কানামাছি পর্ব-১৩

0
1769

#কানামাছি
#পার্টঃ১৩
#জান্নাতুল কুহু (ছদ্মনাম)
ইহানের গায়ের উপর ঢলে পড়লো সাঁঝ। বৃষ্টির পানিতে আপাদমস্তক ভিজে গেছে। চোখ বন্ধ করার আগে তার মনে হলো কেউ ধরে নিয়েছে তাকে।

চোখ খুলে নিজেকে ঘরে আবিষ্কার করলো সাঁঝ। মাথাটা ঝিনঝিন করছে। উঠে বসলো। তখনই চোখের সামনে আলোর ঝলকানি দেখতে পেলো। তার মনে হতে থাকলো জোরে জোরে বজ্রপাত হচ্ছে। কান চেপে ধরলো। তাও শব্দ কমছে না। বরং ক্রমেই বেড়ে চলেছে। মনে হচ্ছে মাথার ভিতরে শব্দটা গেথে গিয়ে বারবার প্রতিফলিত হচ্ছে। সাঁঝের মনে হলো কান থেকে এখনই রক্ত বের হতে শুরু করবে। চোখের সামনে ঘরের ভিতরে যেন বজ্রপাত দেখতে পাচ্ছে। যতটা সম্ভব হলো গুটিশুটি মেরে বসলো। এখনই মনে হচ্ছে সব শেষ হয়ে যাবে।

ইহান ঔষধ কিনে নিয়ে ঘরে এসে দেখলো সাঁঝ কান চেপে ধরে বিছানার এক কোণে বসে আছে। এতো তাড়াতাড়ি জ্ঞান ফিরেছে বেশ অবাক হলো। সাঁঝ চোখ বন্ধ করে বসে আছে। ইহান সামনে গিয়ে বলল,

—” সাঁঝ! উঠে পড়লে কেন? শুয়ে পড়ো। ডাক্তার রেস্ট নিতে বলেছে”

সাঁঝ মনে হলো তার কোন কথায় শুনতে পেলো না। ইহান সাঁঝের হাত ধরে ডাকলো,

—” সাঁঝ!”

সাঁঝ চোখ খুলে ইহানের দিকে তাকিয়ে বলল,

—” শব্দটা বন্ধ করুন। আমি আর শব্দ নিতে পারছি না। আমি মরে যাবো”

ইহান অবাক হয়ে বলল,

—” কোথায় শব্দ? কোন শব্দ নেই তো”

সাঁঝ কোন জবাব দিলো না। হয়তো তার কথায় শুনতেই পায়নি। ইহান সাঁঝের কান থেকে জোর করে হাত সরিয়ে নিলো।
সাঁঝের মুখে অবর্ননীয় আতঙ্ক দেখা দিলো। সে আরো গুটিশুটি মেরে বসলো। ইহানের কাছ থেকে দূরে সরে গেলো। ইহান হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

—” কোন শব্দ নেই এখানে। আমি আছি শুধু। আমার কাছে আসো”

—” বজ্রপাত আমাকে শেষ করে দিবো”

—” সাঁঝ কোন বজ্রপাত নেই। এখন আকাশ পরিষ্কার”

সাঁঝ একটু শুনলো। ইহানের কথা একটু বিশ্বাস হলো হয়তো। ইহানের দিকে এগিয়ে গেলো। একসময় ইহানের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে কান্না শুরু করলো। ইহান সাঁঝের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেও সাঁঝের কান্নার মাত্রা ক্রমাগত বাড়তেই থাকলো। একসময় কান্নাটা চিৎকার দিয়ে কান্নায় পরিণত হলো। মনে হলো ভিতরের সব আর্তনাদ বের হয়ে আসবে। সাঁঝের চিৎকার শুনে বাড়ির সবাই তাদের রুমে এসে পৌছালো। ইহানের মা এসে সাঁঝ কে কিছু বলতে গেলে ইহান ইশারায় তাদের থামিয়ে দিয়ে ঘর থেকে যেতে বলে। সাঁঝ কান্না করতেই থাকলো। একসময় কান্না করতে করতে ঘুমিয়েও গেলো। হয়তো ঘুমের ঔষধ যেটা দেয়া হয়েছিলো সেটা কাজ করছে। ইহান সাঁঝকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। কেন যেন সাঁঝের এই আর্তনাদ তার সহ্য হচ্ছে না!
,
,
,
🌿
মাঝরাতে সাঁঝের ঘুম ভেঙে গেলো। অন্ধকার ঘরে ভয় জাপটে ধরলো। মনে হলো আবার শব্দ হচ্ছে। সাঁঝ ডেকে উঠলো,

—” ইহান”

প্রথমবার সাড়া না পেয়ে সাঁঝ আবার ডাকলো,

—” ইহান উঠুন। আমার ভয় করছে”

ইহান সাঁঝের গলা শুনে ধড়মড় করে উঠে বসলো। লাইট জ্বেলে জিজ্ঞেস করলো,

—” কি হয়েছে?”

—” আমার ভয় লাগছে”

—” ভয় পেও না। আমি আছি এখানে”

সাঁঝ ইহানের কাঁধে মাথা রাখলো। বলল,

—” আপনি আমাকে ছেড়ে যাবেন না প্লিজ। বাবা আর ভাইয়ার মতো আমাকে একা করে স্বার্থপরের মতো যাবেন না প্লিজ। মনে রাখবেন একজন মানুষ আপনার পথ চেয়ে বসে আছে”

ইহান কিছু বলল না। সাঁঝ আবার বলতে শুরু করলো,

—” ছোট বেলা থেকে আমি বজ্রপাতে ভয় পাই। তখন শব্দ হলেই দৌড়ে বাবার কাছে চলে যেতাম। বাবাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকতাম। তারপর একদিন বাবা আমাকে একা করে চলে গেলো। এরপর ভয় পেলে ভাইয়ার হাত ধরে বসে থাকতাম। কিন্তু ভাইয়াও চলে গেল আমাকে ছেড়ে। এরপর থেকে বৃষ্টি হলেই আমি ঘরের দরজা জানালা বন্ধ কানে হেডফোন গুজে বসে থাকতাম। নাহলে দুটো ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাতাম। আমার ভয়ের কোন সঙ্গী নেই।”

ইহান কাঁধে পানির অস্তিত্ব টের পেলো। সাঁঝ কান্না করছে। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বলল,

—” আমি আছি। এখন একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।”

—” হুম”

ইহান সাঁঝের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলো। একসময় সাঁঝ গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো। ইহান সাঁঝের মুখ পানে তাকিয়ে দেখলো।।
,
,
,
🌿
টেবিলল্যাম্প জ্বেলে ইহান কিছু কাগজ নিয়ে বসে আছে । একবার সাঁঝের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকালো। ইহানের মনে হয় সাঁঝ ভিতরে ভিতরে একটা নিঃসঙ্গ, অভিমানি, জেদি, ছোট বাচ্চা। যে একটা ভাঙা পরিবার থেকে এসেছে। ভালোবাসা পায়নি তাই অসম্ভব রকমের জেদি। নিজের কষ্টগুলো ঢাকার জন্য মুক্তি পাওয়ার জন্য অন্য মানুষকে আঘাত করে কষ্ট দেয়। অন্যের অনুভূতির সাথে খেলা করে। হয়তো এতে মনে শান্তি পায়।
এই ভীতু, অন্ধকারের মধ্যে বসে থাকা বাচ্চার একটা হাত দরকার যে তাকে টেনে আলোতে আনবে। যে আলোকে সাঁঝ হয়তো ভয় পায়। সাঁঝের ভিতরের যে সত্তাটা মানুষকে আঘাত করে, একটু একটু করে কষ্ট দিয়ে মারতে পছন্দ করে সেই সত্তাটাকে শেষ করা প্রয়োজন। ইহানের মনে মায়া হলো কিছুটা। কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজেকে বলল,
“সাঁঝকে নিয়ে ভাবা বন্ধ করো। তোমার কিছু উদ্দেশ্য আছে। আর সেই কাজ তোমাকে করতে হবে”

ইহান একটা কাগজ মেলে ধরলো। তাকে লেখা অনিকের শেষ চিঠি। যেদিন অনিকের মিশনে যাওয়ার কথা ছিলো সেদিন লেখা।

বিগ ব্রো,
সাঁঝ আমার সাথে সম্পর্কটা শেষ করে ফেলেছে। ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে। ও অন্য কারোর হয়ে যাবে। আমি কিভাবে নিজের খুশিটা অন্য কোন মানুষের হতে দিবো? আমি ওর কাছে গেলে ও যে নিজেকে শেষ করে দিবে। আমি ওর মৃত্যুর কারণ কখনো কোনদিন কোনভাবেই হতে পারবো না। আমার যে ওকে ছাড়া নিঃশ্বাসটুকু নিতেও কষ্ট হচ্ছে! আমি কিভাবে নিজের খুশি ছাড়া নিজের প্রাণটা ছাড়া বাঁচবো? আদোও কি আমি বাঁচতে পারবো? আমি পারবো না। তুমি ভালো থেকো। খুব ভালো থেকো।
লিটিল

চিঠিটা পড়ে ইহানের সাঁঝের প্রতি মায়াটা কেটে গেলো। সাঁঝ ইচ্ছা করে অনিককে মিথ্যা বলেছে। নাটক করেছে। অনিক কতো মিনতি করেছিলো! সে কল রেকর্ড শুনেছিলো সাঁঝে আর অনিকের কথার। এরপর সাঁঝ একটা মিথ্যা ভয়েস রেকর্ড ছড়িয়ে দেয় যাতে অনিকের নাম ছিলো। সেই ভয়েস রেকর্ডের কোন প্রমান নেই। কিন্তু মুহুর্তের মাঝে যেটা অনিকের জীবনকে একটা বিভীষিকা বানিয়ে তুলেছিলো। এইসব কারণে অনিক ইচ্ছা করে অপারেশনের সময় গুলির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সবার সামনে এটা একটা এক্সিডেন্ট হলেও আসলে এটা একটা আত্মহত্যার প্রচেষ্টা ছিলো।

অনিক তার চাচাতো ভাই হলেও সে নিজে অনিকের বড় হওয়া দেখেছে। বলতে গেলে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে। অনিক অনেকটাই তার সন্তানের মতো। অনেকগুলো বছর অনিকের থেকে দূরে ছিলো কিছু প্রতিজ্ঞার কারণে। কিন্তু সন্তানের থেকে দূরে থাকলেও কি ভালোবাসাটা কমে?কমে না। আর অনিকের বর্তমান এই অবস্থার কারণ সাঁঝ। সাঁঝকে তো শাস্তি পেতেই হবে।

ইহান চিঠিটা রেখে তার আর অনিকের ছোটবেলার একটা ছবি বের করলো। কিছুক্ষণ দেখার পর ছবিটা অতি যত্নে সবার চোখের আড়ালে থাকবে এমন একটা জায়গায় রাখলো। যার নাগাল কেউ পাবে না।

সাঁঝের পাশে শুয়ে সাঁঝের মুখের আতঙ্কটা পর্যবেক্ষণ করতে থাকলো। চোখ বন্ধ করলে একদিকে সাঁঝে আর্তচিৎকার আর আরেকদিকে দিনের পর দিন আইসিইউএর বেডে শুয়ে অনিকের মৃত্যুর সাথে লড়াইয়ের ছবি ভেসে উঠলো। নিজের কাছে মনে হলো দোলাচালে পড়েছে সে! কেন মনে হলো বুঝলো না। (চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে