কাঁচ কাটা হীরে পর্ব-০৫

0
754

#ধারাবাহিক গল্প
#কাঁচ কাটা হীরে
পর্ব-পাঁচ
মাহবুবা বিথী

আহসান ঐ সময়টাতে প্রচন্ড ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিলো। পরে জেনেছিলাম ও জেনিফারকে এক আধটু পছন্দ করতো। জেনিফার ছিলো অনেকটা গায়ে পড়া স্বভাবের মেয়ে। ওর মতো মেয়েরা কখনও কাউকে ভালোবাসতে পারে না। ওরা শুধু নিজেকে ভালোবাসে। নিজেকে ভালোরাখার তরে ওরা অনেক কিছু করতে পারে। এমনকি নিজেকে বিকিয়েও দিতে পারে। আহসান ছাত্র হিসাবে টপার ছিলো, নেতৃত্বের গুনাবলী ছিলো তাই অল্প সময়ে ভার্সিটির খুব পরিচিত মুখ হয়ে উঠলো। জেনিফারও তখন ওকে অনেক প্যাম্পার করতো। পহেলা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারী এসব দিবসে আহসানকে পাঞ্জাবী গিফট করতো। আহসানের তখন যা বয়স ছিলো ও ভাবতো জেনিফার হয়তো ওকে সত্যিই খুব পছন্দ করে। কিন্তু ওর ভুল ভাঙ্গে যখন ওকে ভার্সিটি থেকে দুবছরের জন্য বহিস্কার করা হয়। সেসময় জেনিফার সরকারদলীয় এক রাজনৈতিক নেতাকে বিয়ে করে বিশ্বট্যুরে বেরিয়ে পড়ে। যাইহোক আহসানের আর পরীক্ষা দেওয়া হয় না। ডিপ্রেশন কাটাতে আমি ওকে ক্রমাগতভাবে কাউন্সেলিং করতে থাকলাম। সেই বস্তির ঘরে ওর সাথে সারারাত কাটানোর পর আমার এক ধরনের দায়বদ্ধতা কাজ করে। আর একটা বিষয়ছিলো ও চাইলে আমার নামটা ভার্সিটিতে জানাতে পারতো। তাহলে ওর মতো হয়তো আমার প্রতিও দুবছরের বহিস্কারের আদেশ জারি হতো। আর তখনি আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমি যদি কাউকে বিয়ে করি তাহলে আহসানকেই বিয়ে করবো। এজন্য আমার দেশে থাকা চলবে না। কারণ আমার বাবার যা স্টাটাস আমার জন্য লোকের কাছে তাকে অনেক কথা শুনতে হবে। এটাও আমাকে দহন দিবে। তাই এখানে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমাই। চিঠির মাধ্যমে আহসানের সাথে আমার যোগাযোগ চলতে থাকে। অবশ্য ইংল্যান্ডে চলে যাওয়ার আরও একটা কারণ ছিলো। আহসানের ভার্সিটির দুবছর বহিস্কারাদেশ পার হওয়ার পর ও ফাইনাল পরীক্ষা দিতে পারে। দেশে তখন বহুদলীয় গনতন্ত্র প্রতিষ্টিত হয়েছে। কিন্তু আহসানের ঐ ছাত্ররাজনীতির কারণে কালো তালিকাভুক্ত হওয়ায় ওর ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রে অনেক জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিলো। আসলে ওর তো মামা খালুর জোর ছিলো না। একদম তৃনমূল থেকে উঠে আসা মানুষ আহসান। সব মিলিয়ে আমরা দুজন ইংল্যান্ডে থিতু হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
আহসান পরীক্ষা দেওয়ার কিছুদিন পর আমি দেশে ফিরে এসে ওকে বিয়ে করে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমাই। এবং ইংল্যান্ডে এসে আমরা দু,জনে খুব সুখী ছিলাম। প্রথম জীবনে যখন দুটো মানুষ ঘর বাঁধে কত কিছু নিয়ে তাদের মাঝে খুনসুটি হয়। অথচ আমাদের মাঝে সেরকম খুনসুটিও কখনও হয়নি। আমরা দুজনে সংসারের কাজকর্ম ভাগ করে করে নিতাম। খরচও দুজনে সমানভাবে শেয়ার করতাম। কোনোকিছু নিয়ে সামান্য মুখ কালো কখনও হয়নি। অথচ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো ডিভোর্স হয়ে গেল। যদিও ডিভোর্সটা আমিই ওকে দিয়েছিলাম।
——মামনি তোমাদের ইংল্যান্ডে থিতু হওয়ার খবর জেনিফারের কাছে পৌঁছালো কিভাবে? আর উনার ডিভোর্স হলো কেন?
——আসলে এসব খবর তো চাপা থাকে না। জেনিফার লন্ডনে আসার এক বছর আগে আমাদের এক বন্ধুর সাথে ইংল্যান্ডে দেখা হয়েছিলো। ওর নাম রিতা। ও একসময় জেনিফারের বন্ধু ছিলো। ওর হাসব্যান্ড ডাক্তারী পেশায় ছিলো। ডাক্তারী বিদ্যায় উচ্চতর ডিগ্রী নিতে লন্ডনে এসেছিলো। পরে অবশ্য ওরা দেশে ফিরে গিয়েছে। ওর কাছ থেকে জেনিফার আমাদের লন্ডনের ঠিকানা সংগ্রহ করে। জেনিফার ছিলো প্রচন্ড ধুর্ত। তাই প্রথমে চিঠি আমার কাছে পাঠায়। যাতে ওর প্রতি আমার কোনো সন্দেহ না জন্মায়। এবং ওর স্বামীকে যে ও ডিভোর্স দিয়েছে এটা আমার কাছে ও হাইড করেছিলো। তবে আহসান ওর ডিভোর্সের বিষয়টা জানতো কিনা সেটা আমার জানা ছিলো না। আমি যদি জানতাম ও ওর স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে লন্ডনে এসেছে তাহলে হয়তো ওকে নিয়ে অন্যরকম চিন্তভাবনা করতাম। তবে দোষটা আমি একা জেনিফারকে দিবো না। আমার মতে আহসানও সমান দোষে দোষী। আমি এও বিশ্বাস করি মানুষের ভালোবাসা এতো ঠুনকো হবে কেন?যে প্রাত্তন প্রেমিকাকে দেখা মাত্রই বর্তমানের প্রেমটা মুহুর্তে উবে যাবে? এমন ভালোবাসার আমার দরকার নেই। যে ভালোবাসা অবিশ্বাসের চোরাবালীতে আটকে যায় সে ভালোবাসাকে আমি ঘৃনা করি।
—– মামনি, কোনো কারণ ছাড়াই উনার স্বামী উনাকে ডিভোর্স দেন?
—–আসলে জেনিফারের চাহিদা ছিলো পাহাড়সমান। ওকে ডিভোর্স দিয়ে ওর স্বামী মনে হয় হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। আর জেনিফারও যখন দেখেছে ওর স্বামী ওর চাহিদার ভার আর বইতে পারছে না তখন ওর পাওনা বুঝে নিয়ে ডিভোর্স দেওয়াকে শ্রেয় মনে করেছে।
——তুমি আবার লন্ডনে কবে ফিরে গেলে?
—–বন্ধুদের সাথে দেখা করে আসার একসপ্তাহের মধ্যে লন্ডনে পাড়ি জমাই। আহসানকে না জানিয়ে আমি লন্ডনে রওয়ানা দেই। লন্ডনে আমার বাসায় পৌঁছাতে রাত দশটা বেজে গিয়েছিলো। জেনিফার আর আহসান কেউই তখন বাসায় ছিলো না। ডোরবেল বাজানোর সাথে সাথে আমার শ্বাশুড়ী মা দরজা খুলে আমাকে দেখে হাঁউ মাউ করে কাঁদতে থাকে। আমিও তখন কিছুটা নার্ভাস হয়ে যাই। উনার কান্না দেখে আমার মনে হলো আদৌ কি আমার সংসারটা ঠিক আছে নাকি ঘুণ পোকা পুরোটাই খেয়ে ফেলেছে। তবে ভুল মানুষকে ভালোবেসে আঁকড়ে থাকার চেয়ে একা থাকা আমার কাছে অনেক সম্মানের। তাই ভালো মন্দ যাই ঘটুক আমার জীবনে সবকিছুকে আমি স্বাভাবিকভাবে নিবো। এরকম সাহস বুকে নিয়ে শাশুড়ী মাকে জিজ্ঞাসা করলাম,
——মা আপনি এভাবে কাঁদছেন কেন? আপনি ঠিক আছেন তো?
——আমি ঠিক আছি গো মা। তবে তোমার সংসারটা মনে হয় নর্দমার বেনোজলে ভেসে গেল।
——কেন কি হয়েছে?
——আসছো যখন সবই দেখতে পাইবা। অনেক লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে আসছো। হাতমুখ ধোও ফ্রেস হও।দাদুভাইরে হাতমুখ ধুয়ে আগে খাবার খাওয়াও। নিজেও খাওয়া দাওয়া করো। রাত বাড়ুক। তারপর সব নিজের চোখেই দেখতে পাইবা। ওরা অনেক রাতে বাড়ি ফিরে। আমি দরজা খুলি না। ওদের কাছে চাবি থাকে। ওরা নিজেরাই চাবি খুলে ঢুকে।
—–আহসান তো মা আগে এতো রাত করে বাড়ি ফিরতো না। অফিস থেকে ফিরে বাসায় থাকতো। প্রয়োজন ছাড়া বের হতো না।
——(কান্না থামিয়ে)মাগো, সৎসঙ্গে স্বর্গবাস আর অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। তবে আজ আমার নিজের উপর বড্ড রাগ হয়। আগে যদি জানতাম আমার পেটের সন্তানের এমন অধঃপতন আমাকে দেখতে হবে তাহলে আঁতুড় ঘরে ওর মুখে লবন দিয়ে মেরে ফেলতাম। জোয়ান বয়সে বিধবা হইছি। স্বামী ছাড়া তো দিব্যি বাঁইচা রইছি। সন্তান ছাড়াও বাঁইচা থাকতে পারতাম। এতো কষ্ট করে ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করে ওকে মানুষ করলাম। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে নতুন করে আর সংসারও পাতলাম না। জোয়ান বয়সে বিধবা হওয়ার কি জ্বালা তা আমি হাঁড়ে হাঁড়ে বুঝেছি। সবাই শুধু বিছানায় নিয়ে শুইবার চায়। একদিকে যেমন ইজ্জত আব্রু রক্ষা করেছি অপরদিকে মানুষের জামা কাপড় সেলাই করে ওর পড়ার খরচ যুগিয়েছি। এতো ত্যাগের আমার কি লাভ হলো?
শাশুড়ী মায়ের মুখে ঐ কথাগুলো শোনার পর আমার নিজের কষ্টের বোঝা যেন অনেকটা হালকা অনুভব হলো। কারণ আমার বাবা হাইঅফিসিয়ালি জব করেছেন। সেক্ষেত্রে জীবনটা আমার স্বাচ্ছন্দে কেটেছে। তারপর বিয়ের পরে আহসানের সাথেও সুন্দর সময় পার করেছি। আমি সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত একজন নারী। যদি আহসানকে আমি ডিভোর্স দেই তাহলেও আমার কোনো সমস্যা নেই। নিজের খরচ, সন্তানের ভরণপোষণ চালানোর মতো সামর্থ আমার আছে। কিন্তু আমার শাশুড়ীর জীবনতো ষোলো আনাই কষ্টে কাটলো। আমি শাশুড়ীমাকে ঘুমাতে বললাম। উনি হয়তো অপ্রিতিকর পরিস্থিতি এড়াতে নিজের রুমে ঢুকে দরজাটা লক করে দিলেন।রাত বারোটার দিকে গাড়ির হর্ণ শুনতে পেলাম। লন্ডনে তখন শরৎকাল। রাতের বেলায় তাপমাত্রাটা একটু নেমে যায়। হালকা শীত অনুভব হয়। আমি গায়ে পাতলা একটা শাল জড়িয়ে দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। ওরা দুজন পুরো মাতাল হয়ে গাড়ি থেকে নামলো। তারপর দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে দরজার কাছে এগিয়ে আসতে লাগলো। আমাকে দেখে আহসান বৈদ্যুতিক শকড খাওয়ার মতো দূরে ছিটকে পড়লো।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে