#কাঁচের_সংসার
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_২
রাতে আর ঘুম এলো না আরোহীর। কীভাবেই বা আসবে! বিয়ের পর শত রাগ-অভিমান হলেও আরোহী কোনোদিন একা থাকেনি। তার ভীষণ ভয় হতো, যদি আরিয়ানও তার আপন-জনদের মতো হারিয়ে যায়! তাই তো সে আরিয়ানকে ছাড়া একটা রাতও পার করেনি। শেষের কয়েকমাস তাদের মনের সাথে দুরুত্ব বাড়লেও আরোহী একদিনও নিজের রুম ছাড়া কোথাও থাকেনি। বিয়ের পর আরোহী নিজের একটা দিনও আরিয়ানকে ছাড়া কাটাইনি। আর আজ! আরিয়ানকে ছাড়া আজ থেকে সে বেঁচে থাকবে। এতদিন মনের মধ্যে যে ভয়টা বাসা বেঁধেছিল সেটাই হলো। অবশেষে আরিয়ানও হারিয়ে যেতে লাগলো। আরোহীর নিজের সাজানো রুমটা আজ থেকে অন্য কারো। আজ থেকে এই সংসারে অন্য কারো ছোঁয়া। আজ থেকে আরোহীর চিরচেনা রুমটাও অন্য কারোর। সে তো চেয়েছিল, এই সংসারটাকে আপন করে নিতে কিন্তু কেন পারলো না! কেন এই সংসার তাকে দূরে ঠেলে দিল।
আরোহী অশ্রুমাখা দৃষ্টিতে রুমের ডানদিকের দেয়ালের দিকে নজর দিল। এই দেয়ালের পাশের রুমটা আরিয়ানের। মাঝখানে একটা দেয়াল, কিছুই দেখা যাচ্ছে না কিন্তু আরোহী মসৃন দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রইল। কিছু দেখা না গেলেও সে অনুভব করছে, কল্পনা করছে এই দেয়ালের ঐপারে আজ অন্য কোনো নতুন দম্পতি স্বপ্ন বুনবে। আচ্ছা, আরিয়ান কী আরোহীর সাথে বিয়ের প্রথম দিন যেমন সুখের স্বপ্ন বুনেছিল আজও কী স্নেহার সাথে তেমন বুনবে! ভাবতেও অশ্রুতে ভরে আসলো আরোহীর চোখ। আরিয়ানের সাথে আজ অন্য কোনো নারী একই রুমে সে সহ্য করতে পারছে না!
———-
আরিয়ানের ঘুম ভাঙলো ভোরে। তাও মোবাইলে পরপর দুইবার কল এর বিরক্তি-কর শব্দে না চাইতেই ঘুম ভেঙে যাওয়াতে বাকি ঘুমটুকুও মুহূর্তের মধ্যে উবে গেল। সে আর মোবাইল ঘাটলো না। শোয়া থেকে উঠে বসে স্বভাব’তই প্রতিদিনের ন্যায় তার বামদিকে চোখ দিতেই কোথাও জানি সূচের মতো বিধলো।
‘কী!এভাবে চমকে উঠলে কেন!’
আরিয়ান বিনিময়ে কোনো জবাব না দিয়ে কিছু সময় থম মেরে বসে রইল। আস্তে আস্তে কালকের দিনের ঘটনা সব মনে পড়তেই সে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। এতো কিছুর পরও সে কিভাবে ভাবলো যে!তার পাশে আরোহী আছে! এক মুহূর্তের জন্য মাথা থেকে সব বেরিয়ে গেল বুঝি!
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশ থেকে মোবাইল নিয়ে স্ক্রিনে দৃষ্টি দিতেই অফিস থেকে কল দেখে দ্রুত পদে উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাগে কাপড় গুছানো শুরু করলো।
স্নেহা বুঝে উঠতে পারলো না কিছু। সে কিছু জিজ্ঞেস করার উদ্দেশ্যে মুখ খুলতেই আরিয়ান রাগী দৃষ্টিতে পাশে বসা স্নেহার দিকে তাকালো।
‘আজকে আমার তাড়াতাড়ি উঠতে হবে, ডেকে দিতে বলিনি !’
‘এতো ভোরে কই যাচ্ছ! আর ব্যাগই বা কেন গুছাচ্ছ!’
‘অফিসের কাজে আজকে শহরের বাইরে যাওয়ার কথা ছিল। ভোরে ভোরে রওনা দেওয়ার কথা ছিল। এক মুহূর্তের জন্য এটা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল।’ কাপড় গুছানো শেষ করে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে জবাব দিল আরিয়ান।
‘ আজ বিয়ের পরের দিন। বিয়ে করতে না করতেই অফিসের কাজে বাইরে যাচ্ছ…!’ স্নেহার কথায় আরিয়ান বিনিময়ে কোনো জবাব দেওয়ার কোনো প্রয়োজনবোধ মনে করলো না। সে সকালের নাস্তা তৈরী করতে বলে সজোরে ওয়াশরুমের দরজা আটকে দিল।
স্নেহা বিরক্ত-মাখা চেহারাই শোয়া থেকে উঠে বসলো। বিয়ের একদিন পার না হতেই ফরমায়েশ খাটা শুরু করে দিয়েছে। না চাইতেই ইচ্ছের বিরুদ্ধে স্নেহা উঠে দাঁড়ালো। তার কেন এতো কষ্ট করতে হচ্ছে! আরোহী আছে না! তাকে গিয়ে বললেই তো হলো। আরিয়ান বের হতে হতে ততক্ষনে নাস্তা তৈরী হয়ে যাবে। তখন না হয় নিজে রান্না করেছে বলে স্নেহাই নাস্তা বেড়ে দিবে।
স্নেহা দ্রুতপদে রুম থেকে বেরিয়ে গেস্ট রুমের দিকে পা বাড়ালো। রুমের দরজা ভেতর থেকে আটকানো। স্নেহা তা দেখে একবার মুখ বাঁকালো। জমিদারের মতো শুয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছে আর এদিকে স্নেহা ঘরের বউ হয়ে ভোরবেলায় উঠে যেতে হয়েছে। এখন থেকে তো আরোহীর আর অধিকার নেই যে বাড়ির বউ এর মতো পড়ে পড়ে সব করবে!
স্নেহা আর কিছু না ভেবে পরপর দুইবার ডাক দিতেই ওইপাশ থেকে আরোহীর মুখ ভেসে উঠলো। আরোহীর ফোলা ফোলা চেহারা দেখে স্নেহার হঠাৎ করে খারাপ লেগে উঠলো। এই বাড়িতে আরোহীর বিয়ের পর সে যতবারই আসতো, কোনোবারই আরোহীকে হাসি ছাড়া এমন শুকনো মুখে দেখেনি কিন্তু আজ হঠাৎ এই প্রথম।
‘কিছু লাগবে!’ শুকনো মুখে আরোহী জিজ্ঞেস করতেই স্নেহার ধ্যন ভাঙলো।
‘হ্যাঁ, বলছি কী। আরিয়ান অফিসের কাজে বাইরে যাবে তাই নাস্তা তৈরী করতে ডাকলাম। আর যাই বলো না কেন, এখন তো আর শুয়ে-বসে কাটাতে নিজের মনেও সাঁই দিবে না। অন্যের বাড়িতে শুয়ে-বসে থাকতে নিজের বিবেকেও তো বাধা দিবে।’ স্নেহা নিজের খারাপ লাগা দূরে রেখে আরোহীকে একনাগাড়ে কথাগুলো বলে উঠতেই আরোহী শুকনো মুখে হাসলো।
‘আচ্ছা, দ্রুত নাস্তা তৈরী করো।’ বলেই স্নেহা তরীঘরি করে প্রস্থান করলো। আর আরোহী মনে মনে আওড়ালো ‘অন্যের বাড়ি’। একদিন পার না হতেই কথাটি শুনতে হলো তার! শোনারই কথা। এখন থেকে তো এই ঘরে তার আর অধিকার নেই। এমনিও আর কয়দিনই বা আছে। থাক না বলে নিক।
আরোহী স্নেহার দিকে তাকালো। একটা মেয়ে হয়ে কিভাবে আরেকটা মেয়ের সংসারে আসে! অবশ্য, সে স্নেহাকে দোষ দেয় না কারণ দোষ তো তার কপালের।
সে আর কিছু না ভেবে রুম ছেড়ে বেরিয়ে রান্নাঘরে পা বাড়ালো। এই ঘরে সবকিছুই তার নিজের হাতে সাজিয়ে তুলেছিল কিন্তু নিয়তি বড়োই নিষ্ঠুর। একদিন আগেও যে সংসারের আনাচে-কানাচে তারই নাম উচ্চারণ হতো সেই সংসারের আনাচে-কানাচে আজ থেকে অন্য কারোর নাম উচ্চারিত হবে। হায় নিয়তি!
রান্নাঘরে গিয়ে আরোহী চুপচাপ নাস্তা তৈরী করে নিল। নাস্তা তৈরীর মাঝে একটুও স্নেহা আরোহীকে কিছু এগিয়ে দেয়নি, সে শুধু দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে উঁকি দিচ্ছে। আরোহী সেদিকে না তাকিয়ে চুপচাপ কাজ সেড়ে নিল। নাস্তা তৈরী করে টেবিলে রাখতে গেলে স্নেহা দৌড়ে আগ-বাড়িয়ে সেগুলো কেড়ে নিল।
‘বলছি কী, তোমাকে আর কাজ করতে হবে না। তুমি এইবার রুমে যেতে পারবে।’
আরোহী স্নেহার কারসাজি সব বুঝতে পেরেও কিছু বললো না। সে রুমের উদ্দেশ্যে জায়গা প্রস্থান করলো।
আরিয়ান ড্রয়ইং রুমে এসেই দেখলো স্নেহা নাস্তা বেড়ে দিচ্ছে। সে চেয়ার টেনে বসতেই তার মনে হচ্ছে তার পাশে স্নেহা নয়, আরোহী দাঁড়িয়ে আছে।
এতক্ষনে আরোহীর শাশুড়িও এসে পাশে বসলো।
তিনি টেবিলে চোখ ঘুরিয়ে নাস্তা দেখে অবাক হয়ে খুশি হওয়ার ভান করে বলে উঠল,
‘বাহ্! এতকিছু করে ফেললি! এতো কষ্ট করতে গেলি ক্যান!’
‘স্বামী আর শাশুড়ি মায়ের জন্যই তো করলাম। এতে কষ্ট কীসের!’
আরিয়ান কিছু না বলে চুপচাপ শুনে গেল। গেস্ট রুমের দিকে চোখ যাচ্ছে বারবার। গেস্ট রুমের দরজা ভেতর থেকে আটকানো।
‘মা, আরু কই! ওকেও খেতে ডাকো!’
‘কোথায় আবার! পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে হয়ত। এখন তো অন্যের ঘাড়ে বসে বসেই খাচ্ছে!’
আরিয়ান বিরক্তসূচক ‘চ-ক্রান্ত’ শব্দ করে খাওয়ায় মনোযোগ দিল। খাবার মুখে দিতেই সে একবার স্নেহার দিকে তাকালো,
‘এই খাবার…!’
‘আমি! আমি রান্না করেছি।’ আরিয়ানকে মাঝে পথে থামিয়ে স্নেহা খুশি হওয়ার ভান করে উৎফুল্ল কণ্ঠে জবাব দিল।
‘আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, এটা তুই না আরু বানিয়েছে!’
‘এসব কী বলছো তুমি। ও তো এখনো দরজাই খুলেনি আর আমার এতো কষ্টের রান্না করা খাবারকে তুমি আরোহীর নাম দিয়ে দিচ্ছ!’
‘ সত্যি না হলে তো এতো রিএক্ট করার তো কথা না। এতো দিন যাবৎ আরুর রান্না খেয়ে আসছি আর তুই একদিনেই এসব!’
‘আরু, আরু, আরু! এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। তুমি সব জায়গায় আমাকে ফেলে আরোহীকে টানছো কেন! বর্তমানে আমি তোমার স্ত্রী!’
‘তুই হয়ত ভুলে যাচ্ছিস আমার শর্তের কথা। তুই সবকিছু জেনে আরোহীকে মেনে নিতে পারলেই আমি বিয়ে করবো বলেছিলাম।’ বলেই আরিয়ান ব্যাগ নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।
স্নেহা আরিয়ানের শেষ কথায় চুপসে গেল।
আরিয়ান মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মেইন দরজার দিকে পা বাড়াতে নিতেই আবার পেছন ফিরে গেস্ট রুমের দরজার দিকে এক ফলক তাকালো। বিয়ের পর এরকম অফিসের কাজে আরিয়ান আরোহীকে বলা ছাড়া কোনোবার যায়নি। সে পেছন ফিরে গেস্ট রুমের দিকে পা বাড়ালো। পরপর কয়েকবার ডাক দিয়েও ভেতর থেকে কোনো সাড়া-শব্দ না আসাই আরিয়ান মলিন দৃষ্টিতে বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। সে ভাবলো – হয়ত আরোহী দরজা খুলতে অনিচ্ছুক।
#চলবে ইন শা আল্লাহ।