কাছে_কিবা_দূরে পর্ব-১২

0
337

#কাছে_কিবা_দূরে
#পর্ব-১২
হঠাৎ লাইট জ্বলে ওঠায় তানি চমকে উঠলো। চোখ বন্ধ করে ফেলল৷ শুভ্র তানির দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে হেসে ফেলল। হাসির শব্দ শুনে তানি চোখ খুলল। দুজনের মাঝখানে এক হাত পরিমাণ দূরত্ব এখন৷ তানির বুকের ভিতর দ্রিম দ্রিম শব্দ হচ্ছে, শুকনো ঢোক গিলল একটা। শুভ্র এতো কাছে কেন এসেছে! বিয়ের একুশ দিন হতে চলল, শুভ্র কী তবে তানির উপর অধিকার ফলাতে এসেছে!
তানির হৃদস্পন্দন বেড়ে চলছে। হৃৎপিন্ডে রক্ত চলাচল ও দ্রুত গতিতে বেড়ে গেছে, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।

শুভ্র এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তানির দিকে। ওর খুব মজা লাগছে তানির এভাবে ভয় পাওয়া দেখে। ইচ্ছে করে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে তানির গালে ঠান্ডা হাত টা রাখলো। তানি কেঁপে উঠল। শুভ্র সাথে সাথে হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, তোমাকে পরীক্ষা করে দেখছিলাম।

তানি উঠে বসতে বসতে বলল, পরীক্ষা মানে?

“মানে রাগী, ভীতু, লাজুক তানিকে তো দেখে ফেলেছি। ভয় পেলে তানিকে কেমন লাগে সেটা দেখছিলাম আর কী!”

কথাটা শেষ করেই শুভ্র লাইট অফ করে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। তানি তখনও বোকার মতো বসে রইলো।
কিছু সময় বাদে খেয়াল করলো শুভ্র ঘুমিয়ে গেছে। তানির তখন খুব লজ্জা লাগলো। ইশ! ও কতকিছু ভেবে ফেলেছে। ছিঃ ছিঃ শুভ্রকে নিয়ে এতো খারাপ ভাবতে পারলো কী করে!
অবশ্য শুভ্র যে দুষ্ট সেটা বুঝতে পেরেছে আজ রিকশায় বসে। সারারাস্তা ইচ্ছে করে হাত ধরে রেখে তারপর কী ভাব টা’ই না নিলো।

তানি এতোদিনে বুঝে গেল, বয়স বাড়লে কী হবে। পেটে পেটে দুষ্ট বুদ্ধির অভাব নেই। পুরো পেট ভর্তি ই দুষ্ট বুদ্ধি। ব্যাপার টা ভেবে তানি নিঃশব্দে হাসলো।

******
শুভ্র তানির নতুন বিবাহিত জীবন এভাবেই খুনসুটিতে কাটতে লাগলো। স্বামী, স্ত্রীর সহজাত সম্পর্ক দুজনের মধ্যে না হলেও বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে। তানির ভালো ভালো রান্না খেয়ে শুভ্র’র অভ্যাস ও খারাপ হয়ে যাচ্ছে। একদিন অফিস থেকে ফিরে বলল, তানি তোমার রান্না খেতে খেতে বাজে অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে। রেস্টুরেন্টের খাবার এখন খুব বিস্বাদ লাগছে। তানি লজ্জা পেলেও খুব খুশি হলো। আজকাল ওর নিজের ও রান্না করতে খুব ভালো লাগে।

শুভ্র যতক্ষন বাড়িতে থাকে ততক্ষণ ওর শুধু শুভ্র’র কাছাকাছি থাকতে ইচ্ছে করে৷ কিন্তু শুভ্র বাসায় ফিরেও ল্যাপটপ কিংবা, বইয়ে মুখ গুজে থাকে। আর শুক্রবার তো সারাদিন পরে পরে ঘুমায় তাই তানির সময় কাটে শাশুড়ী, ননদ, দেবর এদের সাথে। তবে মঙ্গলবার দিন টা তানির জন্য খুব শুভ। এই দিনে অনেক টা সময় শুভ্র কে কাছে পায়৷ বাড়িতে কেউ থাকে না বলে সংকোচ ও কম হয়। তানি খেয়াল করেছে শুভ্র মঙ্গলবার ওকে বেশ সময় দেয়। বাইরে ঘুরতে নিয়ে যায়, কিংবা ছাদে কফি খেতে খেতে গল্প বলে। তাই তানি মঙ্গলবার দিন টা’কে নাম দিয়েছে মঙ্গলবার বিলাস। মনে মনে খুব আক্ষেপ ও যে কেন সপ্তাহে আরেকটা মঙ্গলবার থাকলো না।

এক মঙ্গলবার শুভ্র এসে তানিকে বলল,
“এই তানি আজ তুমি বসে থাকো। আমি রান্না করি। ”

তানি চোখ কপালে তুলে বলল,
“আপনি কেন রান্না করবেন? ”

শুভ্র হেসে বলল, আরে ভয় পেয়ো না। তোমার মতো ভালো না পারলেও আমি রান্না পারি। বিদেশে নিজেই রান্না করতাম।

তানির ভরসা হলো না। বলল,

“থাক আমিই রান্না করে ফেলি।”

“আরে তুমি দেখো আমি কিভাবে রান্না করি।”

সত্যি সত্যি আটঘাট বেঁধে শুভ্র রান্না করতে নামলো। তানি অবাক হয়ে দেখলো কী সুন্দর অভিজ্ঞ হাতে শুভ্র একটার পর একটা কাজ করে যাচ্ছে। তানিকে কিচ্ছু করতে দিচ্ছে না। চুপচাপ বসে থাকতে বলেছে।

তানি মনোযোগ দিয়ে রান্না দেখছে। শুভ্র চুলায় সবজি চাপিয়ে তানিকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কী কফি খাবে?

“না।”

“খেতে চাইলে বলো। আমি নিজের জন্য বানাবো। ”

“তাহলে খাব।”

শুভ্র তানির চোখের দিকে তাকিয়ে হাসলো।

ঝটপট কফি বানিয়ে তানির হাতে দিতে দিতে শুভ্র বলল,
“দেখো তো কেমন হয়েছে?”

তানি চুমুক দিয়ে স্মিত হেসে বলল, খুব ভালো হয়েছে। আপনি তো দারুণ কফি বানাতে পারেন।

শুভ্র বিশ্বজয়ী হাসি দিয়ে বলল, মাই প্লেজার।

তানি অবশ্য মিথ্যে বলল। কফি খেতে আহামরি কিছু লাগে নি। তাছাড়া ওর কফি পছন্দ ও না। ও চা প্রেমি। কিন্তু শুভ্র’কে সেটা ইচ্ছে করেই বলে নি। মানুষ টা এত কষ্ট করে বানিয়েছে!

শুভ্র কফি খাওয়ার ফাঁকে তরকারি টা দেখতে দেখতে বলল, আচ্ছা তানি তুমি এতো কম কথা বলো কেন আমার সাথে? ”

তানি বিস্মিত গলায় বলল, কই?

শুভ্র আড়চোখে তাকিয়ে বলল, আমি দেখেছি। অভ্র, আনিকার সাথে হেসে হেসে গল্প করো। আর আমার সাথে কথা বলতে এলে হ্যাঁ, না এসবে চালিয়ে দাও। আর আমি কথা বলতে বলতে মুখ ব্যথা করে ফেলি।

তানি মুখে কিছু বলল না। মনে মনে বলল, আমার যে আপনার কথা’ই শুনতে বেশী ভালো লাগে।

শুভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এই যে আমি বক বক করছি আর তুমি মাথা নুইয়ে শুনে যাচ্ছ। ব্যাপার টা কী বলোতো? তোমার বর পছন্দ হয় নি?

তানি আঁতকে উঠে বলল, না না খুব পছন্দ হয়েছে।
মুখ ফসকে কথাটা বলে নিজেই হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলো। শুভ্র সেটা দেখে শব্দ করে হেসে ফেলল। তানি লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলল। শুভ্র বলল,
“আরে লজ্জা পাচ্ছ কেন? আমারও তো বউ পছন্দ হয়েছে। শুধু বউয়ের রাগ টা একটু বেশী এই যা। ”

তানি বলল, মোটেও না।

“হ্যাঁ সেটা টের পেয়েছি”।

“আসলে আমার আপনার কথা শুনতে বেশী ভালো লাগে তাই নিজে কম বলি”।

শুভ্র গভীর চোখে তানির দিকে তাকালো। সেই তাকানো স্থায়ী হলো না। তরকারি তে মনোযোগ দিতে দিতে বলল, কিন্তু আমারও মাঝে মাঝে যে তোমার কথা শুনতে ইচ্ছে করে।

“তাহলে এবার থেকে বলব”।

“এবার থেকে না। এক্ষুনি বলো। ”

তানি অবাক গলায় বলল, কী বলব?

শুভ্র এক সেকেন্ড ভেবে বলল, তোমার প্রেমের গল্প বলো।

“আমার তো প্রেম হয় নি। বাবার পছন্দে বিয়ে হয়েছিল। ”

“উঁহু। বিয়ের গল্প শুনবো না। প্রেমের গল্প। প্রেম হয় নি ঠিক আছে কিন্তু কারোর না কারোর প্রেমে তো পড়েছ সেটার গল্প বলবে।”

তানি বলল, বলব কিন্তু একটা শর্ত আছে।

“কী শর্ত?”

“আপনাকেও আপনার প্রেমের গল্প শুনাতে হবে”।

শুভ্র অতিসন্তঃর্পনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ওকে। তার আগে রান্না শেষ করে নেই। প্রেমের গল্প মনোযোগ দিয়ে শুনতে হয়।

শুভ্র’র বলার ভঙ্গি দেখে তানি হেসে ফেলল৷

রান্না শেষ করে শুভ্র এক কাপ চা তানির জন্য, আর নিজের জন্য কফি নিয়ে বারান্দায় এলো।

তানি চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বলল, আমার জন্য কফি আনলেন না কেন?

শুভ্র নির্বিকার গলায় বলল, কফি খেয়ে মুখ কুচকে ফেললে তোমাকে দেখতে ভালো লাগে না তাই।

তানি লজ্জা পেল সেই সাথে খুশিও হলো। শুভ্র তার মানে ওকে মনোযোগ দিয়ে দেখেছে।

শুভ্র বলল, তানি ডোন্ট বি লেট। তাড়াতাড়ি শুরু করো।

“উঁহু আপনি আগে বলুন”।

“তোমার আগে বলার কথা ছিলো। ”

“উঁহু আপনি আগে।”

শুভ্র শাসিয়ে বলল, চিটিং করলে কিন্তু ঘ্যাচাং করে মাথাটা কেটে ফেলব।

“আচ্ছা”।

শুভ্র বলতে শুরু করলো,

আমার আর অবন্তীর দেখা হয়েছিল টিএসসিতে। এক বন্ধুর বার্থডে ট্রিটে। অবন্তীকে আমার খুব ভালো লেগেছিল কিন্তু অবন্তী আমাকে পছন্দ করলো না কারণ আমার নাক নাকি বোচা।

“কিন্তু আপনার নাক তো বোচা না। ”

“তখন ছিলো। ঘুষি মেরে মেরে ঠিক করেছি।”

“এ্যা?”

“তুমি গল্প শুনবে?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন”

“অবন্তী আমাকে পছন্দ করলো না কিন্তু আমার যেহেতু পছন্দ হয়েছিল তাই বন্ধুর কাছ থেকে ওর নাম্বার নিয়েছিলাম। তখন গ্রামীন ফোনের রাত ১২ টার পর কলরেট ফ্রী ছিলো। মায়ের ফোন থেকে অবন্তী কে ফোন করলাম। তখন আমার নিজের ফোন নেই। মূলত তখনও মাম্মাস বয়। অবন্তীর নিজের ফোন না। ফোনটা ওর বোনের। তার হাজবেন্ড আবার দেশের বাইরে থাকে। আমি ফোন দিলেই বিজি। হঠাৎ একদিন পেয়ে গেলাম। অবন্তী কে চাইলে প্রথমে রাজি হলো না কিন্তু আমি এমন ভাবে বলেছিলাম যে পরে দিতে বাধ্য হলো।

“কিভাবে বলেছিলেন? ”

“মানে ব্যাপার টা একটু লজ্জার। ”

“বলুন প্লিজ। ”

“না মানে বয়স কম তো, রিকোয়েস্ট করার পরও শুনছিলো না তাই এক পর্যায়ে কেঁদে ফেললাম”।

তানি বজ্রকন্ঠে বলল, তারপর?

“অবন্তী ফোন কানে ধরে যখন শুনলো আমি তখন বিস্মিত হলো। ”

“তারপর? ”

“তারপরের ঘটনা ভয়াবহ। অবন্তী আমাকে অকথ্য ভাষায় গালি দিলো। ”

“কী গালি দিয়েছিল?”

শুভ্র কপট রাগ দেখালো। তানি বলল, তারপর?

“গালি শুনতেও আমার কাছে বেশ লাগলো। সেদিন গালি শুনে অন্যান্য দিনের চেয়ে ভালো ঘুম হলো। এরপর সেই বন্ধুটিকে নিয়ে অবন্তীর বাড়ির সামনে হাজির হলাম। উদেশ্য অবন্তী কে এক নজর দেখা।

“ছিঃ আপনি এতো ছ্যাচড়া ছিলেন? ”

“প্রথম প্রেম সবাই কেই বেহায়া, ছ্যাচড়া বানিয়ে দেয়। তারপর অবন্তী রাগারাগি চেঁচামেচি করলেও আমি পিছু ছাড়লাম না। লেগেই থাকলাম, এক পর্যায়ে অবন্তী সায় দিলো। সেই থেকেই আমাদের সম্পর্ক। তারপর… বিয়েশাদি.. ঝগড়াঝাটি।

“আর বলতে হবে না।”

শুভ্র’র মুখের ধরন পাল্টে গেছে৷ তানি বলল,

“আচ্ছা আমার টা শুনুন। ”

“হ্যাঁ হ্যাঁ বলো।”

“আমি জীবনে একজনের ই প্রেমে পরেছিলাম। ”

“আচ্ছা!”

“তখন আমি কেবল এসএসসি পরীক্ষা শেষ করে ঢাকায় এসেছি খালার বাসায়। এক বৃষ্টিতে তার সাথে প্রথম দেখা।

“কিভাবে দেখা?”

“আমি তখন শহুরে জীবন যাপনে অভ্যস্ত নই। বৃষ্টি হলে যে নালা খুলে দেয় সেটা জানতাম না। খালার বাসার সামনের রাস্তা পানিতে ডুবে গেছে। সেই পানিতে হাটতে গিয়ে বেখায়েলে ড্রেনে পড়ে গেলাম। একটা ছেলে কোথা থেকে যেন এসে আমার হাত ধরে তুলল।

“কোথা থেকে এসেছিল?”

“জানিনা”।

“সাথে কী ঘোড়া ছিলো? আর পোশাক কী রাজাদের ছিলো ”

তানি চোখ পাকিয়ে তাকালো।

শুভ্র বলল, তারপর?

“তারপর ছেলেটা আমাকে এগিয়ে দিয়ে চলে গেল। আমি অনেক খুঁজেও আর তাকে পাই নি। তার নাম, ঠিকানা কিছু জানি না। তবুও মনের ভিতরে গেথে রইলো। শ্রাবণের প্রবল বৃষ্টি এলেই তাকে আমার মনে পরে। ”

“এটা আবার কেমন প্রেম?”

“জানিনা৷ তার হয়তো আমাকে মনে নেই কিন্তু আমি তাকে বৃষ্টি হলেই মনে করি।”

“আহারে বেচারা নাম, ধাম কিছু না বলেই তোমার হৃদয় হরন করে নিয়ে গেল?

তানি ভেবেছিল শুভ্র’র কিছু একটা মনে পরবে। কিন্তু শুভ্র’র কিছু মনে নেই দেখে হতাশ হলো।

শুভ্র সিরিয়াস গলায় বলল, আমার মনে হয় ছেলেটাকে একটু খুঁজলেই পেয়ে যেতে। সিটি কর্পোরেশনের লোকেদের সাথে যোগাযোগ করলেও পাওয়া যাওয়ার কথা।”

“মানে?”

“মানে যারা ময়লা পরিষ্কার করে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। যে ছেলে ড্রেন থেকে তোমাকে তুলেছে সহজে তার তো ড্রেন পরিস্কারের কাজের সাথে যুক্ত থাকার কথা। ”

তানি খিলখিল করে হাসতে লাগলো। এই ব্যটা যখন জানবে যে সে নিজেই সেই ছেলে। তখন কপাল চাপড়াবে।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে