কনফিউশন
পর্ব ২৫+২৬
সেই যে আরশি ভোরবেলা কাব্যর সাথে হাঁটতে বের হলো, এরপর থেকে সে আর নিজেকে গৃহবন্দী করে রাখে না। প্রতিদিন আমরিনের সাথে খেলে, বাগানে যায়, ছাদে যায়। কদিন পর মেডিকেলে ভর্তি হলো। এরপর কী যেন হলো! প্রতিদিন কাব্যর সাথে কোনো না কোনো উসিলায় তার দেখা করা হতো। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আরশি মাঝেমাঝে কোনো উসিলা বের না করে অপেক্ষা করতো, কাব্য কী করে সেটা দেখার জন্য। এবং সেদিন কাব্য নিজেই উসিলা বের করে দেখা করতো। আরশির কী যে ভালো লাগতো! হতো অনেক গল্প। বেশিরভাগ গল্প হতো বই নিয়ে। এখন আরশি অনেক সহজ হয়ে গেছে কাব্যর সাথে। তার সাথে যতো কথা বলে তত কথা বোধহয় রশ্নি বা তিরার সাথেও বলেনি কখনো! কাব্যকে কিছু বলতে পারলে আর কাব্যর সবকথা শুনতে পারলেই যেন পার্থিব সব শান্তি মিলে যায় আরশির। এখন তাদের বাইরেই দেখা হয় বেশি। আরশি কাব্যকে তুমি করে বলে এখন। কাব্যর ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং কমপ্লিট। বিদেশে হায়ার স্টাডিজের জন্য স্কলারশিপের চেষ্টা করছে। ততদিন আগের চাকরিটাই করছে, তবে এখন ফুলটাইম করে। কাব্য প্রতিদিন অফিস থেকে বের হয়ে ফোন করে আরশিকে। আরশি বাইরে থাকলে একসাথে বাসায় ফেরে। এমনই একদিন রিক্সা করে বাসায় ফিরতে ফিরতে কাব্য হঠাৎই জিজ্ঞেস করেছিলো,
“আরশি আমি তোমার তুমি হবো কবে?”
আরশি সেকথায় প্রথমে চমকে গেলেও পরে মৃদু হেসে বলেছিলো,
“তুমি হওয়াটা কি খুব জরুরি?”
“জরুরি নয়, তবে তুমি করে বললে আমার ভালো লাগবে। আমার মনে হয় তোমারও ভালো লাগবে। আমি না বললে তো কখনো তুমি বলবে না, তাই আমি বললাম।”
এরপর থেকে আরশি কাব্যকে তুমি করে বলে। প্রথমে কিছুদিন আপনি তুমি গুলিয়ে যেতো, এরপর একসময় তুমিতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সেই ভয়ঙ্কর স্বপ্নের কথা সবসময়ই মাথায় ঘোরে কাব্যর, নিজের অনুভূতি নিয়ে এখনো সে কনফিউজড, আরশি এবং সে দুই মেরুর মানুষ এটাও সে জানে তবুও কীভাবে যেন দুজন দুজনার কাছে চলে আসছে। যদিও সম্পর্কটা এখনো শুধুই বন্ধুত্বের। কিন্তু আরশি সামনে আসলে কাব্য নিজেকে আটকে রাখতে পারে না। তখন সে কী বলে কী করে নিজেও জানেনা। আবার সামনে না আসলেও আনার জন্য উতলা হয়ে যায়। আরশিও সমানভাবেই উতলা হয় তার জন্য। এটা সে বোঝে। খুব ভালোও লাগে তার। যেহেতু এই সম্পর্কের দড়ি তার হাতে নেই, কেবল এগিয়েই চলেছে আপন গতিতে সেহেতু সম্পর্কটা অন্যদিকে মোড় নেয়ার আগেই সে আরশির কাছে নিজেকে পুরোটা তুলে ধরতে চায়। আরশি যদি তার সাথে নিজের জীবন জড়াতে চায় তাহলে পুরোটা জানা উচিৎ তার। পরে জানলে হয়তো কষ্ট পাবে। কিন্তু অনেকবার চেষ্টা করেও সে এখনো পর্যন্ত তনিকার কথা বলতে পারেনি। সময় সুযোগ হয়ে উঠছে না।
যাদিদ যখন তার ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিলো, তখন ঘুমে চোখ বুঝে আসছে। কেবলই মনে হচ্ছিল এক্ষুণি ঘুমিয়ে পড়ুক। কিন্তু একদিন ফোন না করলে অস্থির হয়ে যায় তিরা তাই বাধ্য হয়েই ফোন করলো। তিরা যেন মোবাইল হাতে তার অপেক্ষায় বসে থাকে। সবসময় একবার রিং হতেই ধরে ফেলে। সবসময়ের মতো আজও হুড়মুড়িয়ে বললো,
“হ্যালো।”
“হ্যালো, কেমন আছো?”
“যাদিদ ছাড়া তিরা কখনো ভালো থাকবে না।”
যাদিদ হেসে বললো,
“তোমার একটা ঘরজামাই বিয়ে করা দরকার ছিলো।”
“চুপ থাকো।”
“চুপ থাকলে ঘুমিয়ে পড়বো।”
“খেয়েছো?”
“হুম। তুমি?”
“পরে খাবো।”
“ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করো। বাড়ি ফিরে যদি দেখি শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছো, না ঘুমিয়ে চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে তাহলে কিন্তু আরেকটা বিয়ে করবো।”
এ কথা শুনে তিরার মাথা গরম হয়ে গেলো। রেগেমেগে বললো,
“খুন করে ফেলবো তোমাকে তাহলে।”
যাদিদ হেসে বললো,
“তখন তো একটুও পাবেনা।”
“আমি না পেলে কাউকে পেতে দেবো না।”
যাদিদ এবার জোরে হেসে দিলো। তিরা বললো,
“সামনে থাকলে তো হাসো না, এখন এতো হাসি কোত্থেকে আসছে।”
“সামনে থাকলে তো এরকম পাগলের মতো রাগ দেখাও না, তাই এতো হাসি না।”
“আমার রাগ দেখে তোমার হাসি পায়?”
“পায়।”
“রাখলাম আমি।”
“রাখলে কিন্তু আর কলব্যাক করবো না, ঘুমিয়ে পড়বো।”
“তুমি এমন কেন যাদিদ?”
“কেমন?”
“বাদ দাও। কবে আসবে তুমি?”
“দেরি আছে রে বাবা। এক কথা কতোবার জিজ্ঞেস করবে?”
“আমার তোমাকে ছাড়া ভাল্লাগে না।”
যাদিদ আবার হেসে বললো,
“মাত্র ৫ দিন একসাথে থেকেই এই অবস্থা?”
“৫ টা দিন ইম্পরট্যান্ট নয়, আমার লাইফটা চেঞ্জ হয়ে গেছে তোমার সাথে বিয়ে হয়ে।”
“অ্যারেঞ্জ ম্যারেজে বউরা এতো পাগল হয় আগে জানতাম না তো। ডিফেন্সের লোকদের কোনো পিছুটান থাকতে নেই। এজন্য ডিফেন্সে ঢোকার পর একটা প্রেমও করলাম না। অথচ আমার অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ করা বউই কিনা প্রেমিকাদের মত পাগলামি করছে! হায় আল্লাহ বাঁচাও আমাকে।”
“এসব কী বলছো তুমি? তোমার তো খুশি হওয়া উচিৎ যে তোমার বউ তোমার জন্য পাগল।”
“আমি কখনোই চাইনা তুমি আমার জন্য পাগল হও। ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছো, এবার মন দিয়ে পড়াশোনা করো। ক্যারিয়ার গড়ো, এনজয় ইওর লাইফ। একটা মেয়ে কেন একটা ছেলেকে এতোটা গুরুত্ব দেবে যে তার অনুপস্থিতিতে মেয়েটা পাগল হয়ে যাবে?”
“তুমি আমার ভালোবাসা চাও না?”
“চাই। যখন আমি বাড়ি থাকবো উজার করে ভালোবাসবে, যেমনটা আমি বেসেছি ওই ৫ দিন। কিন্তু যখন দূরে থাকবো কোনো পাগলামি চাইনা তিরা।”
“তাহলে এরপর যখন আসবে আমার পেটে একটা বাবু দিয়ে যাবে। একঅটা ছোট্ট যাদিদ আসবে। এরপর ওকে নিয়ে আমার সময় কেটে যাবে।”
“শিট! তিরা কী বলছো? তোমার এখন পড়াশোনা করার বয়স, বাচ্চা পালার বয়স হয়নি। পড়াশোনা শেষ করবে এরপর বাচ্চা নেবো।”
“আমি তাহলে এতদিন থাকবো কীভাবে?”
“বিয়ের আগে যেভাবে থাকতে।”
তিরার মনে পড়ে গেলো সে কীভাবে বিয়ের আগে উঠতে বসতে সকাল সন্ধ্যা ক্রাশ খেতো। কিন্তু এখন তো কাউকে ভালোই লাগে না। মাথার মধ্যে সারাক্ষণ শুধু যাদিদ ঘোরে। এ কেমন ভালোবাসার জালে বন্ধী হয়ে গেলো সে? তিরার এতো অসহায় লাগছিলো যে সে হঠাৎ কাঁদতে শুরু করলো। যাদিদ বললো,
“তিরা তুমি কি পণ করেছো প্রতিদিন ফোন রাখার আগে কাঁদবে? আর কতোবার বলবো কান্নাকাটি ভাল্লাগেনা আমার।”
“আমি জানিনা কীভাবে এতো ভালোবেসে ফেললাম তোমাকে।”
“আমিও তোমাকে ভালোবাসি তিরা কিন্তু বাস্তবকে আমাদের মেনে নিতে হবে। এমন যদি হতো তুমি কাঁদলেই আমি চলে আসতে পারবো তাহলে নাহয় কাঁদতে, আমি মানা করতাম না। কিন্তু ব্যাপারটা তো এমন না। ওই একটা বাৎসরিক ছুটি ছাড়া আমাদের আর কোনো ছুটি নেই। তাই কান্নাকাটি করো না প্লিজ। তুমি কান্নাকাটি করলে আমার দূরে থাকাটা কষ্টকর হয়ে যাবে।”
যাদিদের মুখে ভালোবাসার কথা শুনলে এতো শান্তি লাগে তিরার কিন্তু ছেলেটা বলে না। আজকের মত অনেকদিন পর একদিন হঠাৎ বলে। অথচ তিরা প্রতিদিন বলতে থাকে৷ এমন কেন ছেলেটা?
বিকেলে আরশি পড়ছিলো এমন সময় কাব্যর ফোন এলো। ফোন ধরতেই কাব্য বললো,
“আরশি হেল্প মি।”
“কী হেল্প?”
“তুমি ডিম ভাজতে পারো?”
“না পারার কী আছে?”
“আমাকে একটা ডিম ভেজে দিয়ে যাবে প্লিজ?”
“ডিম তো তুমি নিজেই ভাজতে পারো!”
“এই মুহুর্তে পারছি না বলেই তোমাকে বলছি।”
আরশির মনে হলো এটা ওকে দেখার জন্য কাব্যর বানানো এক উসিলা। মুখে হাসি ফুটে উঠলো। দ্রুতই সে বের হলো। এই উসিলাগুলো খুব ভালোবাসে আরশি! রশ্নিকে বাগানে যাবে বলতে গিয়ে দেখে সে আমরিনকে নিয়ে ঘুমাচ্ছে। তাই আর বলা হলো না। চলে গেলো নিচে।
কাব্যর ফ্ল্যাটের দরজা খোলাই ছিলো। আরশি ঢুকতেই রান্নাঘর থেকে কাব্য বললো,
“আমি এখানে।”
আরশি সোজা রান্নাঘরে চলে গেলো। গিয়ে দেখে পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে কাব্যর হাত কেটে একাকার অবস্থা। ছুরি, চপিং বোর্ড রক্তে মাখামাখি। আরশি কাব্যর হাতের দিকে তাকিয়ে আঁৎকে উঠে বললো,
“এতোখানি কাটলে কী করে?”
“মাত্রই অফিস থেকে ফিরেছি। প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে, তাড়াহুড়ো করছিলাম।”
“রান্নাবান্না করোনা? আর কিছু নেই খাওয়ার?”
“কাল বিজি ছিলাম, রাঁধতে পারিনি।”
“ফার্স্ট এইড বক্স আছে নাকি আমি নিয়ে আসবো?”
“আমি পরে ব্যান্ডেজ করে নেব, আগে খেয়ে নিই।”
“হাত থেকে এখনো রক্ত পড়ছে কাব্য।”
কাব্য একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
“আনতে হবেনা, ফার্স্ট এইড বক্স আমার আলমারিতেই আছে।”
আরশি দ্রুত পায়ে কাব্যর ঘরে ঢুকলো, পেছন পেছন কাব্য ঢুকলো। কাব্য বললো,
“ডান পাশের কাবার্ডের ২য় তাকে দেখো আছে।”
আরশি যখন আলমারিটা খুললো কাব্য তখন তার পাশেই দাঁড়ানো। ফার্স্ট এইড বক্সটা সরাতেই পেছনে একটা শাড়ি চোখে পড়লো আরশির। সে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে শাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইলো। কাব্যর আলমারিতে শাড়ি কেন সেটা বুঝতে পারছেনা কিছুতেই। কাব্য কিছুটা ইতস্ততবোধ করলো। আরশি নিজের বিস্ময় লুকিয়ে বক্সটা নিয়ে বিছানায় বসলো। বললো,
“তাড়াতাড়ি এসো রক্ত পড়ছে।”
কাব্য চেয়ার টেনে আরশির সামনে বসলো। আরশি চুপচাপ কাব্যর হাত পরিস্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছিলো। কাব্য বললো,
“শাড়িটা কার জানতে চাও না?”
আরশি না তাকিয়েই বললো,
“আমি জেনে কী করবো?”
“সত্যিই জানতে চাও না?”
“না। হবে হয়তো কারো।”
“আমি জানাতে চাই।”
“তাহলে বলো।”
“শাড়িটা কারো নয়, একজনের জন্য কিনেছিলাম। তাকে আর দেয়া হয়নি।”
কেন যেন আরশির বুকের ভার নেমে গেলো। বললো,
“ওহ আচ্ছা।”
“যার জন্য শাড়িটা কিনেছিলাম তার কথা তোমাকে বলতে চাই।”
আরশি হেসে বললো,
“তোমার এক্স গার্লফ্রেন্ডের মেয়ের মা?”
কাব্য মৃদু হেসে বললো,
“ব্যাপারটা সিরিয়াস আরশি।”
“আচ্ছা শুনবো। কিন্তু তোমার তো ক্ষুধা লেগেছে, আগে খেয়ে নাও। ডিম টা আগে ভেজে দেই।”
এটা বলে আরশি রান্নাঘরে চলে গেলো। কাব্য গেলো পেছন পেছন। আগেও যতবার কাব্য বলতে চেয়েছে ততবার আরশিকে কেউ ডেকেছে অথবা আরশি অন্য কথা বলে কাব্যর বলার মুড নষ্ট করে দিয়েছে। এবার বলতেই হবে, দেরি হয়ে যাচ্ছে। আরশি ডিম ভাজছে। কাব্য পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
“তোমার হাতে সময় আছে এখন?”
“না। অনেক সময় দরকার?”
“ঘন্টাখানেক তো লাগবেই।”
“তাহলে রাতে ফোনে শুনিও।”
“না, ফোনে না। সামনাসামনি বলতে হবে।”
“তাহলে সন্ধ্যার পর ছাদে এসো, আজ জোৎস্নারাত।”
“আচ্ছা।”
আরশি প্লেটে ভাত আর ডিমভাজি নিয়ে কাব্যর হাতে দিয়ে বললো,
“আমি এখন আসি।”
“আচ্ছা।”
আরশি উপরে গিয়ে একটা বাটিতে মাছের তরকারি নিয়ে আবার নিচে গেলো। এবার দরজা লাগানো। বেল বাজাতেই কাব্য এঁটো হাতে দরজা খুললো। আরশি বাটি এগিয়ে দিয়ে বললো,
“নাও।”
“আরে ধুর লাগবে না আরশি।”
“স্পেশাল কিন্তু, কলাপাতায় রেঁধেছি।”
কাব্য মুচকি হেসে বাটিটা নিয়ে ঘ্রাণ শুঁকে বললো,
“সরষে দিয়েছো?”
“হুম।”
“অস্থির ঘ্রাণ।”
আরশি হেসে বললো,
“খাও, আমি গেলাম।”
“সন্ধ্যার অ্যাপয়েন্টমেন্ট কোনোভাবে ক্যান্সেল যাতে না হয় প্লিজ।”
চলবে…
কনফিউশন
পর্ব ২৬
আরশি ঘরে ঢুকে বুকে বালিশ চেপে বসে রইলো। ভয়ঙ্করভাবে বুক কাঁপছে তার। কাব্য কী বলবে? কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে এক্স গার্লফ্রেন্ডের কথা বলবে। কাব্যর মতো ছেলের এক্স থাকবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু সেই এক্সের কথা সে আরশিকে বলতে চাচ্ছে এটা অস্বাভাবিক। তাহলে কি কাব্য কোনো সম্পর্কে যাওয়ার আগে পুরোনো সব বলে নিতে চায় যাতে পরে ঝামেলা না হয়? এ কথা ভাবতেই আরশির প্রচন্ড ভালো লাগলো। কাব্যর অনেক বদ অভ্যাস আছে এটা ঠিক কিন্তু সব ছাপিয়ে এই ছোটো ছোটো গুণগুলোই যে বারবার মুগ্ধ করে ফেলে আরশিকে!
যাক অবশেষে তনিকার কথা আরশিকে বলার সুযোগ পাওয়া গেলো। ফোনে বলার সুযোগ হয় অহরহ। কিন্তু কাব্য সামনাসামনি বলতে চায়। সব শুনে আরশির প্রতিক্রিয়া দেখতে চায় কাব্য। যেটা ফোনে বললে সেটা সম্ভব না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে চা খেতে খেতে এ কথাই ভাবছিলো কাব্য। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে বিকেল থেকে সন্ধ্যা হতে একটু বেশিই সময় নিচ্ছে। অপেক্ষা করা মুশকিল, যতটুকু হালকা লাগছে ততটুকুই দুশ্চিন্তা হচ্ছে। আরশি হয়তো এখন তাকে একরকম ভাবছে। তনিকার কথা শোনার পরে আরেকরকম ভাববে। তা ভাবুক। কাব্য যেমন মানুষ, তেমনটা স্পষ্ট থাকা উচিৎ আরশির কাছে।
সন্ধ্যার পর রশ্নি ও আরশি দুজনে একসাথে বসে চা খেলো। এরপর আরশি ছাদে গেলো। যেহেতু আরশি প্রায়ই ছাদে বা বাগানে হাঁটে তাই রশ্নি আর এ ব্যাপারে ভাবলো না। ছাদে যেতে যেতে আরশি কাব্যকে ফোন করতেই সে চলে এলো। আরশি বললো,
“এতো তাড়াতাড়ি এলে কীভাবে?”
“বাগানে ছিলাম।”
“ও আচ্ছা।”
আরশিদের ছাদে ছোটো একটা বসার ব্যবস্থা আছে। সেখানেই বসলো দুজন। কাব্য বললো,
“আজকের চাঁদটা সুন্দর।”
“হ্যাঁ।”
জোৎস্নার ভেসে যাওয়া আলোয় শুভ্রের মতো আরশিকে দেখে কাব্য বিমোহিত হয়ে গেলো। মেয়েটাকে একেক সময় একেক রকম সুন্দর লাগে। এইযে আরশির হাসি হাসি সুন্দর মুখ, এটা তো একটু পরেই মিলিয়ে যাবে। তখন কি জগৎ সংসারের আর কিছু ভালো লাগবে কাব্যর? আজ কি তবে বাদ দেবে তনিকার কথা? কিন্তু আজ তো প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিলো, আরশিকে বলেছেও সে কথা। তবে কি আরেকদিন বলবে? কাব্য যখন এসব ভাবনায় বিভোর ছিলো তখন আরশি বললো,
“কী ভাবছো?”
“কিছু না।”
“কী যেন বলবে বলেছিলে?”
কাব্য ভাবলো যা হবার হবে, বলে দিক আজ। কাব্য বলতে শুরু করলো,
“হুম বলবো। ভাবছি কোনদিক থেকে শুরু করবো! সব এতো এলোমেলো!”
আরশি হেসে বললো,
“একদিক থেকে শুরু করলেই হয়।”
“আচ্ছা এলোমেলোভাবেই বলি৷ এসব গুছিয়ে বলা সম্ভবও না বোধহয়।”
“বলো।”
“মেয়েটার নাম তনিকা। গতবছর ওর সাথে আমার সম্পর্ক হয়। এর আগে আমার কারো সাথে কিছু ছিলো না, এটাই আমার প্রথম প্রেম বলতে পারো।”
“আচ্ছা।”
“তনিকার সাথে আমার পরিচয় এক বন্ধুর মাধ্যমে। আমাদের বন্ধুদের আড্ডায় আসতো। ছেলেদের সাথেই তার ওঠাবসা বেশি, মেয়েদের সাথে তার যায় না। মেয়েটা প্রচন্ড সাহসী ও জেদি। প্রকাশ্যে সিগারেট খায়, স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড, কোনো ন্যাকামি নেই, ভনিতা নেই, লজ্জা নেই, জড়তা নেই, একদম বোল্ড। আই লাইক দ্যাট টাইপ অফ গার্ল। আড্ডায় আসতো, প্রায়ই দেখা হতো, কথা হতো। এভাবেই ভালো লাগার শুরু। বুঝতাম সেও আমাকে পছন্দ করে। অল্প কয়েক মাসের পরিচয়েই আমাদের প্রেম হয়। পয়েন্ট টু বি নোটেড, আমিই তাকে প্রোপোজ করেছিলাম।”
আরশি হেসে বললো,
“এরকম মেয়ে সিনেমায় দেখা যায়।”
কাব্যও হেসে বললো,
“বাস্তবেও আছে তবে রেয়ার।”
“তারপর কী হলো?”
“মা আমার বেস্টফ্রেন্ড। মার কাছে আমি কিছুই লুকাই না। জীবনের প্রথম একটা প্রেম করছি, লুকানোর তো প্রশ্নই আসেনা। তনিকার ব্যাপারটা মায়ের সাথে শেয়ার করি। মা আবার অতি উৎসাহী। সে তনিকার সাথে কথা বলতে চাইলো। আমি কথা বলিয়ে দিলাম দুজনার।”
“বাহ।”
“ভালোই চলছিলো। তবে ঝামেলাটা হলো কিছুদিন পর। যখন আমরা লিভ টুগেদার শুরু করলাম।”
এবার আরশি চমকে গেলো। কি বলবে বুঝতে পারলো না। কিছু কি বলা উচিৎ? নাকি চুপচাপ শুনে যাওয়া উচিৎ? অবশেষে আরশি বললো,
“কিন্তু আমাদের দেশে দুজন অবিবাহিত ছেলেমেয়ে একসাথে কীভাবে থাকতে পারে? এটা কি সম্ভব?”
“তনিকা হুট করে এসে থাকতে শুরু করে। জেদ ধরে সে যাবেনা। শেষে উপায় না দেখে বাড়িওয়ালাকে বলি বিয়ে করে ফেলেছি।”
আরশি এবার আর কিছু বললো না। কাব্য বলতে লাগলো,
“ধীরে ধীরে তনিকা আমার ব্যাপারে একটু বেশিই ক্রেজি হয়ে যাচ্ছিলো। ব্যাপারটা প্রথমে আমার ভালো লাগলেও পরে অস্বস্তিতে রূপ নিলো যখন সে আমার বাসায় এসে উঠলো।”
“তোমার ফ্যামিলির কেউ কখনো তোমার বাসায় আসতো না?”
“না, কক্সবাজারে বাবার কিছু হোটেল আছে তারই একটার ব্রাঞ্চ ঢাকায় আছে। কেউ এলে সেখানেই ওঠে।”
“ওহ আচ্ছা।”
“সমস্যা ফ্যামিলি বা পারিপার্শ্বিক কোনো দিক থেকে ছিলো না। সমস্যাটা আমাদের মধ্যেই তৈরি হয়েছিলো। কিংবা বলা ভালো আমার মধ্যে।”
আরশি চুপ। কাব্য বললো,
“মাসখানেক একসাথে থাকার পর আমি একটা জিনিস আবিস্কার করলাম তা হলো প্রতিবার ওর সাথে পারসোনাল টাইম স্পেন্ড করার পর আমি খুব বিষণ্ণবোধ করি। তখন আমার কিছু ভালো লাগে না। এরপর থেকে কিছুটা দূরে থাকার চেষ্টা করি।”
আরশি এবারো কিছু বললো না। কাব্য বললো,
“ব্যাপারটা তনিকাকে বলবো কিনা বুঝতে পারছিলাম না। সে কষ্ট পাক এটা আমি চাচ্ছিলাম না। সে হ্যাপি ছিলো আমার সাথে।”
আরশি এসবের সাথে পরিচিত না। কি বলবে জানেনা তাই চুপ করেই রইলো। কাব্য বললো,
“কিছুদিনের মধ্যে আরো কিছু জিনিস আবিস্কার করলাম যেমন, তনিকা যখন বাইরে থাকে এবং আমি একা থাকি তখন খুব ভালো থাকি৷ আবার আমি যখন বাইরে থাকি তখনও খুব ভালো থাকি। এরপর আমি ইচ্ছে করে লেট নাইট পর্যন্ত অফিস করতাম বা আড্ডা দিতাম যাতে আমি ফেরার আগে সে ঘুমিয়ে পড়ে। এভাবে আসলে আমি পারছিলাম না। এরমধ্যেই সেমিস্টার গ্যাপ এলো, তখন কক্সবাজার গিয়ে এক মাসের বেশি থাকলাম। এদিকে তনিকা পাগল হয়ে যাচ্ছিলো কবে ফিরব বলে আর আমি ওদিকে অযুহাত খুঁজতে থাকলাম কীভাবে আমার ঢাকা আসা আরো পেছানো যায়।”
আরশি বললো,
“খুবই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি।”
কাব্য একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
“প্রচন্ড।”
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। এরপর কাব্য বললো,
“যাই হোক, এরপর এক্সাম কাছাকাছি আসায় ঢাকা ফিরতে হলো। কিছুদিন পর আমি যা বুঝলাম তা হলো আমি তনিকাকে ভালোবাসি না, ভালোলাগে ওকে আমার। আর এই ভালোলাগাকেই ভালোবাসা ভেবে ভুল করে ফেলেছি আমি৷ তোমাকে বলেছি প্রপোজ আমি করেছিলাম। ভুলটা যেহেতু আমার সেহেতু এতদিন একসাথে থাকার পর সম্পর্কটা ভাঙতে চাচ্ছিলাম না। আমাদের দেশে অনেক স্বামী স্ত্রী তো ভালো না বেসেও একসাথে থাকে আমিও সেরকমই থাকার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু সেভাবেও আমি পারছিলাম না, হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। আমি শুধু এই অভিনয়, পালিয়ে বেড়ানো এসব থেকে মুক্তি চাচ্ছিলাম। তাই তনিকার সাথে সব কথা শেয়ার করার সিদ্ধান্ত নিই। তার সব জানা দরকার। সব শুনে সে যা সিদ্ধান্ত নেবে তাই হবে। সে কো-অপারেট করে থাকতে চাইলে থাকবে, চলে যেতে চাইলে চলে যাবে। তবে আমি সবকিছুর আগে তার কাছে মাফ চেয়ে নেই ভুলটা তো আমারই ছিলো।”
“তারপর?”
“তারপর আর কী! সব শুনে তনিকা খুব বাজেভাবে রিয়্যাক্ট করে।”
“কিরকম?”
“ভুল বোঝে, রেগে যায়। ওর হাতের কাছে টেবিলে একটা কাচি ছিলো সেটা ছুঁড়ে মারে। ব্রেকাপ করে। তারপর ওর সব জিনিসপত্র নিয়ে চলে যায়।”
“তোমার গালের কাটা দাগটা কী সেই কাচিতে কাটা?”
“হ্যাঁ।”
“এরপর আর যোগাযোগ করেনি?”
“করেছে তবে আমার সাথে নয়, আমার মায়ের সাথে।”
“আন্টির সাথে কেন?”
“মাকে সব বলেছে। মা আমাকে ভুল বোঝে এখনো। যতোবার দেখা হয় ততবারই সেসব কথা তোলে। তনিকার বিয়ে হয়েছে গতবছরই আমাদের ব্রেকাপের পর। কিন্তু তারপরেও আমার উপর ওর রাগ এখনো মেটেনি। তিরার বিয়ে থেকে আমি সোজা বাড়ি চলে গেলাম না?”
“হ্যাঁ।”
বাড়ি যাওয়ার পর কী হয়েছে তা সব বললো কাব্য। সব শুনে আরশি বললো,
“আন্টিকে কেন সব বললো?”
“জিজ্ঞেস করিনি?”
“কেন?”
কাব্য মৃদু হেসে বললো,
“কারণ সে চায় আমি তাকে ফোন করি, সে কেন এসব করছে জিজ্ঞেস করি। কিন্তু আমি তা করবো না।”
চলবে…