষ যখন করলেই শাস্তি তো পেতেই হবে বেগম। (নিয়াজ মির্জা)
-ক কি শাস্তি? সত্যিই বলছি আর এমন ভুল করব না। (কান্তা মনি)
-শাস্তি পেতেই হবে। এক্ষেত্রে কাউকেই আমি ছাড় দেইনা বেগম। এখন আমি খাবার আনতে পাঠাচ্ছি। সব খেতে হবে। প্রতিদিনের মতো বাহানা দিলে চলবেনা বেগম। (নিয়াজ মির্জা)
বেগম নূর জাহান চোখ বন্ধ করে বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে। কান্তা মনি মৃদু পায়ে বেগম নূর জাহানের কক্ষে প্রবেশ করে।
-আম্মা মাথা ব্যথা করছে? (কান্তা মনি)
বেগম নূর জাহান চোখ খুলে পাশ ফিরে তাকিয়ে সামনে কান্তা মনিকে দেখে নড়েচড়ে বসে কপালে হাত ঠেকিয়ে বলে ওঠেন,
-ওই একটু ধরেছে আরকি। (বেগম নূর জাহান)
-ঘুমান না রাতে ঠিক মতো? চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। কি এমন চিন্তা করেন যে রাতে ঘুমান না ঠিক মতো? শরীরটা ঠিক আছে তো আম্মা? মাথায় তেল দিয়ে দেই? একটু ঘুম আসবে। (কান্তা মনি)
-আহা। এই মেয়ে এই খারাপ মানুষের জন্য এতো দুশ্চিন্তা করার লাগবেনা তোমার। আমি ঠিক আছি। (বেগম নূর জাহান)
-আম্মা এভাবে কেন বলছেন? আমি তেল মালিশ করে দিচ্ছি। ভালো লাগবে। (কান্তা মনি)
হন্তদন্ত পায়ে তেলের শিশি নিয়ে এসে বেগম নূর জাহানের মাথায় তেল মালিশ করে দিতে লাগল কান্তা মনি।
হঠাত বেগম নূর জাহান কান্তা মনির হাত টেনে নিয়ে তার পাশে এনে বসান। বেগম নূর জাহান কান্তা মনির দুহাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চোখের পানি বিসর্জন নিয়ে বলে ওঠেন,
-মারে আমাকে ক্ষমা করে দে। আমি মানুষ চিনতে ভুল করেছি মা। আমি সব সময় গরিব আর ধনীর মাঝে তফাৎ করার চেষ্টা করেছি। কখনো বোঝার চেষ্টা করিনি, সবার মাঝেই মন থাকে। আমার কৃতকর্মের অনুতপ্ততা আমাকে রাতে ঘুমোতে দেয়না মা। তোর এই মাকে ক্ষমা করে দে। আমি তোকে অনেক অত্যাচার করেছি। না জানি আমার চোখ না খুললে আরও কত কি করতাম। আমাকে ক্ষমা করে দে মা। আমি মানুষ চিনতে অক্ষম ছিলামরে।
-বেগম নূর জাহানের দুহাতে চুমু খেয়ে তার বুকে মাথা রেখে কান্তা মনি বলে ওঠে,
-আম্মা এভাবে বলবেন না। আমার কোনো ভুল থাকলে তা ক্ষমা করে দিয়ে আমাকে মেনে নিন আম্মা।
-তুই তো হেতিজার মতো আমার আরেকটা মেয়েরে। এখন থেকে তুই এই মায়ের বুকের মাঝে সংরক্ষিত থাকবি। (বেগম নূর জাহান)
-তোকে একটা কথা বলতে চাই মা। অনেক গুরুত্বপূর্ণ। হয়ত না বললে অনেক বড় ভুল হয়ে যাবে।(বেগম নূর জাহান)
পুরো কথা বলার আগেই পেছন থেকে কারও কন্ঠ শুনে থেমে যান বেগম নূর জাহান।
চলবে…