কলঙ্ক পর্ব-১৯

0
1603

#কলঙ্ক
#১৯তমো_পর্ব
#অনন্য_শফিক


পরদিন বিকেল বেলা ম্যামের সাথে দেখা করতে যাই।মনে প্রচন্ড ভয়।না জানি আবার ম্যাম ইউনিভার্সিটি প্রক্টোরিয়্যাল বডির কাছে কম্প্ল্যান করেছেন কি না!হতেও তো পারে যে আজ তিনি আমায় দেখা করার কথা বলে নিয়ে আমায় পানিশমেন্ট দিয়ে বসবেন।সারা দেশেই এমন চলছে।উপরমহল থেকে নীচ মহল পর্যন্ত সবাই তাদের অধীনস্থদের উপর তাদের মর্জিমতো যা তা করছে। পছন্দ হচ্ছে তো উপরে উঠিয়ে নিচ্ছে। পছন্দ হলো না কোন কারণে তো পায়ের তলায় পিষে মারছে।ম্যাম যদি এমন কিছু করেন!
তারপর হঠাৎ করে মনে পড়ে যায় তিনি ঈচ্ছে করলেই যা তা করতে পারেন না আমার সাথে।কারণ আমি দূর্বল নয়।যারা বুক ফুলিয়ে সত্য বলতে জানে তারা কখনোই দূর্বল হয় না!

ম্যামের অফিসে যাই ভয়ে ভয়ে। গিয়ে সালাম দেই।
‘আসসালামু আলাইকুম ম্যাম।’
ম্যাম আমার দিকে তাকান। তারপর মৃদু হেসে বলেন,’ও তুমি এসেছো। আচ্ছা পাঁচ মিনিট বাইরে গিয়ে বসো।’
আমি বাইরে গিয়ে একটা বেঞ্চের উপর পা ঝুলিয়ে বসে থেকে দুশ্চিন্তা করি। হঠাৎ করে আমার মেহরাবের কথা মনে পড়ে। আচ্ছা মেহরাব কীভাবে আমায় ছেড়ে চলে যেতে পারলো এভাবে?ওর আসলেই আমার প্রতি কোন দরদ নাই! পৃথিবীর সব ছেলেরাই প্রতারক!
তারপর আবার নিজেই নিজের ভুলের জন্য জিভ কাটি।জিভ কেটে মনে মনে বলি,আমি তো ভুল কিছু ভাবছি।কারণ মেহরাব নিজের মুখেই তো বলেছে সে একদিন আমায় ভালোবাসবে। তবে তা এক্ষুনি নয়।আরো অনেক পরে।যখন আমার পড়াশোনার পাঠ শেষ হবে। নিজে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবো তখন!
এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ একটা কন্ঠ শুনে তাকালাম।
ম্যাম কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আমার সামনে। তিনি হাসিমুখে বললেন,’চলো।’
আমি ম্যামের পেছন পেছন হাঁটতে লাগলাম।
ম্যাম বললেন,’পেছন পেছন নয়। আমার পাশাপাশি হাঁটবে।এসো।’
আমি ম্যামের পাশাপাশি হাঁটতে লাগলাম।
ম্যাম এবার বললেন,’আমায় ভয় পাওয়ার কিছু নেই।আমায় তুমি এখন থেকে বন্ধু ভাবতে পারো!’
আমি ভীষণ রকম অবাক হয় ম্যামের কথা শুনে।ম্যাম এটা কেমন ধরনের কথা বললেন? আমার সাথে তার বয়সের কত প্রার্থক্য!তার সাথে আমার বন্ধুত্ব হয় কী করে?
ম্যাম আমায় চুপচাপ হাঁটতে দেখে বললেন,’কী ভাবছো?’
আমি তাড়াহুড়ো করে বললাম,’না ম্যাম। কিছুই ভাবছি না।’
ম্যাম বললেন,’তুমি যে বিষয়টা নিয়ে এখন ভাবছো তা আমি জানি। তুমি ভাবছো আমার সাথে তোমার বন্ধুত্ব কী করে হতে পারে ঠিক তাই তো?’
আমি অবাক হই।ম্যাম এটাও কীভাবে জেনে ফেললেন!
ম্যাম এবার বললেন,’শুনো তূর্ণা, আমাদের দেশের বড়রা মানে গার্ডিয়ানরা যে কমন ভুলটা করে তা হলো বয়ঃসন্ধিকালীন ছেলে মেয়েদেরকে তারা কঠোর শাসনে রাখে।প্রেম, ভালোবাসা, ফিজিক্যাল বিষয়গুলোকে ওদের কাছে নিষিদ্ধ করে প্রকাশ করে। কিন্তু ওরা আদতে জানে না যে এই বয়সটা ছেলে মেয়েদের কৌতুহলের বয়স। এবং এই বয়সী ছেলে মেয়েরা নিষিদ্ধ জিনিসগুলোর প্রতিই সবার আগে ঝুঁকে!
এবং তা তাদের জানার কিংবা বোঝার উৎসাহ থেকেই। কিন্তু বাবা মা যদি এই সময়ে তাদের কাছে এসব বিষয় না লুকোতেন। সবকিছু ভেঙে ভেঙে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলতেন। নিজেকে সন্তানদের কাছে এমন করে প্রকাশ করতেন যেন সন্তানও তাদের কাছে তাদের নিজেদের গোপন বিষয়ে কথা বলতে সাহস পায়, উৎসাহ পায়। তবে কিন্তু ছেলে মেয়েরা এই বয়সে ভয়ংকর কিছু করার সিদ্ধান্ত নিতে পারতো না একা একা।এই যে তুমি একটা ছেলের সাথে রিলেশন করলে। তারপর বিয়ে করে ফেললে গোপনে। কেন করলে এটা? বিয়ের আগে কেন বাবা মাকে জানাওনি?একটা ভয়ে তাই না? তুমি ভেবেছিলে তখন বাবা মা জানতে পারলে তোমায় মেরেই ফেলবে।তেজ্য করবে!তাই না?
এটা তুমি শুধু একা না। আমাদের দেশের সবকটি ছেলে মেয়েই এমন ভাববে।কারণ আমাদের বাবা মা কিংবা শিক্ষকেরা বন্ধু সুলভ নয়।আজ যদি তোমার বাবা মা তোমার বন্ধুর মতো হতো তবে কিন্তু তুমি ওই ছেলেটাকে বিয়ে করার আগে তোমার মাকে জানাতে। তারপর তোমার মা সবকিছু শুনে সিদ্ধান্ত নিতো ছেলেটা আসলে ভালো মানুষ কি না!জেনে বুঝে দেখতো
সে তোমার জন্য যোগ্য কি না!না আমি অর্থ বিত্তের যে যোগ্যতা তার কথা বলছি না!সে মানুষ হিসেবে তোমার যোগ্য কি না তার কথাই বলছি। এখন তুমি বলো, বন্ধুত্বের বিষয়টা কী শুধু সম বয়সীদের জন্য প্রযোজ্য নাকি অসীম বয়সীদের জন্যও?’
ম্যামের কথাগুলো শুনে আমার ভেতরটা কেমন হু হু করে কেঁদে উঠে। চোখে কেমন জল এসে ঢেউ খেলে যায়। আমার তখন শুধু মনে হয়, আমার মা যদি আমার বন্ধু থাকতো তবে তো আমার অত বড় ভুলটা হতো না!
ম্যাম আমার দিকে তাকান। আমার আরো কাছে ঘেঁষে এসে আমার একটা হাত ধরেন। তারপর বলেন,’তূর্ণা, সবকিছু বুঝতে পেরেছো তুমি তাই না?’
আমি মাথা কাঁত করে হ্যা বলি।
ম্যাম এবার বলেন,’তোমায় ডেকেছি কেন জানো?একটা চরম সত্য বলতে।এটা আমার বিষয়ে।এসো আমার সাথে এসো।’
ম্যামের সাথে আমি হাঁটতে লাগলাম।ম্যাম আমায় ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে নিয়ে গেলেন। তারপর মাঠের দূর্বা ঘাসের উপর বসে বললেন,’বসো আমার পাশে বসো।’
আমি ম্যামের মুখোমুখি হয়ে বসলাম।
ম্যাম এবার বললেন,’আমিও তোমার মতো একটা ভুল করেছিলাম। আমার বাবা মা ছিলেন খুব কঠোর।একটা প্রেমের সম্পর্ক ছিল আমার। ছেলে গরীব ঘরের।আমি জানতাম বাবা মা আমার এই সম্পর্ক কোনদিন মেনে নিবেন না।তাই ছেলেটাকে হারানোর ভয়ে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়েই ছেলেটাকে নিয়ে পালিয়েছিলাম। কিন্তু দুঃখের কথা কী জানো? আমার একটা ছেলে হওয়ার পর সে হুট করে একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। তারপর অনেক খুঁজেও তাকে আর পাইনি।আমি অবশ্য তখন পড়াশোনাও ছেড়ে দিয়েছিলাম।কী ভয়ংকর বিপদে যে পড়েছিলাম তখন। ভেবেছিলাম মরে যাবো। কিন্তু মরতে পারিনি নিজের জন্ম দেয়া ছেলেটার মায়ায়। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম মরে যাওয়ার চেয়ে বাবা মার কাছে গিয়ে আশ্রয় নেয়া উত্তম।তারা আর যায় করুক, একেবারে জানে তো আর মেরে ফেলবে না।আর আমি তখন এটাও মেনে নিয়েছিলাম যে, লাজ লজ্জা মৃত্যুর চেয়ে অবশ্যই নিঠুর নয়! মানুষ কিছু বললে বলুক তাতে আমি কান দিবো না। আমার পথে আমি এগিয়ে যাবো। আবার পড়াশোনা করবো।
তূর্ণা, বাড়িতে ফিরে যাওয়ার পর ভাইয়েরা কী যে মার মেরেছে আমায়।বাবা মা কত কী যে বলেছে।পাড়া পড়শীরা আমাদের বাড়ির সবকজন মানুষকে নিয়েই হাসি তামাশা করতো।ওরা বলতো, বিয়ে ছাড়াই অসভ্যতামি করে সন্তান জন্ম দিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসছি! প্রথম প্রথম খুব কাঁদতাম। একদিন বাড়ির ছাদ থেকেও লাফাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মরতে এবারও বাঁধা হলো আমার সন্তান।মনে হলো আমি মরে গেলে তো আমার ছেলেটা আনাথ হয়ে যাবে!
তারপর মৃত্যুর সিদ্ধান্ত বদলে নিলাম। বাবাকে হাতজোড় করে বললাম,বাবা আমায় শেষ একটা সুযোগ দাও।আমায় পড়তে দাও।
সেবার বাবা কীভাবে যেন গলে গেলেন আমার কথায়। তারপর পড়াশোনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স হয়ে গেল। পড়লাম ইংরেজি বিভাগে। তারপর হয়ে গেলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার। এছাড়াও আমার নিজের একটা বিজনেস দাঁড় করিয়ে ফেললাম।বইয়ের একটা ভালো ছাপাখানা,একটা ভালো লাইব্রেরী গড়ে তুললাম। তারপর গ্রামে ফিরলাম। গ্রামের মানুষ,ঘরের মানুষ তখন আমায় মাথায় তুলে ফেলতে চায়। কিন্তু সেই কদার্য গ্রামে আমি আর রইলাম না।কারণ ওখানে থাকলে আমায় নিয়ে তামাশা করা মানুষগুলোর মুখ দেখলে আমার ভেতর আগুন জ্বলে উঠতো।আমি চাইতাম না এমনটি হোক।আমি এদেরকে হিংসা করতে চাই না।এরা বুঝে না। মূর্খ মানুষ।আমি দূর থেকেই এদেরকে শিক্ষার আলোয় আনতে নিজের টাকায় গ্রামে স্কুল করে দিয়েছি। বয়স্কদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিয়েছি।’
ম্যামের কথা শেষ হলে আমি তার দিকে তাকাই।ম্যামের চোখে জল। তিনি ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে নিয়ে চোখ মুছেন। তারপর বলেন,’আমার ছেলে এ বছর বুয়েট থেকে সিভিল ইন্জিনিয়ার হয়ে বের হয়েছে। দেশের বাইরে চলে যেতে চেয়েছিল ও।আমি যেতে দেইনি। ওকে বলেছি, তোদের মতো মেধাবীরা বাইরে চলে গেলে এই দেশের অন্ধকার দূর হবে কী করে!’
আমি কী বলবো ম্যামকে বুঝতে পারছিলাম না। পৃথিবীতে এমন ভালো মানুষ আজও আছে?অথচ কাল এই ম্যামকেই কত কঠোর ভেবেছিলাম আমি!
ম্যাম নিজেই তখন বিষয়টা পরিষ্কার করলেন। তিনি বললেন,’আসলে গতকাল তোমার সাথে যে খারাপ ব্যবহার করেছি আমি এটা শুধু তোমায় টেস্ট করার জন্য। আমি শুধু তোমায় দেখতে চেয়েছিলাম তুমি পারবে কি না টিকে থাকতে!আমি টেস্ট করে বুঝতে পেরেছি তোমার ভেতর সুপ্ত আগুন আছে।এই আগুন আস্তে আস্তে জ্বলতে শুরু করেছে। এভাবে যদি আগুনটা জ্বলতে থাকে তবে আর কেউ তোমায় আটকে দিতে পারবে না। কিন্তু সব সময় মনে রেখো তূর্ণা,বাজে লোকের কথায় কান দেয়া যাবে না।মন খারাপ করা যাবে না।তুমি সব সময় তাদের কথা শুনবে আর তাদেরকে মনে রাখবে যারা তোমায় এগিয়ে যেতে সাহায্য করে!’
আমি ম্যামের হাতটা শক্ত করে ধরলাম কারণ এই হাতটা ভরসার।এই হাতটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার।
ম্যাম আবারও বললেন,’আরেকটা বিষয় তোমায় পরিষ্কার করি। তোমার সিটটা আমি ওই মেয়েকে দেইনি।এই মেয়েকে সিটের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন আমাদের ইউনিভার্সিটির প্রক্টর মহোদয়।কারণ তুমিও তখন নাই।ওরা ভেবেছিলেন তুমি আর আসবে না।আর এই মেয়েটিও প্রক্টরের পরিচিত।’

সন্ধ্যা হয়ে আসছে।আলোয় আলোয় ভরে উঠছে শহর।আমি তখন ভাবলাম, আহ্,আমি যদি সেদিন মরে যেতাম তবে এমন একজন মহৎ মানুষের দেখা পেতাম কী করে!তার কাছ থেকে এমন সুন্দর সুন্দর কথাগুলো শুনতে পেতাম কী করে?আর তখন খুব গভীর ভাবে বুঝতে পারি যে, আত্মহত্যা কোন সমাধান নয়। বেঁচে থেকে জীবন গড়ার চেষ্টাটাই বরং সমাধানের পথ।আর মানুষ যখন নিজেকে গড়তে চায় তখন তাকে ভেঙে দিতে অনেকেই আসবে। তবে সত্য হলো এটাও যে তুমি নিজেকে গড়ে তুলতে চাইলে তোমাকে গড়ে দিতেও অনেকেই আসবে!সেই মানুষদের তোমায় চিনতে হবে। এবং তুমি এদের কথাই মনে রাখবে!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে