#কানামাছি
#পার্টঃ১১
#জান্নাতুল কুহু (ছদ্মনাম)
—” অনিক ছাড়ো আমাকে। বাঁচাও কেউ আমাকে। অনিক ছাড়ো। কেউ আছে আশেপাশে?”
সাঁঝের দিকে হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনিক।সাঁঝের গলা চেপে দাঁড়িয়ে আছে অনিক। সাঁঝের মুখ শুকিয়ে আসছে। নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। মনে হচ্ছে তীব্র শ্বাসকষ্টে এখনই মারা যাবে। অনিক হিংস্রভাবে বলল,
—” আমারও ঠিক এমনই লাগছিলো সেদিন যেদিন তুমি আমার সাথে সম্পর্কটা ভেঙে দিয়েছিলো। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো তোমাকে ছাড়া। কিন্তু তুমি তো বিয়ে করে নিলে এই ইহানকে”
সাঁঝ চেষ্টা করেও অনিকের লোহার মতো হাতকে ছাড়াতে পারছে না। মনে সাড়াঁশির মতো চেপে ধরেছে। অনিক আবার বলল,
—” কি ছিলো এই ইহানের মধ্যে যা আমার মধ্যে নেই”
সাঁঝ কোন উত্তর দিতে পারছেনা। অনেকক্ষণ হাসফাস করার পরে অনিকের হাত একটু হালকা হলে জোরে একটা লাত্থি মারলো অনিককে।
হঠাৎ একটা আর্তচিৎকার শুনে সাঁঝ জেগে বসলো। অন্ধকারে কোন একটা জায়গায় আছে। এখনো মনে হচ্ছে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সাঁঝ নিজের মাথা চেপে ধরে বসলো। চিন্তা ভাবনা ধোয়াশার মধ্যে আছে। আ… একটা মৃদু চিৎকারে মাথা একটু পরিষ্কার হলো সাঁঝের। মনে পড়লো কাল তার বিয়ে ছিলো আর সে এখন বাসর রাতে আছে। পাশে তাকিয়ে অন্ধকারের মধ্যেই দেখলো ইহান নেই। সাঁঝ ডাকলো,
—” ইহান?”
—” আ… আ.. আমি এখানে”
বিছানার ওপাশ থেকে ইহানের আওয়াজ শুনে সাঁঝ টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে ঝুকে দেখলো ইহান চোখ মুখ কুচকে নিজের কোমড় চেপে নিচে শুয়ে আছে।
সাঁঝ জিজ্ঞেস করলো
—”আপনি এখানে কিভাবে?”
ইহান বলল,
—” আমি কি দোষ করেছিলাম সাঁঝ? এতো জোরে কিক মেরে ফেলে দিলে কেন নিচে?”
সাঁঝ একটু বিব্রত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—”ওটা আপনার লেগেছে?”
—” হ্যা তোমার পাশে আমি বাদে আর কেউ ছিলো না তো!”
সাঁঝ মনে মনে বলল,”স্বপ্নে অনিককে মেরে বাস্তবে আপনার লাগলো”
তারপর বলল,
—” আচ্ছা আসুন। খুব বেশি লেগেছে?”
সাঁঝ ইহানকে তুলে বিছানায় বসালো। ইহান বলল,
—” তাও লেগেছে একটু”
—” মুভ বা এই টাইপের কিছু নেই?”
—” হ্যা ওই বেডসাইড টেবিলের নিচের ড্রয়ারে আছে”
সাঁঝ ইহানের কোমড়ে স্প্রে করতে করতে বলল,
—” এজন্য রাতে বলেছিলাম একটা ইন্ডিয়া পাকিস্তানের বর্ডার দিই। আপনিই আমাকে বর্ডার দিতে না দিয়ে শুধু একটা বালিশ দিলেন”
ইহান মিনমিনে স্বরে বলল,
—” আমি কি জানতাম নাকি তুমি মাঝরাতে এরকম কিক মারো! জানলে অবশ্যই দিতাম”
সাঁঝ অনুতপ্ত হয়ে বলল,
—” সরি। আমি বুঝতে পারিনি”
—” ঠিক আছে ”
স্প্রে করা হলে সাঁঝ জিজ্ঞেস করলো,
—” ব্যথা কি কমেছে?”
—” বেটার। তুমি চিন্তা করো না। সকালে একটা মেডিসিন নিলে ঠিক হয়ে যাবে। তুমি ঘুমাও। অনেক রাত এখন”
—” I am sorry.”
ইহান একটু রেগে বলল,
—” হয়েছে আর এতো সরি বলো না। মন খারাপও করো না। শুধু বর্ডারটা ঠিক মতো দাও”
সাঁঝ বালিশ দিয়ে তাদের বিছানায় একটা ইন্ডিয়া পাকিস্তানের বর্ডার দিলো। যাতে অনিককে মারতে গিয়ে আবার ইহানকে মেরে না দেয়।
,
,
,
🌿
সকালে ঘুম থেকে উঠে রাতের কথা মনে হতেই সাঁঝ লজ্জা পেলো। বাসর রাতে ঘুমের মধ্যে বরকে কিক মেরে বিছানা থেকে ফেলে দিয়েছে। ছি ছি।
সাঁঝ বর্ডারের উপর ভর করে ইহানের দিকে তাকালো। মনে হচ্ছে গভীর ঘুমে আছে। ভালো করে ইহানকে পর্যবেক্ষণ শুরু করলো। গায়ের ফর্সা। সরু নাক। গালে চাপদাড়ি। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। নাকটা কোন কারণে লাল হয়ে আছে। সাঁঝের মনে হলো নাকে হাত দিলে হাতে লাল রঙ লেগে যাবে। ইহানের নাকে হাত দেয়ার ইচ্ছাটাকে দমন করে উঠ পড়লো। একটু পরেই হয়তো ডাকতে আসবে। তাই সে শাওয়ার নিয়ে রেডি আয়নার সামনে দাঁড়ালো।
নিজেকে আজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সাঁঝ। কেন জানি আজ নিজেকে অন্যরকম লাগছে তার। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করছে কি পরিবর্তন হয়েছে তার মধ্যে। সাঁঝ যদি একবার পিছন দিকে তাকাতো তাহলে দেখতে পেতো কেউ আলতোভাবে চোখ খুলে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সাঁঝ ইহানের কাছে এসে দেখলো ইহান এখনো ঘুমাচ্ছে। সাঁঝের ইচ্ছা হলো না ডাকার। কোন কাজ না পেয়ে দরজা খুলে বাইরে চলে আসলো।
বেশ বড় একতালা বাসা ইহানদের। সাঁঝ হাঁটতে হাঁটতে ড্রইংরুমে চলে আসলো। এসে তার মনে হলো আসা ঠিক হয়নি। অনেক মহিলা বসে আছে। তাকে কেমন ঘুরে ঘুরে দেখছে! মনে হচ্ছে আগে কখনো মানুষ দেখেনি। সাঁঝের মনে হলো আজকে হয়তো শাড়ি পরা উচিত ছিলো। কিন্তু তার ইচ্ছা হয়নি বলে পরেনি। মালিহা বেগম সাঁঝকে দেখে খুশি হয়ে হাত ধরে টেনে নিয়ে সবার মাঝে বসিয়ে দিলো। তারপর একে একে পরিচয় করিয়ে দিলো। ইহানের দাদী, মামী, ফুফুসহ অনেক মেয়ে আত্মীয় আছে। একজন মহিলা বলে উঠলো,
—” বাহ আজ প্রথম দিনে বউ শাড়ি কেন পরেনি?”
সাঁঝের ইচ্ছা হলো বলতে, “প্রথম দিনে শাড়ি পরতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা আছে নাকি?” কিন্তু বলল না। তার শাশুড়ী বলল,
—” না পরলেও তো কোন সমস্যা নেই আপা? থ্রি পিসে ও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে তাই এটাই ঠিক আছে”
আর কেউ এই বিষয় নিয়ে কোন কথা না বললেও সাঁঝ বুঝলো সবাই তার শাশুড়ীর কথায় ক্ষুব্ধ। কথা বলতে বলতে ইহানও চলে আসলো। সেও রেডি হয়ে এসেছে। আপাতদৃষ্টিতে ইহানকে স্বাভাবিক লাগছে। কিন্তু সাঁঝ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে তাকার পরে বুঝলো কোমড়ে ব্যথা আছে।
ইহান এসে সাঁঝের পাশে বসলে সাঁঝ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো,
—” আপনার ব্যথা কমেছে?”
ইহান তার দিকে না তাকিয়েই বলল,
—” হুম”
—” এখনো কি আছে?”
—” আছে একটু। ব্রেকফাস্ট এর পরে মেডিসিন খেলে ঠিক হয়ে যাবে।”
—” আচ্ছা”
ইহান তার দিকে একবার তাকিয়ে বলল,
—” তোমার ঘুম হয়েছে? কোন সমস্যা হচ্ছে না তো?”
—” না সব ঠিক আছে”
তাদেরকে এভাবে কথা বলতে দেখে একজন বৃদ্ধ মহিলা রসিকতার সুরে বলল,
—” কি এতো কথা বলিস বলতো? আমরাও একটু শুনি”
সাঁঝের কিছুটা অস্বস্তি হলো। না জানি কি না কি ভাবছে সবাই! ইহান হেসে বলল,
—” ছোট দাদী তোমার নাতবৌকে জিজ্ঞেস করছিলাম এখানে কেউ জ্বালাচ্ছে না তো!”
কেউ হেসে উঠলো আর কেউ মুখ গোমড়া করে রাখলো। এরপর সবাই নাস্তা করে নিলো। সাঁঝ রেডি হয়ে নিলো বৌভাতের অনুষ্ঠানের জন্য। অনুষ্ঠানে সাঁঝের বাসা থেকে অনেকেই এসেছিলো। ফুফু-ফুফা সহ মায়ের পরিবারের সবাই। তার আর ইহানের আজকেই যাওয়ার কথা ছিলো ওই বাড়িতে কিন্তু বৌভাতের অনুষ্ঠানে শেষ হতে হতে বেশ রাত হয়ে গেলো। সাঁঝের বাড়ির লোক চলে গেলেও তারা দুজন গেলো না। কাল আবার সাঁঝের বাসা থেকে কেউ আসবে তাদেরকে সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
রাতে সাঁঝ ফ্রেশ হয়ে রুমের বাইরে যাওয়ার সময় ইহান তাকে জিজ্ঞেস করলো,
—” এখন কোথায় যাচ্ছো?”
—” ড্রয়িংরুমে। আন্টি আর ইশিতার সাথে গল্প করতে”
—” ও আচ্ছা”
—” আপনি কি এখন ঘুমাবেন? ১০.৩০ বাজে মাত্র”
—” না এখন ঘুমাবো না। তুমি যাও”
—” হুম”
ড্রয়িংরুম থেকে সাঁঝের গলার আওয়াজ পাওয়ার পর ইহান ঘরের দরজা লাগিয়ে দিলো।
,
,
,
🌿
বিগ ব্রো,
জানো আজ একটা মেয়েকে দেখলাম। শান্তশিষ্ট মনে হলো অনেক দেখে। মেয়েটাকে দেখে আমার একটা বহমান নদীর মতো মনে হয়েছে।
যে বয়ে চলেছে সময়ের সাথে। দেখতে শান্ত কিন্তু ভিতরে হয়তো অনুভূতির
জোয়ার আছে। জানিনা কেন জানি বারবার ওর কথায় মনে হচ্ছে। তোমার কাছে হয়তো কোন একদিন চিঠিগুলো পৌঁছে যাবে তাই নিজের অনুভুতিগুলো লিখলাম।
লিটিল।
,
,
বিগ ব্রো
জানো আমি তোমাকে যেই মেয়ের কথা বলেছিলাম না? সেই মেয়েটার নাম
আর ও কোথায় পড়ে জানতে পেরেছি। নিজের কাজের সুবাদে কিছু সুবিধা
পাই। সেগুলো ব্যবহার করে জেনেছি। মেয়েটার নাম কি হতে পারে বলো
তো? তোমাকে বলে দিবো? না বলবো না। কোনদিন সামনে আসলে সেদিন
বলবো। শুধু এটুকু বলতে পারি আজও মেয়েটাকে দেখে আমার একই কথা
মনে হয়েছে। মেয়েটার শান্ত, চুপচাপ,আর কিছুটা বিষন্নতার মুখোশের আড়ালে রয়েছে হাজারো না বলা অনুভূতি, শত শত অপ্রকাশিত ইচ্ছে আর স্বপ্ন। আচ্ছা মেয়েটাকে দেখলেই কেন আমার এমন মনে হয়? আমি কি প্রেমে পড়েছি ওর? আর আমার এখন ইচ্ছা হয় সেই অনুভুতিগুলোর গন্তব্য আমি হবো। কেন এই ইচ্ছা হয়? যদি চিঠিটা পৌঁছাতে পারি সেদিন তোমার উত্তর শুনবো।
লিটিল।
,
,
ইহান দ্বিতীয় চিঠিটা পড়ার পরে চিঠির বক্সে রেখে দিলো। বক্সের ভিতরে অনেকগুলো ডাকটিকিটবিহীন খামে চিঠি আছে। পড়া শেষ সবগুলো। তার উদ্দেশ্যেই লেখা। কিন্তু যখন সে চিঠিগুলো হাতে পেয়েছে তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। আজ আবার এই দুইটা চিঠি বের করে পড়লো কারণ চিঠির প্রেরকের মতো সেও একই রকম অনুভূতির সম্মুখীন হচ্ছে। ক্রমেই দূর্বলতা তৈরী হচ্ছে। যেটা কাটিয়ে উঠতে হবে। (চলবে)
#কানামাছি
#পার্টঃ১২
#জান্নাতুল কুহু (ছদ্মনাম)
ভিড়ের মধ্যে একটা লোক ইচ্ছা করে শাড়ির কুচির উপর পা দিয়ে কুচি কিছুটা টেনে ধরে চলে গেলো। পাশ কাটিয়ে যাওয়ার পরে পিছন ঘুরে একবার পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে হাসি দিলো। সাঁঝের ইচ্ছা করলো লোকটার দাঁত বরাবর একটু ঘুষি মারতে। দাঁত না পড়লেও অন্তত নড়ে তো যাবে সেটাই মনে শান্তি দিবে।
ব্যর্থভাবে চারিদিকে আরো একবার চোখ বুলিয়ে নিলো সাঁঝ। গলা ছেড়ে কান্না করতে ইচ্ছা হচ্ছে। চারিপাশে ভয়াবহ ভিড়। এর মধ্যে সে একপ্রকার হারিয়ে গিয়েছে। লোকেরা যাওয়ার সময় গায়ের সাথে গা লাগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। সাঁঝ ডানপিটে মেয়ে হলেও এই ভিড়ের মধ্যে তার সাথে খারাপ কিছু হলে সে কিছুই করতে বা বলতে পারবে না। বরং কিছু বললে মানুষ তার চরিত্রের উপর আঙ্গুল তুলবে। একবার শেষ বারের মতো কুচিটা হাতে ধরে ডান পাশে যাওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু ফলস্বরূপ মানুষ তার পায়ের উপর, শাড়ির উপর পা দিয়ে হেঁটে চলে গেল। সাঁঝে ভয় হতে শুরু করলো এখানে তো কত ধরনের মানুষ আছে। এই ভীড়ের মধ্যে খারাপ কোন অভিজ্ঞতা না হয়ে যায়! আবার ভয় হলো শাড়ি সামলাতে পারবে তো?
আকাশের দিকে তাকালো সাঁঝ। সূর্য নিজের পূর্ণ শক্তি ব্যবহার করছে। ঘামে পিঠ ভিজে একাকার হয়ে গেছে। প্রাণটা যেনো বলছে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি।
দুপুরবেলা এই মেলাতে আশার আইডিয়া তারই ছিলো। আজ ফুফা আর মায়ের স্বামী তাদের নিতে এসেছিলো ইহানের বাসায়। সাঁঝ অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছিলো এই দুজন মানুষকে দেখে। এর থেকে কেউ না আসলে সে আর ইহানই যেতে পারতো। মায়ের স্বামী নিজের গাড়ি এনেছিলো। নিজেই ড্রাইভ করে নিয়ে যাবে সেই উদ্দেশ্যে। গাড়িতে উঠার পরেই মায়ের স্বামী দুটা প্যাকেট হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
—” এই নাও তোমাদের জন্য কিছু গিফট”
সাঁঝ অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলো। গাড়ির মধ্যে গিফট কে দেয়? সাঁঝ না নেয়ায় ওটা ইহানই নিয়েছিলো। ইহান বলল,
—”Thank you”
মায়ের স্বামী বলল,
—” এটা আমার পক্ষ থেকে তোমাদের দুজনের জন্য। আগেই দিয়ে দিলাম”
ইহান শুধু প্রতিত্তরে সৌজন্যমূলক হাসি দিয়েছিলো। এরপর শুরু হলো আরেক ঝামেলা। ফুফা আর সামনে বসেছিলো, পিছনে সে আর ইহান। সামনে বসে ভিউ মিরর দিয়ে ফুফা বারবার সাঁঝের দিকে তাকাচ্ছিলো। সাঁঝ ইহানের পাশে বসে এই বিষয় নিয়ে চরম অস্বস্তিতে পরে। নির্বোধ ফুফা কিছু বুঝেনা বারবার অসহ্যের মতো সাঁঝের দিকে তাকাচ্ছে। সাঁঝ তো ইহানের দিকে তাকাতেই পারছিলো না অস্বস্তিতে। সাঁঝের ইচ্ছা করছিলো তখনই গাড়ি থেকে নেমে যায়। কোনমতে মোটামুটি বাড়ির কাছে আসার পর এই মেলা চোখে পড়ে। বেশ কয়েকদিন ধরেই চলছে। তখন সাঁঝ গাড়ি থামিয়ে ইহানকে বলে,
—” চলুন মেলাতে যাই”
সবাই অবাক হয়েছিলো। ইহান জিজ্ঞেস করলো,
—” এই দুপুর বেলাতে মেলায় গিয়ে কি করবা?”
—” বাড়ির সবার জন্য কেনাকাটা করে নিয়ে যাই! বাচ্চারাও আছে”
ইহান অবাক হয়ে বলেছিলো,
—” মেলা থেকে?”
—” মেলা বলে অবজ্ঞা করবেন না। বানিজ্য মেলা। শহরের বড় বড় দোকান থেকে এখানে স্টল দেয়। আর পছন্দ না হলে পরে কিনবো। এখন তো দেখে আসি”
মায়ের স্বামী বলল,
—” না না সাঁঝ কি বলছো? কেনাকাটা করতে হবে না। যদি করতেই হয় পরে করো। এখন বাসায় চলো”
সাঁঝ বিশাল একটা মেকি হাসি দিয়ে বলেছিলো,
—” না না কি বলছেন? জামাই প্রথমবার শশুড়বাড়ি যাচ্ছে কিছু তো দায়িত্ব আছে না?”
সাঁঝের এই দায়িত্বের কথা শুনে ইহান গলে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—” Are you sure?”
—”100% sure. Let’s go”
তাদের যাওয়ার কথা শুনে ফুফা প্রথমবার মুখ খুলে জিজ্ঞেস করলো,
—” আমরা সবাই যাই? নাহলে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করি? তোমরা ফিরবে কি করে? দুপুরে খাবে না?”
সাঁঝ বলে,
—” না না আমাদের দেরী হবে। আপনারা চলে যান। আমরা সিএনজি বা রিকশায় করে চলে আসবো। গিয়ে খাবো”
এরপর অতি উৎসাহে ইহানকে নিয়ে ফুফার দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গাড়ি থেকে বের হয়ে আসলো। আর এই উৎসাহের কারণে ভুলেই গেছে ফেসবুক স্ক্রল করে ফোনটা গাড়িতেই রেখেছে। আসার সময় ফোন আনতে ভুলে গেছে।
মেলার ভিতরে বেশ কিছুক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে টিকিট কিনে আনার পরে ইহান জিজ্ঞেস করে,
—” তোমার এই দুপুরবেলাতে মেলায় কেনাকাটা করার আইডিয়াটা কি ঠিক হলো? মানুষ কিন্তু অনেক”
ইহানের কথা উড়িয়ে দিয়ে সাঁঝ বলেছিলো,
—” আরে দুপুরবেলাতেই আসতে হবে। মানুষ কম থাকবে। এই বাইরেই ভিড়।
ভিতরে ঢুকলে দেখবেন ফাকা।”
ভিতরে ঢুকে সাঁঝের ধারনা ভুল প্রমান হলো। মানুষ গিজগিজ করছে। তার উপর জায়গায়টা ছোট মনে হচ্ছে। এবং বালি ফেলা জায়গা। হাঁটতে সমস্যা হচ্ছে। ভিতরে ঢুকে সাঁঝ একটু অবাক হয়ে বলেছিলো,
—” এই দুপুরে এতো মানুষ কেন?”
ইহান একটু আশেপাশে তাকানোর পরে বলল,
—” আজ মেলার শেষ দিন। বিকালে শেষ। তাই সবাই তোমার মতো ভেবেছে দুপুরে কে আসবে? এবং এতো ভীড়”
এরপর দুজন মিলে দোকান ঘুরতে থাকলো। ইহান সাঁঝকে বলেছিলো সামনে বা পাশে পাশে হাঁটতে। সাঁঝ না শুনে দোকান ঘুরে হাঁটছিলো। শাড়ি পায়ে বেঁধে হাঁটতে সমস্যা হচ্ছিলো। ফলস্বরূপ ইহানকে হারিয়ে ফেলেছে। আর এখন এই ভীড়ের মাঝে একা দাঁড়িয়ে আছে। একটা ছেলে তার পায়ের কাছে শাড়িতে পা দিয়ে চেপে ধরলো। একদিকে টান পড়েছে। সাঁঝের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। ছেলেটা তার পাশে আসলে সে তার নিজের শরীরের সব ভর ছেলেটার পায়ের উপর দিয়ে পায়ে পাড়া দিলো। ছেলেটা চোখ মুখ কুচকে তার দিকে তাকিয়ে না থেমে চলে গেলো।
সাঁঝের মনে হলো কেউ ইচ্ছে করে তার পিঠে হাত লাগিয়ে চলে গেলো। পিছনে ঘুরেও কাউকে দেখতে পেলো না। চোখের কোণে পানি জমতে শুরু করলো তার। মনে মনে আল্লাহ কে ডাকলো। হঠাৎ কেউ তার পিঠের সাথে একদম এসে দাঁড়ালে সাঁঝের কান গরম হয়ে যায়। রেগে পিছনে ঘুরে ইহানকে দেখতে পায়। দেখেই কেঁদে দিয়ে বলে,
—” এসেছেন আপনি? কোথায় ছিলেন এতক্ষন?”
—” তোমাকেই খুঁজছিলাম। তখন তো বললাম পাশে পাশে হাঁটো। তা তো হাঁটলে না।”
সাঁঝের যেন প্রাণ ফিরে আসলো। বলল,
—” হাঁটতে পারছি না”
ইহান পিছনে দাঁড়িয়ে সাঁঝের দুই পাশে হাত দিয়ে একটা বলয়ের মতো তৈরী করলো। যাতে কেউ সাঁঝকে ছুতে না পারে। তারপর বলল,
—” কুচি ধরে সাবধানে হাঁটো। কেউ এখন ডিস্টার্ব করবে না”
সাঁঝের মনে হলো এই প্রতিরক্ষা বলয় ভেদ করে কেউ তার ক্ষতি করতে পারবে না। এমন একটা আশ্রয়েরই যে খুব দরকার ছিলো তার। ইহানই কি তার সেই আশ্রয়?
এরপর হেঁটে একপাশে আসার পরে ইহান তাকে আড়াল করে দাঁড়ালো শাড়ি ঠিক করে নেয়ার জন্য। তার অবস্থা দেখে বলল,
—” ঘেমে তো গোসল করে ফেলেছো”
—” হুম”
সাঁঝ ভাবলো ইহান নিশ্চয় এবার মেলায় আসা নিয়ে বকা দিবে বা কিছু বলবে। সে প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছি ইহান কিছু বললে সেও বলবে। কিন্তু ইহান কিছু বলল না। বরং ফ্যান আছে এমন একটা দোকানে নিয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ বসলো। তারপর বাকি শপিং করে ইহান তাকে একপ্রকার নিজের সাথে চেপে ধরে মেলার বাইরে আসলো।
সিএনজিতে করে আসার সময় সাঁঝের মনে হলো কেউ একজনও তার এই জীবনে আসলো যে তার হাতকে শক্ত করে ধরতে পারবে। ভাইয়া যাওয়ার পর থেকে এই কঠিন পৃথিবীকে একা মোকাবেলা করতে গিয়ে নিজের উপরে এবং ভিতরে কাঠিন্য চলে এসেছে। এখন তার বিপদকে মোকাবেলা করার মতো না হলেও বিপদের সময় পিছনে এসে পথ আগলে রাখার মতো কেউ তো আছে!
,
,
,
🌿
নিষ্পলক ভাবে উপরের দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছে সাঁঝ। তার ফেক একাউন্টটা হ্যাক হয়ে গেছে। মাত্র কয়েকদিনের জন্য সেটা একটিভ ছিলো। তারপর বন্ধ করে দেয়। কিন্তু এর মাঝেই হ্যাক হয়ে গেছে। পাসওয়ার্ড দিয়ে ঢুকতে পারছে না গত তিনদিন ধরে চেষ্টা করেও। যে করেছে তাকে অবশ্যই টেকনোলজি নিয়ে এক্সপার্ট হতে হবে। কম্পিউটার, কোডিং, সফটওয়্যার এগুলোতে পারদর্শী হতে হবে।
একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসলো আপনা আপনি। আজ সে হাসপাতালের সেই কেবিনের সামনে আবার গিয়েছিলো। আশা ছিলো হয়তো যাকে অনিক ভাবছিলো তাকে আবার দেখতে পাবে। কিন্তু সেখানে কেউ ছিলো না। ফাকা রুম। হয় রোগীকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে না হলে ওখান থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
সাঁঝ চোখ বন্ধ করলো। প্রচন্ড গরমে অস্বস্তি লাগছে দুপুরবেলা। ইহান বাসায় নেই। অনেক ব্যস্ততা আছে তার। তাই ঐ বাসা থেকে ফিরে দুদিন পর থেকে নিজের কাজে লেগে পড়েছে। আর সাঁঝ ওবাসা থেকে ফিরেছে দুই সপ্তাহ হলো কিন্তু এখনো ভার্সিটিতে যায়নি। যাবে কাল বা পরশু থেকে। চোখ বন্ধ করে একসময় ঘুমিয়ে পড়লো।
একসময় হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো সাঁঝের। ঘুম কেন ভাঙলো সেটা বোঝার চেষ্টা করতেই বাইরে তাকিয়ে দেখলো অন্ধকার হয়ে গেছে। খুব সম্ভবত বৃষ্টি পড়ছে। তার চোখ ঘড়ির দিকে যেতেই মনে প্রশ্ন আসলো এতোক্ষণ ঘুমিয়েছি? ইহান কি চলে এসেছে অফিস থেকে?
জোরে বৃষ্টির শব্দ শুনে সাঁঝের খেয়াল হলো আজ অনেক কাপড় ধোয়া হয়েছে। সেগুলো সব বারান্দায় মেলে দেয়া আছে। তড়িঘড়ি করে উঠে কাচের দরজা ঠেলে বারান্দায় গিয়ে দেখলো ঘরের থেকে বোঝা না গেলেও বাইরে প্রচন্ড জোরে বৃষ্টি হচ্ছে। সাথে বাতাস আর মেঘের ঝলকানি তো আছেই। এতো কাপড় তুলতে সাঁঝ হিমসিম খাচ্ছে। হঠাৎ জোরে মেঘ ডেকে উঠলো। মনে হলো কানে তালা লেগে যাবে। সাঁঝের হাত থেকে কাপড়গুলো পড়ে গেলো। ভয় আকড়ে ধরেছে। তার সব থেকে বড় ভয় এই বজ্রপাত! কোন রকমে কাপড় তুলে পিছনে দরজা খুলতে গিয়ে দেখলো দরজা বন্ধ। খুলছে না। কয়েকবার চেষ্টা করেও খুলতে পারলো না।
তখন আবার জোরে বজ্রপাত শুরু হলো। বজ্রপাত একবার শুরু হলে বেশ কিছুক্ষণ থাকে। সাঁঝ কান্না শুরু করে দিলো। এতো শব্দ আর এতো আলো! সাঁঝ দিয়ে ডাকলো,
—” ইহান! ইহান!”
বৃষ্টি আর বজ্রপাতের কারণে তার এতো জোরে চিৎকার ঘর পর্যন্ত পৌছাচ্ছে কিনা সন্দেহ! তাই সাঁঝ কান্না করতে করতে চিৎকার দিয়ে ডাকলো,
—” ইহান!”
কাচের দরজায় হাত দিয়ে বাড়ি মারতে শুরু করলো। চিৎকার দিতে গিয়ে মনে হলো গলা ছিড়ে যাবে। আবার ডাকলো,
—” আন্টি,… ইশিতা…..”
আবার জোরে শব্দ হলে বলল,
—” আন্টি… আঙ্কেল…”
সাঁঝের মনে হলো এবার সে জ্ঞান হারাবে। শেষ চেষ্টা হিসেবে ডাকলো,
—” বাবা… বাবা বাঁচাও। ভাইয়া বাঁচাও আমাকে। ভাইয়া………”
চিৎকার দিতে দিতে সাঁঝ মেঝেতে বসে পড়লো।
ইহান নিজের ঘরের দরজার সাথে হেলান দিয়ে সামনে বারান্দার দিকে তাকিয়ে আছে। বারান্দা থেকে তাকে দেখা যাবে না তার উপর পর্দা আছে তাই সাঁঝ তাকে দেখতে পাচ্ছে না। সে সাঁঝের চিৎকার শুনতে পাচ্ছে আর দরজায় বাড়ি মারাটাও দেখতে পাচ্ছে। ইহানের ফোন আসলে ফোনটা তুলে নেয়। জিজ্ঞেস করলো,
—” ডা. সাহেব আমার ভাই মানে অনিকের অবস্থা কি?”
—” একই রকম। কোমায় আছে। উন্নতি বা অবনতি কিছুই হচ্ছে না”
—” আপনারা চেষ্টা চালান। বাকিটা আল্লাহর হাতে।দেখা যাক কি হয়”
ইহান ফোন কেটে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। গত প্রায় তিনমাস ধরে অনিকের অবস্থা হয় অবনতি হচ্ছে নাহয় এক জায়গায় থেমে আছে। কিছুক্ষণ পরে ইহান হেঁটে বারান্দার কাছে গেলো। (চলবে)