কাছে_কিবা_দূরে পর্ব-০৬

0
340

#কাছে_কিবা_দূরে
পর্ব-৬
পরদিন বিকেলে তানিকে নিয়ে শপিংয়ে যাওয়া হলো। ঘরে পরার জামা কাপড় ছাড়াও বিয়ের জন্য যা যা কেনা হয়েছিল সব ই আবার নতুন করে কিনতে হবে। অভ্র, ইরা, আনিকা, মাহফুজা গিয়েছিল তানিকে নিয়ে। শাড়ি কেনার সময় তানি বেছে বেছে জলপাই রঙের দুটো শাড়ী কিনেছে। বেনারশী কেনার সময় হলো বিপত্তি। তানি তখনও খুঁজলো জলপাই রঙ। মাহফুজা গলা নামিয়ে বলল, কাল তো তোর বউভাত আছে তানি। লাল, গোলাপি কিছু নিলে ভালো হতো না?
তানি আর কোনো উচ্চবাচ্য করলো না। সিঁদুর রঙা লাল বেনারশী সানন্দে নিলো। অভ্র খোঁচা দিয়ে বলল, ভাবী ভাইয়ার পছন্দের রঙ তো নেভি ব্লু। জলপাই রঙ তো না। তানি লজ্জা পেল, সেই সাথে আফসোস ও হলো কেন নীল রঙের কিছু কিনলো না।

কেনাকাটা শেষ করে রেস্টুরেন্টে সবাই মিলে বার্গার আর কোল্ড কফি খেল। ইরা আর অভ্র পুরো সময় মাতিয়ে রাখলেও তানির শুভ্র’র কথা মনে করলো। শুভ্র থাকলে এখন হয়তো সিরিয়াস ভঙ্গিতে মজার কিছু একটা বলে সবাইকে হাসাতো। তানি যে একটু পর পর উদাস হচ্ছিলো সেটা অভ্র খেয়াল করলো। বলল, তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে হবে ভাইয়া একা আছে।

আনিকা অবাক গলায় বলল, ভাইয়া একা আছে তো কী হইছে? ভাইয়া কী কচি খোকা?

অভ্র লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, নতুন নতুন বিয়ের পর পুরুষ মানুষ বউয়ের কাছে কচি ই থাকে।

তানি হকচকিয়ে গেল। মাহফুজা কপট রাগ দেখিয়ে বলল, আচ্ছা! তা তুই ক’টা বিয়ে করেছিস যে এসব জানিস!
ইরাও চোখ রাঙানি দিয়ে বলল, বিয়ের আগেই দেখি এসব ব্যাপারে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে বসে আছ!

অভ্র আমতা আমতা করে বলল, আরে এসব তো আশেপাশের মানুষজন কে দেখে শিখেছি।

পুরো সন্ধ্যাটা খুনসুটিতেই কেটে গেল তানির। বাসায় ফিরেও শুভ্র’র সাথে খুব একটা কথা হলো না। ল্যাপটপে মনোযোগ দিয়ে কাজ করছিলো শুভ্র। তানি রাতের খাওয়া শেষ করে ঘরে এলে শুভ্র বলল, তানি লাইট অফ করতে পারো। আমার কোনো সমস্যা হবে না।

তানি বলল, না থাক। আমার অসুবিধা হচ্ছে না।

“আরে না। তুমি শুয়ে পড়ো। সকালে তাড়াতাড়ি উঠতে হবে তোমার “।

“আপনি ঘুমাবেন না?”

“আমার দেরি হবে। কিছু কাজ আছে সেগুলো শেষ করতে হবে।”

তানি ইতস্তত করে বলল, মা বলেছে কাল আমাদের রাজশাহী যেতে হবে।

শুভ্র স্ক্রিনে চোখ রেখেই বলল, যাওয়া কী খুব জরুরী?

“এটা নাকি নিয়ম। বউভাতের পর যেতে হয়। ”

“কিন্তু আমি তো যেতে পারব না তানি। আমার কাজ আছে।”

“কিন্তু নিয়ম ভাঙা উচিত হবে?”

“সেরকম হলে তুমি তোমার বাড়ির লোকজনের সাথে চলে যেও। যে ক’দিন থাকতে ইচ্ছে হয় থেকো। এরপর অভ্র গিয়ে নাহয় তোমাকে নিয়ে আসবে”।

তানির চোয়াল শক্ত হলো। ঠান্ডা স্বভাবের মানুষের এই এক দোষ। এরা অল্পেই রেগে যায়। রাগতে যেমন সময় লাগে না, রাগ কমতেও সময় লাগে না। তানির খুব রাগ হলো। এটা কেমন কথা বলল শুভ্র! বিয়ের পর বউভাতে বউ কখনো একা যায়! এতে লোকজন নানান কথা বলে। শুভ্র কী সেসব জানে না! জানবে না কেন! এর আগেও তো এমন অভিজ্ঞতা তার ছিলো।

তানি কাঠ কাঠ গলায় বলল, বিয়ের পর হাজবেন্ড ওয়াইফ একসাথে প্রথমবার যেতে হয়। এইটুকু তো আপনার জানার ই কথা তাই না?

শুভ্র তীক্ষ্ণ চোখে তানির দিকে তাকালো। আধ মিনিট সময় ধরে তানিকে দেখলো। এরপর ল্যাপটপ রেখে উঠে এসে তানির মুখোমুখি বসে বলল, হ্যাঁ জানি। আনফরচুনেটলি বিয়ের অভিজ্ঞতা আরও একবার হয়েছিল।

তানি এখন ঠিক নিজের মধ্যে নেই। তাই বুঝতে পারছে না যে শুভ্র’র বলা কথাগুলো অন্যান্য সময়ের মতো না। তানি বলল, তাহলে?

“তাহলে কী সেটার ব্যখ্যা তো একবার দিলাম। আমার ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে তাই যেতে পারব না”।

তানি স্থির চোখে কিছু সময় দেখে হঠাৎই কেঁদে ফেলল। ঘটনার আকস্মিকতায় শুভ্র হতভম্ব হয়ে গেল। বলল,

“আরে তানি কাঁদছ কেন!”

তানি জবাব দিলো না। শুভ্র বারবার জিজ্ঞেস করলো। এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে শুভ্র বলল, তানি তোমার কান্না শেষ হলে আমার কিছু বলার আছে।

তানি চোখ মুছে ফেলল। এতক্ষনে খেয়াল হলো যে একটু বেশী ই রিয়েক্ট করে ফেলেছে। আমতা আমতা করে বলল, আসলে……

শুভ্র থামিয়ে দিয়ে বলল, তানি তোমার কিছু ব্যাপার জেনে রাখা ভালো। ব্যাপার টা এতো তাড়াতাড়ি বলা উচিত হবে না ভেবে বলা হয় নি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে না বললে আমাদের দুজনের জন্য ই ঝামেলা।

“কী?”

“তোমার আর আমার বিয়েটা হুট করে ঠিক হয়েছে। আমার কাছে ব্যাপার টা খুব তাড়াতাড়ি হয়েছে। বিয়ের আগে যে মেন্টাল প্রিপারেশন দরকার সেরকম কোনো প্রিপারেশন আমার ছিলো না।

“আসলে আমি একটু বেশী রিয়েক্ট করে ফেলেছি। আই এ্যাম স্যরি।

“আমার কথা এখনো শেষ হয় নি তানি”।

তানি মাথানিচু করে ফেলল। শুভ্র বলল,

“তানি শোনো, তোমাকে আমি বিয়ে করেছি মায়ের পছন্দে। মায়ের পছন্দের উপর ভরসা আছে বলেই বিয়ের আগে তোমার ছবি ছাড়া আর কিছুতে আমি ইন্টারেস্ট দেখাই নি। বিয়ে নিয়ে আমার আর কোনো স্বপ্ন বা, ইচ্ছে এসব কিছুই ছিলো না। মা চেয়েছে আবার বিয়ে হোক তাই করেছি। দ্যাটস ইট। তোমার শুনতে খারাপ লাগলেও আজ কিছু কথা শুনতে হবে। আমি অবন্তীকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম। বিয়ের আগে যে অবন্তীকে আমি ভালোবেসেছি সেই অবন্তীর এক পার্সেন্ট ও বিয়ের পর পাই নি। হ্যাঁ সে পাল্টে গিয়েছিল। ছোট ছোট ব্যাপার নিয়ে মেন্টালি টর্চার, ঝগড়াঝাটি এসবে লাইফ দূর্বিষহ হয়ে গেলেও অবন্তীকে ভালোবাসা বন্ধ হয় নি। বরং পাগলের মতো ভালোবাসতাম যেন সেই ভালোবাসা দেখে অবন্তী নিজেকে শুধরে নেয়। কিন্তু নিয়তিতে লেখা ছিলো অন্যকিছু।

শুভ্র কিছু সময় থেমে থেকে আবারও বলল, অবন্তী নেই অনেক দিন হলো। তবুও আমার দ্বিতীয়বার বিয়ে, সংসার এসবে ভীষণ ভয় হয়। একটা নরমাল জীবন চাই আমার। যেখানে কাউকে কৈফিয়ত দিতে হবে না, ঝগড়াঝাটি, পেইন কিছু থাকবে না।
তুমি কী বুঝতে পারছ আমি কী বলতে চাইছি?

তানি শুকনো গলায় বলল, বুঝেছি।

“আমার কাছ থেকে এক্ষুনি সব এক্সেপক্ট কোরো না তানি। আমার কিছু সময় প্রয়োজন।

তানি মাথা নাড়লো। শুভ্র আবারও বলল,

“তুমি পড়াশোনা করতে চাও বলছিলে। আমি তোমাকে সব রকম হেল্প করব। দেখবে সময় কেটে যাবে। তাছাড়া দুজন, দুজন কে জানার মতো সময় ও পাবো।

তানি কিছু বলল না।

“তানি তোমার হয়তো মন খারাপ হচ্ছে। কিন্তু আমার অবস্থাটাও বুঝতে হবে তোমায়। আমি ঘর পোড়া গরু তাই সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পাই।

তানি স্বাভাবিক গলায় বলল, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আপনার যা ভালো মনে হয় করবেন। আমি আপনার উপর কিছু চাপিয়ে দেব না।

শুভ্র স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ঠোঁট প্রশস্ত করে বলল, থ্যাংকস তানি। আমার মন বলছে তুমি আমার খুব ভালো বন্ধু হবে।

তানি একটু হাসার চেষ্টা করলো। সে’রাতে তানির দু’চোখে এক ফোটা ঘুম ও আসে নি। বারবার শুভ্র’র বলা কথাগুলো ভেবেছে। আসলে শুভ্র’র দোষ নেই, দোষ ওর ই। শুভ্র’র দুটো ভালো কথায় ওর এতো টা ভাবা উচিত হয় নি। শুভ্র নিশ্চয়ই সবার সাথেই অমন। নিজের উপর লজ্জা লাগছে। কেন যে এতো টা হ্যাংলাপনা করতে গেল! তানি অতি সন্তঃর্পনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বিয়ের পর পর ই শুভ্র’র প্রতি ওর মায়া জন্মে গেছে এই কথাটা শুভ্র’কে ও কিভাবে বুঝাবে! হ্যাঁ বিয়ে হয়েছে কেবল চার, পাঁচদিন। কিন্তু এই অল্প সময়ে এক অদৃশ্য মায়ার জালে আটকে গেছে তানি। কেন এমন হলো সেটা ও জানে না। শুভ্র’কে দেখলেই অবচেতন মন শুধু জানান দেয়, ওই মানুষ টা তোর তানি।
তানি মন শান্ত করার চেষ্টা করে। চোখ বন্ধ করে বলে, না সে আমার না। সে আমার হতে চায় না।

চলবে…..

সাবিকুন নাহার নিপা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে