কলা পাতায় বাঁধিব ঘর পর্ব-১২+১৩

0
1067

#কলা পাতায় বাঁধিব ঘর
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_১২+১৩

হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে জনসমাগম। কেউ বসে আছেন ডাক্তার দেখাবেন বলে, কেউ বা ডাক্তার দেখাতে মা, বোন বা স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন। বড় বড় প্রাইভেট হাসপাতালগুলো ঝকঝকে তকতকে পরিষ্কার থাকে। কোথাও ময়লার টিকিটা ও থাকেনা।
পুষ্পকে নিয়ে প্রথমেই একজন গাইনোকলজিস্ট এর শরণাপন্ন হলো রাউফুন। পরিচিত ডাক্তারের স্ত্রী হওয়ার সুবাদে আচরণের দিকটায় আরও নম্রতা, মিষ্টিতা, কোমলতা পেলো পুষ্প।
খুঁটিনাটি প্রয়োজনীয় কিছু বিষয় সম্পর্কে অবগত হয়ে ডাক্তার হাফসা সানজিদা পরীক্ষানিরীক্ষায় গেলেন। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ আর তলপেটে অস্বাভাবিক ব্যথাটি স্বাভাবিক পিরিয়ডের ব্যথা নয়।
তিনি চেয়ার ঘুরিয়ে রাউফুনের মুখোমুখি হলেন। আপাতত পুষ্পকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজনীয় কথাবার্তা গুলো রাউফুনের সঙ্গেই সেরে নিচ্ছেন ডাক্তার হাফসা সানজিদা। দুহাত মুঠোবন্দী করে কনুইয়ে ভর করে হাতদুটো টেবিলে রাখলেন। সরাসরি চূড়ান্ত কথায় পৌঁছাতেই বললেন,

-“ডঃ রাউফুন আপনার ওয়াইফের মিসক্যারেজ হয়েছে। অনেকসময় মিসক্যারেজ হওয়ার যথাযথ কারণগুলো আমরা নির্ণয় করতে পারিনা। আপনার স্ত্রীর ব্যাপারটিও তেমন। আপনি একজন ডঃ। তাই আমার কথাগুলো আপনার বোঝার কথা।
অনেকগুলো কারণেই মিসক্যারেজ হতে পারে। তার মধ্যে কিছু কারণ হিসেবে আমরা যেসকল কারণকে প্রাধান্য দিই সেগুলো হলো,
বাচ্চার জন্মগত ত্রুটি- যেমন গর্ভধারণের সময় ভ্রূণ যদি অনেক বেশি অথবা কম ক্রোমোজম পায়, তখন ভ্রূণ ঠিকমতো তৈরি হয়না। ফলে মিসক্যারেজ হয়ে যায়। আবার মায়ের শরীর থেকে বাচ্চার শরীরে রক্ত সরবরাহ হওয়ার মাধ্যমে কোনো ত্রুটি থাকলেও মিসক্যারেজ হয়। অনেকসময় জরায়ুর ত্রুটি, অস্বাভাবিক আকৃতির কারণে বাচ্চা বেড়ে উঠতে না পেরে মিসক্যারেজ হয়।

তাছাড়াও মায়ের অসুস্থতা-যেমন কিডনি সমস্যা, ডায়াবেটিস, ব্লাড প্রেসার, বিভিন্ন ইনফেকশন থাকলে কিংবা মা যদি অতিরিক্ত পরিশ্রম ও অতিরিক্ত ভ্রমন করে থাকেন, তবে সে ক্ষেত্রে মিসক্যারেজ হতে পারে।

গর্ভকালীন সময়ে অনেক মায়েরই বিভিন্ন জিনিস খেতে ইচ্ছে করে। অনেকের মলম কিংবা সিগারেট ও খেতে ইচ্ছে করে। হাস্যকর হলেও সত্যি। এই ধরনের ব্যাপারগুলো থেকে অবশ্যই দূরে থাকা উচিত। সিগা’রেট, ম’দ্যপান, ক্যাফেইন গ্রহন, এন্টিবায়োটিক ঔষধ ব্যবহারে মিসক্যারেজ হতে পারে।
তাই বিবাহের পরবর্তী সময়ে পিরিয়ড মিস গেলে অবশ্যই সতর্কতা মেনে চলা উচিত। আপনাদের পরবর্তী সন্তান নেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আপনারা যদি অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ দেখে কালই নিয়ে আসতেন, তাহলে আমাদের চেষ্টা করার কিছু থাকতো।”

রাউফুন মনযোগ দিয়ে ডঃ এর কথা শ্রবণ করলো। ভেতর থেকে চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। সে সন্তানটির বাবা। না চাইতেও একটা খারাপ লাগা তাকে ঘিরে ধরেছে। যদিও ডাক্তারদের সবরকম পরিস্থিতিতে শক্ত হওয়া মানায়। তবুও ডাক্তারি পেশার বাইরে সম্পর্কগুলো কি বাঁধা মানে? সুপ্ত অনুভূতি গুলো কি গোপন করা যায়?
রাউফুন সবকিছু বুঝে নিয়ে পুষ্পকে রাখা কেবিনের পর্দা ঠে’লে ভেতরে প্রবেশ করলো। আজ আর রোগী দেখবেনা।
সুদীর্ঘ আখিজোড়া নিদ্রায় আচ্ছন্ন, হাতে ক্যানুলা ফিট করা। রক্তক্ষরণের ফলে গায়ের চামড়া শুভ্র হয়ে উঠলো। মলিন চোয়ালে মায়া মায়া ভাব। কাউকে তীব্রভাবে ভালোবাসলে তার সকল কিছুতেই মায়া খুঁজে পাওয়া যায়, হুটহাট তার যেকোনো রূপে প্রেমে পড়া যায়। এই মুহূর্তে রাউফুনের মনে তীব্র বাসনা জাগলো। ইচ্ছে করছে এই রোগা, জীর্ণ শরীরের অধিকারিণীকে তীব্র উৎকন্ঠায় বুকের সাথে মিশিয়ে নিতে। শুকনো মুখশ্রী উষ্ণ চুম্বনে ছুঁয়ে দিতে। বিনিময়ে তার অধর সুধার ছোঁয়া ললাটে স্থান করে নিতে।
রাউফুন মাকে ফোন করে ছোট করেই পুষ্পর মিসক্যারেজের ব্যাপারটা জানিয়ে দিলো। কিন্তু তিনি যে হাহুতাশ করে হসপিটালে পৌঁছে যাবেন, সেটা কে জানতো?

রোকসানা ছেলেকে ফোন করে কেবিন নাম্বার জেনে সোজা চলে এসেছেন। তিনি আরও একটি কাজ করলেন, পুষ্পর বাবার বাড়িতে খবর পাঠিয়ে দিলেন। তাদের তো মেয়ে। মেয়ের ভালোমন্দ খবর জানার অধিকার তাদেরও আছে। রাউফুন চাইছিলোনা সবাইকে টেনশন দিতে। ব্যাপারটা এখন জানানোতে সবাই যতটা প্যানিক করবে, হাসপাতালে এসে হৈচৈ করবে? পরে শুনলে ততটা হৈচৈ হতোনা। ঠান্ডামাথায় সব সামলে ওঠা যেতো। রাউফুনের মায়ের সাথে সাথে পুষ্পর বাড়ি থেকেও চাচা-চাচি সহ পুষ্পর মা ও এসেছেন। তার দাদুকে কেউ নিয়ে আসেনি। তিনি বসে বসে কান্নাকাটি করছেন আর নাতনির জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া চাইছেন। এরমাঝে খতম পড়ার নিয়ত করে ফেলেছেন।
আমরা বৃদ্ধ মানুষগুলোকে যতই অবহেলা করিনা কেনো, বিনিময়ে তারা আমাদের ভালোবাসা দিয়ে যায়। সবসময় তাদের দোয়া আমাদের উপর লেগে থাকে। রেহানা খালাকে দাদুর কাছেই রেখে আসা হয়েছে। উনিও চেয়েছিলেন আসার জন্য। কিন্তু নিয়ে আসা হয়নি।

সবাই পুষ্পকে দেখে শান্তনা বানী শুনিয়ে যাওয়ার শেষ সময়ে পুষ্পর মা পাশে বসলেন। দুহাতের মুঠোয় শক্ত করে তার হাত চেপে নিয়ে কন্ঠস্বর খাটো করে কোমল গলায় বললেন,
-“আমি তোমার মা হতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারিনি। তুমি হয়তো নিজের মায়ের জায়গা আমায় দিতে পারোনি। কিন্তু আমি মন থেকেই তোমায় সন্তানের জায়গায় আসন দিয়েছি। শুধু তোমার মা হতে পারবো বলে তোমার বাবার শর্তে আমি রাজি হয়ে যাই। নিজে কখনো গর্ভে সন্তান ধারণ করার কথা ভাবিনি। আমি জানি আমার একটি মেয়ে আছে। আমি তার মা নই, কিন্তু সে আমার মেয়ে। আমি আল্লাহর কাছে তোমার সর্বোচ্চ সুখ কামনা করি। তুমি দুচোখ মেলে সুখকে বরণ করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমায় উত্তম প্রতিদান দেবেন।”

পুষ্পর মা সন্তর্পণে ভেজা চোখজোড়া লুকিয়ে নিলেন। পৃথিবীতে হাজারো সুখী মানুষ অন্তরে দুঃখকে পুঁজি করে রাখে। তারমধ্যে পুষ্পর মা একজন। তিনি কোনো দো’ষ না করেও মাতৃত্বের স্বাদ নেওয়া থেকে বঞ্চিত। নামেমাত্র একটা সাংসারিক বেড়াজালে আবদ্ধ থাকলেও তিনি নিজেকে সুখী দাবী করতে পারেননা। নিজের স্বামীর কাছে কখনো মন খুলে ইচ্ছের কথা জানানোর সাহস পাননা। তিনি প্রথম স্ত্রী হারিয়ে নির্দয়, কঠিন মানবে পরিণত হয়েছেন। শুধু নিজের দিকটাই দেখলেন, কিন্তু পুষ্পর মায়ের দিকটা দেখলেননা, নিজের মেয়ের দিকটা দেখলেননা।

পুষ্পর আজ নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। ঢোক গলাধঃকরণ করে নিচুশব্দে শুধালো,
-“আমি সারাজীবন নিজের কাছে অপরাধী থাকবো। তোমার জীবনটা ভিন্ন হতে পারতো। তুমি একটি সুখী জীবন পেতে পারতে। আমার জন্যই তোমাকে এই সংসারে নিয়ে আসা, অথচ আমার কাছ থেকেই তুমি সামন্যতম গুরুত্ব পাওনি। বিশ্বাস করো তোমার প্রতি আমার কেনো অভিযোগ নেই। শুধু আমার মায়ের জায়গায় আমি তোমাকে বসাতে পারিনি। আমাদের সম্পর্কটি আরও সুন্দর হতে পারতো। যদি বাবা আমাদের দুজনকেই কাছে টানতো।”

পুষ্পর মা তার চুলের ভাঁজে হাত গলিয়ে বললেন,
-“এখনও তো সময় আছে। আমি তোমার মা আছি।”

পুষ্প চোখ বুঁজলো। নেত্রজোড়ার ধার ঘেষে নোনাজল গড়িয়ে পড়লো।

সবাই বেরিয়ে গেলো। পুষ্পর মাথার কাছে টুল নিয়ে বসলো রাউফুন। ডানহাতে পুষ্পর জীর্ণ হাতখানা ধরে অপরহাত চুলের ভাঁজে রাখলো।
পুষ্প নেত্রপল্লব খুললো। রাউফুনের মুখের দিকে কিছুসময় তাকিয়ে শব্দহীন ভাবে শরীর কাঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। রাউফুন শক্ত থেকে পুষ্পকে সামলে চললো। তার কন্ঠস্বর কখনো রূঢ় নয়। সর্বদাই সে কোমলতার সহিত কথা বলতে পছন্দ করে। কন্ঠস্বর খাদে নামিয়ে একটু খানি ভালোবাসা, একটুখানি আদর ঢেলে দিলো গলায়। কোমলতা,নম্রতা, ভালোবাসার মিশ্রণের শুধুলো,

-“আমার সুখসয্যা সঙ্গিনী, বৃদ্ধ বয়সের সাথী, আমার প্রিয় নারী, বিষাদ মুহূর্তে একটুখানি সুখের কারণ তুমি। জীবনে ভেঙে পড়া মানায়না। আমাদের জীবনটা শেষ হয়ে যায়নি, চাওয়া-পাওয়া গুলো পূরণ হওয়ার জন্য প্রচুর সময় রয়েছে।
জীবনটাকে উপভোগ করো। জীবন উপভোগ বলতে আমরা আনন্দ আর সুখকে বুঝি। জীবনের কিছু কিছু সময় আল্লাহ আমাদের পরীক্ষায় ফেলে জীবনকে উপভোগ করতে শেখায়। মূলত সুখ হলো দুঃখের বিপরীত একটা সুন্দর সংজ্ঞা। দুঃখ না থাকলে সুখ উপলব্ধি করা যায়না। জীবনের স্বাদ আস্বাদন করতে হলে সুখের সাথে দুঃখকেও বরণ করে নিতে হয়। জীবন তখনই উপভোগ করা যায়, যখন সুখের সাথে সাথে দুঃখের ও স্বাদ নেওয়া যায়।
আমি চাইনা তুমি কঠিন হয়ে যাও। আমি চাই তুমি নিজের মাঝে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে শেখো।”

পুষ্প রাউফুনের হাতের পিঠে ঠোঁট ছুঁইয়ে ধরা গলায় বলল,
-“এতবার কেনো আল্লাহ আমায় পরীক্ষায় ফেলেন? জানেন? আমার মা বলে যাকে জানেন, তিনি আমার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী। আমার মা আমার ছোটবেলায় মা’রা যান। বাবাকে কাছে পাইনি, এই পর্যায়ে এসে মাতৃত্বের স্বাদ পাওয়ার আগেই হারিয়ে বসলাম। কিছুই কি আমার নেই?”

রাউফুন যতনে পুষ্পর হাত বুকের সাথে মিশিয়ে পুষ্পর ললাটে গভীর চুমু খেয়ে বলল,
-“আছি, তোমার আমি আছি। এই মানুষটা একান্ত তোমার, কেবল তোমার ব্যক্তিগত মানুষ।”

পুষ্প ভীষণ আদরে গুটিয়ে গেলো, নিজেকে মিইয়ে নিয়ে একটুখানি সান্নিধ্য পাওয়ার আশায় রাউফুনের দিকে ঝুঁকে গেলো।
রাউফুন মৃদু হেসে বলল,
-“এটা হসপিটাল। বাড়িতে গেলে নিজের প্রাপ্যটা বুঝে নিও।”

পুষ্প মুখ ভার করে বলল,
-“বাড়ি ফিরবো কখন?”

এ পর্যায়ে রাউফুন শব্দ করেই হাসলো।
#চলবে……

#কলা_পাতায়_বাঁধিব_ঘর
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_১৩

পুষ্পর বাবার বাড়ি থেকে লোকজন এসেছে তাকে দেখতে। আজ সাথে করে দাদু আর রোহানা খালাকেও নিয়ে এসেছে। আরেকটা বিষয় হলো পুষ্পর বাবা ছুটিতে ছুটে এসেছেন মেয়েকে দেখতে। রিশা আজ আর ভার্সিটিতে যায়নি। ঘরেই ফোন দেখতে দেখতে একটা চকলেট নিয়ে বসলো। অবশিষ্ট অংশ মুখে দিতেই নাবিল আসলো।

-“তুমি কি খাও রিশা আপু? দেখি হা করো।”

রিশা মেকি হেসে বলল,
-“আমি বি’ষ খাই।”

নাবিল অবুঝ বাচ্চা বলল,
-“তাহলে আমাকেও বিষ দাও।”

রিশা একটা চকলেট নিয়ে ধরিয়ে দিলো নাবিলের হাতে। নাবিল মানলোনা। তার বিষ চাই। সে ও রিশা আপুর মতো বি’ষ খাবে। রিশা কপাল চাপড়ে বলল,
-“ছোট্ট জামাই, এটাই বিষ।”

নাবিল কান্নাকাটি শুরু করলো। কেঁদে কেঁদেই বলল,
-“মিথ্যে বল কেনো? এটা চকলেট। তুমি আমাকে বিষ দাও। আমি বি’ষ খাবো।”

নাবিলের চিৎকার চেঁচামেচিতে সবাই এসে জিজ্ঞেস করলো “কী হয়েছে?”

রিশা অসহায় মুখ করে ঘটনার বিস্তারিত বলল। রাউফুন নাবিলকে কোলে নিয়ে বলল,
-“চলো শালাবাবু। আমরা দুজনে মিলে বি’ষ খাবো।”

নাবিল রাউফুনের সাথে গেলো।
একগ্লাস জুস ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-“এটাই বি’ষ।”

নাবিল গ্লাস দূরে সরিয়ে বলল,
-“এটা তো জুস।”

রাউফুনের মুখ পাংশুটে বর্ণ ধারণ করলো।
-“আরে ভাই জুসের সাথে বিষ গুলে মিশিয়ে দিয়েছি।”

নাবিল এক ঢোকে গ্লাস খালি করে দিয়ে নিজের কাজে চলে গেলো। আবার ফিরে এসে বলল,
-“দুলাভাইয়া, বি’ষ মজা ছিলো। আমাকে আবার পরে দিও।”

রাউফুন ঠোঁট চেপে হাসি আটকানোর চেষ্টা করলো। নাবিলের বাবা শব্দ করে হেসে ফেললেন। সাথে রাউফুন ও যোগ দিলো।

★★★

ঘরের দরজা বন্ধ করার শব্দ পেয়ে পেছন ফিরলো পুষ্প। বিস্ময়ে হতবাক হলো চোখজোড়া। বাবা এসেছেন? পুষ্প চোখেমুখে বিস্ময়ের রেশ রেখেই প্রশ্ন করলো,

-“আপনি আমার ঘরে? দরজা বন্ধ করলেন কেনো?”

মীর হোসেন মেয়ের পাশে বসলেন চুপচাপ। মাথায় হাত রাখতে নিলেই পুষ্প সরে বসে। তাচ্ছিল্য করে বলল,
-“যখন মাথায় হাত রাখার কথা ছিলো, তখন তো রাখেননি?”

মীর হোসেনের দৃষ্টি নত। কন্ঠস্বর খাটো করেই বললেন,
-“এই বাবা মানুষটাকে কি ক্ষমা করা যায় না? আমি নিজের কর্মের জন্য সত্যিই অনুতপ্ত। বাবা অনেক কষ্ট দিয়েছি তোমাকে। আমার ছোট্ট পুষ্প মাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আজ ক্ষমা চাইতে এসেছি মা।
তোমার মায়ের মৃ’ত্যুর খবর আমি মেনে নিতে পারিনি। নিজের অন্যায়ের ক্ষমাটুকু চাওয়ার সুযোগ তোমার মা আমায় দেয়নি। তখন আমি দিশেহারা ছিলাম। আমি বুঝিনি আমার অবহেলা আমার মেয়ের উপর কতটা প্রভাব ফেলবে। আমাদের বাবা মেয়ের সম্পর্কের মধ্যে কতটা দূরত্ব সৃষ্টি করবে।”

মায়ের কথা ওঠায় দু-চোখ ভরে উঠলো। পুরনো অভিমান মাথা চাড়া দিলো। রাগ মিশ্রিত গলায় ফোঁপাতে ফোপাঁতেই বলল,
-“আপনি আমার মাকে কষ্ট দিয়েছেন, আপনি আমাকে কষ্ট দিয়েছেন, এখন আবার নিজের স্ত্রীকে কষ্ট দিচ্ছেন। কেনো? কেনো সবাইকে কষ্ট দিয়ে পাপের বোঝা বাড়িয়ে তুলছেন? আজ আপনি কেনো এসেছেন? যখন আমার আপনাকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিলো, তখন আপনি ছিলেননা। একটা বাচ্চার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মা-বাবা। মাকে হারিয়ে সেই বাচ্চা কার কাছে যাবে? কাকে চাইবে? নিশ্চয়ই বাবাকে তাইনা? কিন্তু আমি আপনাকে পাইনি। আমি মানছি আপনার কৃতকর্মের জন্য আপনি অনুতপ্ত। আমার মায়ের কাছে ফিরে আসার পূর্বেই মাকে হারিয়েছেন। কিন্তু একই অন্যায় আপনি আমার সাথে করলেন। আমাকে দূরে ঠেলে দিলেন।
আমি কি একবার ও বলেছি, আপনারা কোনো সন্তান নিতে পারবেন না? তাহলে আপনার স্ত্রীকে কেনো মাতৃত্বের স্বাদ থেকে বঞ্চিত করেছেন? আমি এখন বুঝতে পারছি মা হতে না পারলে কতটা কষ্ট লাগে। আমার ভাগ্য অতি উত্তম। আমি সৌভাগ্যবতী বলে রাউফুনের মতো মানুষকে পেয়েছি। যে আমার পাশে থেকে আমাকে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে। আর আপনার স্ত্রী? তিনি সেই পাশের মানুষটির কাছ থেকেই নিঃসন্তান হওয়ার শর্ত পেলো। আপনি কতটা ভুলের ক্ষমা চাইবেন বলুনতো? একটা ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে না পেরে আপনি বারবার অন্যায় করে গিয়েছেন।
আমার কথাগুলো তেঁতো লাগছে? লাগবেই তো।
এসব করে কি লাভ হচ্ছে? নিজে শান্তি পাচ্ছেন তো? আপনার কষ্ট হচ্ছেনা? হচ্ছে, কষ্ট ঠিকই হচ্ছে। তাহলে কেনো এমন করলেন?”

মীর হোসেনের চোখের কোনে পানি জমা হলো। নিজেকে এখনো শক্ত রাখতে চাইছেন। শেষ বয়সে এসে সন্তানের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য মন আকুপাকু করে, একজন নিজস্ব সঙ্গী দরকার। যার সাথে মন খুলে সুখ-দুঃখ গুলো ভাগ করা যাবে। কিন্তু নিজের কর্মের কারণেই সেই পথা খোলা নেই। এবার চোখের পানিতে কপোল ভিজলো। মীর হোসেন বললেন,
-“কী করলে আমার ক্ষমা মিলবে?”

পুষ্প ফুঁপিয়ে উঠে বলল,
-“আপনার বর্তমান মানুষটাকে ভালোবাসুন। আমার মাকে সুখে রাখতে পারেননি। উনাকে সুখে রাখুন। আমার আর কিছুই চাওয়ার নেই।”

মেয়ের কপালে দীর্ঘসময় নিয়ে চুম্বন করলেন মীর হোসেন। পুষ্প বাঁধা দিলোনা। কতগুলো বছর পর বাবার সেই আদুরে ছোঁয়া পাচ্ছে।
মীর হোসেন বললেন,
-“তুমি কি আমায় একটা চার্ট তৈরি করে দেবে? আসলে আমি এখনো বুঝতে পারছিনা কিভাবে চলবো।”

পুষ্প ক্ষেপে গেলো।
-“আমি কি চার্ট তৈরি করার চাকরি নিয়েছি? ভালোবাসিনা আমি আপনাকে। যান এখান থেকে। আমার কাছে আর আসতে হবেনা কাউকে।”

মীর হোসেন দুর্বোধ্য হাসলেন। আস্তে আস্তে মেয়ের রাগ ঠিকই নামবে। কয়েকদিন একটু রাগ দেখাবে। আজ ভেতরটা শান্তি লাগছে। কতগুলো বছর নিজের ভেতরে সবটা পুষে রেখেছেন। মেয়ের কাছে ক্ষমা চাইতে পেরে নিজেকে ভারমুক্ত লাগছে। কথা বলিয়ে দেওয়ার কাজটা রাউফুন করেছে। মেয়ের জন্য যোগ্য কাউকে পেয়ে গর্বে বুক ফুলে উঠলো তার। বাবাকে বেরিয়ে যেতে দেখে পুষ্প আড়চোখে তাকালো। পরপরই রাউফুন ভেতরে ঢুকলো।
হন্তদন্ত হয়ে ব্যস্তগলায় বলল,
-“কি সাংঘাতিক! কি সাংঘাতিক! পুষ্প? তুমি কি আমায় দেখতে না পেয়ে কেঁদেছো? এত বর পাগল হলে কি হয়? লোকে আমায় লজ্জা দেবেতো। সবাই বলবে কি জাদু করেছিস বউকে?”

পাশ থেকে বালিশ নিয়ে ছুড়ে মা’রলো পুষ্প। রাউফুন ক্যাচ তুলে নিয়ে বলল,
-“আশ্চর্য! তুমি লজ্জা পাচ্ছো কেনো? লজ্জা পেলে বুঝি বরকে হিট করতে হয়?”

পুষ্প কটমট করে বলল,
-“আপনাকে আমি বলেছি, আমি আপনাকে না দেখতে পেয়ে কাঁদছি? কি এমন মানুষ, তাকে না দেখতে পেলে আমাকে নাকি কাঁদতে হবে।”

রাউফুন তীক্ষ্ণচোখে তাকিয়ে মুখ খুলতে নিলেই পুষ্প থামিয়ে দিয়ে বলল,
-“আর একটা কথাও বলবেননা। যান বের হন।”

রাউফুন দরজার কাছে গিয়ে লক করে আবার ফিরে এলো। গলার স্বর খাদে নামিয়ে একটু কাছে ঝুকলো রাউফুন।
-“তোমার নজর দেখছি এখন আর পড়েনা আমার উপর। মাথায় কী চলছে?”

পুষ্প আড়চোখে তাকিয়ে বলল,
-“সারাদিন হাসপাতালে থাকলে কার নজরে পড়বে?”

রাউফুন আরেকটু ঘনিষ্ঠ হলো।
-“ছুটি নেবো? ঘুরতে যাবে? তোমারও মন ফুরফুরে হলো আর আমার ও একটু পাত্তাটাত্তা পাওয়া হলো।”

কোলের উপর রাউফুনের মাথা তুলে নিয়ে চুলের ভাঁজে হাত গলিয়ে দিলো পুষ্প। আহ্লাদী স্বরে বলল,
-“কবে ছুটি নেবেন?”

-“কবে ছুটি নিতে বলছো? তুমি যখন বলবে তখনই নেবো।”

পুষ্প বলল,
-“আমার তো মন চাইছে আজই ঘুরতে চলে যাই।”

রাউফুন ভাব নিলো কিছুটা। বলল,
-“ছুটি নিয়ে ঘুরতে নিয়ে যেতে পারি একটা শর্তে?”

-“এখন আবার কী শর্ত?”

-“বেশি কছুনা, ওই এখন একটু আদর-টাদর করে দিলেই হবে।”

হেসে ফেললো পুষ্প। রাউফুনের ইচ্ছে পূরণ করতেই এগিয়ে গেলো। দুগালে শক্ত করে চুমু দিয়ে বলল “হয়েছে?”

রাউফুন যেনো আকাশ থেকে পড়লো এমন একটা রিয়াকশন দিয়ে বলল,
-“কি আশ্চর্য! তুমি এখনো আমায় ছুঁয়েছো নাকি?”

এই বলে পুষ্পর পুরোমুখে নিজ অধর ছোঁয়া দিয়ে বলল -“এখন ঠিক আছে।”

পুষ্প হাসলো শুধু।

★★★

রিশা নাবিলের মাকে বলল,
-“শাশুড়ী আম্মা তোমার ছেলের সাথে বিয়ে দিবে কবে? আমি তো বুড়ি হয়ে যাচ্ছি।”

নাবিল মায়ের পেছনে লুকিয়ে বলল,
-“আমি বড় হলে বিয়ে করবো।”

রিশা দুষ্টুমি করে বলল,
-“কিন্তু তখন যে আমি বুড়ি হয়ে যাবো? আমার দাঁত পড়ে যাবে?”

নাবিলের মা বলল,
-“সমস্যা নেই, আমরা দুইটা বউ রাখবো। একজন বুড়ি হলেও সমস্যা নেই।”

দুটো বউয়ের কথা শুনে নাবিল লজ্জা পেয়ে মায়ের সাথে আরও মিশে গেলো। পুষ্প সোফায় বসা ছিলো। সে বলল,
-“কাকি এখনই বিয়ে দিয়ে দাও। রহিম-রূপবান এর মতো তোমার ছেলেকে লালন-পালন করে বড় করবে।”

★★★

রাউফুন হসপিটাল থেকে ছুটি নিলো কিছুদিনের জন্য। এমনিতেও বিয়ের পর তারা দূরে কোথাও বেড়াতে যায়নি।
পুষ্প আগে থেকেই সব গোছানো শুরু করেছে। গতকাল রাউফুন বাসায় ফেরার সময় পুষ্পর জন্য শপিং করে এনেছে। সেখান থেকে সবগুলো জামা-শাড়ি ট্রলিতে ভরে নিয়েছে। দুজনের জামাকাপড় গোছগাছ করে রাউফুনকে কল দিলো।

-“আমি কি এখন রেডি হবো?”

-“হ্যাঁ, আমার আসতে আর ২০ মিনিট লাগবে। তোমারতো সময় লাগবে রেডি হতে।”

পুষ্প চট করে একটা কফি কালার শাড়ি পড়ে নিলো। বাকি সাজগোছের জন্য ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে পড়লো।
★★★
পুষ্পর ইচ্ছেতেই তারা কক্সবাজার এসেছে। পুরোরাস্তা উপভোগ করতে করতেই এসেছে পুষ্প। ভ্রমনের সময় তার একটুও ঘুম পায়না। এখানে এসেই বিছানায় পড়লো। আর ওঠাউঠির নাম নেই। তাকে ওঠাতে না পেরে রাউফুন নিজেও পুষ্পকে জড়িয়ে শুয়ে পড়লো।

#চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে