কাছেপিঠে পর্ব-০৮

0
738

~কাছেপিঠে~
পর্বসংখ্যা০৮

সকাল সাতটা অনুমানিক। বেশ শান্তিপূর্ণ একটা রাত এবং ঘুম দুটোই পেয়েছে ইভান। এখন সমস্যা শীত লাগছে বেশি তার। ঘুম ঘুম চোখে উঠে বসলো ইভান।পাশে তাকালেই দেখে বিছানা ফাঁকা। গুটানো চাদর হাতে নিয়ে শরীরের সাথে মুড়িয়ে এদিক-ওদিক চেয়ে মিষ্টিকে খুঁজলো। দরজায় শব্দ হলে বাথরুমের দিকে দৃষ্টি ছুঁড়লো ইভান। হঠাৎ মিষ্টির হাতে তার শার্ট আর জিন্স ভেজা অবস্থায় দেখে ইভানের চোখ ছানাবড়া। তার বহু পুরনো দিনের একটা কথা মনে পড়লো। কি গাজব বেইজ্জতিই না করেছিলো। নাফাখুন জলপ্রপাত দেখতে গিয়েছিলো তারা ছয় বন্ধুবান্ধব মিলে।সুন্দর পরিচ্ছন্ন স্থান দার্জেলিং পাড়ায় ইভান প্রথমবারের মতো নিজের ভালোবাসার কথা প্রকাশ করেছিলো।মিষ্টিতো সেদিন জবাব দিলোই না,নাফাখুমের পানিতে ধাক্কা মেরে কাপড়চোপড় ভিজিয়েছিলো।শুধু তাই না এক্সট্রা পোশাকও পানিতে ভিজিয়ে দিয়েছিলো।শুধুমাত্র ভালোবাসার কথা বলার জন্যই তার নাজেহাল অবস্থা করেছিলো মেয়েটা।শর্টপ্যান্ট পড়েই তাকে রিসোর্টে ফিরতে হয়েছিলো।

আজও নিশ্চয় কোন কিছুর প্রতিশোধ নিতে এমনটা করলো মিষ্টি।দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইভান মিষ্টির দিকে চেয়ে বলল,

— বেক্কল! আমার কাপড় ভিজিয়েছিস কেন?
এখন আমি কি পড়বো।

মিষ্টি কর্ণারে টেঙে রাখা ছোট্ট দড়িটিতে ইভানের কাপড় বিলিয়ে দিয়ে এসে আয়েশি ভঙ্গিতে সোফায় বসলো। ভেজা চুলের আগা থেকে টপটপ পানি গড়িয়ে পড়ছে। পরনের শাড়িটা বেশ গুছিয়ে পড়েছে মিষ্টি। দেখতে বেশ আকর্ষণীয় লাগছে।মনের মধ্যে অসভ্য ইঙ্গিত আসতেই নিজেকে ধমকালো ইভান। বরাবরেই তার সাথে এসবের জন্য ঝগড়া লাগতো।আর ঝগড়া নয়। মিষ্টি ইভানের দিকে চেয়ে বলল,

— ইভু উঠে দাঁড়া।আমাকে একটু নেচে দেখা।
অনেকদিন তোর নাচ দেখি।

ইভান দাঁতে দাঁত চেপে মিষ্টির দিকে চেয়ে বললো,

— এটা আমার নাচার সময়? বেয়দ্দব।তাড়াতাড়ি আমার কাপড়ের ব্যবস্থা কর। আমার শীত লাগছে।

মিষ্টি সদ্য কিশোরী বয়সে পা দেওয়া কিশোরীদের মতো হেসে উঠলো। বললো,

— হারামি।তুই কি মনে করেছিস? তোর আদরে আমি তোর সব আচরণ ভুলে গিয়েছি। কি কি বলেছিস সব মনে আছে।

ইভান ভ্রূঁ কুঁচকালো মিষ্টির কথায়। কিছুসময় চিন্তিত মনে চুপ থাকলো। হঠাৎ মনে পড়লো সে একটা ভাবনা খসেছিলো মনে মনে। মিষ্টিকে মানানোর পর,ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করে হলেও চাকরিটা ছাড়ানোর চিন্তাভাবনা করেছিলো।কিন্তু এখন মিষ্টি নিজেই এ কথা বলার সুযোগটা ছিনিয়ে নিচ্ছে। কি করা যায়। অতঃপর ইভান হাসলো হালকা ভাবে।বললো,

— ভুলিস না।মনেই রেখে দে।তাহলে অন্তত
আমাকে মনে রাখবি।

—- এখন উঠ,নেচে-কুঁদে আমাকে ইম্প্রেস কর।

ইভান ঝট করে চাদর সরিয়ে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো৷ ধুপধাপ এদিক সেদিক কেমন করে যেনো ঘুরেফিরে নাচলো,কি নাচ,এ নাচের নাম কি মিষ্টি জানেনা। তবে বেশ মজা পেয়েছে।হাসতে হাসতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার মতো অবস্থা। ইভানের মেজাজ তখন সপ্তম আকাশে। রাগে গিজগিজ করছিলো মিষ্টিকে কিছু বলতে। বেচারা পারলো না। যদি এবারে ছয়মাসের দূরত্ব চলে আসে? তাহলে সে পাগল হয়ে যাবে একদম।
তবে ইভান বাথরুমে যেতে যেতে মিষ্টির দিকে হাত বাড়িয়ে মাথায় একটা চড় মেরে দিলো। মিষ্টি হাসি থামালো না।অনেকদিনে এই অহংকারীটার অহংকার মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। মাথায় হাত দিয়ে মিষ্টি ইভানের গতকাল আর আজকের অন্যরকম অর্থাৎ আগের রূপে ফিরে আসার কথা ভাবতে লাগলো। সেদিন মা-ছেলে মিলে বেশ তো থাকে ছোটলোক বলেছিলো। শেষে তো এই ছোটলোকের কাছেই আসতে হলো।মিষ্টি ভাবনায় পড়লো একটু। মাঝেমাঝে ইভান একদম অদ্ভুত হয়ে যায়।তখন চেনা যায় না বললেই চলে। তবে সবকিছুর মধ্যে ইভানের একটা জিনিস সে বেশ লক্ষ করেছে,সেটা হলো ইভান দূরত্ব জিনিসটা সহ্য করতে পারেনা। সেটা যতোই ভয়ংকর ঝগড়া হোক।কিন্তু আচরণ গুলো একদম কলিজায় এসে লাগার মতো কষ্টকর।যাক এবার যদি পরিপূর্ণ ভাবে শোধরালেই হয়।

কলিংবেলের শব্দ শুনে দরজা খুলতে চলে গেলো মিষ্টি। দরজা খুলে জুঁইকে বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো মিষ্টি। জুঁইয়ের অগ্নি দৃষ্টি মিষ্টির ভেজা চুলে তাক করে আছে। মিষ্টির ডাকে ভাবনার ঘোর থেকে বের হলো জুঁই। দৃষ্টি সরিয়ে রাগান্বিত স্বরে বললো,

— তোরা দু’জনের চাকরানী আমি?মাইনে দিয়ে পালিস আমাকে? তোরা রোমেন্স করতে এখানে আসবি,আর তোদের কাপড় আমি আনবো।অসহ্যকর…

মিষ্টি ভাবলো সকাল সকাল এতোটা পথ আসার জন্যেই হয়তো জুঁই রেগে আছে। রাইদা হারামিটাকে বলেছিলো তাদের জন্য কাপড় পাঠাতে। আর সে পাঠানোর জন্য আর মানুষ পেলো না। মিষ্টি বললো,

— স্যরি রে দোস্ত। আয় ভেতরে আয়।
নাস্তা করে যা।

জুঁই হাতের ব্যাগটা মিষ্টির হাতে দিয়ে বললো,

— দরকার নেই আমার তোদের নাস্তার।
আর তোর একফোঁটা আত্মসম্মান নেই। যে ইভান তোকে এতো এতো কথা বললো,অপমান করলো তার কাছে ফিরে এসেছিস।কি বলেছিলাম তোকে? যতোই যাই হয়ে যাক, নিজের অপমানের কথা ভুলে এসব পুরুষের কাছে নিজেকে ধরা দিবি না। পরে কষ্ট তো তুই-ই পাবি। দ্যাখ,তোকে আবারও হেনস্তা না করে মা-ছেলে মিলে।

মিষ্টির ভেতর বেশ খারাপ লাগতে লাগলো। যতোই সে উপরে শক্ত হয়ে থাকতে চায়। ততোটায় ভেতরে ভেতরে ভেঙে যায়।এ মুহূর্তে জুঁইয়ের কথা শুনে অনেক খারাপ লাগছে মিষ্টির।সে আসলেই ইভানের কাছে এসে ভুল করেছে? ইভান যদি আবারও আগের মতো হয়।
জুঁই হাসলো মৃদু ভঙ্গিমায়। আলগা হাসিটা দৃষ্টির অগোচরেই থাকে। প্ল্যান ‘এ’ কাজে দেয়নি তো কি হয়েছে? প্ল্যান ‘বি’ ও তো করতে পারে।তার আগে মারজিয়ার ব্রেনওয়াশ করতে হবে। মিষ্টির ভাবনার সুতোয় টানা দিয়ে জুঁই বললো,

— যাক তোরা যখন সব ঝামেলা মিটিয়ে ফেলেছিস তখন তো আর সমস্যা নেই।থাকার কথাও না। তবে পুরুষ মানুষকে টাইটে রাখা দরকার।যতোই বউ পাগল হোক,দিন শেষে অন্য স্বাদ খুঁজবেই খুঁজবে।

— ইভু এমন নয় জুঁই।তুই শুধু শুধু এসব বলছিস।

জুঁই মুখটা কাঁদো কাঁদো করে বললো,

— আমার দুলাভাইও এমন ছিলো না রে মিষ্টি। কতো ভালোবাসতো আপুকে। অথচ দেখ এখন দ্বিতীয় পক্ষ নিয়ে বেশ সুখেই আছে।আপুর খোঁজ অবধি নেয় না। প্রেমের বিয়ে,মা-বাবা তো আপু নামটাও শুনতে পারে না।সব কপালের দোষ৷ তাই সময় থাকত তোকে সাবধান করছি।

জুঁই জানে ইভান এখন আসতে পারবে না এখানে। তাই তার সাদাসিধা বউটার মাথায় বিষ ঢুকিয়ে দিলো।যেমনটা সে প্রথম থেকে করে আসছে। ইভানকে নিজের করে পাবে সে আশা জুঁইয়ের নেই,পেয়ে গেলেও সে তা সাদরে গ্রহণ করবে।তবে ইভানকে আর মিষ্টিকে কষ্ট পেতে দেখলে তার বেশ ভালোই লাগে। তাদের দোষ একটা। তাদের প্রেমের শুরুর কথা জুঁই জানতে পারেনি,যখন জানলো তখন কাজের কাজ কিছু হওয়ার ছিলো না। মিষ্টি সহস্র চিন্তার সাগরে নামিয়ে দিয়ে কখন যে জুঁই তার সামনে থেকে চলে গিয়েছে সেটা খেয়ালই করেনি মিষ্টি। ইভান এসে মিষ্টিকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাত ধরে টেনে মিষ্টিকে ভেতরে এনে দরজা লাগিয়ে দিলো। মিষ্টিকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো,

— কার কথা ভাবছিস এতো? ইদানীং আমি
ছাড়া আর কারো কথা ভাবা হয় বুঝি?

— হয়তো, ভবিষ্যতের। কি যে আছে কপালে…

মিষ্টি ইভানের হাতে কাপড়ের ব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে নাস্তা বক্সটা হাতে নিয়ে চলে গেলো কিচেনে।বেশ জোরেসোরে খিদে পেয়েছে মিষ্টির।আপাততে খেয়েদেয়ে নিবে, এরপর বাসায় ফিরতে হবে। সেখান থেকে সোজা কমিউনিটি সেন্টারে।

উদরে শক্তহাতের চাপ পেয়ে ঘাঁড় ঘুরিয়ে থাকালো মিষ্টি। ইভান তখন গালের সাথে গাল লাগিয়ে রাখলো। বললো,

— কি করছিস? হেল্প লাগবে?

— তুই কি হেল্প করবি আমার?

— এই যে তুই দাঁড়িয়ে চা বানাবি,তখন আমি তোর পিঠ মালিশ করে দিবো। মাথা টিপে দিবো। হাত ও টিপে দিবো…

বলতে না বলতে মিষ্টি ইভানের বুকে হাতের কনুই দিয়ে ধাক্কা মেরে বললো,

— হতচ্ছাড়া সর। সবসময় অসভ্যতামি। যা এখন।

ইভান হাসতে হাসতে মিষ্টিকে ছাড়লো। চলে গেলো না। ঠাঁই দাঁড়িয়ে দেখতে থাকলো তার ব্যস্ত বউটাকে। ইভান ভাবনায় পড়লো মিষ্টিকে নিয়ে বাসায় ফিরবে।কিভাবে। দু’চোখে সহ্য করতে পারেনা ইভানের মা মিষ্টিকে।এখন গেলে কি যে হবে?

__________

কমিউনিটি সেন্টারে প্রবেশ করতেই ইভান আর মিষ্টির চোখ তুবড়ে গিয়ে পড়লো স্টেজের উপর দাঁড়িয়ে থাকা বর-বউয়ের দিকে। তারা উভয়ে ইভান আর মিষ্টিকে এগিয়ে আসতে দেখে হাসলো। তাদের কাছে এসে বসতেই আফিন ইভানের কাঁধে চাপড় মেরে রাইদাকে বললো,

— বাহ! রাইদা দেখ দুজনের চহারার। কতো হাস্যজ্জ্বল দেখাচ্ছে। তোরা এভাবে থাকতে পারিস না সবসময়। কতো সুন্দর দেখাচ্ছে দুজনকে।

রাইদা বললো,

— এদের ভেতরে গণ্ডগোল আছে আফিন।।
তাই এদের সবসময় ঝামেলা হয়। যাক,এবার থেকে সাবধান।আর নয় ঝগড়া,করুন মিলে সুখী সংসার।

অবশেষে,
আফিন আর রাইদার বিয়েটা হয়ে গেলো। জমজমাট খানাপিনার আসরে,ছবি তুলার সময় সব জায়গায় ইভান মিষ্টির হাতটা আঁকড়ে ধরে রাখলো। কারো সাথে পরিচয় করার সময় মিষ্টির কাঁধে হাত রেখে বলে,’ মাই ওয়াইফ মিষ্টি!’
কথাটা শুনলে বরফের মতে গলে যায় মিষ্টি।রাগ অভিমান কোথায় গিয়ে যেনো লুকিয়ে পড়ে। সবাই যখন বর-বউ নিয়ে ব্যস্ত৷ মিষ্টি তখন দৃঢ়ভাবে ইভানের হাতটা তুলে আলতোভাবে ঠোঁট ছোঁয়ায়। ইভান আঁড়চোখে সবটা দেখে, না দেখার ভান ধরে থাকে।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে