কানামাছি পর্ব-০১

0
3651

#কানামাছি
#জান্নাতুল কুহু (ছদ্মনাম)
#পার্টঃ১

পাত্রপক্ষের সামনে শাড়ি, চুড়ি পরে আদর্শ পাত্রী হয়ে এসে সিগারেট ঠোঁটে চেপে তাতে আগুন ধরিয়ে নিলো সাঁঝ। সামনে বসা ভুড়িওয়ালা পাত্র বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকলো সাঁঝের দিকে। সাঁঝ পাত্রের দিকে তাকিয়ে একবার চোখ মেরে উদাস ভঙ্গিতে জানালার বাইরে তাকালো। মাঝে মাঝে সিগারেটটা নিয়ে ঠোঁটে চেপে ধরছে। কিন্তু টান দিচ্ছে কিনা সেদিকে কারোর নজর নেই।

কেউ আশা করতে পারেনি সাঁঝ এমন করতে পারে। একটা জামরঙা শাড়ি আর সাথে ম্যাচিং চুড়ি পরে যখন মাথা নিচু করে পাত্রের সামনে এসেছিলো তখন খুব শান্ত মনে হয়েছে সবার। আর মেয়েকে শান্ত দেখে পাত্রের মা হেঁটে দেখাতে বলেছে। সেটাও করেছে। কিন্তু বসার পরেই সাঁঝ সিগারেট জ্বালিয়েছে। পাত্রের মা আর্তচিৎকার দিয়ে বলল,

—”ছি ছি এই মেয়ে সিগারেট খায়? নেশাখোর মেয়েকে দেখতে এসেছি আমার বাবুর জন্য?”

পাত্রের মা মুখ কুঁচকে সাঁঝের ফুফু রোমেসা বেগমের দিকে তাকালো। তারপর হেড়ে গলায় বলল,

—”কেমন মানুষ আপনারা? মেয়েকে কেমনভাবে মানুষ করেছেন? নেশাখোর মেয়েকে মিথ্যা বলে গছিয়ে দিতে চাচ্ছিলেন আমাদের কাছে? যে মেয়ে সিগারেট খায় সে যে গাঞ্জা খায় না বা নষ্ট মেয়ে না তার কোন নিশ্চয়তা আছে? কেমন শিক্ষা পেয়েছে মেয়ে?”

রোমেসা বেগম আমতাআমতা করে বললেন,

—”আসলে ও মানে….”

উনার কথা আর আগালো না। উনি চুপ হয়ে গেলেন। সাঁঝ জানালার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পাত্রের মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

—” ইনারা আমাকে কোন শিক্ষা দেয়নি। এটুকু ভুল বলেছেন। বাকি উনাদেরকে যা বলেছেন ঠিক বলেছেন। আরো বলতে পারেন। সমস্যা নেই ”

রোমেসা বেগম সাঁঝের দিকে কটমট করে তাকালেন। আর সাঁঝের ফুফা তাহের সাহেব কাশতে শুরু করে দিলেন। সাঁঝ নিজের ফুফা-ফুফুর কর্মকাণ্ডকে উপেক্ষা করে পাত্রের দিকে সিগারেট দিয়ে বলল,

—” একটা টান দিবেন নাকি? দিলে নিতে পারেন। আমার সমস্যা নেই। আমার আবার সবকিছুই শেয়ারিংয়ের অভ্যাস আছে বুঝলেন”

সাঁঝ মিষ্টি করে একটা হাসি দিলো। পাত্র অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো।আর পাত্রের মা চোখ গোলগোল করে তাকিয়ে থাকলো সাঁঝের দিকে। বললেন,

—” মেয়ে এরকম আগে জানলে কখনোই আসতাম না। এমনিতে মেয়ের গায়ের রঙ ময়লা তারপর মেয়ের চরিত্রের কথা নাই বা বললাম। ছি ছি এই বাড়িতে থাকতেও অপবিত্র লাগছে”

পাত্রের মা পাত্রকে একপ্রকার টানতে টানতে হনহন করে বের হয়ে গেল। সাঁঝ একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে সিগারেটটা হাতে নিয়েই বাসার ভিতরে গেল। পিছন থেকে হঠাৎ সাঁঝের ফুফু সাঁঝের হাত চেপে ধরলো। এতো জোরে ধরলো যে কাচের চুড়ি ভেঙে সাঁঝের হাত কেটে গেলো। ফুফু দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

—” বেয়াদপ মেয়ে। ইচ্ছা করে এক চড় মেরে সবগুলো দাঁত ফেলে দিই। আমাদের এতো অসম্মান করছিস তুই!”

—” তোমাদের সম্মানও আছে নাকি? আমার তো জানা ছিলো না। আর আমি বিয়ে করবো না সেটা ভালো করেই জানো। তারপরও সম্বন্ধ আনো কেন? তোমাদের শিক্ষা হয় না? এতোজনকে তো তাড়িয়েছি তাও প্রতিবার বাবার নামে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে আমাকে ওদের সামনে যেতে বল!”

সাঁঝে হাতের সিগারেটের আগুনটা ফুফুর হাতে লাগিয়ে দিলো। সাথে সাথে রোমেসা বেগম হাত সরিয়ে নিলো। মিষ্টি হেসে সাঁঝ বললো,

—” সরি। ভুলে লেগে গেছে”

সাঁঝ আর কিছু না বলে চলে গেলো নিজের রুমে। হাতের রক্ত পরিষ্কার করে রান্নাঘরে থেকেই নিজের খাবার নিয়ে টেবিলে বসে খেতে লাগলো। রোমেসা বেগমের রাগ উঠে গেলো সাঁঝের এমন নির্লিপ্ত ব্যবহার দেখে। সে খাবার প্লেটটা সাঁঝের সামনে থেকে তুলে নিলো। কেবল দুই গ্রাস খাবার মুখে নিয়েছিলো সাঁঝ। উনি ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,

—” লজ্জা করে না ফুফুর ঘাড়ের উপর বসে খাচ্ছিস? বিয়ে করে বিদেয় হোস না কেন? নিজের বাপ আর ভাইটাকে কে তো খেয়েছিস। মা অন্য জায়গায় বিয়ে করে সংসার পেতেছে। আর মেয়েটাকে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে গেছে।”

সাঁঝ মাথা নিচু রেখে খুব শান্ত স্বরে বলল,

—” আমি তোমাদের ঘাড়ে বসে খাচ্ছি না। তোমরা বরং আমার বাড়িতে বসে বসে গিলছো। এই বাড়ি আমার বাবার ছিলো। আর এখন আমার। তুমি কি মনে করো আমি জানিনা তুমি বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে বাড়ির শেয়ার ছেড়ে দিয়েছিলে? আমি সব জানি”

রোমেসা বেগমের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। একটা শুকনো ঢোক গিলে বলল,

—” অসভ্য মেয়ে। ফুফার উপর বসে খেয়ে আবার বলিস আমরা তোর বাড়িতে আছি? আমা দেবরের বিয়ের সম্বন্ধ এনেছিলাম। তা তো তুই বিয়ে করবি না। নাহিদ কাল আসছে। ওর সাথে আর কোন বেয়াদপি করবি না বলে দিলাম”

—” তোমার ওই চরিত্রহীন দেবর নাহিদের সাথে বিয়ে কেন ওর মুখ আমি দেখতে চাই না। ওই ছেলে তো কথা বলার সময় মুখের দিকে তাকায় না। ওর চোখ সারা শরীরের উপর ঘুরে বেড়ায়। আগের বার আমার হাত ধরেছিলো শুধু সিগারেটের ছ্যাকা দিয়েছিলাম। এবার কিছু করলে হাত একদম গুড়িয়ে দেবো”

রোমেসা বেগম ভয় পেয়ে গেলেন। উনি মুখে হম্বিতম্বি করলে ভিতরে ভিতরে সাঁঝকে ভয় পান। এখন তো মনে হচ্ছে সাঁঝের কথা আর চোখ থেকে আগুন ঝরছে। সাঁঝ আবার বলল,

—” আর বাকি থাকলো তোমার ওই স্বামীর কথা। সে কোন কাজ তো করেই না বরং শশুড় বাড়ির ইনকাম উড়িয়ে বেড়ায়। আমার সব জানা আছে সে কোন কোন জায়গায় কি কি করে বেড়ায়! ভালো চাইলে আমার মুখ খুলিয়ো না”

সাঁঝ একবার আড়চোখে এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা ফুফার দিকে তাকালো। সে ভয়ে সুড়সুড় করে ঘরে ঢুকে গেলো। এই লোকটাকে দেখলে সাঁঝের ইচ্ছা হয় বাড়ি থেকে বের করে দিতে। নিজের ভাইয়ের মতো ইনার চোখের দৃষ্টি ঠিক নেই। কথা বলার সময় মুখ বাদে জায়গায় চোখ থাকে এই ফুফার। কিন্তু তার বাবা নিজের বোনকে ভীষণ ভালোবাসতো তাই বাবার কথা ভেবে এদের বের করতে পারে না।
খাওয়া শেষ না করেই হাত ধুয়ে ছাদে চলে এলো সে। মন মেজাজ প্রচন্ড খারাপ হয়ে আছে। হাতে সিগারেটের প্যাকেট আর গ্যাসলাইট। বমি বমিও লাগছে। সাঁঝ সিগারেট খায় না। গন্ধও সহ্য করতে পারেনা। কিন্তু একটু একটু করে আগুনে পুড়তে দেখলে তার ভিতরটা শান্ত হয়। নিজের ভিতরে শান্তি অনুভব করে। আজ সিগারেট মুখে নিয়েছে। এজন্যই বমি বমি লাগছে।

একটা সিগারেট ধরিয়ে দূরে রেখে সেটার দিকে তাকিয়ে থাকলো। এভাবে পুড়তে দেখলে মনে হয় যাক তার মতো অন্য আরো জিনিস আছে যেগুলো পোড়ে। নিজের জীবনটা একটা দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই না তার কাছে।

বাবা নাম দিয়েছিলো সেমন্তী সাঁঝ। বাবা, মা আর বড় ভাই সাহেলকে নিয়ে ছোট একটা পরিবার ছিলো। মা-বাবার লাভ ম্যারেজ ছিলো। তাদের দুজনের মধ্যে ভালোবাসার কোন কমতি ছিলো না।কিন্তু একটা ঘটনার পর সব বদলে যেতে থাকে। সাঁঝ যখন ক্লাস নাইনে পড়ে তখন একদিন বাবার সাথে বেড়াতে গিয়েছিলো। নিজে জেদ ধরে ছিলো বেড়াতে না নিয়ে গেলে কান্না করবে। বাবা তাকে খুব ভালোবাসতো। তাই মোটরসাইকেলে করে বেড়াতে গিয়েছিলো। রাতে বেলা ফেরার পথে এক্সিডেন্টে বাবা স্পট ডেড হয়। আর সাঁঝ আহত। যাওয়ার সময় একটাই হেলমেট ছিলো। সেটা বাবা পড়েছিলো। কিন্তু ফেরার পথে মোটরসাইকেল চালাতে চালাতে বাবা তাকে জোর করে পড়তে বলেছিলো হেলমেটটা। আর শেষ সময়ে ধাক্কাও দিয়েছিলো যাতে রাস্তার পাশে গিয়ে পড়ে যায় সে। সাঁঝের মনে হয় বাবা সব জেনে বুঝে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে নিজেকে ঝুকিতে ফেলে দিয়েছিলো।

মা বাবার মৃত্যুর পর একপ্রকার পাথর হয়ে গিয়েছিলো। প্রায় দেড় সপ্তাহ পরে হাসপাতাল থেকে ফিরে যখন সাঁঝ মাকে সব বলে তখন মায়ের মনে হতে থাকে সব সাঁঝের জন্য হয়েছে। সে না থাকলে তার বাবা এভাবে মারা যেতো না। শুধু মা কেন তার নিজের কাছেও এমন মনে হয়। বাবাকে একবার জড়িয়ে ধরে সরি বলতে পারলে খুব ভাল হতো। মায়ের সাথে তাদের সম্পর্কের দুরত্ব সে সময়ে বাড়তে থাকে। বাবার মৃত্যুর দুই বছর পরে সাঁঝ যখন ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়তো তখন তার মা এই বাসায় তাদের দুজনকে ফেলে অন্য একজনের সাথে বিয়ে করে নেই। এখন তো নিজের মায়ের উপর ঘৃণা হয়। তাদের নাকি লাভ ম্যারেজ ছিলো! অফুরন্ত ভালোবাসা ছিলো! এজন্য মানুষটা যাওয়ার দুই বছর পরেই আরেকজনকে বিয়ে করে এখন সুখে সংসার করছে। এখন সাঁঝ নিজের মায়ের মুখদর্শনও করে না। তখন ভাইয়া তার একমাত্র আশ্রয় হয়ে দাঁড়িয়। আর ফুফুরা এই বাসায় চলে আসে।

এর দেড় বছর পরে ভাইয়াও তাকে ছেড়ে যায়। সাঁঝ আকাশের তারাগুলোর দিকে তাকালো। চোখ বন্ধ করতেই একটা দৃশ্য ভেসে উঠলো। একটা মাঠে একটা ছেলেকে একটা পুলিশ অফিসার বেধড়ক মারছে। আর ছেলেটা কান্না করতে করতে বলছে,

—” স্যার মেরেন না। স্যার আল্লাহর দোহায় লাগি আর মারবেন না। আল্লাহর কসম আমি এই কাজ করিনি। বিশ্বাস করেন স্যার। আর মারবেন না।”

ছেলেটা মাইর সহ্য করতে না পেরে পুলিশ অফিসারটার পায়ের পড়লো। পুলিশ তাকে পা দিয়ে ঠেলে একটা শয়তানি হাসি দিয়ে বলল,

—” সর! আমার পায়ে পড়বি না। ইভটিজিং করিস? হ্যা? মেয়েদের গায়ে হাত দিস? অপহরণ করার হুমকি দিস? বাসায় চিঠি পাঠাস তোর সাথে না গেলে তুলে নিয়ে যাবি?”

পুলিশটা আবার মারতে শুরু করে। গায়ের রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। শার্ট ছিড়ে গেছে ছেলেটার। নাক থেকে রক্ত পড়ছে। কিন্তু ছেলেটা আর প্রতিরোধ করা শক্তি পাচ্ছে না। পুলিশটা একটু থামলে ছেলে ক্ষীণ স্বরে বলল,

—” স্যার আমি এই কাজ করিনি। আমারও বোন আছে। আমি কিভাবে এই কাজ করি?”

পুলিশের অত্যাচার এখানেই শেষ হলো না। ছেলেটার গলায় জুতার মালা পরিয়ে সারা মাঠ ঘোরানো হলো। আশেপাশে শত শত লোকজন শুধু দেখে গেল। কেউ টু শব্দটা পর্যন্ত করলো না। কেউ কেউ মজা নিয়ে দেখতে থাকলো। কেউ ভিডিও করে ছেড়ে দিলো ইন্টারনেটে।
এরপরে সাঁঝের চোখের সামনে আরেকটা দৃশ্য ভেসে উঠলো। তার ভাই ঘুমিয়ে আছে।হাসপাতালের মর্গে। চিরঘুমে চলে গেছে। সামনে থাকা পুলিশ বলল,

—” এক্সিডেন্ট পেশেন্ট। হাসপাতালে আনার পরে মৃত্যু । আপনি চান না তাই পোস্টমর্টেম হবেনা।”

সাঁঝ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। কোন আঘাতের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না দেহে। এভাবে এক্সিডেন্টে মারা গেল তার ভাই? এটা আদোও এক্সিডেন্ট না আত্মহত্যা?

সাঁঝ চোখ খুলে আকাশের দিকে তাকালো। কত তারা দেখা যাচ্ছে! আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,

—” ভাইয়া এবার আমি খেলা শুরু করবো। কানামাছি খেলা। চোখ থাকবে বাঁধা। আর কোনদিক থেকে কি হবে চেয়েও বুঝতে পারবে না”

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে