#কলঙ্ক
#২৫_তমো_পর্ব
#অনন্য_শফিক
‘
‘
দিন যাচ্ছে। খুব দ্রুত দিন যাচ্ছে। ইউনিভার্সিটি আবার খোলা হয়েছে।ক্লাস করছি রেগুলার।দু একদিনের ভেতর রেজাল্ট হবে।আমি জানি ভালো পরীক্ষা দিয়েছি। রেজাল্ট ভালো হবে ইনশাআল্লাহ। তবুও ভয় করে।স্যার ম্যামরা যদি ভুল করে নম্বর কম দেন!
এখন আর পড়তেও মন বসে না। শুধু চিন্তা হয়। রেজাল্ট নিয়ে চিন্তা।
মেহরাব দু’দিন আগে ফোন করেছিল।সে জিজ্ঞেস করেছিলো,’ রেজাল্ট কবে?’
আমি বললাম, ‘চারদিন পর।’
তারপর সে বললো, ‘তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। তবে পরীক্ষায় ফার্স্ট হলেই কেবল এই সারপ্রাইজ পাবে তুমি!’
আমার তখন থেকেই মন কেমন করছে।বুক ধড়ফড় করছে।আমি এখন সর্বক্ষণ উদগ্রীব হয়ে থাকি।মনে মনে আল্লাহকে ডাকি।বলি,আল্লাহ,দেও না আমায় ফার্স্ট বানিয়ে!প্লিজ আল্লাহ প্লিজ!
কতদিন নামাজ পড়া হয় না। এখন নামাজ ধরেছি। কোরান পড়েছিলাম ছোট বেলায়। তারপর আর পড়া হয়নি। গতকাল থেকে আবার পড়া ধরেছি।না এসব যে রেজাল্টের জন্য করছি তা না। মনকে প্রশান্ত করার জন্য। অবশ্য এতে কাজও কিছুটা হয়েছে।মন প্রশান্ত হয়েছে।
আমি জানি, এবং এটা তোমাদেরও জানা উচিৎ।যে তুমি যে ধর্মেরই হও না কেন তুমি যদি তোমার ধর্মের প্র্যাকটিসিং কাজগুলো নিয়মিত করো তবে তোমার অস্থির মন প্রশান্ত হবেই!
‘
সন্ধ্যা বেলায় শুয়ে আছি বিছানায়। শিশির ভাইয়া খোঁচাতে এসেছিল আমায়। পাত্তা পায়নি।
অবশ্য আমায় কথা বলাবার জন্য কম চেষ্টা করেনি।
একবার বলেছে, এই শোন, আমার মনে হচ্ছে কী জানিস?তুই এই পরীক্ষায় লাড্ডু পাবি!
আমার তরফ থেকে কোন জবাব না পেয়ে বেচারা অন্য উপায় বের করলো।
বললো,’তূর্ণা,একটা কাজ করে দে না আমার প্লিজ!আসলে তোর কাছে এসেছি এই কাজটার জন্যই। আমার না গার্লফ্রেন্ডের সাথে প্রচন্ড ঝগড়া হয়েছে আজ। ঝগড়া করে ওকে একটা চড়ও দিয়েছি। তারপর কোন কথা না বলে চলে এসেছি।জানি না ওর অবস্থা এখন কী! আমার মনে হয় ওর একটা কী দুটা দাঁত পড়ে যাওয়ার কথা।তুই কী একটু ওর ফোনে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করবি ওর কয়টা দাঁত পড়েছে?’
শিশির ভাইয়ার এই কথাটা শুনে আমার ভীষণ হাসি পেয়েই যাচ্ছিল। কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেকে আমি স্থির করে রাখলাম।
শিশির ভাইয়া ব্যর্থ হয়ে স্থান ত্যাগ করলো।
ও চলে যাওয়ার পর দরজা আটকে দিয়ে আমি অনেকক্ষণ ধরে একা একা হাসলাম।
আসলে শিশির ভাইয়া অসাধারণ একটা মানুষ।সে ইচ্ছে করলেই আমায় এভোয়েড করতে পারতো। কিন্তু করেনি।বোনের মতো দেখেছে আমায়। বন্ধুর মতো পাশে থেকেছে।আর কতো সাবলীলভাবে যে আমার ভুল আর আবেগগুলোকে আস্তে আস্তে কাটিয়ে তুলতে চেয়েছে!তুলেছেও অনেকটা।ওর সাথে কথা বলি না ঈদুল ফিতরের দিন সন্ধ্যা থেকেই।প্রায় পঁচিশ দিন হয়ে গেছে।ও বারবার চেষ্টা করে কথা বলতে।আমি ইচ্ছে করে কথা বলি না। তবে আমার মন থেকে কোন রাগ নেই ওর প্রতি। আমার ভালো লাগে ওর মজার মজার কথাগুলো। আমার কেন জানি মনে হয় আমি যদি ওর সাথে রাগ ভেঙে কথা বলে ফেলি তবে সে আর আমার সাথে মজা করতে আসবে না। মজার মজার কথাগুলো তার মুখ থেকে আর শুনতে পাবো না!
‘
রাতে খাওয়ার পর ম্যাম বললেন,’তূর্ণা, তোমাকে আজকাল এমন চিন্তিত মনে হয় কেন?’
আমি মৃদু হাসার চেষ্টা করি।বলি,’কই? না তো!’
ম্যাম বলেন,’মার চোখ কী ফাঁকি দেয়া যায়?কী হয়েছে তোমার বলো তো?’
আমি কিছু বলি না।চুপ করে থাকি।
শিশির ভাইয়া তখন ম্যামের কাছে এসে বলে,তার পরীক্ষার রেজাল্ট। বেচারি ভয়ে তটস্থ।মনে হচ্ছে এবার ফেল মারবে!’
ম্যাম তখন শিশির ভাইয়ার মাথায় এক চাটি দেন। তারপর বলেন,’এখান থেকে ভাগ তো তুই।যতোসব অলোক্ষুণে কথা! আমার মেয়ে ফার্স্ট হবে দেখিস!’
শিশির ভাইয়া দরজা দিয়ে বের হয়ে যেতে যেতে বলে,’ও ফার্স্ট হলে আমি ওকে সুমদ্র দেখিয়ে আনবো মা।কথা দিলাম।আর হতে না পারলে ওকে এক প্লেট তেলাপোকা বাজি খাওয়াবো বললাম।মনে থাকে যেনো!’
ম্যাম হাসেন।বলেন,’পাগল ছেলে!’
শিশির ভাইয়া চলে যাওয়ার পর ম্যাম আমায় বলেন,’তোমার কাছে একটা আবদার আছে আমার। তুমি রাখবে তূর্ণা?’
আমি বলি,’কী আবদার বলুন ম্যাম।রাখবো। ‘
ম্যাম তখন আমার দিকে কেমন মায়া মায়া চোখে তাকান। তারপর আমার একটা হাত ধরে বলেন,’আমায় মা বলে ডাকবে তুমি?’
আমি জানি না আমার কী হয়েছে! হঠাৎ ম্যামকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলি।
ম্যাম আবেগতাড়িত গলায় বলেন,’ডাকবে কি না বলো?প্লিজ বলো!’
আমি কান্নার জন্য কথা বলতে পারি না।দম আটকে আসে। তবুও বলি। কাঁদতে কাঁদতে বলি,’আমি আপনাকে মা বলেই ডাকবো।মা, আপনি কী আমায় তুই করে ডাকবেন? মায়েরা তো তার মেয়েকে তুই করেই ডাকেন না!’
ম্যাম তখন কান্নাভেজা গলায় বলেন,’ডাকবো।তুই করে ডাকবো । এখন থেকে তুমি আমার তুই।’
আমি মাকে জড়িয়ে ধরি।জন্মধাত্রী মা নন।আলোকদাত্রী মাকে।
‘
রেজাল্ট হয়েছে। আমি রেজাল্ট দেখতে যাইনা।ঝিম মেরে বসে আছি ক্লাস রুমে।সবাই যাচ্ছে।তারা অবশ্য আমায় যাওয়ার জন্য তাড়াও করেনি।তাড়া করার কোন কারণও নাই। ওদের চোখে আমি ক্লাসের টপার কোন ছাত্র না!
ক্লাসরুমে বেঞ্চির উপর বসে থেকে ভয়ে ধুঁকছি।
সাহস হচ্ছে না বোর্ডের কাছে যাওয়ার।ওদের সাথে গিয়ে দেখি যদি আমার রেজাল্ট খারাপ হয়েছে এই ভয়ে যাচ্ছি না।
হঠাৎ আমার বন্ধু উর্মি এসে আমায় অবাক করে দিয়ে বলে,’টপাররা আগে থেকেই জানে তার রেজাল্ট কী হবে! এই জন্য একা একা শান্তশিষ্ট হয়ে রেজাল্ট না দেখে ক্লাসরুমেই বসে থাকে!’
আমি কিছু বুঝতে পারি না । ভয়ে ভয়ে বলি,’আমার রেজাল্ট কী হয়েছে রে?’
উর্মি বলতে যাবে কিন্তু এর আগেই ক্লাসের প্রায় সবাই হুল্লোড় করতে করতে আসে এদিকে।কেউ কেউ এসে আমায় জাপটে ধরে।আর বলাবলি করতে থাকে,কী কারিশমা দেখালি রে তূর্ণা!তুই একটা বই লিখে ফেল।শর্ট টাইমে ক্লাসে ফার্স্ট হওয়ার উপায়!’
ওদের কথা শুনেও আমার বিশ্বাস হতে চায় না।আমি তখন ক্লাস রুম থেকে বের হয়ে বোর্ডের কাছাকাছি যাই। তারপর আমার রেজিঃ নম্বর খুঁজে বের করি। তারপর চোখ ভিজিয়ে কেঁদে উঠি।আমি ফার্স্ট হয়েছি। সিজিপি এ – প্লাস আসেনি। কিন্তু একেবারে কমও হয়নি।
বোর্ডের কাছ থেকে আমার তখন সড়তে ইচ্ছে করে না। ওখানে দাঁড়িয়ে গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এখানে শব্দ করে কাঁদা যাবে না।তাই আমি চুপি চুপি কাঁদি।আর তখন আমার পিঠের উপর কারোর একটা কোমল হাতের স্পর্শ পেয়ে পেছনে তাকাই।মা এসেছেন। আমার আলোকদাত্রী মা।
মা বললেন,’খুশি তো?’
আমি সঙ্গে সঙ্গে মাকে জড়িয়ে ধরি। কাঁদতে থাকি মার বুক ভিজিয়ে।মা আমার পিঠে আর মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। তারপর বলেন,’মেহরাবকে ফোন করে জানিয়ে দে।আমি শিশির ছাগলটাকে খবরটা দেই।ওর তো আবার তোকে সমুদ্রে নিয়ে যাওয়ার কথা!’
‘
মেহরাব আমার ফোন রিসিভ করলো না। পরপর তিনবার ফোন করার পর চতুর্থ বার যখন ফোন করলাম তখন কল হয় না।সুইচ অফ জানায়। আমার তখন খারাপ লাগে। কান্না আসে আবার!
মা আমার দিকে তাকিয়ে বলেন,’কী হয়েছে ? ফোন ধরেনি?’
আমি বলি,’না মা। তিনবার কল হয়েছে। এখন সুইচ অফ করে ফেলেছে।মা আমার সাথে ও এমন করছে কেন?কত আশা করে ফোন করেছি রেজাল্ট জানাবার জন্য!’
মা আমায় সান্তনা দেন। বলেন,’হয়তোবা এখন সে বিজি আছে।সময় হলে ঠিকই ফোন দিবে দেখিস। এখন শোন, শিশিরকে ফোন দেয়ার পর ও হ্যালো বলার আগেই কী বললো জানিস?’
আমি বললাম,’কী বললো?’
বললো,’তূর্ণাকে নিয়ে আমি সমুদ্রে যেতে পারবো না। আরেকজনের হবু বউ নিয়ে আমি সমুদ্রে যাবো কোন দুঃখে!’
আমি মন খারাপ করি না এতে। সমুদ্র দেখার খুব একটা শখ নাই আমার। সমুদ্র তখন দেখবো যখন আমি সফল হবো।এর আগে নয়।
‘
বাসায় যাই প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে। কিন্তু গিয়ে চমকে উঠি।গেইট খুলে ভেতরে ঢুকতে যাবো ঠিক তখন হঠাৎ কেউ একজন খপ করে আমার হাত ধরে ফেলে ভেতর থেকে।আমি ভীষণ রকম ভয় পেয়ে ভেতরে চোখ রাখতেই দেখি মেহরাব।মেহরাবকে দেখে খুব রাগ হলো আমার। এমনিতেই ওর প্রতি আমার অভিমান জমে আছে। ওকে ফোন দিলাম কতোবার রিসিভ করেনি।
আমার খুব ইচ্ছে করছে ওর বুকের উপর এলোপাথাড়ি কিল ঘুষি মারতে। কিন্তু তা আর এখন করতে পারছি না। আমার সাথে মা আছে। তাছাড়া এটা করাও আমার ঠিক হবে না।মেহরাবের সাথে আমার প্রেমের সম্পর্ক নাই।ও আমায় এখনও ভালোবাসে না। একদিন বাসবে বলেছে।
মা মেহরাবের সাথে কথা বলেন না। চুপিচুপি ঘরে চলে যান।
আমি তখন আবেগপ্রবণ হয়ে মেহরাবকে বলি,’ফোন ধরোনি কেন?’
মেহরাব হাসে। হেসে বলে,’ভুলে গেছো?আমি তো আগেই বলেছিলাম তুমি ফার্স্ট হলে আমি তোমায় সারপ্রাইজ দিবো।এই তো সারপ্রাইজ দিলাম।বাড়ি থেকে তোমার জন্য ঢাকায় এসে গেছি। ফোন রিসিভ করলে তো অতটা অবাক হতে না তাই না?’
আমি কথা বলি না। আমার চোখ কেমন ছলছল করে। আবার কান্না পাচ্ছে। এখন কিছুতেই কাঁদা যাবে না।না না না।
‘
মেহরাব বলে,’আসো পুকুর পাড়ে যাই!’
আমি অবাক হয়ে বলি,’এখানে আবার পুকুর পাড় কোথায় পাবে?’
মেহরাব বলে,’আছে।আমি চিনি।আসো আমার সাথে।’
বলে সে আমায় একটু দূরে একটা পুকুরের কাছে নিয়ে যায়। তারপর ওই পুকুরের পাড়ে আমায় বলে,’তূর্ণা, তুমি চোখ বন্ধ করো তো একটু!’
আমি কিছু বলি না।ওর নির্দেশ পালন করি।
এরপর অনুভব করি ও আমার হাতের আঙুলে কিছু একটা পরিয়ে দিচ্ছে। আমার শরীর তখন কেমন শিরশির করতে থাকে। বুকের ভেতরটা কেমন দা দ্রিম দ্রিম করে বাজতে থাকে।
মেহরাব এবার বলে,’প্লিজ! ওপেন ইউর আইস।’
আমি চোখ খুলি।চোখ খুলতেই দেখি ও আমার হাতের অনামিকায় রিং পরিয়ে ওই আঙুল ধরেই এখনও হাঁটু গেড়ে বসে আছে।
আমি লজ্জা পাই।কান্না পায় আমার।
আমি ওর দিকে তাকাই জলভরা চোখে। তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় বলি,’কী চায়?’
মেহরাব তখন বলে,’তোমাকে।’
‘
সে রাতে আরেকটা অদ্ভুত কান্ড করেন মা।
‘
#চলবে