#কান্তা_মনি
#পর্ব_৬
#লেখনীতে_আফিয়া_অন্ত্রীশা
সিড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে নিতেই শোরগোল শুনে পুনরায় নিচে নেমে এসে বাইরের দিকে উঁকি দেয় কান্তা মনি। সাধারণ প্রজাদের ভিড়ের মধ্যে চেচামেচি শুনে ভ্রু কুচকায় কান্তা। একটুবাদেই শুনতে পায় দুই-তিনদিন ধরে নাকি প্রজাদের বাড়ি-ঘরে রাতে লুটপাটের ঘটনা ঘটছে। মুখ ঢেকে এসে অস্ত্র বের করে ভয় দেখিয়ে সব লুটপাট করে নিচ্ছে। লুটপাটকারীদের গায়ে নাকি জমিদারবাড়ির রক্ষীদের পোশাক থাকে। প্রজাগণ তাই ঝাপিয়ে পড়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করছে জমিদার বাড়ি থেকেই নাকি লোক পাঠিয়ে তাদের সব লুটপাট করা হচ্ছে। জমিদার বাড়ির সিংহদ্বারের সামনে সাধারণ প্রজাদের ভীড় উপচে পড়ছে।
-আপনারা অনুগ্রহপূর্বক শান্ত হোন। (হঠাত সিংহদ্বারের সামনে এসে দাঁড়ায় নিয়াজ মির্জা)
-বাবু মশাই আমরা এই অন্যায় কিছুতেই মাইনা নেব না। আমরা বুইঝা গেছি এই জমিদারবাবু ষড়যন্ত্র কইরা লোক পাঠাইয়া আমাগো লুটপাট করাইতেছেন। (প্রজাগণ)
-খামোস। আর একটা বাজে কথা বলবেন না। আপনারা ভাবলেন কিভাবে যে আপনাদের মুখে খাবার তুলে দেয় সেই আপনাদের পেটে লাথি মারবে? একটা যুক্তি দেখান কেন আপনাদের জমিদারবাবু আপনাদেরকে লুটপাট করতে চাইবে? এতে তার স্বার্থকতা কি? সামান্য পোশাকের সাদৃশ্যতার ওপর নির্ভর করে আপনারা স্বয়ং জমিদারের ওপর আঙ্গুল তুলছেন? (গর্জে ওঠে নিয়াজ মির্জা)
চিৎকার চেচামেচি শুনে একে একে শাহ জাহাঙ্গীর মির্জা, শাহ সুলতান মির্জা, শাহ মহাশিন মির্জা, নওশাদ সিংহদ্বারের সামনে এসে উপস্থিত হন।
নিয়াজ মির্জার কথা শুনতেই প্রজাগণ নিশ্চুপ হয়ে যায়। কারো মুখ থেকে আর টু শব্দটি বের হয় না।
-এই ঘটনা কারা ঘটাচ্ছে তা অবশ্যই বের করা হবে। আপনারা ভয় পাবেন না। আপনাদের যা যা ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ অবশ্যই জমিদারবাড়ি থেকে দেওয়া হবে।আপনাদের যথাযথ নিরাপত্তা আমরা দেব। আপনারা আজ আসতে পারেন।
কক্ষের নির্জনতা ভেঙে নিয়াজ মির্জা বলে ওঠে,
-আব্বা আমি কিছুটা রহস্য রহস্য গন্ধ পাচ্ছি। কে বা কারা ষড়যন্ত্র করছে আমি ঠিক অবগত নই কিন্তু এটা একের অধিক মানুষের ষড়যন্ত্র। আর তাদের লক্ষ্য হয়ত জমিদারী দখল করে নেওয়া।
জমিদার কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে চুপ করে থেকে বলে ওঠেন,
-আমারও তাই মনে হচ্ছে। এটা ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই হতে পারেনা।
-এটা কার বা কাদের কাজ হতে পারে? কাদের এত দুঃসাহস? (শাহ সুলতান মির্জা)
-হয়তবা আমাদের খুবই কাছের কেউ। হতে পারে আমাদের বংশেরই কেউ। (তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে কক্ষ ত্যাগ করে নিয়াজ মির্জা)
সকলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নিয়াজের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে।
-নওশাদ কড়া পাহারার ব্যবস্থা করো প্রতিটা মহল্লায়। (জমিদার শাহ জাহাঙ্গীর মির্জা)
-জ্বি মামাজান আমি এখনই ব্যবস্থা করছি। (নওশাদ)
-মহাশিন তুমি নিয়াজের সাথে এই ষড়যন্ত্রের তল্লাশি চালাও। আমার জানা চাই কার এই দুঃসাহস। সুলতান প্রজাদের যা যা ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে সব কিছুর হিসাব কষে তাদের পুনরায় সন্তুষ্ট করে দাও। (জমিদার শাহ জাহাঙ্গীর মির্জা)
জমিদারের কথায় স্বায় জানিয়ে সকলে কক্ষ ত্যাগ করেন।
বেগম নূর জাহানের খিচুরি পছন্দ বিধায় মেহেরুন্নেছার পরামর্শে তার জন্য পরম যত্নে খিচুরি রান্না করে নিয়ে কক্ষের দিকে পা বাড়ায় কান্তা মনি। রক্ষী দরজা খুলে দিতেই কাঁপা কাঁপা পায়ে ভেতরে প্রবেশ করে কান্তা মনি। বালিশের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছেন বেগম নূর জাহান।
-আম্মা! (কান্তা মনি)
হঠাত মেয়েলি কন্ঠ পেয়ে চোখে মেলে তাকান নূর জাহান।
-এই তুই এখানে কেন? বের হ এখনি। (নূর জাহান)
-দোহাই লাগে আম্মা আমার সাথে এমন করবেনা না। আমাকে একটু সময় দিন আমি ঠিক আপনার মন থেকে আমাকে নিয়ে যত রাগ আছে সব ভুলিয়ে দেব। আম্মা আপনার জন্য আমি খিচুরি রান্না করে নিয়ে এসেছি। একটু খেয়ে দেখুন। (কান্তা মনি)
-তোকে বলেছিনা আমার কক্ষ হয়ে বের হয়ে যা। তোর হাতে পানিও আমি স্পর্শ করব না। (নূর জাহান)
-আমি খুব যত্নসহকারে বানিয়েছি শুধুমাত্র আপনার জন্য। একটুখানি খেয়ে দেখুন আম্মা। (কান্তা মনি)
গম্ভীর মুখ করে কান্তা মনির হাত থেকে খিচুরির থালা গ্রহণ করেন বেগম নূর জাহান।এক লোকমা মুখে তুলেই কাশতে কাশতে মুখ থেকে মাটিতে ফেলে দেন খাবার।
-আম্মা কি হয়েছে? কষ্ট হচ্ছে? (বলে পানি এগিয়ে দেয় কান্তা মনি)
ঢকঢক করে পানি খেয়েই হাপাতে হাপাতে হুংকার করে ওঠেন নূর জাহান।
-মারতে আসছিস আমাকে? ঝাল খাইয়ে মারতে চাইছিস তুই আমাকে? (নূর জাহান)
-কিন্তু আম্মা আমি তো একটুও ঝাল দেইনি আপনি খেতে পারেন না তাই। তাহলে ঝাল লাগবে কিভাবে? (কান্তা মনি)
-তবে কি আমি মিথ্যা বলছি। আমাকে তোর পথ থেকে সরিয়ে রাজত্ব করার জন্য ঝাল খাইয়ে মারতে চাইছিস তাইনা? বের হ আমার সামনে থেকে। (নূর জাহান)
নূর জাহানের হুংকার শুনে মেহেরুন্নেছা, হেতিজা, যোহরা, মুর্শিদা, রেহানা, কক্ষে প্রবেশ করে।
-কি হয়েছে আম্মা তুমি এমন কেন করছো? আর এমন হাপাচ্ছো কেন? (হেতিজা)
-এই মেয়ে আমাকে ঝাল খাইয়ে মারতে চাইছিল। ও তো না জানা নয় যে আমি ঝাল খেতে পারিনা তাই আমার খাবারে কখনো ঝাল দেওয়া হয়না। (নূর জাহান)
-বিশ্বাস করুন আম্মা আমি একটুও ঝাল দেইনি খিচুরিতে। (কান্তা মনি)
-এই মেয়ে যে কি ফন্দি এটে জমিদার বাড়িতে এসেছে বোঝা মুশকিল। (রেহানা)
রেহানার কথায় তাল মিলায় যোহরা।
মুখে শাড়ির আচল চেপে কাঁদতে কাঁদতে কক্ষ থেকে ছুটে বের হয়ে যায় কান্তা মনি। মেহেরুন্নেছা ও হেতিজাও তার পিছে পিছে চলে যায়।
রেহানা গিয়ে খিচুরির থালা থেকে একটু মুখে নিয়ে নূর জাহানের দিকে ভ্রু কুচকে তাকায়।
-চাচীজান খাবারে তো একটুও ঝাল হয়নি তবে বলছেন কেন ঝাল হয়েছে? (রেহানা)
রেহানার কথায় যোহরা নূর জাহানের দিকে ভ্রু কুচকে তাকায়। নূর জাহানের বাকা হাসি দেখে দুজনই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।
-চাচীজান আসলেই আপনার বুদ্ধির প্রশংসার করতে হয়। (যোহরা)
-এই মেয়ে কিভাবে এই জমিদার বাড়িতে টিকে থাকতে পারে আমিও দেখি। (নূর জাহান)
মেহেরুন্নেছার কোলে মুখ গুজে ডুকরে কেদে যাচ্ছে কান্তা মনি। কান্তা মনির মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন মেহেরুন্নেছা।
-ভাবিজান এভাবে কেদো না। ভুল হতেই পারে। আমি আম্মাকে বুঝিয়ে বলব তবুও তুমি কেদো না। (হেতিজা)
-আমিতো একটুও ঝাল দেইনি। (কান্নারত অবস্থায় বলে উঠল কান্তা মনি)
-তাহলে ভাবিজান বলছে কেন ঝাল হয়েছে? (মেহেরুন্নেছা)
-জানিনা আমি কিছু জানিনা। (বলেই আবারো মেহেরুন্নেছার কোলে মুখ গুজে কাঁদতে থাকে কান্তা মনি)
রক্ষী দ্বার খুলে দিতেই নিয়াজ গটগট পায়ে কক্ষে প্রবেশ করে। কান্তা মনিকে কান্না করতে দেখে মুখটা ভার হয়ে যায় নিয়াজ মির্জার।
নিয়াজ মির্জাকে কক্ষে প্রবেশ করতেই হেতিজা ও মেহেরুন্নেছা কক্ষ হতে বের হয়ে যায়।
চোখ মুছে ঠোট কামড়ে কান্না থামানোর বৃথা চেষ্টা করতে থাকে কান্তা মনি। নিয়াজ মির্জা মৃদু পায়ে কান্তা মনির দিকে অগ্রসর হতেই কান্তা মনি এক পা পেছনে সরে যায়। কান্তা মনির দু’বাহু আকড়ে ধরে নিয়াজ মির্জা বলে ওঠে,
-সবটা খুলে বলো আমাকে কান্তা মনি।
-কি বলব? (কান্তা মনি)
-যা হয়েছে তাই বলবে। কেন কাদছো খুলে বলো আমাকে। (নিয়াজ মির্জা)
-এমনিই কাদছি কিছুই হয়নি। (কান্তা মনি)
-কথা না ঘুরিয়ে সত্যটা বলো। (রাগি কন্ঠে বলে ওঠে নিয়াজ মির্জা)
কান্না মাখা কন্ঠে সব খুলে বলে কান্তা মনি।
-চোখের পানি মুছে ফেলো কান্তা মনি। আমি সব জানি। ভয় পেতে হবে না যে আমি তোমাকে ভুল বুঝে দূরে ঠেলে দেব। আমি সবসময় তোমার সাথে আছি। খাবারে ঝাল হয়নি তা আমি জানি। আর শোনো এই চোখের পানি খুব মূল্যবান। একটু একটুতেই যে চোখের পানি ফেলো পরে দরকারে আর খুজে পাবেনা এই চোখের পানিকে। শক্ত হও কান্তা মনি। এভাবে সবকিছুতেই ভেঙ্গে পড়লে আমার কান্তা মনি সাহসি আর আত্মনির্ভরশীল কিভাবে হবে? আর কাদবেনা সহজে। আমি চাই আমার কান্তা মনি সাহসী হয়ে উঠুক। তুমি নারী এত নরম হলে চলবেনা, সব কিছু নাড়িয়ে খেতে শিখতে হবে। তুমি ভবিষ্যত জমিদারের বেগম। একটা কথা মনে রেখো, জমিদার বাড়িতে যে নাড়িয়ে খেতে জানে সেই টিকতে পারে। (নিয়াজ মির্জা)
চোখের পানি মুছে নেয় কান্তা মনি।
-আমার আম্মা আর দাদীজানের ভেতরেও প্রথম প্রথম কোনো সখ্যতা ছিল না। আম্মা নিজে অনেক লড়াই করে দাদীজানের মনে এবং এই জমিদারবাড়িতে নিজেকে দাঁড় করিয়েছে। তোমাকেও অনেক লড়াই করতে হবে। আমার জীবনের অনেক ঝুঁকি রয়েছে। কখন না জানি হারিয়ে যাই। কিন্তু আমি আমার কান্তা মনিকে সাহসী,বিদ্রোহী হতে দেখতে চাই। (নিয়াজ মির্জা)
নিয়াজের কথা শুনে হঠাত কান্তা মনির বুকের মাঝে ছ্যাত করে ওঠে। ছলছল চোখে নিয়াজের দিকে তাকায়।
নিয়াজ দু’হাতের মাঝে কান্তা মনির মুখ নিয়ে কপালে তার অধরোষ্ঠ ছোয়ায়।
গভীর রাত। চোখে ঘুম নেই যুবতির। নিয়াজ গভীর ঘুমে মগ্ন। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আনমনে কল্পনার জগত সৃষ্টি করতে ব্যস্ত যুবতী। হঠাত বাইরে থেকে কিছু একটা কান্তা মনির গায়ের ওপর এসে পড়তেই ধ্যান ভাঙ্গে তার। বাইরের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে পায়ের কাছে তাকায় কান্তা মনি। পাথরের খন্ডের গায়ে একটা কাগজ মোড়ানো অবস্থায় তার পায়ের কাছে পড়ে আছে। পাথরের খন্ড থেকে কাগজটা ছাড়িয়ে নেয় কান্তা মনি। অক্ষর সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান থাকায় কাগজে কিছু একটা যে লেখা আছে তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি কান্তা মনির।
“প্রাণে বাঁচতে চাইলে জমিদার বাড়ি ছাড়ো।“
লেখাটা পড়েই কাগজটা ভাজ করে শাড়ির আঁচলের সাথে বেঁধে রাখে কান্তা মনি। মাথায় তার শত প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কে তাকে এমন হুমকি দিতে পারে? জমিদার বাড়ির কেউ?
ভোর হতেই নূর নাহারের মৃত্যুর সংবাদে শোকের ছায়া এসে পড়েছে জমিদার বাড়িতে।
চলবে…