কাছেপিঠে পর্ব-০৯

0
683

~কাছেপিঠে~
পর্বসংখ্যাঃ০৯

রাত প্রায় এগারোটা। ঘুমের জন্য চোখ মেলে রাখা দ্বায় হয়ে পড়েছে মিষ্টির। চোখ টান টান রেখেই ইভানের পাশের চুপটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকলো। ইভান ইতিমধ্যে দুইবার ডোরবেল বাজিয়েছে।দরজা খুলছে না দেখে আরেকবার বাজাতে যাবে,তার আগেই হঠাৎ দরজাটা খুলে গেলো।
দরজার অপাশে অত্যন্ত সুন্দরী অল্প বয়সী এক মেয়েকে দেখে মিষ্টির ভ্রূ দ্বয়ের মাঝে ভাঁজ ফুটে উঠলো। ইভান আগেবাগে জানিয়েছে তার মা এসেছে।থাকবে কিছুদিন।তারপর চলে যাবে। কিন্তু অপরিচিত মেয়েটিকে দেখে মিষ্টি ঘুম উধাও হয়ে যায়। রক্তিম চোখে তাকালো ইভানের দিকে।
ইভান তখনো অচেনা মেয়েটির দিকে তাকিয়েছিলো।মেয়েটিকে চেনা মনে হচ্ছে,তারপরও চিনতে পারছেনা ইভান। মেয়েটি দু’জনে একসাথে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হালকা হেসে বললো,

— ইভান ভাইয়া আমি সেঁজুতি।

— সেজুঁতি? ওহ হ্যাঁ মনে পড়েছে। কেমন আছিস?

— আমি ভালো আছি। ভেতরে এসো ভাইয়া।

মিষ্টি হনহনিয়ে চলে যেতে নিলে ইভান হাত চেপে ধরে আঁটকে রাখে। ইশারায় সেঁজুতির দিকে চেয়ে বললো,

— তোর ভাবি।পরিচিত হ।

ইভানের কথায় সেঁজুতি অবাক হলো যেনো। তার ফুফি মারজিয়া তো এ ব্যপারে কিছু বলেনি তাকে। অথচ,সবকিছু তাকে জানাতো মারজিয়া।এমন একটা কথা জানালো না দেখে মন খারাপ হয় তার।তারপরও হালকা হেসে মিষ্টির দিকে চেয়ে সেঁজুতি বললো,

— কেমন আছো ভাবি।আসলে তোমাকে চিনতে পারিনি।

মিষ্টি জবাবে কিছু বললো না। চুপচাপ ভেতরে প্রবেশ করলো।যেতে যেতে কিচেনের দিকে দৃষ্টি রাখলো।মারজিয়া বেশ আয়েশ করেই ডায়নিং টেবিলে বসে খাচ্ছেন। মিষ্টি এবং মারজিয়া দু’জনে চোখাচোখি হয়। মারজিয়া দৃষ্টির ভাষা বুঝার ক্ষমতা মিষ্টির নেই। তারপরও সে নিজের ঘরে চলে আসলো।মহিলার দুই তিনদিন ভালোমতো থেকে খেয়েদেয়ে চলে গেলেই বাঁচে মিষ্টি। দরজা আঁটকানোর আগে মিষ্টি আরেকবার তাকালো বাইরে। ইভান এখনো দাঁড়িয়ে কথা বলছে। মেজাজ বেজায় খারাপ হলো মিষ্টির। এতো কিসের কথা?

ইভান ফিরলো আরো দশমিনিট পর। আসার সময় তার মায়ের সাথে কথা বলে আসলো।ফ্রেস হয়ে এসে বিছানার কাছে আসতেই হাত-পা কেমন অচল হয়ে আসতে লাগলো ইভানের। অস্থির লাগছে ভেতরের দিকে। চোখমুখ কেমন করে যেনো অন্ধকার হয়ে আসছিলো। মিষ্টি বিছানা শুয়ে পড়েছে অনেক আগেই। মুখটা ওদিকে ফিরে রাখলো।ইভান বিরক্ত হলো। এখন তো আড তাদের মধ্যে ঝগড়া চলছেনা যারজন্য ওদিকে ফিরে থাকবে। ইভান আস্তে আস্তে শুয়ে পড়লো মিষ্টির পাশে। মিষ্টির গায়ে হালকাভাবে হাত রেখে পাড়ি জমালো ঘুমের দেশে।

আজ শনিবার। পূর্বের রুটিন অনুযায়ে আজকে রান্না করার দায়িত্ব মিষ্টির। যেহেতু বাসাটা তার নিজেরই তাই মিষ্টি কারো অনাধিকার চর্চাতে মাথা ঘামায়না। মারজিয়া এমনটা প্রায় সময় করতেন।নিজের তৃতীয় স্বামীর সংসার ছেড়ে মিষ্টিকে জ্বালাতে আসতো। মিষ্টি কিচেনে এসে দেখলো সব কেমন অদ্ভুত এলোমেলো। তার হাতের গুছানো জিনিসপত্র এদিক-ওদিক রাখা।কাঁচের গ্লাসগুলো হাতে নিয়ে দেখলো কেমন তেলতেলে হয়ে আছে।রাগ রাগলো খুব মিষ্টির।তারপরও ইভানের মা সে জন্য নিজেকে সংযত রাখলো।
মহিলার স্বভাব-চরিত্র বেশ খারাপ বলেই ইভানের বাবার সাথে তাঁর ছাড়াছাড়ি হয়। শুনেছিলো দিনে প্রায় সময় তাদের অতিক্রম করতো ঝগড়া করে।ইভান সে সব দেখেই ঝগড়াটে ধরণের স্বভাবর পেয়ে যায়। তার খাওয়া-পরার অভাব না থাকলে শান্তি এবং সুখের বড়োই অভাব ছিলো। তাদের বিচ্ছেদের পরও ইভান তার বাবার সাথে থাকতো। টাকার লোভে মহিলা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সে স্বামীও মারা যায়। এখন যাকে বিয়ে করেছেন সে একজন্য ব্যাংকার। টাকাপয়সা যা ইনকাম হয়,তা মারজিয়া এবং তার ছেলেমেয়েদের পেছনেই ব্যয় করে ফেলেন তিনি। বহুদিন বিলাসী জীবনযাপনের জন্য মারজিয়ার ইচ্ছে আকাঙ্খাটাও থেকে যায় আগের মতো। যারজন্য উনার কিছুতেই কুলোয় না। এরপর নামলো ছেলেকে বউয়ের থেকে দূরে করে নিজের হাতের মুঠোয় আনতে।যাতে বিলাসী জীবনে কোন বাঁধা না আসে।নাহলে মারজিয়ার তার প্রথম স্বামীর সাথে বিচ্ছেদের পর এতোটাও খবর রাখেনি ইভানের,যারজন্য আজ ছেলে ছেলে করে জান দিয়ে দিচ্ছে।ইভান তার মায়ের সব বিষয়ে অবগত।তারপরও চুপ থাকে কারণ হাজার হোক মারজিয়া তার ‘মা’।

ইভান উঠার আগেই পরোটা বানিয়ে রাখলো মিষ্টি।সাথে গরুর মাংস।আগের রান্না করা ছিলো ফ্রিজে। তা থেকে গরম করে টেবিলে রাখলো। তারপর গেলো চা বানাতে। চা বানিয়ে আনার পর দেখলো ইভান এসে বসেছে। মিষ্টি এসে বসবে তার আগেই সেঁজুতি এসে ইভানের পাশে বসলো। ইভানকে প্লেটে পরোটা তুলে দিলো।বাটিতে মাংস নিয়ে ইভানের সামনে রাখলো। সাথে রাখলো এক গ্লাস পানি। মিষ্টি হতভম্ব হয়ে গেলো সেঁজুতির আচরণে। এমন একটা ব্যপার তার সামনে আজ প্রথম ঘটলো। ইভান মিষ্টির মুখের হাবভাব দেখে ক্ষীণ হাসলো।এরপর সেঁজুতির দিকে চেয়ে বললো,

— এটা তোর ভাবিকে দে আগে।
এতকষ্ট করে বানিয়েছে।আমাকে পরে দিস।

সেঁজুতি তড়িঘড়ি করে বললো,

— না এটা তুমি খাও।ভাবির জন্য আমি আবার নিচ্ছি।

সেঁজুতি নিতে গেলে,মিষ্টি বাঁধা দিয়ে বললো,

— তুমি তোমার জন্য নাও।আমি আর ইভান একসাথে খাবো।

বলতে বলতে ইভানের পাশের চেয়ারে বসে মিষ্টি সর্বপ্রথম পরোটা ছিঁড়লো। এরপর মাংসের ঝুলে ডুবিয়ে নিজের মুখে পুড়ে নিলো। সেঁজুতি আমতা আমতা করতে করতে গেস্টরুমের দিকে তাঁকালো। মারজিয়া ক্রুদ্ধ চোখে চেয়ে থাকলো সেঁজুতির দিকে।
সেঁজুতি উঠে আসার সাহস পায় না।চুপচাপ সেও খেতে লাগলো। এখানে তার ফুফি তাকে একটা কাজের জন্য এনেছে।সেটা পূর্ণ না হলে ঠিকমতো তার ফুফি তার আস্ত রাখবেনা।

খাওয়া দাওয়ার পর্ব চুকিয়ে মিষ্টি নিজের ঘরে চলে আসলো। এলোমেলো হয়ে আছে পুরো ঘর। ইভান তাহলে আবারও আগের মতো শুরু হয়ে গিয়েছে। এতদিন মিষ্টির কথা শুনার ভয়ে আগেবাগে সব গুছিয়ে ফেলতো। আজ থেকে আবার মিষ্টিকে সব করতে হবে। ভাবতে ভাবতে সব গুছিয়ে ফেললো মিষ্টি।ইভান এসে রেডি হতে লাগলো। মিষ্টি তখন দরজা আঁটকে শাড়ির পড়তে নিচ্ছিলো।ইভান আয়না দিয়েই সুগভীর চোখে তাকালো। মিষ্টি তখন নিজ কাজে মত্ত।হালকা কেশে ইভান বললো,

— খেয়াল রাখিস,তুই সেখানে
শিক্ষক হিসেবে যাচ্ছিস। গল্পগুজব করতে নয়।
তাই অনুরোধ করবো কোন মানুষের সাথে বেশি কথা বলবিনা।

মিষ্টি কুঁচিতে চোখ রেখে ঠোঁট টিপে হেসে বললো,

— কোন মানুষের কথা বলছিস?

— ছেলে’মানুষ! যাস্ট দূরে থাকবি।
আমি যাতে না দেখি কারো সাথে কথা বলছিস।

— আমি তো বলিনা।কিন্তু আমার সাথে বলতে আসলে আমি কি করতে পারি?

ইভান শার্টের বাটন লাগাতে লাগাতে এগিয়ে আসলো মিষ্টির দিকে। এরপর বললো,

— কিছুই করবি না, চড় মেরে দিবি।
তোর হাত তো মুখের চাইতে বেশি চলে, তাই সেটাকে কাজে লাগাবি।

মিষ্টি হাসলো। শাড়ির আঁচল কাঁধে তুলে দিয়ে ইভানের কাছে এসে কাঁধের উপর হাত তুলে দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। মুহূর্তের মধ্যে সুন্দর একটা অনুভূতি হলো ইভানের।দুজনে কিছুটা সময় নীরবে কাটালো। এরপর চলে গেলো একে-অপরের গন্তব্যে…

জুঁই অফিসে এসে হাতের কাজ গুছিয়ে ইভানের কেবিনে এসে ইভানকে খুঁজলো। সম্পূর্ণ কেবিন ফাঁকা। বের হয়ে আসার পথে দেখলো ইভান কোথায় থেকে যেনো ব্যস্তপায়ে এগিয়ে আসছে। জুঁই এগিয়ে এসে বললো,

— দোস্ত, তোর না মাটন বিরিয়ানি প্রিয়?

ইভান হাঁটা থেমে দাঁড়িয়ে গেলো।অকস্মাৎ, প্রশ্নে সে অপ্রস্তুত হয়ে হালকা হেসে চারপাশে তাকালো।এরপর বললো,

— হ্যাঁ তবে সেটা মিষ্টির হাতের রান্না হলে।

জুঁই বিরক্তমুখে হাসার চেষ্টা করলো। মনে মনে ভাবলো এতোদিন ধরে মারজিয়া আন্টি কি করে এসেছে? দুইদিন আগেও তো মিষ্টির নামও শুনতে পারতো না ইভান।অথচ,কাল আর আজ তাদের মাখামাখি দেখে মাথায় আগুন ধরে যাচ্ছে জুঁইয়ের।
হাতের বাক্সটা ইভানের হাতে দিয়ে বললো,

— মা রেঁধেছে আজ।খেতো মন চাইলে খাবি।নাহলে ফেলে দিস আমাকে ফেরত দিস না।

বলেই জুঁই চলে গেলো নিজের ডেস্কে। ইভান জুঁইয়ের মনের মধ্যাকার ভাবনা জানেনা।তাই সে চুপচাপ নিজের কেবিনে চলে আসলো।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে