#কানামাছি
#পার্টঃ১৫
#জান্নাতুল কুহু (ছদ্মনাম)
একগুচ্ছ লাল গোলাপ নিয়ে সাঁঝের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ভার্সিটির মেয়েদের বর্তমান ক্রাশ। ইনি নতুন জয়েন করেছেন লেকচারার হিসেবে আর এসেই মেয়েদের ক্রাশে পরিনত হয়েছে। উনাকে দেখলে মেয়েরা তার পিছনে বলে উঠে, “aww কি কিউট আর হ্যান্ডসাম”
সেই ক্রাশ আতিক স্যার অনেকগুলো টকটকে লাল গোলাপ নিয়ে সাঁঝের সামনে নার্ভাসভাবে হাসছে।
আর ঘটনার আকস্মিকতায় সাঁঝ থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে বলে উঠলো, “ব্যাপারটা কি হলো? এই আতিক স্যার এমন ফুল নিয়ে এসেছে! লক্ষন তো ভালো না ইনার।” সাঁঝ আশেপাশে মাথা ঘুরিয়ে তাকালো। এখন তেমন স্টুডেন্ট নেই। আর অফিসরুমের পাশে গাছতলায় তেমন কেউ না থাকলেও যারা আছে তারাই তাদের দুজনকে ঘুরে ঘুরে দেখছে। আতিক মৃদু হেসে নার্ভাসভাবে বলল,
—” সাঁঝ এটা তোমার জন্য”
সামনে এগিয়ে দেয়া জিনিস কিভাবে ফিরিয়ে দেবে। সাঁঝ বিব্রত হয়ে ফুলগুলো নিলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো,
—” স্যার কিসের জন্য?”
—” এমনি মানে তোমার মতো ফুলকে আরো কিছু ফুল তো দেয়ায় যায় না?”
—” মানে?”
সাঁঝ অবাক হয়ে গেলো।
আতিক স্যার আবার হেসে বলল,
—” হ্যা মানে তুমি এমনি নম্র, সুন্দর মিষ্টি একটা মেয়ে ফুলের মতো! কিন্তু যখন প্রয়োজন আসে তখন কাটার ভূমিকাটাও পালন করো। তুমিও একটা গোলাপের মতোই। তোমাকে গোলাপ দিলে কোন সমস্যা হওয়ার কথা না”
সাঁঝ পারলে নিজের কপাল চাপড়ায়। তিন চারদিন আগে একটা কাজের জন্য যেকোন স্যারের একটা পারমিশন লাগতো। সাঁঝ কাজের লিডার ছিলো। এখন পুরানো কোন স্যারের কাছে গেলে হাজারটা প্রশ্নসহ আরো ঝামেলা করতো। তাই নতুন এই আতিক স্যারের কাছে গিয়েছিলো যাতে সহজেই পারমিশন পেয়ে যায়। তখন কাজ আদায়ের জন্য হেসে হেসে কথা বলেছিলো যার ফলাফল এখন দেখা যাচ্ছে। আর কালকে কয়েকটা ছেলেকে একটু শিক্ষা দিয়েছিলো কারণ ছেলেগুলো খুব পাওয়ার দেখাচ্ছিলো নিজেদের। এখন গ্রুপের মেইন দায়িত্ব বলতে গেলে সাঁঝের উপর। নিশ্চয় আতিক স্যার সেটাও দেখেছে! এজন্য কাটাসহ ফুলের উপাধি পেলো। আতিক স্যার আবার বলল,
—” তোমার ক্লাস শেষ কখন? ক্লাস শেষে ব্যস্ততা না থাকলে কোন কফিশপে বা কোথাও বসে কথা বলা যাবে?
সাঁঝ আশেপাশে তাকালো। এই আতিক স্যার কি বোধবুদ্ধি সব গুলে খেয়েছে নাকি? আশেপাশে যারা আছে তারা সবাই তাকিয়ে দেখছে। অন্য কিছুতে সাঁঝের কিছু যায় আসে না কিন্তু তার আর আতিকের নামে কিছু ভার্সিটিতে কিছু ভেসে বেড়াক এটা সে চায় না। তার উপরে ইহানও এখানেই চাকরি করে। নিশ্চয়ই ইনি জানেন না ইহান তার স্বামী! সাঁঝ জোর করে হেসে বলল,
—” না স্যার আমি ব্যস্ত আছি আমার সময় হবে না।”
—” আচ্ছা তাহলে কোনদিন তোমাকে আমার বাসায় নিয়ে যাবো সবার সাথে দেখা করতে”
সাঁঝ কিছু বলতেই যাবে তখন অফিসের দিক থেকে ইহান তাদের কাছে আসলো। সাঁঝের চোখ ইহানের উপর আটকে গেলো। একটা কফি কালারের শার্ট পড়েছে। দারুণ লাগছে। সকালে দেখেছে ইহানকে। কিন্তু এখন যেন আরো সুন্দর লাগছে। কিছুটা ঘেমে আছে। শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত গোটানো। চুলগুলো এলোমেলো। সব মিলিয়ে চোখ সরাতে পারছে না। হঠাৎ মনে হলো ভার্সিটির মেয়েরা কি ইহানের উপর ক্রাশ খায়নি? জানতে হবে। যারা ইহানের উপর লাইন মারা ট্রাই করছে তাদের ভালো করে খবর নিতে হবে। ইহান আতিক স্যারের দিকে তাকিয়ে বলল,
—” কি ফুলকে ফুল দেয়া হচ্ছে?”
আতিক স্যার মনে হয় একটু অবাক হলো কিন্তু সেটা মুখে প্রকাশ করলো না। হেসে বলল,
—” হ্যা সাঁঝকে আমার কাছে ফুলের মতোই লাগে। তাই আর কি”
ইহান গোলাপগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল,
—” Wow red roses! Good choice”
আতিক স্যার আবার হেসে বলল,
—” Thanks”
সাঁঝ ইহানের মুড বোঝার চেষ্টা করলো। কিন্তু বুঝতে পারলো না। ইহান সাঁঝের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
—” ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান হচ্ছে নাকি?”
ইহাম সবটা শুনেছে এটা বুঝতে পেরে আতিক স্যার কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো ।সেটা মুখ দেখেই বোঝা গেলো। উনি তাও হেসে বলল,
—” হ্যা ভাবছি একদিন সবাইকে আমার বাসায় দাওয়াত করবো”
ইহান চাপাস্বরে বলল,
—” হ্যা তাতে মেয়েকে আরো ভালো করে দেখেশুনে নেয়া যাবে তাই তো?”
সাঁঝ ইহানের কথা শুনে চোখ গোলগোল করে তাকালো। ইহান চাপাস্বরে বলেছে বিধায় আতিক স্যার বুঝতে পারিনি। সে বলল,
—” সরি আপনি কি বললেন বুঝতে পারলাম না”
—” মানে মিটিং আছে তো। যাবেন না?”
—” হ্যা চলুন”
সাঁঝ এতোক্ষণ ধরে সব কথা শুনার পরে বলল,
—” স্যারেরা আমি আসি। আমার কাজ আছে”
সাঁঝ আর কিছু বলতে না দিয়ে গোলাপগুলো নিয়ে হাঁটতে শুরু করে দিলো। তার আর ইহানের বিয়ের খবর স্টুডেন্টদের মধ্যেই মাত্র কয়েকজন জানে। আর টিচারদের মধ্যে কেউ জানেই না। আতিক স্যারও জানে না। সেজন্য আজ এগুলো বলে গেলো।
,
,
,
🌿
মিটিং শেষ করে ইহান কফি হাতে নিয়ে বাবার ব্যবসার ফাইলের দিকে তাকালো। ভার্সিটিতে এখনো কাজ বাকি বলে বাসায় যেতে পারছে না। তার পাশের চেয়ার আতিক এসে বসলো। তার হাতেও কফি আছে। ইহান একটা সৌজন্যমূলক হাসি দিলো। এমনিতে তার মেজাজ খারাপ হয়ে আছে প্রচন্ড রকমে। তাও এই আতিকের কারণেই। সাঁঝকে লাল গোলাপ দেয়া হচ্ছে! সাঁঝ গোলাপ ফুলের মতো! আর সাঁঝ যদি ফুল হয়েও থাকে তাহলে সেটা শুধু আর শুধুমাত্র তার। সে দেখবে এই ফুলকে, সাজিয়ে রাখবে, ছবি তুলবে, সুবাস নিবে। অন্য কারোর না এই ফুল! উনি আসছেন মাঝখান থেকে ফুল দিতে!
আতিক জিজ্ঞেস করলো,
—” খুব ব্যস্ত নাকি?”
—” না তেমন না। এই ফাইল চেক করছি”
—” ও। আচ্ছা আপনি তো বেশ কিছুদিন ধরে এখানে আছেন। তো সাঁঝের ব্যাপারে কিছু জানেন?”
ইহান ফাইল থেকে মুখ তুলে তাকালো। ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো,
—” কি জানবো?”
আতিক ইতস্তত করে বলল,
—” না এই মানে মেয়েটা কেমন তারপর ভার্সিটি ব্যাকগ্রাউন্ড কেমন এইসব আর কি”
ইহান আবার কাজে মনোযোগ দিতে দিতে বলল,
—” লেখাপড়া তে বেশ ভালো। মানে এক কথায় ভালো স্টুডেন্ট। আর ক্লাস থেকে বাইরে কাজ কারবার বেশি করে। অবশ্য খারাপ কিছু করে না। ভালো কাজই করে। কিন্তু কেন বলুন তো?”
—” আসলে মেয়েটাকে আমার বেশ ভালো লেগেছে। মানে বেশ তেজী মেয়ে। কিন্তু নিজের বিয়ের কথা কিভাবে নিজের মুখে পাত্রীকে বলি? যদি ওর বাসার লোকের সাথে যোগাযোগ করা যেতো তাহলে ভালো হতো। আপনার সাথে আমি একদিন ওকে আসতে দেখেছি। ওর বাসার ব্যাপারে কিছু জানেন? জানলে বলবেন আমি আমার বাসা থেকে প্রস্তাব পাঠাবো”
ইহান বিষ্ময়ে তাকিয়ে থাকলো। কিভাবে রিয়্যাক্ট করবে বুঝছে না। তার কাছে তার বউয়ের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে কথা বলছে? এমন অভিজ্ঞতা কোন মানুষের হয়েছে কিনা সন্দেহ। মুহুর্তে ইহানের রাগ লাগতে শুরু হলো। মানে প্রচন্ড রকমের রাগ। চিৎকার দিয়ে বলতে ইচ্ছা হলো, “শুনুন সাঁঝ আমার বিয়ে করা বউ। ও শুধু আমার। ও আমার আছে আর আমারই থাকবে সবসময়। ওর দিকে চোখ তুলে তাকাবেন না”
কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে কিছুই বলতে পারলো না। আর একই সময়ে আতিকের ফোন আসায় আতিক উঠে চলে গেলো। আতিক চলে যাওয়ার পরে ইহানের ভিতরে আরেক সত্তা জেগে উঠলো। দ্বিতীয় সত্তা বললো, “তুমি তো ওকে ভেঙে ছেড়ে দিবে”।
প্রথম সত্তা প্রচন্ড ক্রোধে বলল,” কোন ছেড়ে দেয়া টেয়া না। যা ভাঙাচোরা হবে আমার সাথে থেকেই হবে। সাঁঝের ইচ্ছা থাক আর না থাক ও আমার সাথেই থাকবে সারাজীবন। ওর উপর শুধু আমার অধিকার আছে”
ইহান নিজের মাথা চেপে বসলো। বিরক্ত লাগছে। তার লক্ষ্য অন্য কিছু। নিজের লক্ষ্য থেকে সরা যাবে না। ইহানের মনে হলো লম্বা একটা শাওয়ার নেয়ার দরকার। মোবাইলে মেসেজের শব্দ পেয়ে চেক করে দেখলো সাঁঝের মেসেজ এসেছে। “আমার ক্লাস, কাজ শেষ। আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। কখন আসবেন?”
ইহান রিপ্লে করলো, “থাকো আমি আসছি একটু পরে”
নিজের কাজ শেষ করে কাগজপত্র গুছিয়ে ইহান সাঁঝকে খুঁজতে খুঁজতে ক্যান্টিনের দিকে আসার পরে দেখলো সাঁঝ আর আতিক সামনাসামনি বসে হাতে চা নিয়ে কথা বলছে। ইহানের দেখে রাগ হয়ে গেলো। সাঁঝ হঠাৎ হেসে দিলো কথা বলার সময়। এমন কি বলছে যে সাঁঝ হাসবে? দুনিয়ার সবার সাথে সাঁঝ হেসে কথা বলতে পারে শুধু তার সাথে ছাড়া।
ইহান ওদের কাছে না গিয়ে ক্যান্টিন থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকলো যাতে সাঁঝ তাকে দেখতে পারে। সাঁঝ তাকে দেখতে পেয়ে উঠে তার দিকে আসতে শুরু করে। সে আগে আগে গিয়ে গাড়িতে বসে।
আর এদিকে সাঁঝ ইহানকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আতিককে পিছনে রেখে চলে আসলো। সে ইহানের জন্য অপেক্ষা করছিলো ক্যান্টিনে আর কোথা থেকে আতিক স্যার এসে চা খাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করলো। সাঁঝ মানা করতে পারলো না। আতিক “স্যার” বলে কথা।
সে আসার আগেই ইহান চলে গেলো। সাঁঝের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। এতো কি তাড়া ছিলো যে দুমিনিট দাঁড়াতে পারলো না? আজ একটা ছোট খাটো সাজা দিতে হবে ইহানকে। সাঁঝ গাড়িতে এসে বসলো। ইহান তার দিকে মুখ না ঘুরিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকলো। সাঁঝ বুঝলো না কি হয়েছে যে এমন মেজাজ দেখাচ্ছে? সে ইহানকে জিজ্ঞেস করবে না কি হয়েছে। কেন জিজ্ঞেস করবে? ইহান গাড়ি চালাতে শুরু করলো।
দুপুর গড়িয়ে বেলা এখন বিকালের দিকে। আকাশের রোদ মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে। ঠান্ডা বাতাস হচ্ছে। ঝড় বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে। জানালা দিয়ে বাতাস এসে লাগছে মুখে। শান্তি লাগছে। সারাদিন এতো গরম ছিলো! বাড়ি যেতে পারলে বাঁচে। ইহান গাড়িটা বাড়ির দিকে না নিয়ে গিয়ে অন্য দিকে ঘুরালো। সাঁঝ জিজ্ঞেস করলো,
—” কোথায় যাচ্ছেন? বাসায় যাবেন না?”
ইহান থমথমে গলায় বলল,
—” কেন আমার সাথে যেতে ভয় করছে?”
সাঁঝের এমন গা জ্বলানো কথা শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। তবুও শান্ত স্বরে বলল,
—” সেটা না। এমনি। যেখানে ইচ্ছা চলুন।”
ইহান তার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুতভাবে বলল,
—” যাবে তো?”
—” যাবো না কেন?”
ইহান সামনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—” আতিক কি বলছিলো?”
—” তেমন কিছু না। এই পড়ালেখা কেমন চলছে এইসব”
ইহান কোন উত্তর দিলো না। সাঁঝ জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। ইহান শহরের বাইরে এসেছে সাঁঝকে নিয়ে। দুপুরবেলা হোক বা আকাশ মেঘলা সেজন্য হোক যেকোন একটা কারণে রাস্তায় মানুষ নেই। দুই একটা গাড়ি যাচ্ছে। রাস্তার ধারে সারি সারি উঁচু গাছ লাগানো। গাছগুলো দুপাশ থেকে বেকে এসে রাস্তার উপর ছাউনির মতো তৈরি করেছে। অসম্ভব সুন্দর লাগছে। রাস্তাটা বেশ অন্ধকার অন্ধকার লাগছে। ইহান একজায়গায় গাড়ি থামিয়ে দিলো। সে নামলেও সাঁঝ নামলো না।
সাঁঝের পাশে দরজা খুলে বলল,
—” আসো”
সাঁঝ বাইরে এসে দাঁড়ালো। গাড়ির ভিতর থেকে বুঝতে পারেনি রাস্তার একপাশে বড় একটা বিল আছে । তাতে কচুরিপানা আছে। আকাশ মেঘলা হওয়ায় পানিও কালো লাগছে। দারুণ লাগছে। কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পরর ইহান বলল,
—” চলো”
—” কোথায়?”
ইহান উত্তর না দিয়ে সাঁঝের হাত ধরে হাঁটা শুরু করলো। সাঁঝের একটা অন্যরকম অনুভূতি হলো। যে অনুভূতির সাথে সে পরিচিত না। কোন নাম দিয়ে এই অনুভূতিকে সঙ্গায়িত করতে পারলো না। ইহান হাত ধরে একটা গাছের কাছে আনলো। সাঁঝ দেখলো কাঠগোলাপের গাছ। থোকায় থোকায় ফুল ফুটে আছে। সাঁঝ মুগ্ধ হয়ে ফুলের দিকে তাকিয়ে থাকলো। ইহান এক ফাকে নিজের ফোন বের করে সাঁঝের অগোচরে কয়েকটা ছবি তুলে নিলো। তারপর ফুল ছিড়ে নিলো।
সাঁঝের পিছনে গিয়ে চুলে ফুল লাগাতে লাগাতে বলল,
—” তোমাকে লাল গোলাপের মোহে না কাঠগোলাপের শুভ্রতায় মানায়”
সাঁঝের ভিতরে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেলো ইহানের কথা শুনে। কিছুটা ভালো লাগাও কাজ করলো।
,
,
,
🌿
বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাখিদের উড়ে যাওয়া দেখছে আর নিজের মেজাজকে ঠান্ডা করার চেষ্টা চালাচ্ছে সাঁঝ। আজ তাদের ঘুরতে যাওয়ার কথা ছিলো। দ্বিতীয় ঘুরতে যাওয়া। প্রথমটা ছিলো ভার্সিটি থেকে গাড়িতে করে কাঠগোলাপের গাছের কাছে যাওয়া। আর আজ একমাস পরে অন্য কোথায় যেনো ইহান নিয়ে যাবে বলেছিলো। বিকাল হয়ে গেছে। সে রেডি হয়ে বসে আছে। কিন্তু ইহান এখনো কাজ থেকে বাসায় এসে পৌছায়নি। রুমের ভিতরে কারোর আসার শব্দ শুনে ভিতরে গিয়ে দেখে ইহান এসেছে। তাকে দেখেই বলা শুরু করলো,
—” সরি সরি সরি। দেরী হয়ে গেছে। আসলে বিজনেস মিটিং ছিলো। শেষ হতে লেট হলো”
সাঁঝ কোন উত্তর দিলো না। সে মনে মনে ঠিক করছে ইহানের সাথে কি করা যায়? কোন একদিন ইহানের ভার্সিটিতে যাওয়ার সময় বাথরুম আটকে বসে থাকবে। তাহলে বুঝবে অপেক্ষা করতে কেমন লাগে!
ইহান শার্টের হাতার বোতাম খুলতে খুলতে কাপড় নিয়ে শাওয়ার নিতে চলে গেলো। একটু পরেই ইহান বাথরুম থেকে বের হয়ে আসলো। সাঁঝের চোখ ইহানের চুলের দিকে গেলো। ঠিকমতো মাথা মোছা হয়নি। চুলে পানি চিকচিক করছে। ইহান তার সামনে এসে বলল,
—” কি হয়েছে বলো তো? মুখ এমন করে রেখেছো কেন?”
সাঁঝ কোন উত্তর দিলো না। ইহান তার দিকে দুই পা এগিয়ে এসে বলল,
—” অন্য কারোর সাথে থাকলে তখন তো হাসতে থাকো। আমার সাথে থাকলে মুখটা এমন করে রাখো কেন?”
সাঁঝ তাও কোন উত্তর দিলো না। ইহান দুই হাত দিয়ে সাঁঝের কোমড় জড়িয়ে ধরে চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলো,
—” কি কমতি আছে আমার মধ্যে?”
সাঁঝ ইহানের কাজে আংশিক ভড়কে গেলো। হঠাৎ কেউ বলে উঠলো,
—” সরি ভুল টাইমে চলে এসেছি। ভাইয়া জিজ্ঞেস করতে এসেছিলাম তুই কি খাবি?”
ইহান সাঁঝকে ছেড়ে দিলো। ইশিতা উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। ইহান বলল,
—” না আমি খেয়ে এসেছি। এখন বের হবো তোর ভাবীকে নিয়ে”
—” আচ্ছা আমি গেলাম”
ইশিতা দৌড়ে চলে গেল। সাঁঝ ইশিতার কান্ডে লজ্জা পেয়ে গেলো। ইহানের সামনে থেকে সরে বারান্দায় চলে আসলো।
,
,
,
🌿
পার্কে এসে সাঁঝের মন ভালো হয়ে গেলো। ইহান লেট করার জন্য যেটুকু রাগ ছিলো সেই রাগ নিয়ে সাঁঝ আবার ভেবে দেখবে বলে ঠিক করেছে। বাথরুম আটকের রাখার শাস্তি দিবে কিনা সেটাও ভেবে দেখবে। ইহান যেখানে এনেছে সেটাকে পুরোপুরি পার্ক বলা যাবেনা। অনেক বড় জায়গা। প্রচুর গাছপালা আছে। নানান রকম ফুলের গাছ। আর বসার জায়গা আছে। পার্কের মধ্যে লেক আছে। টলটলে পানি। লেকের মাঝ দিয়ে আবার ব্রিজ আছে। পায়ে হেটে যাওয়া যায়। দারুণ সুন্দর। কিন্তু সমস্যা হলো এটা বাসা থেকে গাড়িতে আসতে দেড় ঘন্টার পথ। তাই চাইলেই আসা যাবে না।
লেকের মাঝ দিয়ে ব্রিজের উপর হাঁটার সময় সাঁঝ আশেপাশে তাকালো। খুব বেশি মানুষ নেই। দূরে বেঞ্চে নাহলে গাছের নিচে অনেক যুগল বসে আছে। দুই একটা পরিবারও দেখা যাচ্ছে। গল্প করছে। ব্রিজে শুধু সে আর ইহান। ব্রিজের দুপাশে অবশ্য রেলিং দেয়া নেই। বাচ্চাদের জন্য বিপদজনক।
ইহান হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করলো,
—” তুমি সাঁতার জানো?”
—” নাহ”
ইহান হঠাৎ সাঁঝের হাত ধরে পানির দিকে পিঠ বরাবর ঝুকিয়ে দিলো। সব এতো দ্রুত হলো যে সাঁঝ প্রথমে ভয় পেয়ে গেলো। সে দুই হাত দিয়ে ইহানের হাত ধরলো। ইহান মুখে একটু হাসি ঝুলিয়ে বলল,
—” আমি এখন হাত ছেড়ে দিলে কি হবে?”
সাঁঝ ওইভাবে ঝুলে থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে ইহানের মতো একটু বাঁকা হেসে বলল,
—” আমি পড়ে গেলে আপনি তো আছেন বাঁচানোর জন্য”
এরপর সাঁঝ মুহুর্তের মধ্যে ইহানের পায়ের সাথে নিজের পা বাঁধিয়ে ইহানের হাত শক্ত করে ধরে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ইহানের পিছনে এসে দাঁড়ালো। ইহান অবাক হয়ে গেলো। কারণ ইহানের ধারনার মধ্যেও ছিলো না কেউ ঐরকম অবস্থা থেকে নিজে নিজে সোজা হতে পারবে। সাঁঝ পিছন থেকে বলল,
—” এবার আমি যদি আপনাকে ধাক্কা দিই?”
ইহানের অবাকের রেশ কাটছে না। সে বলল,
—” আমি সাঁতার জানি। সাঁতার জানা মানুষ জ্ঞান থাকা অবস্থায় ডুবে না”
এরপর সাঁঝ ইহানের পাশে চলে আসলো। দুজনে আবার হাঁটা শুরু করলো। সাঁঝ জিজ্ঞেস করলো,
—” আপনি ওরকম করলেন কেন?”
—” তোমাকে ভয় দেখানোর জন্য”
সাঁঝ হাসলো। ইহান আবার বলল,
—” By the way তুমি কিন্তু খুব ট্রিকস জানো”
এবারও সাঁঝ কিছু বললো না।
পার্ক ঘোরা শেষ হলে দুজনে বাইরে চলে আসলো। পার্কের ভিতরে কোন কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। বাইরে মেইন রাস্তায় আসার পর একটা ফুচকার দোকান আছে। পাশে আরো কয়েকটা স্টল আছে। ফুচকা ইহানের তেমন পছন্দ না হলেও সাঁঝের বেশ ভালো লাগে। তাই ফুচকা খাবে বলে ঠিক করে। কিন্তু ওখানে বেশ ভীড় আর বসার জায়গা নেই। তাই ইহান সাঁঝকে রাস্তার অপর পাশে থাকতে বলে। ফুচকা কিনে নিয়ে এসে গাড়ির সামনে বা ভিতরে বসে খাবে।
ইহান ফোনে কথা বলতে বলতে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো। একসময় হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার মাঝে চলে যায়। অল্প কিছু গাড়ি যাচ্ছে। তাই হাঁটতে তেমন সমস্যা হচ্ছে না ইহানের। আর সাঁঝ আশেপাশের গাছগাছালিগুলো দেখছে। সামনে তাকিয়ে দেখলো ইহান এখনো ফোনে কথা বলছে। অন্য কোন দিকে খেয়াল নেই৷ আর বিপরীত দিক থেকে অল্প গতিতেই একটা ট্রাক প্রায় ইহানের কাছে চলে এসেছে কিন্তু হর্ণ দিচ্ছে না। সাঁঝ চিৎকার দিয়ে বলল,
—” ইহান পিছনে ট্রাক”
ইহান পিছনে ঘুরে সরে আসতে আসতে এক্সিডেন্ট হয়ে গেলো। ট্রাকটা না থেমে বরং গতি বাড়িয়ে চলে গেলো। আর সাঁঝ দেখলো ইহান রাস্তায় পড়ে আছে। রক্তে লাল হয়ে যাচ্ছে রাস্তা। (চলবে)