~কাছেপিঠে~
পর্বসংখ্যাঃ০৭
মিষ্টি ছেলেটিকে রাইদার সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য ঘরে রেখেই দ্রুত বেরিয়ে এলো। আশেপাশে উঁকি দিয়ে খুঁজলো ইভানকে। মেহমাহ গিজগিজ করছে চারিদিক।দুই’পক্ষে আত্মীয়দের জন্য এক জায়গাতেই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এতো এতো মানুষের ভীড়ে কাঙ্খিত মুখখানা না দেখে বিষণ্ণ চেহারা নিয়ে নিচে নামতে গেলো।তার আগেই কোথায় থেকে যেনো হাওয়ায় ভেসে উড়ে আসার মতো করে মিষ্টির সামনে এসে দাঁড়ালো মুহিত, বললো,
—- থাম থাম,কোথায় যাচ্ছিস?
মিষ্টি আশেপাশে চেয়ে বললো,
— নিচে যাচ্ছি।কিছু বলবি?
— তোরে নিচে যাইতে মানা করছে।
—- কে মানা করেছে?
—- নামও বলে দিতে হইবো? তুই বুঝস নাই এ কথা
কে বলতে পারে?
মিষ্টি চোখমুখ শক্ত করে বললো,
— যার কথা বলছিস,তাকে আমি চিনি না। সর সামনে থেকে।
— দোস্ত নিচে মানুষজন বেশি,না গেলে ভালো হতো।
তাছাড়া তোর লজ্জা করবে না।
মিষ্টি জবাব দিলো না। সে এমনিতেই নিচে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করেনি। তবে ইভান নিচে যেতে বারণ করেছে কথাটা শুনে মেজাজ তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো মিষ্টির। বিয়ের পর থেকে একটা বিয়ের অনুষ্ঠান ঠিকমতো এ্যাটেন্ড করতে দেয়নি হারামিটা।আজ নিজের প্রিয় বান্ধবীটার বিয়ের আনন্দেও সামিল হতে দিচ্ছেনা।নিজের বিয়েটাও হয়েছিলো সাদামাটায়। মিষ্টি নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বললো,
— এখান থেকে সোজা নিচে গিয়ে তোর বন্ধুকে বলবি,বেশি বাড়াবাড়ি করলে আমি মিষ্টি এখনি নিচে গিয়ে এক চড়ে তার চাপার সব দাঁত ফেলে দিবো।
মুহিত খুকখুক করে কেশে উঠলো।হাতের ফোনটা তুলে মিষ্টির হাতে দিয়ে বললো,
— ধর তুই বল। আমি যাচ্ছি।
মুহিত আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না। নিচে নেমে গেলো।মিষ্টি তার বিষ্ময়কর দৃষ্টি সমেত তাকালো ফোনের স্ক্রিনের দিকে। ‘ইভান’ নামটা স্পষ্ট দৃশ্যমান হলো স্ক্রিনে। মিষ্টির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো যেনো।ইভান এতক্ষণ লাইনে ছিলো। মিষ্টি ফোন কানে ঠেকিয়ে রাখলো কিছুক্ষণ। ইভান এতক্ষণ মুহিত আর মিষ্টি উভয়ের কথোপকথন শুনলো।এখন তাদের কন্ঠস্বর শুনতে না পেয়ে বুঝলো মিষ্টি ফোন কানে ঠেকিয়ে রেখেছে,আর মুহিত চলে এসেছে। ইভান এবার উত্তেজিত হয়ে গেলো মিষ্টিকে দেখার জন্য। অসীম রাগের মধ্যে একঝলক দেখার তীব্র আকুতি দমন করা সম্ভব হয়না ইভানের। মিষ্টির ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। সে অধীর আগ্রহের সাথে অপেক্ষা করে আছে যদি একটিবারের জন্য ইভান কথা বলে। মিষ্টিকে নিরাশ করে দিয়ে ফট করে লাইনটা কেটে দিলো ইভান। হতাশ হয়ে মিষ্টি আর নিচে যাওয়ার সাহস পেলো না। পূনরায় রাইদার ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।সেখানে দেখলো অনেক অপরিচিত মুখ। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে এলোমেলো পায়ে ছুটলো ছাদের দিকে। হাতের কাছে নিজের ফোনটার দিকে চেয়ে চাপা শ্বাস ত্যাগ করলো। সেদিন রাতে ফোন রেখেই চলে এসেছিলো মিষ্টি। ইনিয়েবিনিয়ে হয়তো ইভান তার ফোনটাও দিয়ে দিয়েছে এখন তার হাতে। তারমানে সম্পর্কে ইতি টানার সময়ও হয়ে এসেছে। ইভান হয়তো আর কোন রকম পিছুটান রাখতে চায়ছেনা।
ইভান ভেবেছিলো এখানে এসে খেয়েদেয়ে তারপর বাসায় ফিরে যাবে। কিন্তু এসে মিষ্টিকে দেখে তার সব ভাবনা এলোমেলো হয়ে গেলো। ইভানের ইচ্ছে করছে একছুটে গিয়ে মিষ্টিকে কোলে তুলে একেবারে বাসায় নিয়ে যেতে। তারপর ইচ্ছেমতো রাগাতে। তারপর ঝগড়া আর মারপিট করতে।মিষ্টি মারপিটে বেশ ওস্তাদ। অনেকদিন হচ্ছে মেয়েটাকে ছুঁতে অবধি পারছেনা,বুকে নিতে পারছেনা। আর আজ তো সেজেগুজে মাথা খারাপ করে দিয়েছে ইভানের। ইভান চাইলেও মিষ্টির রঙিন প্রলেপ মাখানো ঠোঁট,কাজল টানা চোখ কিছুই ভুলতে পারছে না। বার বার চোখের সামনে দৃশ্যমান হয়ে মেজাজ ধরিয়ে দিচ্ছে।
ইভান উপরে এসে মিষ্টিকে খুঁজে পেলো না কোথাও।
ছাদের উপর যেতে পারে সে ধারণা মনে নিয়ে সোজা চলে এলো ছাদে। দরজায় এসে দেখলো মিষ্টিকে একা একা দাঁড়িয়ে থাকতে।
হলুদ অনুষ্ঠান নিচে হলেও উপরেও বেশ সুন্দর করে লাইটিং করা হয়েছে। এখন শীত শেষের দিকে চলে এসেছে৷ ঠাণ্ডা বেশি না পড়লেও কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে আছে চারপাশ। ইভান দৃঢ়পায়ে এগিয়ে গেলো মিষ্টির কাছে। কারো উপস্থিতি টের পেয়ে পেছন ফিরলো মিষ্টি। সটান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ইভানকে দেখে মৃদু হাসলো। জিজ্ঞেস করলো,
— কেমন আছিস দোস্ত?
ইভানের চোখ জ্বলে উঠলো। এখন তাহলে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কাটছাঁট হয়ে গেলো।এজন্যই সম্মোধনটা বন্ধু হওয়ার ভিত্তিতে করলো।বেশ ভালো মিষ্টি। ইভান একটু সময় নিয়ে জবাব দিলো,
— ভালো,তুই?
— ভালো।
এরপর মিষ্টি দৃষ্টি ঘুরিয়ে একদম সামনের দিকে ছুঁড়লো। রাস্তার দ্বারে হরেক রকম মরিচ বাতি দিয়ে সাজানো। মিষ্টির হঠাৎ ইচ্ছে হলো ইভানকে জ্বালাতে। তারপর কিছু একটা ভেবে আর বললো না। তবে মিষ্টি এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেনা। তাই ফিরে চলে যেতে উদ্যত হয়ে ইভানকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— যাই তাহলে,তুই থাক।
ইভান মিষ্টিকে আঁটকাতে বলল,
— বাড়িতে যাস নাই?
— ওহ হ্যাঁ গিয়েছি। কাল এসেছি।
আসার মন ছিলো না রাইদাটার জন্য না এসে পারলাম না।
— কিছু বলেনি তোকে তাঁরা?
— আরে ধূর কি বলবে,এতোদিন পর আমাকে
পেয়ে বাবা-মা ভীষণ খুশী হয়েছে। আমার উপর তাদের কোন রাগ নেই আর। সবচেয়ে বেশি খুশী হয়েছে বাবা।
মিষ্টি সম্পূর্ণ কথা মিথ্যে বললো ইভানকে,বাড়িতে গিয়ে মার খাওয়ার শখ নেই তার। যতোই মেয়ে এখন বয়সে পূর্ণবতী নারী হোক,মার একটাও মাটিতে পড়বে না সিউর। তার বাবা অত্যন্ত গরম মেজাজের মানুষ। একটু এদিক-ওদিক হলেই বাড়িসুদ্ধ মাথায় তুলেন।
মিষ্টির কথার পিঠে ইভান কিছু বলতে নিবে তার আগেই, তখনকার ছেলেটি ছাদের উপর উঠে এসে বললো,
— ম্যাডাম আপনি এখানে,আমি আপনাকে
সারাবাড়ি খুঁজে চলেছি। খাবেন না?
মিষ্টি এবার প্রচণ্ড বিরক্ত হলো।এই ছেলেটা আর আসার সময় পেলো না। একটু উপকার করতে গিয়ে একেবারে ফেঁসে গেছে মিষ্টি।ছেলেটা যেখানে দেখে সেখানেই এগিয়ে মিষ্টির সাথে কথা বলে।তখন তো সমস্যা ছিলো না। এখন কি করবে। তারপরও হাসিমুখে ছেলেটির দিকে চেয়ে বললো,
—- আপনি যান,আমি আমার ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলে আসছি।
ছেলেটি সাথে সাথে চলে গেলো। ইভান রাগে অভিমানে ফুঁসতে লাগলো। মিষ্টির ইভানের ভুল ধারণা ভাঙাতে বললো,
— আফিনের ফুফাতো ভাই হয়।
ইভান আশেপাশে তাঁকালো।নিজের রাগ সামলে বললো,
— তোর সাথে সম্পর্ক কী সেটা বল?
— ওর বোন আমাদের কলেজে ভর্তি হয়েছিলো।
তখন থেকে পরিচিত।
ইভান আর একটা কথাও শুনার প্রয়োজন বোধ করলো না। গটগট পায়ে নেমে গেলো ছাদ থেকে।
মিষ্টির প্রচণ্ড অস্থির হয়ে ছুটলো ইভানের পেছন পেছন। পাগলটা সবসময়ের মতো ভুল বুঝে থাকবে এ ভয়ে।
অনেকটা পথ দৌড়ে এসে হাঁপিয়ে উঠলো মিষ্টি।ইভান পেছন ফিরেও তাঁকালো না। গাড়ির কাছাকাছি আসতেই ইভান পেছন ফিরে মিষ্টির দিকে চেয়ে বললো,
— যদি কোনদিন আমাকে একটুও ভালোবেসে থাকিস।তাহলে সোজা গাড়িতে এসে ওঠ।আমার তোকে চাই…
— তাহলে কথা দে,আমার সাথে ঝগড়া করবিনা।
—- ঠিকাছে,চলে যা আসতে হবে না তোর। ধূর হ।
ইভান দরজা খুলে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লো।গাড়ি স্টার্ট দিতে দেখে মিষ্টি দৌড়ে এসে দরজা খুলে ফ্রন্ট সিটে বসে পড়লো।
মিষ্টি ইভানের দিকে ফিরে বললো,
— তোর না আমারে ভালো না আর,বিরক্ত লাগে,অসহ্য লাগে। এখন?
— মুখ বন্ধ রাখ বেয়াদ্দপ।
হঠাৎ ইভানের ফোনটা বেজে উঠলো, ফোন হাতে নিয়ে দেখলো আফিন কল দিয়েছে। ইভান চট করে ফোনটা কেটে দিলো। তখনি মিষ্টির ফোনটাও বেজে উঠে।রাইদার ফোন দেখে ইভান ফোনটা কেড়ে নিয়ে সেটাও বন্ধ করে দিলো।
— আরে ফোন কাটলি কেন? সুইচ ওফ্ফ ও করে দিলি ওরা কি ভাববে?
মিষ্টির কথার জবাব দিলোনা ইভান।গম্ভীরমুখে সামনের দিকে চেয়ে থাকলো।
মিষ্টি অন্যমনষ্ক হয়ে সিটে হেলান দিয়ে বসলো। শান্তিতে চোখ বুঁজে আসতে চাইছে তার। দুইদিনের বা তিনমাসের দূরত্ব হুট করে মাঝখানের দুইদিন কিভাবে যেনো ঘুছিয়ে দিলো। চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে আসলো একে-অপরকে। ইভান মিষ্টিকে নিয়ে চলে আসলো তার অন্য একটা এ্যাপার্টমেন্টে।
মিষ্টি আগেই ভেতরে প্রবেশ করলো। ইভান দরজা বন্ধ করে দরজা কাছে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকলো। মিষ্টি লাইট জ্বালাতে জ্বালাতে বললো,
—- চলে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলে চলে যেতে পারিস।
তবে আমি কোথাও যাচ্ছি না এখন।বেশ ঘুম পাচ্ছে গতকাল রাতে ঘুমাতে পারিনি।
—আমি তো গত দুই রাতই ঘুমাতে পারিনি তোর চিন্তায়।
ইভান হাত দুটো উপরে তুলে দু’দিকে প্রসারিত করে বললো।
— সোজা বুকে আয়। আমাকে বিশ্বাস করা যে,তুই আসলেই আমার কাছে আছিস।
মিষ্টি হাত কচলাতে কচলাতে দৃঢ়পায়ে এগিয়ে আসতে লাগলো।ইভান এতো সুন্দর করে ডাকে যে না এসে পারে না। মিষ্টিকে দৃঢ়পায়ে আসতে দেখে ইভান গলার স্বর বাড়িয়ে বললো,
— আরে কচ্ছপ গতিতে আসছিস কেন জান?
খরগোশ গতিতে দৌড়ে আয়।
মিষ্টি সত্যিই এবার দৌড়ে এসে ইভানের বুকের উপর হামলে পড়লো। ইভান শক্ত হাতে জড়িয়ে বুকের সাথে চেপে ধরলো মিষ্টিকে। ইভান মিষ্টির গলায় মুখ গুঁজে রেখেই বললো,
— আর কখনো ছেড়ে যাবি না আমাকে।
তাহলে দেখিস তোরে কেমন মার মারি।কখনো স্বামীর হাতের মার খাস নাই। তাই তোর এতো সাহস বেড়েছে।
(চলবে)
________________
©তারিন_জান্নাত