কানামাছি পর্ব-১০

0
1941

#কানামাছি
#পার্টঃ১০
#জান্নাতুল কুহু (ছদ্মনাম)
—” নিজের নোংরা নজর ঠিক কর। মেয়েদের পা থেকে মাথা পর্যন্ত স্ক্যান করার আগে একবার নিজের এই ভাঙা হাতের দিকে তাকাবি। এবারের মতো ছেড়ে দিয়েছি এরপর আর প্রাণে বাঁচবি না। মাটির দিকে তাকিয়ে চলবি। খুব সাহস না তোর? সাঁঝের পিছনে লাগবি? ওর ক্ষতি করবি? এতোদিন তো ও তোকে শিক্ষা দিয়েই এসেছে। এবার থেকে আমিও আছি ওর সাথে। কিছু বলার আগে ভেবে নিবি এর পরের বার কি হবে!”

সাঁঝ ইহানের গলায় কথাগুলো শুনে থমকে দাঁড়ালো। হাসপাতালে দেখতে এসেছে সবাই নাহিদকে। ইহানও এসেছিলো দেখতে। ইহান ভিতরে নাহিদের সাথে কথা বলার নাম করে ঢুকেছিলো। সাঁঝ ইহানের জন্য অপেক্ষা করছিলো। তার মানে গত রাতে ইহান নাহিদকে মেরেছে। সাঁঝের কানে একটা কথা বাজতে লাগলো, “সাঁঝের সাথে আমি আছি।”

কেউ আছে তার সাথে। যে তার সাথে তাল মিলাচ্ছে। হঠাৎই সাঁঝের নিজের মায়ের প্রতি কিছুটা কৃতজ্ঞতা জন্মালো। মা জোর না করলে সে হয়তো ইহানের সাথে বিয়ে করার কথাটা ভাবতে পারতো না। সাঁঝ হাঁটতে হাঁটতে অন্য দিকে চলে আসলো। এদিকে মানুষ কম। হয়তো সিরিয়াস পেশেন্টরা থাকে। অনেক বড় একটা করিডর। করিডরে যত সামনের দিকে যাচ্ছে কোলাহল, মানুষ তত কমে যাচ্ছে। সাঁঝের একসময় মনে হলো একটা ভৌতিক হাসপাতালে চলে এসেছে। করিডরের শেষ প্রান্তে কোন মানুষ নেই। এমনকি ডাক্তার নার্সও নেই। দুইপাশে কিছু রুম আছে। আর সামনে একটা বড়া জানালা আছে। রাস্তার রোডল্যাম্পের আলো আসছে ওখান থেকে। নিজের গায়ে থাকা কাচা ফুলের গন্ধ বারবার নাকে এসে লাগছে। সাঁঝ গয়নাগুলোর কিছু কিছু খুলে পাশের ডাস্টবিনে ফেলে দিলো। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের হলুদ শাড়ি এখনো পরনে আছে।

নাহিদের মার খাওয়ার ঘটনা কাল রাতে ঘটলে তাকে আজ সকাল থেকে কেউ কিছুই বলেনি। সবাই তার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে ব্যস্ত ছিলো। এমনকি ফুফুর মধ্যে কোন হেলদোল দেখতে না পেয়ে সাঁঝ বেশ অবাক হয়েছিলো। তারপর বিকালে সব অনুষ্ঠান শেষে সবাই জানালো নাহিদ হাসপাতালে ভর্তি। ইহানদের বাসাতে বলা হয়েছে নাহিদ এক্সিডেন্ট করেছে। তাই ইহান নাহিদকে দেখতে এসেছিল। কিন্তু ইহানের আসল উদ্দেশ্য তো নাহিদকে ভয় দেখানো ছিলো।
সাঁঝ আনমনে হেসে উঠলো। ইহান তার জন্য ভাবে!

পিছন দিকে তাকিয়ে তার গা ছমছম করে উঠলো। কেউ নেই সে একা একা দাঁড়িয়ে আছে এই রাতের বেলায়। সে পিছন দিকে আসার সময় দুই পাশে থাকা হাতে গোনা কয়েকটা রুমের প্রতি তার তীব্র আকর্ষণ হলো। সাঁঝ সবগুলোতে উঁকি মেরে মেরে দেখতে থাকলো। সবগুলোই ফাকা। শেষের আগেরটাতে একজন শুয়ে আছে। হাতে পায়ে মাথায় নানা ধরনের যন্ত্র লাগানো। সাঁঝ চোখ সরিয়ে নিলো। দ্বিতীয়বার তাকানোর পরে সাঁঝ চমকে উঠলো। অনিক! সাঁঝের আবছা মনে হলো অনিক শুয়ে আছে। মুখ প্রায় দেখতে পাচ্ছেনা। আরো ভালো করে দেখার জন্য রুমটার কাঁচের জানালা ঘষামাজা শুরু করলো। কিন্তু তাও দেখতে পেলো না ঠিক মতো। হঠাৎ বাজখাঁই গলায় শুনতে পেলো,

—” এখানে কি চায়?”

সাঁঝ চমকে উঠলো। একটু স্থির হয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখলো একজন নার্স তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সাঁঝ বলল,

—” কিছু না এমনি হাঁটতে হাঁটতে এসেছি”

—” এটা হাসপাতাল। সব জায়গায় এমনি হাঁটা যায় না। আর হাঁটতে আসলে কি উঁকি মারতে হয়?”

—” না আসলে এমনি।”

সাঁঝ একটু চুপ থেকে আবার জিজ্ঞেস করলো,

—” এই তিনটা রুম কিসের জন্য?”

মহিলাটি থমথমে গলায় বলল,

—” এগুলো আইসিইউ”

সাঁঝ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—” আইসিইউ তো ওইদিকে আছে। তাহলে এগুলো কি?”

—” এগুলো স্পেশাল।”

—” আইসিইউ আবার স্পেশাল হয়?”

মহিলাটা বিরক্ত হয়ে বলল,

—” আপনি ডাক্তারও না নার্সও না। এতো প্রশ্ন কেন আপনার? আর এখানে যে উকি মারছেন আপনার কাছে পারমিশন আছে?”

—” না”

—” পারমিশন না থাকলে এখানে আসতে পারবেন না। এখন যান”

সাঁঝ আর কিছু বলতে পারলো না। চলে আসলো। সে লোকটাকে ঠিকমতো দেখতে না পেলেও মোটামুটি শিউর ওটা অনিক। অনিক আইসিইউ তে আছে? কিন্তু মনের মধ্যে আবার খচখচ শুরু হলো অনিক তো? কিভাবে জানবে? আশিককে বললে হয়তো বিরক্ত হবে। সে নিজেও তো কিছু করতে পারবে না। সাঁঝের ভিতরে তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো। তার কাছে অনিকের ছবি এখনো আছে। আবার জানার ইচ্ছা হচ্ছে অনিকের আসলে কি হয়েছিলো? ও কি ইচ্ছা করে গুলির সামনে দাঁড়িয়েছিলো কিনা জানতে হবে।

আনমনে হাঁটতে হাঁটতে মূল হাসপাতালে এসে গেলো। মা, ফুফু ফুফাকে দেখতে পাচ্ছে। ইহানও আশেপাশে আছে কোথাও। একটু পরে ইহানও কোথা থেকে এসে গেলো। তাকে দেখে বলল,

—” তোমার চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে। অনেক ক্লান্ত মনে হয়”

—” হ্যা অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পরে রেস্ট নেয়ার সময় পাইনি।”

—” এখন চলো। নাহিদের বাসা থেকে লোক আসছে। কাল তো বিয়ে সেজন্য তোমার ফুফা,ফুফু থাকতে পারবে না।”

—” আচ্ছা।”

নাহিদের কথা মনে হতে সাঁঝের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। ইহানের দিকে তাকিয়ে হেসে দিলো। ইহান জিজ্ঞেস করলো,

—” কি?”

—” কিছু না। আপনি অনেক ভালো”

ইহান তব্দা মেরে দাঁড়িয়ে থাকলো। সাঁঝ এতো মিষ্টি স্বরে কখনো কথা বলে না। এরপর ইহান নিজের বাসায় আর সাঁঝ নিজের বাসায় চলে আসলো। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় সেই মানুষটার কথা মনে হচ্ছিলো যাকে দেখে অনিক মনে হয়েছে। খুব অদ্ভুত লাগছিলো দেখতে। একবার মনে হয়েছে অন্য কেউ। আরেকবার মনে হয়েছে ওটা অনিক। সাঁঝ নিজের মাথা চেপে ধরেছে। এই গোলকধাঁধা থেকে বের হতে পারছে না সে!
,
,
,
🌿
গোলাপ দিয়ে সাজানো খাটে বসে আছে সাঁঝ। রুমটা বেশ সুন্দর করে ফুল, মোমবাতি দিয়ে সাজানো। কিন্তু সাঁঝের মেজাজ খিটখিটে হয়ে আছে। মনে হচ্ছে পাগল হয়ে যাবে। একে সারাদিনের শারিরীক ধকল তার উপর মানসিক ধকল!
সকাল থেকে শুধু ধকল যাচ্ছে। এখন রাত বারোটা তাও একটু রেস্ট নিতে পারেনি।
সকালে ইহান আর ওর পরিবারের অল্প কয়েকজন কাজী নিয়ে এসে বিয়ে পড়িয়ে গিয়েছে। তারপর বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত একটা কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছে। সেখানে ইহান আর তার সব আত্মীয়দের সাথে শুধু কুশল বিনিময় করতে গিয়েই সে হাপিয়ে গেছে। এরপর এই বাসায় চলে আসলো। কিছুক্ষণ সবার সাথে বসে কথা বলে খেয়েদেয়ে এখন বসে আছে ইহানের জন্য।
বিয়ের কবুল বলার মুহুর্তের কথা মনে হতেই সাঁঝ অন্যমনস্ক হয়ে গেলো। তখন মনে হয়েছিলো বাবা আর ভাইয়া থাকলে কত ভালো হতো। একটা শব্দ কবুল তারপর থেকে অন্য একজন মানুষের সাথে জীবনটা একদম জুড়ে যাবে। যদিও ইহানের জন্য কোন অনুভূতি নেই সাঁঝের মনে তাও ইহানের সাথেই সে জুড়ে গিয়েছে।

সাঁঝ রুমটার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। সবই প্রায় সাদা। ইহানের পছন্দের রঙ সাদা। সাথে বাথরুম আর ট্রান্সপারেন্ট গ্লাস দেয়া বারান্দা আছে। বারান্দার সামনে অবশ্য পর্দা টাঙানো সাদা রঙের। চোখ বুলাতে গিয়ে সাঁঝের চোখ সামনের মিনি সোফাতে গেলো। সেখানে ইহানের বিয়ের শেরওয়ানি আছে। মানে ইহান চেঞ্জ করেছে। সাঁঝ মনে মনে বলল,

—” উনি চেঞ্জ করে ফুরফুরানো মেজাজে ঘুরছেন। আর আমি এতোসব ভারী জামা কাপড় পরে থাকবো? মোটেও না”

সাঁঝ নিজের লাগেজ খুলে কাপড় বের করতে গেলেই ডায়েরিটা চোখে পড়লো। তার কানামাছি ডায়েরি। এটা সাথেই নিয়ে এসেছে। ওখানে রেখে আসার সাহস হয়নি। কারোর সাথে পড়তে দেয়া যাবে না। সাথে দুটো মেমরি কার্ড আর নিজের পুরাতন সিমটাও এনেছে। এগুলো লাগেজের নিচের দিকে রেখে কাপড় নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে রুমের ভিতরে পায়চারী করতে থাকলো। ইহানের শেরওয়ানীর পকেটে একটা কাগজ দেখতে পেয়ে সেটা বের করে নিলো। পারমিশন ছাড়া খুলে দেখবে কিনা সেটা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেলো সাঁঝ। আবার মনে হলো ইহানের স্ত্রী সে। দেখতেই পারে। কোন সমস্যা নেই।

কাগজটা খুলে দেখলো হসপিটালের বিল। প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকার কাছাকাছি বিল। টাকার পরিমাণ দেখে সাঁঝের চোখ কপালে উঠে গেলো। রিলিজ করার কোন কথা লেখা নেই। তারমানে রোগী এখনো ভর্তি অথচ এতো বিল! কিন্তু এতোক্ষণ পরে হাসপাতালের নাম দেখে সাঁঝের খটকা লাগলো। নাহিদ যে হাসপাতালে ভর্তি আছে এটা সেই হাসপাতালের বিল। ইহান ওই হাসপাতালে কার বিল দিলো?

সাঁঝ কাগজটা আবার নিজের জায়গায় রেখে একটা সিগারেট বের করে জ্বালিয়ে বারান্দায় চলে গেলো। নিজের ভিতরে আর রাগ, বিরক্তি এসে ভর করছে। আগুন দেখলে শান্তি লাগবে তাই ধরালো। আকাশের দিকে তাকিয়ে সাঁঝের মনে হলো ইহান তার জীবনে এসেছে তাকে পাগল বানিয়ে দেয়ার জন্য!
সিগারেটটা একটু একটু করে পুড়ছে আর সাঁঝ একদৃষ্টিতে দেখছে।
একটু পরে ইহান এসে বলল,

—” কি মিসেস কি চলছে?”

সাঁঝ না ঘুরেই বলল,

—” কিছু না”

ইহান সিগারেট নিজের হাতে তুলে নিয়ে বলল,

—” বাহ এটাও আছে দেখছি”

সাঁঝ এবার পিছনে ঘুরলো। ইহান ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে এসেছে। তার মানে অনেকক্ষণ আগে রুমে এসেছে। বারান্দায় থাকার কারণে খেয়াল করেনি। সাঁঝ ইহানের চোখের দিকে তাকালো। খুশির ঝিলিক দেখা যাচ্ছে চোখে।
ইহান জিজ্ঞেস করলো,

—” মন খারাপ নাকি?”

—” না ক্লান্ত লাগছে”

সাঁঝের হাতে হঠাৎ জ্বলতে শুরু করলে সাঁঝ আহ করে নিচে তাকিয়ে দেখলো ইহান তার হাতে সিগারেটটা ধরে আছে। ইহান সাঁঝের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে নিয়ে বলল,

—” সরি সরি সরি। আমি আসলে বুঝতে পারিনি। আমি ইচ্ছা করে করিনি। পুড়ে গেছে। ইশ খুব ব্যথা হচ্ছে?”

ইহান সিগারেট ফেলে দিয়ে সাঁঝের হাত নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলো। কিন্তু ফেলে দেয়ার পরে সেটা সাঁঝের পায়ের উপর পড়লো। পায়ের অনেকখানি পুড়ে গেলো। ইহান নিচু হয়ে বসে সাঁঝের পায়ের উপর থেকে সরিয়ে নিলো।
কেউ তার জন্য এতো ভাবছে এতো ব্যাকুল হচ্ছে দেখে সাঁঝের ভালো লাগলো।
কিন্তু সাঁঝ যদি নিচে তাকিয়ে ইহানকে ভালো ভাবে দেখতো তাহলে ইহানের মুখে একটা হাসির ঝিলিক দেখতে পেতো। (চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে