কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ৯+১০
তিরা বেশিরভাগ দিন সকাল ও দুপুরের খাবার একসাথে খায়। আজও হয়েছে তাই। দুপুরে খাওয়ার পর আরশি টেবিল গোছাচ্ছিলো। তিরা বসে বসে মুরগীর হাড্ডি চিবুচ্ছে। আরশি সব গুছিয়ে টেবিল মুছতে মুছতে বললো,
“তিরা আমি বলেছিলাম না তোর কালা চণ্ডীদাস তোর জঘন্যতম চয়েজ?”
“হ্যাঁ। তুই তো সবসময় ওর দোষ ধরার জন্য বসে থাকিস।”
“লোকটা ভয়ঙ্কর সিগারেটখোর, অসভ্যও বটে তবে আজ তার সম্পর্কে একটা অন্য ব্যাপার জানলাম।”
তিরা অতি উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কী সেটা?”
“এই লোকটা তোর ক্রাশলিস্টের একমাত্র ব্রিলিয়ান্ট লোক!”
“সত্যি?”
তিরা উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়াতেই হাতের ধাক্কা লেগে প্লেটটা ছিটকে সরে গেলো। হাড্ডিগুলো আরশির সদ্য পরিস্কার করা টেবিলের এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে পড়লো। আরশি চোখ গরম করতেই তিরা বললো,
“আমি সব পরিস্কার করে দেব সোনা। তুই বলনা
কীভাবে বুঝলি চণ্ডীদাস ব্রিলিয়ান্ট? বলনা বলনা।”
আরশি তিরার প্লেটটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে টেবিলটা আবার মুছতে মুছতে বললো,
“ওইযে বইটা পড়তে এনেছিলাম না?”
“হ্যাঁ।”
“ওটাতে কিছু বুকমার্ক ছিল৷ যেসব পৃষ্ঠায় বুকমার্ক ছিল সেসব চ্যাপ্টার সম্পর্কে তার মতামত ওই বুকমার্ক গুলোতে লিখে রেখেছিলো। আমি ওগুলো দেখে অবাক হয়ে গেছি। অনেক নলেজ আছে তার। আজকালকার ছেলেদের এত উন্নত ভাবনা! এটাও কী সম্ভব?”
একথা বলে আরশি রান্নাঘরে গিয়ে প্লেট ধোয়া শুরু করলো। তিরা প্লেটটা আবার টেবিলে রেখে আরশির পেছন পেছন রান্নাঘরে ঢুকলো। খুশিতে বাকবাকুম করতে করতে বললো,
“তার মানে তুই ফটোশ্যুটে যেতে রাজী?”
আরশি বিরক্ত হয়ে বললো,
“একথা কখন বললাম?”
“বলতে হবে কেন? তুই তো এতদিন কাব্যকে খারাপ বলতি, আজ ভাল বলছিস তার মানে যেতে আপত্তি নেই এটা আমি বুঝে নিয়েছি।”
“আমি আগে তাকে খারাপ বলিনি। বলেছি তাকে আমার পছন্দ না। আর আজও ভালো বলিনি। তার একটা গুণ চোখে পড়েছে সেটাই বলেছি। ভালো মন্দ বিচারের আমি কে?”
“তার মানে যাবি না?”
“না যাবো না। এই বিষয়ে আর কোনো কথা শুনতে চাই না। তোর প্লেটটা আবার কোথায় রাখলি? ওটা নিয়ে আয় ধুয়ে ফেলি।”
তিরা মুখ কালো করে প্লেট আনতে গেলো।
সন্ধ্যাবেলা তিরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাব্যর সাথে ফোনে কথা বলছিলো। আরশি যাতে আর কাব্যকে লোকটা বলতে না পারে তাই কাব্যর আসল বয়সটা জানা দরকার। তাই সে জিজ্ঞেস করলো,
“আচ্ছা কাব্য তোমার বয়স কতো বলো তো?”
“হঠাৎ বয়স জানতে হবে কেন তোমার?”
“আমার লাগবে।”
কাব্যর মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। এতো দিন এমন একটা সুযোগই তো সে খুঁজছিলো। বললো,
“কত আর? আমি কি অত বুড়ো নাকি? এবার ৩৬ হবে মাত্র।”
“কী বলো এতো বয়স তোমার?”
“এ আর এতো কোথায়? পুরুষ মানুষের এই বয়স একটা বয়স হলো? সময়মতো বিয়ে দিলে তোমার বয়সী মেয়ে থাকতো আমার। তাই বলে নাতি নাতনি তো আর থাকতো না।”
“কি বলছো এসব তুমি!”
“কেন কি বললাম?”
তিরা আহত কন্ঠে বললো,
“আমি তোমার মেয়ের বয়সী?”
“হ্যাঁ আমার এক্স গার্লফ্রেন্ডকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিলো। সেই এক্স গার্লফ্রেন্ডের মেয়ের বয়স এখন ১৯ বছর। সেই মেয়েটা তো আমারও হতে পারতো। কিন্তু তখন বাবা রাজী হলো না তাই আর বিয়ে করা হলো না। তোমার বয়স কত?”
“আমার ১৮।”
“আরে তুমি তো আমার মেয়ের থেকেও ছোটো।”
তিরা চমকে উঠে বললো,
“তোমার মেয়ে মানে!”
“মানে এক্স গার্লফ্রেন্ডের মেয়ে।”
“ওহ। আচ্ছা কাব্য সত্যি কথা বলো তো। আমি তোমার বন্ধু নই?”
“হ্যাঁ অবশ্যই। আমি তো আমার মেয়ের সাথে বন্ধুর মতোই মিশি।”
“তোমার মেয়ে?”
“এক্স গার্লফ্রেন্ডের মেয়ের কথা বলছি। তুমিও আমার মেয়ের মতো। তুমিও আমার বন্ধু এজন্যই তো তোমাকে আমি তুমি করে বলার পারমিশন দিয়েছি। এজন্যই তো তোমাকে আমি দুবছরের বাচ্চা বলে ডাকি।”
তিরার মাথা ঘুরছে। সে জিজ্ঞেস করলো,
“তাহলে তুমি মাত্র অনার্সে কেন পড়ো?”
“ওইযে গার্লফ্রেন্ডের বিয়ে হয়ে গেলো? এজন্য দেবদাস হয়েছিলাম বহুবছর। এজন্য পড়াশোনায় গ্যাপ পড়ে গিয়েছিলো। এখন সার্টিফিকেট নেই বলে ভালো বিয়ে হচ্ছে না। এজন্য বাবা মা জোর করে আবার পড়াশোনা শুরু করিয়েছে।”
“ওহ! আচ্ছা এখন তাহলে রাখি। আরু ডাকছে।”
“ঠিকাছে।”
ফোন রেখে কাব্য হেসে ফেললো। আর ওদিকে তিরা ভাবতে লাগলো, কাব্য এসব কী বললো? কাব্যর বয়স ৩৬? তাহলে আরশি ঠিকই ধরেছিল? সে একটা ছেলে নয়, একটা লোক? এবার তিরার খেয়াল হলো কাব্য কখনো তাকে নিজ থেকে মেসেজ দেয়নি, ফোন দেয়নি। সে যেমন আগ্রহ নিয়ে অনেক কথা জিজ্ঞেস করতো কাব্য কখনো তার ব্যাপারে সেসব জিজ্ঞেস করেনি। মেয়ের চোখে দেখতো বলেই এতোদিন ধরে এরকম ছিল তাদের সম্পর্ক! আর সে এতো গাধা এই ব্যাপারটুকু বুঝতে পারলো না! সত্যিই তো মেয়ের চোখে না দেখলে তো আর দুবছরের বাচ্চা বলতো না। ভাগ্যিস তিরা কখনো মুখ ফসকে কাব্যকে ক্রাশ খাওয়ার কথাটা বলে ফেলেনি! গুলিটা একদম কানের পাশ দিয়ে গেছে!
বারান্দা থেকে তিরা যখন ঘরে এলো আরশি তখন চুলে তেল লাগাচ্ছিলো। তিরার গোমড়া মুখ দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“কী হয়েছে? হঠাৎ মন খারাপ হয়ে গেল কেন? কোনো খারাপ খবর? কার সাথে কথা বলছিলি?”
তিরা আরশির সামনে বসে ঠোঁট উলটে বললো,
“আরু তোর কি মনে হয় কাব্যর বয়স কত হবে?”
“দ্যাখ ছেলেদের বয়স ধরা মুশকিল। শুকনা পাতলা ছেলেদের বয়স ধরা আরো মুশকিল। কিন্তু একথা জিজ্ঞেস করছিস কেন কী হয়েছে?”
“আমি অনেক বড় একটা ভুল করে ফেলেছি রে। যদিও কেউ জানেনা তবুও নিজের কাছে নিজেরই লজ্জা লাগছে।”
“কী হয়েছে সেটা তো বলবি।”
“ভাগ্যিস আমি কাব্যকে ক্রাশ খাওয়ার কথাটা বলিনি।”
“বললে কী হতো?”
“কেলেঙ্কারি হয়ে যেতো।”
“কীসের কেলেঙ্কারি?”
“কাব্য আমাকে মেয়ের চোখে দেখে। ওইযে দুবছরের বাচ্চা বলে? এজন্যই বলে।”
আরশি অবাক হয়ে বললো,
“কী যা তা বলছিস? মাথা ঠিকাছে তোর?”
তিরা এবার কাব্যর সাথে ওর পুরো কনভার্সেশনটা আরশিকে বললো। সব শুনে আরশি স্থির হয়ে বসে রইলো। তিরা বললো,
“আমি এখন কী করবো?”
“কিছুই করতে হবে না। খুলনা গিয়ে ঘুরে আয়। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“সত্যি?”
“কোচিং এর কেমিস্ট্রি স্যারের কথা ভুলে গেছিস?”
“কোন কোচিং?”
“নাইনে পড়ার সময় আমরা যে স্যারের কাছে কোচিং এ কেমিস্ট্রি পড়তাম? স্যারকে দেখে ক্রাশ খেয়ে ফেললি। স্যারও ভাব জমালো। দুদিন রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেলো? তারপর জানলি সে বিবাহিত? তার বৌ এসে তোকে ঝাড়লো!”
“ওহ হ্যাঁ তুই সেই ফালতুটার কথা বলছিস? আমার খেয়াল ছিলো না।”
“তার বেলায়ও সব কথা জানার পর তুই লজ্জায় মরে যাচ্ছিলি। কিন্তু দুদিন পর তো ভুলে গেলি। এটাই স্বাভাবিক। এই লোকটাকেও ভুলে যাবি।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ।”
“আমি কালই খুলনা যাবো। দেখি অনলাইনে টিকিট আছে কিনা।”
“যাওয়ার আগে বইটা ওনাকে ফেরত দিয়ে যাস।”
“কেন তুই বরং ফেরত দিয়ে আরো বই নিয়ে আসিস। এখন তো ছুটিই।”
“কেন বাজারে কি বইয়ের অভাব?”
“তা না।”
“এটা কোথাও পাচ্ছিলাম না৷ ওনার কাছে পেয়ে এনেছি৷ তাই বলে সব বই আনতে হবে কেন?”
“আচ্ছা আমি দিয়ে দেব।”
তিরা অনলাইনে টিকিট খুঁজতে লাগলো।
আরশির মাথা ঝিমঝিম করছে। শরীরটা তিরতির করে কাঁপছে। সন্ধ্যে থেকে বাতি নিভিয়ে শুয়ে আছে সে। সে এতদিন ভেবেছে শুধু তিরা নয় কাব্যও তিরার প্রতি আগ্রহী। কাব্যর প্রথমদিনের চায়ের দাওয়াত থেকে শুরু করে বুয়া খোঁজার ছুঁতোয় দোতলায় আসা, বাজার তুলে দেয়া সবকিছুই তিরার সাথে দেখা করার জন্য করেছে বলে ভেবেছে। কিন্তু আজ সে যে নাটক করলো তা ভাবাচ্ছে আরশিকে। তিরা সহজ সরল মেয়ে, ওকে বোকা বানানো কাব্যর মতো ছেলের কাছে মামুলি ব্যাপার। কিন্তু আরশিকে বোকা বানানো এতো সহজ না। আরশি স্পষ্টই বুঝতে পেরেছে কাব্য সব বানিয়ে বলেছে। তিরা ইদানীং খুব বেশি এগ্রেসিভ হয়ে যাচ্ছিলো কাব্যর প্রতি। হয়তো সে কারণেই কাব্য আজ তাকে এসব আবোলতাবোল বুঝিয়ে দিলো। যাতে তিরা সরে যায়। তার মানে কাব্য তিরার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলো না। কিন্তু তাহলে এতদিন কাব্য কেন এসব করেছে? আরশির জন্য? কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? তিরাকে রেখে কেউ তাকে কেন পছন্দ হবে? তিরা তার চেয়ে সুন্দরী, স্মার্ট, প্রাণবন্ত। তিরার সঙ্গ যেকোনো মানুষকে আনন্দ দেয়। অপরদিকে সে নিজেকে গুটিয়ে রাখা শামুকের মতো, অনুভূতি প্রকাশ করতে জানেনা, মানুষের সাথে মিশতে জানেনা। দেখতে খারাপ না হলেও তিরার মতো সুন্দরী তো নয়ই বরং কাউকে আকৃষ্ট করার মতো কিছু তার মধ্যে নেই। সেই চেষ্টাও সে কখনো করেনি। আজ পর্যন্ত জোর করেও কেউ তাকে সাজাতে পারেনি। গাঢ় কোনো রঙের জামাও তাকে কেউ পরাতে পারেনি কখনো। সে কখনো পার্লারে যায় না। সে চুল কাটে না, ব্রু প্লাগ করে না। এসবে তার লজ্জা লাগে৷ কলেজ, কোচিং সবখানে বন্ধুরা তাকে আম্মা, দাদী এসব নামে ডাকে। ঠিক বন্ধু নয়, আরশির নিজের কোনো বন্ধু নেই। তিরার বন্ধুরাই আরশির বন্ধু। আরশি যাদের সাথে প্রয়োজন ছাড়া কখনো কথা বলে না। তারাও বলে না। আরশির সঙ্গ তেমন কেউই পছন্দ করে না। কারণ সে বোরিং।
আরশিও নিজেকে উপন্যাসের নায়িকার জায়গায় ভাবতে পারেনি কখনো। বড়জোর নায়িকার বান্ধবী, বোন বা ননদের যে চরিত্র থাকে তার সাথে সে নিজেকে মেলাতে পারে। সাহিল, রশ্নি আর তিরা বাদে এই দুনিয়াতে আর কারো সাথেই কোনো সম্পৃক্ততা নেই আরশির। ১৮ বছর পেরিয়ে গেছে, আজ পর্যন্ত কোনো ছেলে তাকে পছন্দ করেনি। ভালোবাসার কথা বলেনি। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে বখাটেরাও তার দিকে তাকায় না। অথচ তিরা যেখানেই যায় ভুরি ভুরি প্রোপোজাল পায়। সব ছেলেরা যেমন মেয়েকে সঙ্গী হিসেবে চায় তিরা ঠিক তেমন। সবাই তিরাকে পছন্দ করে। সেই তিরাকে গুটি হিসেবে ব্যবহার করে কাব্য তার সংস্পর্শে আসতে চেয়েছিলো এটা সে কেন যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। কিন্তু যুক্তি তো এটাই বলছে। সবকিছু কেমন অদ্ভুত লাগছে তার।
চলবে…
কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ১০
তিরা খুলনা চলে গেছে এক মাসের বেশি হয়ে গেলো। ভর্তির আগে সম্ভাবত আর আসবে না। সারাদিন আরশির একা একা কাটে। এখন রান্না খাওয়া ছাড়া আর কিছু যেন নেই আরশির জীবনে। ওহ হ্যাঁ আরেকটা কাজ আছে, রশ্নি ও তিরার সাথে ফোনে কথা বলা। কিন্তু কোথাও যেতে উচ্ছে করেনা। পাশেই চাচার বাসা। চাচাতো ভাইবোনেরা আছে তবুও সেখানে যেতে ইচ্ছে করে না। একমাত্র রশ্নির কাছে যেতে তার ভালো লাগে তবুও অন্যের বাসায় যাওয়াতেও তার অস্বস্তি। সেখানে গেলে রশ্নির সাথে ঘরের মধ্যে বসে থাকে। কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না৷ সবাই হয়তো অহংকারী ভাবে। তাই সেখানেও যাওয়া হয় না। নতুন যেসব বই ছিলো সেসবও পড়া শেষ। গতকাল অনলাইনে কিছু বই অর্ডার করেছে যা এখনো এসে পৌঁছোয়নি। বই অবশ্য নীলক্ষেতে গিয়ে কিনে আনা যেতো কিন্তু সে বের হতে চায় না৷ কেন যেন মনে হচ্ছে বের হলেই কাব্যর সামনে পড়তে হবে। এই লোকটার সামনে সে আর কখনো পড়তে চায় না। এমনকি এই কারণে সে গত একমাস ধরে বাজারেও যায় না। যা যা লাগবে সাহিলকে বলে ফেরার সময় নিয়ে আসতে। আরশি জানেনা এভাবে কতদিন আড়ালে থাকতে পারবে। একই বাসায় যখন থাকে কোনো না কোনোদিন তো দেখা হয়েই যাবে৷ তখন কী হবে? কীভাবে মুখোমুখি হবে তার? তার চেয়ে দেখা না হোক। আরশি একদম চায় না দেখা হোক!
দুপুরে রান্না করছিলো আরশি। আজ সাহিল সন্ধ্যেবেলায় ওকে নিয়ে রশ্নির কাছে যাবে। যাওয়ার সময় আরশি রশ্নির জন্য তার প্রিয় কিছু খাবার নিয়ে যাবে। এজন্যই এতো আয়োজন। রান্নার মাঝেই বেল বেজে উঠলো। এই অসময়ে আবার কে এলো! আরশি বারান্দা দিয়ে তাকিয়ে দেখে যে বইগুলো অর্ডার করেছিলো সেগুলো এসে গেছে। ডেলিভারি ম্যানকে দাঁড়াতে বলে ভেতরে এসে চুলা নিভিয়ে টাকা নিয়ে নিচে নামলো।
দোতলার বেলের আওয়াজ শুনেই কাব্য দরজা খুলে বের হলো। বের হওয়ার সময় ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বের হলো। ভানটা এমন করতে হবে যে সে বাইরে থেকে এসেছে। আরশি নিচে নামার আগেই কাব্য মূল ফটকের তালা খুলে দাঁড়িয়ে রইলো। গত একটা মাস কাব্য যতক্ষণ বাসায় ছিলো ততক্ষণই খেয়াল রেখেছে কখন দোতলার বেল বাজে। না এবাড়িতে সাহিল ছাড়া কেউ আসে! আর না আরশি বাসা থেকে বের হয়! এই এক মাসে একটা বারও আরশিকে দেখতে পায়নি সে। একদিন কাব্য বাসা ভাড়া দিতে গেলো। সাহিল তাকে ড্রয়িং রুমে বসিয়ে অনেকক্ষণ গল্প করলো। দুজন একসাথে বসে একটা ক্রিকেট ম্যাচের কিছু অংশও দেখলো কিন্তু আরশির সাথে দেখা হলো না। একবার গলার আওয়াজ শুনলো শুধু। আরশি সাহিলকে ডাকলো, সাহিল ভেতরে গিয়ে চা নাস্তা নিয়ে এলো। আরশিকে না দেখতে পেয়ে যে কাব্য মরে যাচ্ছে ব্যাপারটা এমন নয়। কিন্তু না দেখতে পেয়ে চোখের তৃষ্ণা বেড়েই চলেছে তাই বারবার তার চোখ খুঁজে ফিরেছে আরশিকে।
কাব্য যখন ডেলিভারি ম্যানের হাত থেকে বইয়ের কার্টন টা হাতে নিয়ে ইনভয়েসে দেখছিল আরশি কি কি বই অর্ডার করেছে তখন আরশি এলো। কাব্যকে দেখেই কেমন একটা অস্বস্তি শুরু হয়ে গেলো তার ভেতরে। সে খুব করে চাইছে যেন সে স্বাভাবিক থাকতে পারে। আরশি ডেলিভারি ম্যানকে বললো,
“কত হয়েছে?”
“৯৩৯০। ম্যাম সরি ‘গড অফ স্মল থিংস’ বইটি দিতে পারিনি। একদম শেষ মুহুর্তে প্যাকিং এর সময় দেখি বইয়ের ভেতর একটা পাতা ছেঁড়া। এই মুহুর্তে আমাদের স্টকে বইটি নেই৷ আবার স্টক করলে আমরা যোগাযোগ করব।”
“ঠিকাছে।”
আরশি ডেলিভারি ম্যানকে ৯৫০০ টাকা দিলো। ডেলিভারি ম্যান বললো,
“চেঞ্জ নেই ম্যাম?”
“লাগবে না রেখে দিন।”
ডেলিভারি ম্যান চলে যেতেই আরশি গেটে তালা দিচ্ছিলো। এতক্ষণ পর্যন্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে আরশিকে দেখছিলো কাব্য। আজও সে এলোমেলো, কোঁচকানো সুতির জামা আর আধ কোঁকড়া চুল হাতখোপায় বাঁধা। ঘেমে-নেয়ে একাকার! ফরসা মুখ লাল হয়ে আছে। রান্না করছিলো বোধহয়। আরশি সবসময় থাকেই এমন যে দেখলেই ঘরের কেউ ঘরের কেউ অনুভূতি হয়। এতো মায়া কারো মুখে থাকে কী করে? কাব্যর চোখের তৃষ্ণা মিটেছে, মিলেছে মনের শান্তিও। এক মাস না দেখার অভাব যেন এক দেখাতেই পূরণ হয়ে গেলো। আরশি তালা দিয়ে ফিরে তাকাতেই কাব্য এবার কার্টনের ইনভয়েসের দিকে তাকিয়ে বললো,
“গুড চয়েজ! বাই দ্যা ওয়ে ‘গড অফ স্মল থিংস’ বইটি আমার কাছে আছে। আপনি বরং নিয়ে পড়ুন।”
আরশি স্বাভাবিকভাবেই বললো,
“না থাক। আগে যেগুলো নিয়েছি সেগুলো পড়ে নিই। তাছাড়া বইটি আমি আমার কালেকশনে রাখতে চাই।”
“আচ্ছা।”
আরশি কার্টনটার দিকে হাত বাড়াতেই কাব্য বললো,
“বইগুলো অনেক ভারী। আমি উপরে তুলে দেই?”
“থ্যাংকস, আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। আমিই পারবো।”
“আমি নিয়ে দিলে খুব কি ক্ষতি হয়ে যাবে?”
“আমি নিজের কাজ নিজে করতেই পছন্দ করি আঙ্কেল।”
কাব্যর মুখটা হা হয়ে গেলো। অবাক হয়ে বললো,
“হোয়াট! আমি আঙ্কেল?”
আরশি মুখটা স্বাভাবিক রেখে বললো,
“আপনি তিরার বাবার মতো হলে আমার তো আঙ্কেলই হবেন তাইনা?”
“ওয়েট ওয়েট!”
কাব্য বড় একটা নিশ্বাস নিয়ে বললো,
“শুনুন তিরা আমার সাথে কথা বলতো আমিও বলতাম। আমি প্রতিবেশি হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই ওর সাথে মিশতাম। বন্ধুত্বপূর্ণ একটা সম্পর্ক ছিলো। সেই বন্ধুত্বও তিরাই চেয়েছিলো। আমার দিক থেকে ব্যস এটুকুই। কিন্তু তিরা খুব দ্রুত আমার উপর ফল করছিলো। ও যে পরিমাণ ফাস্ট যেকোনো সময় আমাকে প্রোপোজ করে দিতো। এবং তখন না করা ছাড়া আমার কোনো উপায় থাকতো না। তখন কষ্ট কে পেতো? আমি? কষ্টটা তখন তিরা পেতো। ও যাতে সিরিয়াস হয়ে অনেকদূর এগিয়ে পরে কষ্ট না পায় সেজন্য কিছু মিথ্যে বলে আমি ওকে বুঝিয়ে দিয়েছি যে ওর সাথে বন্ধুত্বের চেয়ে বেশি কিছু সম্ভব না। যখন কাউকে গ্রহণ না করা যায় তখন তাকে ভালোবাসার কথা বলার সুযোগই দিতে নেই।”
“বাহ! আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আমাকে এতো দারুন একটা জিনিস শেখাবার জন্য!”
আবারও অবাক কাব্য,
“আমি কী শেখালাম?”
“এইযে শেখালেন যখন কাউকে গ্রহণ না করা যায় তখন তাকে ভালোবাসার কথা বলার সুযোগই দিতে নেই। আমি ভালোবাসার ব্যাপারে একদমই অনভিজ্ঞ। এটা হয়তো ভবিষ্যতে আমার কাজে লাগবে!”
আরশি বইয়ের কার্টন টা কাব্যর হাত থেকে নিয়ে সিঁড়ির দিকে চলে গেলো। কাব্য বিস্ময়ে সেখানেই স্থির হয়ে গেলো। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো এই অসম্ভব বুদ্ধিমতী মেয়েটির দিকে।
চলবে…