#কানামাছি
#পার্টঃ১৬
#জান্নাতুল কুহু (ছদ্মনাম)
কমলা জামায় রক্তের দাগ লেগে আছে। রক্ত শুকিয়ে কালচে বর্ণ ধারন করেছে কিন্তু সাঁঝের সে দিকে কোন মন নেই। বারবার কানে বাজছে ” তোমাকে লাল গোলাপের মোহে না কাঠগোলাপের শুভ্রতায় মানায়”। এখনও কি সে শুভ্রতায় মুড়িয়ে আছে?
অনেকেই তার দিকে বারবার তাকাচ্ছে। সে নিজেও একবার নিজের দিকে তাকালো। জামায়, ওড়নায় ইহানের রক্ত লেগে আছে। হাসপাতালে আসার সময় ইহান তার কোলেই মাথা রেখে দিয়েছিলো। হঠাৎ সাঁঝের মনে হলো এখন হয়তো তার দায়িত্ব কিছুটা কমেছে।
এক্সিডেন্ট স্পট থেকে কাছাকাছি একটা হাসপাতালে ইহানকে নিয়ে গিয়েছিলো। সে ড্রাইভিং জানেনা গাড়ি যোগাড় করে যেতে বেশ দেরী হয়ে গেছিলো। কিন্তু ঐ হাসপাতালে বলল মেডিকেলে নিয়ে যেতে। সাঁঝ চিল্লাপাল্লা করেছিলো কেন তখন ভর্তি নিলো না। তারপরে মেডিকেলে আনলো। রক্তের ব্যবস্থা করলো। এখন ইহান অপারেশন থিয়াটারে। কেন যেন মনে হচ্ছে ইহানের কিছু হয়ে যাবে।
এতোক্ষণ ধরে নিজের ভিতরে যত শক্তি ছিলো সবটা নিংড়ে পরিস্থির সাথে লড়াই করে যাচ্ছে। কাঁদেনি একটুও। ভাঙেনি একদম। চোখ শুকনোই আছে। বাড়িতে খবর দেয়া হয়েছে। আম্মু, আব্বু, ইশিতা হয়তো এখনই চলে আসবে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এটা জীবনের তৃতীয় এক্সিডেন্ট। প্রথমটা বাবার ছিলো কিন্তু বাবার সময়ে বাবার পাশে না থেকে সে নিজেই হাসপাতালে ভর্তি ছিলো। দ্বিতীয়টা ভাইয়ার। তার অজান্তেই ভাইয়া সব করে ফেলেছিলো। আর তৃতীয়টা ইহানের। নিজের চোখের সামনে সবটা দেখলো। তার জীবনের সব আপনজনরা কেন এভাবে চলে যায়? কেন তাকে সব কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়? কি দোষ তার? কোন উত্তর পেলো না।
পাশে তাকিয়ে দেখলো হন্তদন্ত হয়ে আম্মু, আব্বু, ইশিতা আসছে। আব্বু এসেই জিজ্ঞেস করলো,
—” ইহান কোথায়?”
সাঁঝ উঠে দাঁড়ানোর শক্তি পেলো না। বসে থেকেই বলল,
—” অপারেশন থিয়েটারে”
—” ব্লাড, মেডিসিন, ভর্তি করা সব হয়েছে?”
—” হ্যা আব্বু আমি সব ব্যবস্থা করেছি”
আব্বু সাঁঝের মাথায় রেখে বলল,
—” বিশ্বাস রাখো মা সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি একটু খোঁজ খবর নিয়ে আসি”
আব্বু চলে গেলো। সাঁঝের একপাশে আম্মু আরেক পাশে ইশিতা বসলো। আম্মু সাঁঝকে জড়িয়ে ধরলো। কান্না করছে। ভেজা কন্ঠে আম্মু বলল,
—” চিন্তা করো না মা। দেখো ইহান ঠিক হয়ে যাবে। আল্লাহ সব ঠিক করে দিবে। তুমি তো আমার সাহসী মেয়ে। ভেঙে পড়োনা”
সাঁঝ কোন কথা বললো না। তার ভিতরে ঝড় বয়ে গেলেও চোখ থেকে কোন পানি বের হচ্ছে না। সাঁঝের মনে হলো হয়তো তার কান্না করা উচিত। বৃষ্টি আসলে ঝড় থামবে। কিন্তু কান্না করতে পারলো না। আম্মু তাকে জড়িয়ে ধরে নিজেই কান্না করতে থাকলো। ইশিতা বলল,
—” মা শান্ত হও। ভাবী চলো আমার সাথে। হাত মুখ ধুয়ে আসবে। অনেকক্ষণ ধরে আছো”
আম্মুও তাল মেলালো,
—” যাও একটু হাত মুখ ধুয়ে আসো। তোমার জামা আনলে ভালো হতো। এই জামাটা আর কতক্ষণ পরে থাকবে? তাই একটু ফ্রেশ হয়ে আসো। আমি আছি এখানে।”
সাঁঝ কাঠকাঠ গলায় বলল,
—” না আম্মু আমি থাকি এখানে। পরে যাবো। প্লিজ”
সাঁঝের মনে হতে থাকলো সে অপারেশন থিয়েটারের বাইরে বসেও ইহানের হাত ধরে আছে। সে এখান থেকে আড়াল হলেই ইহান হাত ছেড়ে তার চোখের আড়ালে চলে যাবে। তাকে কেউ জোর করলো না।
একটু পরে তার মা আর মায়ের স্বামী আসলো। সাঁঝকে দেখে আঁতকে উঠল। মা বলল,
—” এ কি অবস্থা? ইহান কোথায়?”
আম্মু বলল,
—” অপারেশন হচ্ছে ভিতরে”
মায়ের স্বামী জিজ্ঞেস করলো,
—” ডাক্তার, কেবিন সব ঠিক হয়েছে? আমাকে আগে খবর দিলে হতো। আমার অনেক পরিচিত লোকজন আছে এখানে”
সাঁঝ অত্যাধিক শান্ত গলায় বলল,
—” কেন এসেছেন এখানে? তামাশা করতে?”
সাঁঝের শান্ত গলা শুনে সবাই কেমন যেনো থমকে গেলো। ইশিতে সাঁঝের সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো। সাঁঝ খেয়াল করলো ইশিতার চোখ লাল হয়ে আছে। চোখের পাশে পানির দাগও বোঝা যাচ্ছে। মানে সেও কান্না করেছে আড়ালে। ইশিতা তার হাত ধরে বলল,
—” চলো ভাবী যাই। একটু ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে আসবে। সেই দুপুরে খেয়েছো। তুমি অসুস্থ হলে কিভাবে হবে বলো তো?”
ইশিতার কথা শুনে সাঁঝে গা গুলিয়ে উঠলো। আসলেই কিছু খাওয়া হয়নি,তার উপর হাসপাতালের পরিবেশে বমি বমি লাগছে। সাঁঝ আর কিছু না বলে ইশিতার সাথে চলে গেলো। হাসপাতালের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় সবাই তার দিকে কেমন করে তাকাচ্ছিলো। সাঁঝ সেগুলোকে পাত্তা দিলো না।
ফিরে আসার পরে দেখলো অপারেশন শেষ। ইহানকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সাঁঝ ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলো,
—” ইহান কেমন আছে?”
—” মোটামুটি out of danger. কিন্তু বেশ আঘাত আছে। মেরুদন্ডে আঘাত আছে। সেটা সিরিয়াস না কিন্তু সারতে সময় লাগবে। আর হাত, পা, মাথায় সব জায়গায় আঘাত আছে। মানে এক কথায় সেরে উঠতে সময় লাগবে”
—” এখন কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?”
—” আপনারা তো কেবিনের ব্যবস্থা করেছেন। ওখানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে”
আব্বু বলে উঠলো,
—” হ্যা আমিই কেবিনের ব্যবস্থা করলাম”
সাঁঝ আবার ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলো,
—” জ্ঞান আছে?”
—” না এখনো নেই। আসতে সময় লাগবে”
—” আচ্ছা”
ডাক্তার চলে গেলো। সাঁঝ স্বস্তি পেলো। ইচ্ছা হলো এখনই ইহানের কাছে যেতে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে কেবিনে যেতে চাইলে তাকে নার্স ঢুকতে দিলো না। সাঁঝ অবাক হয়ে গেলো। তাকে কেন ঢুকতে দিবে না? এটাতো আইসিইউ না। তাহলে? নার্সের বক্তব্য আইসিইউ না হলেও মানুষ ঢুকলে ইনফেকশনের ঝুকি আছে। আর এখন জ্ঞান নেই। কথাগুলো বলার সময় বারবার সাঁঝের জামার দিকে তাকাচ্ছিলো।
সাঁঝের জামাও না ঢুকতে দেয়ার আরেকটা অন্যতম কারণ। শেষে সবাই বুঝিয়ে সাঁঝকে বাড়িতে পাঠানোর জন্য রাজী করলো। সাথে আম্মুও যাবে। সাঁঝ পারলে দৌড়ে চলে যায়।
বাড়িতে পৌঁছে শাওয়ার নিয়ে রেডি হয়ে এসে দেখলো আম্মু টেবিলে খাবার নিয়ে বসে আছে। সাঁঝ জিজ্ঞেস করলো,
—” আম্মু তুমি তো যাবে না তাইনা? আমি গেলাম গাড়ি নিয়ে”
আম্মু তাড়াহুড়ো করে বলল,
—” এই এই এদিকে আসো”
সাঁঝ আম্মুর কাছে গিয়ে বলল,
—” বলো ইহানের জন্য কিছু নিয়ে যেতে হবে? আর্জেন্ট হলে এখনই দাও। নাহলে পরে পাঠিয়ে দিও। আমি যাই”
আম্মু সাঁঝকে জোর করে টেবিলে বসিয়ে দিলো। তারপর বলল,
—” খেয়ে যাবে। একদম না খেয়ে যেতে দিবো না”
—” কিন্তু আম্মু.. ”
সাঁঝ কথা শেষ করতে পারলো না। আম্মু ভাত মেখে মুখে দিয়ে দিলো। অগত্যা সাঁঝকে খেতে হলো। আম্মু বলল,
—” তুমি না খেলে কেমন করে হবে? ইহানের দেখাশোনাও করতে হবে না? তুমি অসুস্থ হলে কিভাবে হবে?”
সাঁঝের চোখের কোনে পানি চলে আসলো। মায়ের স্নেহ! তার মা কেন এমন হলো না? তারপর মনে হলো তার মা এমন না বলেই আরেকটা মা দিয়েছে আল্লাহ। যে এতোটা ভালোবাসে। অল্প কয়েকদিনে এতো আপন করে নিয়েছে। আম্মু জোর করে অনেকটা খাইয়ে দিলো সাঁঝকে। এরপর তাড়াতাড়ি করে চলে আসলো হাসপাতালে।
এবার আসার পরে কেবিনে ঢুকে গেলো। কেউ মানা করলেও সাঁঝ থামতো না। ইহানের জ্ঞান ফেরেনি এখনো। অক্সিজেন লাগানো। আরো কিছু কিছু জিনিস লাগানো আছে। সাঁঝ আস্তে করে ইহানের পাশে বসলো। ভালো করে তাকিয়ে দেখলো মুখে কয়েক জায়গায় কেটে গেছে। মুখ কেমন শুকিয়ে গেছে। এতোক্ষণ চোখে কোন পানি না আসলেও এখন চোখ পানিতে ভর্তি হয়ে গেলো। ইহানের হাতের উপর আলতো করে হাত রেখে ফিসফিস করে বলা শুরু করলো,
—” কেন আমার সাথে এমন হয়? সবাই কেন আমাকে একা করে দেয়? যাকে নিজের আপন ভাবি সেই এমন করে। আমি কি দোষ করেছি?”
কিছুক্ষণ পরে কান্না করতে করতেই আবার বলল,
—” আপনার কিছু হয়ে গেলে আমার নিজের উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে যেতো। আমি যাকে ভালোবাসতে যাই সেই অনন্তের পথে চলে যায়। কিন্তু আপনাকে যেতে দিবো না আমি”
সাঁঝ ইহানের হাতের উপর আলতো করে কপাল ছোয়ালো। এখন তার কিছুটা শান্তি শান্তি লাগছে।
,
,
,
,
🌿
—” আমি গেলাম ভার্সিটিতে। তুমি নিজের খেয়াল রেখো। কোন সমস্যা হলে বাড়ির কাউকে ডেকো। আর হাঁটতে সমস্যা হলে কিছু ধরে হেঁটো”
সাঁঝ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলো। ইহান একটু হেসে বলল,
—” আচ্ছা বাবা আর কত বার এক কথা বলবা? আমার মুখস্ত হয়ে গেছে”
—” তবুও তুমি যাতে ভুলে না যাও”
—” আমি ক্লাস নিতে যাওয়া শুরু করেছি। আর তাও তুমি এই কথা বলছো সাঁঝ? আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছি। এখন চিন্তা কম করো”
সাঁঝ একটা রাগী লুক দিয়ে বলল,
—” হুম। আসছি”
ইহান পিছন থেকে ডেকে বলল,
—” আতিকের থেকে দূরে থেকো”
সাঁঝ একটু হেসে দিলো। মুখে হাসির রেশ টেনে বলল,
—” আমি আর কি দূরে থাকবো? উনিই আমার সামনে আসবে না। বেচারা কত শখ করে আমাকে প্রপোজ করবে বলে সব প্রিপারেশন নিয়ে আসলো। আর তুমি কিনা সুস্থ হয়ে প্রথম দিন যেয়েই তার মন এভাবে ভেঙে দিলে!”
ইহান একটু রেগে বলল,
—” খুব কষ্ট লাগছে না আতিকের জন্য?”
সাঁঝ মুখটা একটু বেজার করে বলল,
—” তা তো লাগছেই। এতো মায়া মমতা ভালোবাসা উনার মনে কি আর বলবো?”
ইহান বিছানা থেকে উঠে কিছুটা দৌড়ে সাঁঝের দিকে যেতে বলল,
—” মায়া, মমতা না?”
সাঁঝ আগেই দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। আর ইহান জায়গায় দাঁড়িয়ে হাসতে থাকলো। তারপর সাঁঝের গলায় শুনলো,
—” আম্মু আমি আসছি। তোমার ছেলের দিকে খেয়াল রেখো”
আম্মু বললো,
—” আস্তে যাও। পড়ে যাবে তো!”
সাঁঝ বাইরে চলে গেলো। ইহান আবার বিছানায় এসে বসলো।
গত দুই আড়াই মাস ধরে সাঁঝ তার খেয়াল রাখছে আর বাড়ির লোক সাঁঝের খেয়াল রাখছে। সাঁঝের মধ্যে যে মমতাময়ী আরেকটা রূপ থাকতে পারে সেটা ইহানের ভাবনার বাইরে ছিলো। এক্সিডেন্টের পর থেকে তাকে খাইয়ে দেয়া, ঔষধ খাওয়ানো, হাঁটতে সমস্যা হওয়ার কারণে ধরে ধরে হাঁটতে সাহায্য করা, মাঝরাতে পিঠে ব্যথা হলে গরম সেক দেয়া এই সবগুলোর কোনটাই বাদ দেয় নি। ঔষধের সাইড এফেক্টের জন্য খাবারের রুচি চলে যেতো। তখন সাঁঝ নিজেই বা মাকে বলে নতুন কিছু বানিয়ে আনতো। যে কয়দিন হাসপাতালে ছিলো বাকি সব কিছু বাদ দিয়ে সাঁঝ সবসময় তার সাথে হাসপাতালে ছিলো। এগুলো করার সময় কখনো এতোটুকু বিরক্তির রেশ দেখতে পায়নি সে সাঁঝের ভিতরে।
এই সময়টাতে না চাইতেও তার আর সাঁঝের সম্পর্ক অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে। সাঁঝ আপনি থেকে তুমি তে নেমে এসেছে। আর সে নিঃসন্দেহে ভালোবেসে ফেলেছে সাঁঝকে। কিন্তু আবার নিজের মনেই প্রশ্ন আসে একই সাঁঝের কত রূপ? অনিকের সাথে একরকম আর তার সাথে একদম ভিন্ন? এখন সে নিজেই নিজের প্রতিশোধ আর ভালোবাসার মধ্যে ঝুলছে। কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। আর অনিকের অবস্থা ক্রমান্বয়ে খারাপ হচ্ছে। অনিকের কথা ভাবলেই সাঁঝের উপর বিতৃষ্ণা আছে আসে কিছুটা। এখন ইহান নিজের সাথে নিজের লড়াইয়ে ব্যস্ত। কি করবে?
কয়েকদিন যাবৎ আবার ক্লাস নেয়া শুরু করেছে। আজ অবশ্য তার ছুটি। তাই আর ভার্সিটিতে যায়নি। ইহান অনিকের লেখা চিঠিগুলো আবার পড়ার জন্য নিজের আলমারিতে খুঁজতে শুরু করলো। চিঠির বক্সটা পেলো না কিন্তু একটা পুরানো ডায়েরি পেলো। ইহান বেশ অবাক হলো। কারণ এটা তার না সাঁঝ এই এতোগুলো মাসে কখনো ডায়েরির কথা বলেনি বা তার সামনে বের করেনি। ইহান ডায়েরিটা হাতে নিয়ে নিজের চিঠিগুলো খুঁজতে থাকলো। চিঠিগুলো পাওয়ার পরে সব নিয়ে বসলো একসাথে।
ডায়েরিটা নিয়ে খুব কৌতুহল হচ্ছে। মনে হচ্ছে খুব লুকিয়ে রাখা হয়েছিলো। ইহান ডায়েরি খুলে প্রথম পেজেই সাঁঝ, সাঁঝের বাবা আর ভাইয়ের একটা ছবি পেলো। বেশ পুরানো ছবি। এরপরের পেজে সাঁঝের ভাইয়ের ছবি। নিচে গুটিগুটি অক্ষরে অনেক কিছু লেখা। ইহান না পড়ে পরের পৃষ্ঠাতে গেলো। অনিকের ছবি আটকানো। ইহান চমকে উঠলো। এর নিচেও অনেক কিছু লেখা। ইহান পড়লো। কিছু বুঝলো আর বাকি বুঝলো না। এরপর পিছনের পৃষ্ঠা থেকে পড়া শুরু করলো। পড়া শেষে ইহান থম মেরে বসে থাকলো।
সব কিছুই মিথ্যা মনে হতে থাকলো। ডায়েরির কথাগুলো সত্যি হলে সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না। পৃথিবীর নিকৃষ্ট মানুষের মধ্যে একজন হবে সে। সাঁঝকে নানা সময়ে নানা ভাবে কষ্ট দিয়েছে। এগুলো সব কিছু একটা মিথ্যার উপর ভিত্তির করে দিয়েছে? ছি! নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছা হচ্ছে তার।
,
,
,
,
🌿
বই খাতা নিয়ে বসে থেকেও পড়াতে মন বসাতে পারছে না সাঁঝ। ঘুরে ফিরে ভাবনা শুধু ইহানে গিয়ে আটকে যাচ্ছে। গত বেশ কয়েকদিন ধরে ইহান কেমন যেন হয়ে গেছে। মাঝরাতে উঠে দেখা যায় বারান্দায় বসে আছে। খাওয়া দাওয়া করে না। চোখের নিচেও কিছুটা কালি পড়েছে। হঠাৎ এমন পরিবর্তনের কারণ ধরতে পারে না। সবচেয়ে বড় বিষয় তার মনে হচ্ছে ইহান তাকে এড়িয়ে চলছে। এখন ইহান রুমে নেই। বারান্দায় আছে। সাঁঝ উঠে বারান্দায় চলে গেলো।
ইহানের হাত জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে বলল,
—” কি হয়েছে বলো তো? এমন উদাস লাগে কেন তোমাকে?”
ইহান একটু হেসে বলল,
—” কি হবে? কিছুই হয়নি। তুমি আমাকে নিয়ে বেশি ভাবো এজন্য এরকম মনে হচ্ছে”
—” আমি বেশি ভাবছি না তোমার আসলেই কিছু হয়েছে”
ইহান কোন জবাব দিলো না। একটু পরে ইহান বললো,
—” কাল তোমাকে নিয়ে বাইরে যাবো?”
—” আবার? যদি কিছু হয়?”
ইহান হেসে বলল,
—” আরে কি হবে? প্রতিবার কি এক্সিডেন্ট হবে নাকি?”
সাঁঝ একটু উৎসাহ নিয়ে বলল,
—” তুমি কি আমার জন্য সারপ্রাইজ প্ল্যান করছো?”
—” এই একপ্রকার”
—” আমি এক্সাইটেড”
ইহান সাঁঝের দিকে ঘুরে বলল,
—” এক্সাইটেড পরে হতে পারবা। এখন পড়তে বসো যাও”
শেষের কথাটা টিচারদের মতো বলল। সাঁঝ বলল,
—” যাচ্ছি স্যার”
সাঁঝ চলে গেলে ইহান দীর্ঘশ্বাস ফেললো। হয়তো সাঁঝের সাথে তার শেষ দিন কালকে। কাল সব বলে দিবে। প্রতিনিয়ত একই ছাদের নিচে থেকে গুমড়ে গুমড়ে কষ্ট পাচ্ছে। নিজেকে সাঁঝের অপরাধী মনে হয়। সাঁঝকে একটা মিথ্যা উদ্দেশ্য নিয়ে বিয়ে করেছিলো। ওকে মেন্টালি কষ্ট দিয়েছে! যার জন্য করেছে সে নিজেই একটা অমানুষ। কিভাবে এসব জেনে ভালো থাকবে? আজকাল রাতে ঘুম হয়না। সাঁঝের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারে না। সে তো প্রথম দিকে সাঁঝের সাথে ভালোবাসার নাটক করেছিলো।
কিন্তু সাঁঝের ভালোবাসার তীব্রতা অনেক। যেটা তাকে বাধ্য করেছে ভালোবাসতে। সাঁঝের মতো মেয়ের ভালোবাসার তীব্রতা যতটুকু ঘৃণার তীব্রতাও ততটুকুই তো হবে! হয়তো বেশিই হবে। সাঁঝ হয়তো আর কখনো তাকে মাফ করবে না। তার দিকে ঘুরেও তাকাবে না। নিজের জীবন থেকে ইহান নামটা চিরকালের জন্য মুছে ফেলবে। কিন্তু তাও সে সব সত্যি বলে দিবে কাল। অন্তত নিজের কাছে তো বলতে পারবে যে সাঁঝকে সব সত্যি বলে নতুন করে সব শুরুর প্রচেষ্টা করেছে। বাকিটা তো সাঁঝের হাতে। কিন্তু যখন তার পরিবার থেকে সব জানতে পারবে তখন? মা,বাবা ইশিতাও কি ক্ষমা করবে? না তারাও দূরে ঠেলে দিবে?
অনিক একটা অমানুষ হলেও শেষে যখন সাঁঝ তাকে ছেড়ে দিয়েছিলো তখন যে পরিমাণ কষ্ট পেয়েছিলো ইহানও একই রকম কষ্ট পাচ্ছে। বরং আরো বেশি কষ্ট পাচ্ছে। ভালোবাসার মানুষটার সাথে করা অন্যায়ের অনুতাপে পুড়ছে।
ইহানের চোখ বেয়ে একফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো। সে বলে উঠলো, “সাঁঝ আমি হয়তো তোমাকে কাল হারিয়ে ফেলবো। তোমার জীবনে আমার নামটা কি কোথাও থাকবে? হয়তো থাকবে না। যদি নিজেকে শেষ করে দিতে পারতাম তাহলে হয়তো সব কিছুর একটা সুষ্ঠ সমাধান হতো। নিজের কাজের শাস্তি পেতাম।” (চলবে)