কলঙ্ক পর্ব-০৯

0
3763

#কলঙ্ক
#৯ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক



এলিজা কাছে এসেই বললো,’আপু কেমন আছেন আপনি?’
আমি মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম।যাক বাঁচা গেল। তাহলে এলিজা এসবের কিছুই জানে না।আর ঘটনার দিন সে হোস্টেলে ছিল না।তার দাদির অসুস্থতার কারণে বাসায় ছিল। নয়তো সবকিছু জেনে যেতো!
মনে মনে আমি পিয়াকেও ধন্যবাদ দিলাম। ভাবলাম, আমি তাকে যা ভেবেছি আসলে সে এমন না। হয়তোবা সে কারোর কাছেই বিষয়টা বলেনি। শুধু শুধু আমার উপর রাগটা ঝেড়েছে।ওই যে আমাদের পুরনো দিনের ঝগড়া করার অভ্যেস,ওই অভ্যেস থেকেই এমনটা করেছে সে!

কিন্তু রুমে গিয়েই দৃশ্যপট বদলে গেলো। ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে বিছানা ঠিক করছি আমি। তখন এলিজা বললো,’আপু, ভাইয়া কী পরে কোন যোগাযোগ করেনি?’
ওর মুখ থেকে কথাটা শুনে ভেতরটা আমার কেঁপে উঠলো।মাথা কেমন ঘুরতে লাগলো।
আমি তবুও নিজেকে ঠিক রেখে বললাম,’কোন ভাইয়ার কথা বলছিস?’
এলিজা সামান্য হাসার ভাব করলো। তারপর বললো,’আপনার হাসব্যান্ড এর কথা বলছি!আমান না কী যেন নাম।ওই যে আপনাকে ফেলে রেখে কোথায় জানি নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে?’
আমি চুপ করে গেলাম একেবারে। এখন আর কথা বলা যাবে না।পিয়ার প্রতি যে মনে মনে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া পেশ করেছিলাম এর জন্য এখন দুঃখ হচ্ছে।আর মনে হচ্ছে,পিয়া শুধুমাত্র ঝগড়াটে মেয়ে নয়,ও একটা অমানুষ ।ওর সন্দেহ ছিল আমার প্রতি আগে থেকেই। এবং এমন একটা সুযোগই খুঁজছিলো সে। সেদিন এলিজা বাসায় চলে গেল, আমিও একা,সেন্সলেস হয়ে গেলাম।পিয়ার চোখেও পড়ে গেলাম সেন্সলেস অবস্থায়।সে নিয়ে গেল হসপিটালে।আর সবকিছু জেনে গেলো।ঝগড়া হয় ওর সাথে এর বেশি কিছু নয়।তাও যে এইসব ঝগড়া বড় কিছু নিয়ে তাও না।আর ঝগড়াও খুব বড় হয় না।এই সামান্য একটা বিষয়ের জন্য পিয়া আমার সাথে এমন করতে পারলো?না জানি আরো কত কী বাড়িয়ে বলেছে আল্লাহ জানে!
এলিজা আগে আমায় প্রচন্ড ভয় পেতো।ভয় পাওয়ার কারণ হলো ও যখন প্রথম প্রথম হোস্টেলে উঠলো তখন একদিন আমার সামনে ওর বন্ধুর সাথে ফোনে এমন একটা স্ল্যাং শব্দ বললো যা শুনে আমার মাথায় রক্ত উঠে গেল।আমি সেদিন নিজেকে সামলাতে না পেরে ওর গালে একটা চড় বসিয়ে দিয়েছিলাম।চড় খেয়ে ও বোকার মতো তাকিয়ে ছিল আমার দিকে।আমি তখন ওকে কাছে টেনে নিলাম।আদর করে বললাম,’বড় বোনদের সামনে এভাবে কথা বলা অভদ্রতা। এবং চরম বেয়াদবি।আর কখনো এমন করিস না!’
এলিজা লজ্জায় লাল হয়ে যেতে যেতে বলেছিলো,’সরি আপু!আর কখনো এমন হবে না!’
এরপর থেকে আমায় বড় বোন বলে সম্মান করে কথা বলতো। আমার সামনে দিয়ে হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে চাইতো।কথা বললে আমার সাথে ভয়ে কাঁপতো।
ফার্স্ট ইয়ারের মেয়েগুলোর এমন হয়ই।এরা একটা বছর ইউনিভার্সিটির সিনিয়রদের কাছে মুরগি হয়ে থাকে।না থাকতে চাইলেও এদের মুরগি করে রাখা হয়। এলিজার সাথে ওই ঘটনাটা ছাড়া আর কখনো খারাপ ব্যবহার করিনি আমি। নিজের বোন ভেবে ওকে তুই তুকারি করি। নিজের জন্য কোন ভালো খাবার বাইরে থেকে আনলে ওকে না নিয়ে মুখে দেই না।আর এই মেয়েটাই আজ আমায় ঘা দিয়ে দিয়ে পঁচা কথা বলছে!
এলিজা এবার টেবিলের সামনে চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো,’আপু, আপনার প্রাগন্যান্সির কয় মান্থ হয়েছিল?’
আমি কথা বলি না।মাথা নত করে বিছানায় পা গুটিয়ে বসে থাকি।ও মিটিমিটি হাসে। তারপর আবার মুখ মলিন করে বলে,’রাগ পাচ্ছেন কেন? আপনি তো জানেন না।পিয়া আপু যখন বললো পাঁচ মাসের একটা বাচ্চাকে মেরে ফেলেছেন আপনি মানে এবরোশন করিয়েছেন শুনে এমন খারাপ লাগলো!আপু, আপনি কাজটা ভালো করেননি। আপনি কী জানতেন না বিবাহ ছাড়া অন্য পুরুষের সাথে মিলিত হওয়া হারাম।হাদিসে আছে কোন মেয়ে যদি জেনা করে তবে পরকালে তার সাথে একটা আগুনের ফেরেশতা সেক্স করবে। তারপর মেয়েটা কনসিভ করবে। মেয়েটার পেটে আসবে একটা আগুনের বাচ্চা। সেই বাচ্চা প্রসব করতে গিয়ে কী হবে বুঝতে পারছেন?’
আমি ওর দিকে তাকাতে পারছি না। কিন্তু ওর সাহস মাপছি।ওর মুখে এসব নোংরা কথা কীভাবে আসছে?তাও আমার নাকের ডগায় বসে বসে বলছে!
কিন্তু আমি আর কী করবো? কথা বলতে গেলেই তো বিপদ। এমনিতেই সব গেলো।মান সম্মান চুলোয় গিয়েছে।তল্লাটে যে সিকিভাগ আছে তার রক্ষা করতে না পারলে সর্বনাশ হবে! বেঁচে থাকার শেষ সম্বল একেবারেই যে খুইয়ে যাবে!

একদিন এখানে থাকার পর আমি বুঝতে পারলাম ঘটনাটা পিয়া আর এলিজা ছাড়া আর কেউ জানে না।ওরা জানাইনি।তাই অন্য কেউ কিছু বলেওনি। এমনকি সেদিন যে মেয়েটা হেসেছিল সেও কিছু জানে না।ও এমনিতেই হেসেছিল।

এরচেয়ে খারাপ কিছু ঘটলো এর পরদিন। এলিজা তার তিনটে মেয়ে বন্ধু নিয়ে এলো ঘরে।এলিজাকে নিয়ে চারজন।ওরা রাতে এখানে থাকবে। এলিজা একটু পর বললো,’আপু, আপনি ঘুমিয়ে যান আজ সকাল সকাল।’
আমি অবাক হয়ে বললাম,’কেন? আমার তো পড়াশোনা আছে।এক্সাম খুব কাছে!’
এলিজা কড়া গলায় বললো,’আপনাকে ঘুমোবার কথা বলেছি শুনেননি!যান।মশারি খাটিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ুন।’
আমি ধমকে উঠতে চেয়েছিলাম এলিজাকে। কিন্তু পরমুহূর্তেই হোশ ফিরে এলো।মনে মনে ভাবলাম, সর্বনাশ করে ফেলেছিলাম তো!ওকে ধমক দিলে ও সারা হোস্টেল চিৎকার করে এক করে ফেলতো। তারপর সবাইকে বলে দিতো আমার বিষয়ে জানা সবকিছু!
আমি ওর কথা মেনে ধীরে ধীরে হেঁটে বিছানার কাছে গিয়ে মশারি খাটালাম। তারপর বিছানায় ঘুমোতে গেলাম। কিন্তু চোখে কিছুতেই ঘুম আসছিলো না।ওরা চারজন খুব জোরে জোরে চিল্লাপাল্লা করছিলো!
এলিজা হঠাৎ ওদেরকে বললো,’মামারা,তোদেরকে আজ একটা সারপ্রাইজ দিবো!’
ওরা অবাক হয়ে বললো,’কী?’
এলিজা তাড়াতাড়ি করে ওর ব্যাগ থেকে এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট বের করলো। সাথে একটা দিয়াশলাইয়ের প্যাকেট।
বাকী তিনজন জিনিসটা দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলো। কিন্তু ওদের থেকে একজন চাপা গলায় বললো,’এই,আপু মনে হয় এখনও ঘুমাননি!উনি দেখলে সর্বনাশ হবে!’
এলিজা ফিক করে হেসে উঠলো। হেসে ওই মেয়েটার নিতম্বে চাপড় মেরে বললো,’ও সজাগ থাকলেই কী আর ঘুমালেই কী বা*ল এসে যায় রে ?আমি ওর বাপের পয়সায় সিগারেট কিনি নাকি ও আমার মার পেটের বোন হয়?’
বাকী তিনজন ওর দিকে অবাক চোখে তাকায়। তারপর বুঝে ফেলে মুহূর্তে এই রুমে আমি কতটা অসহায় প্রাণী। এবার ওরা তিনজনও সমান তালে স্ল্যাং ভাষা ইউজ করতে থাকে।কী সব নোংরা নোংরা গল্প যে ওরা করে!
এবার চারজনে সিগারেট ধরায় একসাথে। এলিজা একাই তিন তিনটে সিগারেট ঠোঁটে নিয়ে টান দেয়। তারপর ধুয়োটা আমার দিকে ছেড়ে দিয়ে একটা স্ল্যাং বাক্য ছুঁড়ে!
বাকী তিনজন একে অপরের উপর গড়াগড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে অট্টহাসি হাসে।
আর আমি শুয়ে থেকে মুখে শক্ত করে ওড়না চেপে ধরে কাঁদি।আর মনে মনে ঠিক করি কালই চলে যাবো আমি এখান থেকে। এখানে আর এক দন্ডও নয়। এখানে থাকলে পড়াশোনা তো দূরের কথা এমনিতেই মরে যাবো আমি।ওরা আরো বেশি কিছু করবে। কিন্তু আমি কোন প্রতিবাদ করতে পারবো না। প্রতিবাদ করতে গেলেই তো ওরা আরো বাড়বে। তখন জনে জনে আমার নামে লাগিয়ে বাড়িয়ে ওইসব নোংরা কথা প্রচার প্রসার করবে!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে