কলঙ্ক পর্ব-২২

0
1588

#কলঙ্ক
#২২তমো_পর্ব
#অনন্য_শফিক



ম্যামের বাসায় আসার পর থেকে আমি কেমন বদলে যেতে লাগলাম। আগে কখনো বাইরের বই টই পড়িনি আমি। কিন্তু এখানে এসে দেখি বাড়িতে গড়ে তোলা বিশাল এক বইয়ের লাইব্রেরী।আমি এতো বই দেখে হেসে ফেলি।মনে মনে বলি,ম্যাম পাগল নাকি!এতো বই দিয়ে কী করে মানুষ!
আমার কাছে এইসব বই বিরক্তিকর মনে হয়।বুঝেই পাই না মানুষ অতো বই পাগল হয় কী করে?

ম্যামের ছেলের নাম শিশির।দেখতে অত ফর্সা না। মুখে ঘন দাঁড়ি গোঁফ।চুল বড় এবং কোঁকড়ানো। খারাপ লাগে না দেখতে। এই ছেলের প্রধান কাজ হলো সারাদিন এইসব গল্প উপন্যাস নিয়ে পড়ে থাকা।কী একটা বদ অভ্যাস এটা! আমার কেন জানি মনে হয় এইসব গল্প উপন্যাস পড়া মানেই সময়ের অপচয়!
কিন্তু হঠাৎ একদিন কৌতুহল বশত লাইব্রেরীতে ঢুকি আমি। তারপর বইয়ের তাকের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত সবগুলো বইয়ের গায়ে আঙুল ছুঁইয়ে দেই। তারপর হঠাৎ একটা বইয়ের কাছে এসে থমকে দাঁড়াই আমি।বইটা ঢাউস সাইজের।নাম সাতকাহন। লেখক সমরেশ মজুমদার।এই বইটা কেন যেন হঠাৎ আমার ভালো লেগে গেল। ইচ্ছে করলো পাতা উল্টে পড়তে।আমি লাইব্রীর একটা তাকে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে এক পৃষ্ঠা পড়তেই অদ্ভুতরকম এক ভালো লাগা কাজ করলো। আমার কেন জানি মনে হলো এই বইটা আমাকে পড়তে হবে। আজ সারা রাত ভর এই বই পড়বো আমি!পড়তেই হবে আমাকে!

রাতের খাবারের পর এমনিতে ম্যামের সাথে বসে গল্প করি আমি। নানান ধরনের গল্প। কিন্তু আজ খাওয়ার পর একটুও বসলাম না। সোজা চলে এলাম আমার ঘরে। তারপর সাতকাহন নিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম।উল্টাতে লাগলাম এক এক করে পাতা।প্রতিটা পাতাই কী মোহনীয়!কী সুন্দর সুন্দর শব্দ দিয়ে লিখা গল্প।এই গল্পের নায়িকার নাম দিপাবলী।দিপাবলীর জীবন পড়তে গিয়ে আমি আয়নার মতো স্বচ্ছ দেখতে লাগলাম আমার নিজের জীবন।ওমা বই কী তবে আমাদের নিজেদের কথায় বলে? তবে কী একটা গল্প কাল্পনিক কিছু নয় শুধু!এর ভেতর আমাদের প্রাণও থাকে?
আমি পড়ি। পাগলের মতো পড়ে যাই। এমনিতে ঘুমে ডুবে যাই আমি।আজ ঘুম পায় না।
অনেক রাত হলেও ঘরের লাইট নিভেনি বলে ম্যাম উঠে আসেন আমার ঘরের দরজার কাছে। তারপর দরজায় নক করেন।আমি দরজা খুলে দিলে ম্যাম ঘরে আসেন। তারপর বলেন,’অত রাতেও ঘুমাওনি কেন মা?’
আমি মৃদু হেসে লজ্জামাখা গলায় বলি,’ম্যাম একটা উপন্যাস পড়ছিলাম!’
ম্যাম ফিক করে হেসে উঠেন। তারপর বলেন,’এর জন্য বুঝি এমন লজ্জা পেতে হয়! উপন্যাস কী মন্দ কিছু?একটা উপন্যাস কত কত মানুষের জীবন ধরে রাখে!কত কত ইতিহাস , বীরত্বের কথা আর সংগ্রামের কথা থাকে এর পাতায় পাতায়।বেশ ভালো, পড়ো।আমি খুশি হয়েছি তুমি উপন্যাস পড়ছো এই কথা শুনে। আমার শিশির তো রোজ দু তিনটে উপন্যাস পড়ে শেষ করে।তো কী উপন্যাস পড়ছো মা?নাম কী উপন্যাসের?’
আমি বললাম,’সাতকাহন।’
ম্যাম চোখ বড় বড় করলেন। তারপর মৃদু হেসে বললেন,’কেউ বলে দিয়েছে এটা পড়ার জন্য?’
‘উহু। আমার নিজের ইচ্ছায় নিয়েছি।’
ম্যাম এবার আমার কাছে আসেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে তিনি বলেন,’আসলে আল্লা নিজেই তোমায় সাহায্য করতে চাইছেন মা।এই বই শুধুমাত্র একটা উপন্যাস না।এই বই তোমায় বলে দিবে তুমি কীভাবে সংগ্রাম করে টিকে থাকবে!এই বই তোমায় বলে দিবে তুমি কীভাবে এই সমাজের নারী জাগরণের দূত রুপে আবির্ভূত হবে!এই বই তোমাকে তূর্ণা থেকে একজন দিপাবলী বানিয়ে তুলবে ইনশাআল্লাহ!’
ম্যাম দরজা ভেজিয়ে বাইরে যান।বলে যান,’দরজা বন্ধ করো না।পড়তে থাকো।আমি আসবো একটু পর।’
ম্যাম খানিক পর পিরিচে করে দু কাপ ধোঁয়া ওঠা লেবুর চা নিয়ে এলেন। তারপর চা খেতে খেতে খানিক সময় গল্প করে চলে যেতে উঠলেন। বললেন,একটু পর সাহরি খাওয়ার সময় হয়ে যাবে।আমি এখন গিয়ে চুলোয় রান্না চড়াবো।এই ফাঁকে তুমি পড়তে থাকো। গল্প উপন্যাস পড়তে হয় নিরালায়।একা একা।এখানে অন্য কেউ বসে থাকলে পড়ায় বেঘাত ঘটে।পড়ার আনন্দ মলিন হয়!
ম্যাম বেরিয়ে চলে গেলেন।আমি দরজা ভেতর থেকে আটকে দিয়ে আবার পড়তে শুরু করলাম। সাহরির আগে পড়ে আমি প্রথম খন্ড শেষ করে ফেললাম। প্রথম খন্ড পড়ে আমার মনে হলো আমার চেয়ে দিপাবলীর সংগ্রাম আরো কঠিন ছিল।আর মনে মনে বললাম,এই দিপাবলী যদি জিতে যায় তবে আমিও জিতে যাবো।আমি হারবো না। আমাকে নিয়েও তখন মানুষ একদিন উপন্যাস লিখবে।

সাহরি খেয়ে ফজরের নামাজ পড়ে একটু না ঘুমালে চলে না। কিন্তু সাতকাহন আমায় ঘুমোতে দিচ্ছে না।আমি লাইট জ্বালিয়ে আবার পড়তে বসি। শুয়ে পড়ি,বসে পড়ি। সকালের আলো ফুটলে ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভেঙে ছাদে উঠি। তারপর বেলকনিতে হেলান দিয়ে বসে গোগ্রাসে গল্প গিলি।গল্প খাই।কী যে ভালো লাগে।মন ভরে যায়। অবশেষে শেষ হয়ে যায় বই।দিপাবলি জিতে যায়। আমার তখন কান্না পায়। ভীষণ ভীষণ কান্না। ইচ্ছে করে দিপাবলি হয়ে যেতে। কিন্তু না দিপাবলী হবো কেন আমি।আমি তূর্ণাই থাকবো।আজ যেভাবে আমি সাতকাহন পড়ে দিপাবলি হয়ে যেতে চাচ্ছি একদিন মানুষ আমায় পড়ে তূর্ণা হয়ে যেতে চাইবে।আমি এমন করেই সংগ্রাম করে যাবো। আমাকে বড় হতে হবে।আমি বড় হবো। এখন থেকে সব আবেগ উচ্ছ্বাস ফেলে রেখে বাস্তবকে সিজদা করবো। ঠোঁটে তুলে নিবো তরলের মতো সত্যকে।আমি কিছুতেই হেরে যাবো না।আমি সত্যি সত্যি জিতে যাবো।আল্লাহ ছাড়া কোন শক্তি আমায় রুখে দিতে পারবে না!

এরপর থেকে আমার বই পড়ার শুরু হয়।কত বই পড়ে ফেলি আমি। এভাবেই বই পড়তে গিয়ে শিশির ভাইয়ার বই বন্ধু হয়ে পড়ি আমি। এখন আমার নিত্যদিনের কাজ হলো শিশির ভাইয়ার কাছ থেকে প্রতিদিন দুটো করে বই আনা।সেই বই পড়ে প্রতি সন্ধ্যায় তাকে রিভিউ দেয়া। এবং সাথে সাথে এর থেকে কী শিখলাম আমি তাও বলতে হয় তাকে।আমি বলি। সুন্দর করে বলি। শিশির ভাইয়া আমায় তুই তুকারি করে।বলে,’তূর্ণা,তুই বড় হতে পারবি!আমি তোর চোখে আগুন দেখি।জ্বলজ্বল করতে থাকা আগুন!’

মেহরাবের কথা ভুলে গেছি আমি।কী অদ্ভুত মানুষের মন। এখন আমার মন জুড়ে বিচরণ করে শুধু শিশির ভাইয়া। তার কন্ঠ আমার কাছে মধুর লাগে।তার কুঁকড়ানো চুল,ঘন দাঁড়ি সবকিছু আমার ভালো লাগে। ইচ্ছে করে সারাক্ষণ তাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখি।এই রোগটার নাম কী আমি জানি না। তবে আমার খুব করে উচিৎ এই ভয়ংকর রোগটা খাটিয়ে উঠা।নয়তোবা আমার সংগ্রাম এখানেই থেমে যাবে।আমি হেরে যাবো।

আগামীকাল ঈঁদুল ফিতর।আজ চাঁদ রাত। আমি নিজের হাতেই নিজে মেহেদী পরছি। শিশির ভাইয়া হঠাৎ আমার ঘরে এলো। এসে খানিক সময় চুপচাপ বসে থেকে বললো,’এক কাজ কর তূর্ণা!’
আমি বললাম,’কী?’
‘তোর রং শুকাবে কখন আগে বল?’
‘আরো পাঁচ মিনিট লাগবে।। আচ্ছা কেন বলতো?’
‘এখন বলবো না। হাত ধুয়ার পর বলবো।’
আমি পাঁচ মিনিটের জন্য আর বসে না থেকে সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে বেসিনে হাত ধুয়ে আসলাম।
তারপর বললাম,’বলো ভাইয়া।’
শিশির ভাইয়া হা হা করে হেসে উঠলো।
আমি লজ্জা পাওয়ার মতো ভঙ্গি করে বললাম,’হাসছো কেন এভাবে?’
শিশির ভাইয়া বললো,’তোর কান্ড দেখে।কী বোকা মেয়ে তুই। শোন, কারোর প্রতি তোর ভেতরে থাকা আবেগটা অতটা দেখাতে যাবি না যতোটা দেখাবার পর ওই মানুষটার কাছে তুই কমদামী হয়ে পড়তে পারিস! এবং এটা সত্যও। তুই যাকে খুব পাত্তা দিবি সে দেখবি তোকে ততো অবহেলা করতে শুরু করেছে। এরজন্য বাস্তবতা মেনে তোকে চলতে হবে। সবকিছু করতে হবে বাস্তবতা মেনে।এই যে তুই বলেছিলে পাঁচ মিনিট লাগবে তোর হাত শুকাতে।তোর উচিৎ ছিল পাঁচ মিনিট পরে গিয়েই হাতটা ধুয়া। পাঁচ মিনিট আগে নয়। বুঝতে পেরেছিস?’
আমি অবাক হই। আমার রাগ উঠে কেমন জানি।আর মনে মনে বলি,এ আবার কেমন ধরনের মানুষ। ভেতরে প্রেম টেম বলে কিছু নাই নাকি এর!
শিশির ভাইয়া আমার দিকে তাকালো। তারপর বললো,’দে। আমার ডান হাতে মেহেদি পরিয়ে দে।’
আমি ভীষণ রকম অবাক হই!তাহলে বোধহয় শিশির ভাইয়াও আমায় মনে মনে—
তারপর আর কিছু ভাবি না। লজ্জায় জিভ কাটি।বেশি ভাবতে গেলেই সমস্যা।পরে আম আঁটি দুটোই একেবারে হারায়!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে