কনফিউশন পর্ব ২১+২২

0
1535

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ২১+২২

খন্দকার বাড়ির সবাই আজ বেশ খুশি কারণ কাব্য আজ অনেকদিন পর বাড়ি এসেছে। তাদের যৌথ পরিবারের সবাই একসাথে বসে খায়। একমাত্র এই ছেলেটা থাকেনা। আজ অনেকদিন পর সবাই একসাথে বসে দুপুরের খাবার খাবে তারই আয়োজন চলছিলো। সবাই টেবিলে চলে এলেও কাব্য এলোনা বলে আফতাব খন্দকার নিজেই গেলেন ছেলেকে ডাকতে। কিন্তু ঘরে ঢুকে দেখেন কাব্য সেখানে নেই। শাহনাজের কাছ থেকে শুনেছেন সকালে কাব্য এসেছে, সে ঘুমুচ্ছে। এরমধ্যেই আবার কোথায় গেলো? স্ত্রীকে ডাকতে ডাকতে কাব্যর ঘর থেকে বের হলেন তিনি,
“শাহনাজ কোথায় তোমার ছেলে? ঘরে তো নেই।”
শাহনাজ বেগমের বুক কেঁপে উঠলো। তনিকার কথায় কাব্য কি রাগ করে চলে গেলো? তিনি বললেন,
“দাঁড়াও ফোন করে দেখি কোথায় গেলো!”

কাব্যর বাস তখন কুমিল্লা পার করছে। তখনই মায়ের ফোন এলো। সে ফোন ধরে খুব স্বাভাবিকভাবেই কথা বললো,
“বলো মা।”
“তুই কোথায়?”
“কুমিল্লা।”
“ওমা কুমিল্লা কী করিস?”
“ঢাকা যাই।”
“কাব্য! এটুকুর জন্য তুই আমার সাথে রাগ করে চলে গেলি? তোকে শাসন করার অধিকার কি আমার নেই?”
“তুমি শাসন করোনি মা। আর শাসন করার অধিকার তোমার অবশ্যই আছে।”
“এভাবে চলে গেলি একবার ভাবলি না তোর বাবাকে আমি কি বলবো? তুই এসেছিস বলে বাড়ির সবাই আজ কতো খুশি ছিলো!”
“আমি খুশি ছিলাম সকালে।”
“ফিরে আয় বাবা, দুটো দিন থেকে যা। আমি তোর বাবাকে কিছু একটা বলে ম্যানেজ করি আপাতত।”
“কেন? আমি চলে আসায় বাবা রাগ করলে আমার উপর করবে তোমার তাতে কী?”
“উফ কাব্য তুই সবার খুশি নষ্ট করছিস।”
“বাবা কল দিচ্ছে কথা বলি। তুমি রাখো।”
মায়ের কল কেটে বাবার কল ধরতেই আফতাব খন্দকার বললেন,
“কী ব্যাপার কাব্য? শুনলাম তুমি বাড়ি এসেছো। তা কোথায় তুমি? খেতে বসবো অপেক্ষা করছি।”
“সরি বাবা আমি ঢাকা যাচ্ছি।”
“এতোদিন পর এলে দেখা না করেই চলে যেতে হলো কেন?”
“আমার বস এক্সিডেন্ট করেছে। খবর পেয়ে হঠাৎ চলে যেতে হচ্ছে। আমি কিছুদিনের মধ্যে আবার আসবো বাবা। সরি ফর টুডে।”
“ঠিকাছে।”
বাবার ফোন কেটে কাব্য আবার চোখ বন্ধ করলো। তার কপালের দুপাশের রগগুলো লাফাচ্ছে। ভেঙে ফেলতে মন চাইছে সবকিছু!

“আমরা হানিমুনে যাবো না?”
যাদিদ টিভি দেখছিলো। তিরার এ কথায় টিভি থেকে চোখ সরিয়ে তিরার দিকে তাকিয়ে বললো,
“হানিমুনে যাবো কীভাবে আমার ছুটি শেষের পথে।”
“এখনো তো শেষ হয়নি। চলোনা দুদিনের জন্য কোথাও যাই।”
“না তিরা আর মাত্র দুদিনই ছুটি আছে। তিনদিনের দিন আমি চলে যাবো। শেষ দুদিন আমি আমার ফ্যামিলির সাথে কাটাবো।”
“তার মানে আমাদের হানিমুন হবেনা?”
“হবে। এরপরের ছুটিতে যখন আসবো তখন হানিমুনে যাবো।”
তিরার মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। তবে সে আর এ বিষয়ে কথা বাড়ালো না। শুয়ে পড়লো।

আরশি শুয়ে ছিলো। সে ইদানীং খুব দুর্বল অনুভব করে। গায়ে একফোঁটা শক্তি পায়না। সারাক্ষণ শুয়ে থাকে। উঠে খেতে চায়না, গোসল করতে চায়না, ঘুমায় না৷ শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আরশির যখন সেই ভয়ঙ্কর ঘটনাটা মনে পড়ে বা কেউ মনে করিয়ে দেয় তখন সে এমন হয়ে যায়। এই সময়গুলো রশ্নি একটু বেশি সময় দিতো আরশিকে, বেশি যত্ন করতো। কিন্তু এবার ছোটো বাচ্চা থাকায় অতটা পারছে না। সাহিল অফিস থেকে ফিরলে রশ্নি বললো,
“সাহিল বাবুকে একটু রাখবে আরশি সারাদিন কিছু খায়নি। বাবু যখন ঘুমিয়েছে তখন রান্নাবান্না করেছি। এরপর থেকে সে এতো জ্বালিয়েছে যে আমি আরশিকে খাওয়াবো সেই সুযোগটুকুও পাইনি।”
সাহিল বললো,
“আচ্ছা আমি ফ্রেশ হয়ে এসে বাবুকে রাখছি। কিন্তু তুমি একটু চাচীকে ডেকে নিতে।”
“আরশিকে এভাবে দেখলে চাচী বিরক্ত হয় সাহিল। নানান কথা বলে, ভালো লাগে না আমার ওসব। মাকে বলেছি কিছুদিন এখানে এসে থাকতে। মা কাল আসবে বলেছে।”
সাহিল রশ্নির পাশে বসে তার একটা হাত ধরে বললো,
“রশ্নি আমি তোমার কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। আমাদের বিয়ের ৮ বছরেও আরশি ছোট বলে কখনো মা হতে চাওনি।”
“ধ্যাত আমি তো নিজেই ছোটো ছিলাম। একসাথে দুটো বাচ্চা কীভাবে সামলাবো তাই মা হতে চাইনি।”
“একই তো হলো! এখনো পর্যন্ত আরশিকে তার রক্তের সম্পর্কের আপনজনদের থেকেও তুমি বেশি বোঝো বেশি যত্ন নাও, কীভাবে পারো? গত ৮ বছরে সবাই ওর উপর বিরক্ত হয়ে গেছে, কিন্তু তোমার এতো ধৈর্য আসে কোথা থেকে?”
“আরশি আমার কাছে শুধু আমার ননদ নয় সাহিল। ও আমার মেয়ের মতো। ও আমাকে কতোটা ভালোবাসে কতোটা ভরসা করে তুমি জানোনা।”
“হয়তো জানিনা সত্যিই জানিনা তাই খুব অবাক লাগে।”

রশ্নি প্লেটে ভাত নিয়ে আরশির ঘরে ঢুকে লাইট জ্বালালো। লাইট জ্বলে উঠতেই আরশি উঠে বসলো। ভাতের প্লেট দেখে বললো,
“খেতে ইচ্ছে করছে না ভাবী।”
“ইচ্ছে না করলেও খেতে হবে। নাহলে তুই অসুস্থ হয়ে পড়লে আমি একা দুটো মেয়েকে সামলবো কী করে? নে হা কর।”
আরশি অনিচ্ছাসত্ত্বেও খেতে শুরু করলো। খাওয়াদাওয়া, বেঁচে থেকে জীবনটাকে সামনের দিকে টেনে নেয়া এসব এতো কঠিন হয়ে পড়ে কেন মাঝেমাঝে? ভাত মাখতে মাখতে রশ্নির হঠাৎ সেই ছেলেটার কথা মনে পড়লো আরশি প্রায়ই যার কথা বলতো। তার কথা বলে যদি আরশিকে একটু হলেও সবকিছু থেকে দূরে রাখা যায় সে ভাবনা থেকেই রশ্নি বললো,
“আচ্ছা আমি আসার পর ওই ছেলেটার কথা তো আর একদিনও বললি না?”
আরশির হঠাৎ কাব্যর কথা মনে পড়লো। কী অদ্ভুত! একয়দিন কাব্যর কথা একদম মনে পড়েনি। কিন্তু কাব্যও তো কোনো মেসেজ বা ফোন দিলো না! সেই যে বাড়ি গেলো আর কোনো খোঁজ নেই! রশ্নি আবার বললো,
“কীরে কিছু বল।”
“মনে ছিলো না ভাবী।”
“কী মনে ছিলো না?”
“তার কথা।”
“তোদের নিয়মিত কথা হয় না?”
“না তো।”
“ছেলেটার সাথে পরিচয় হলো কোথায়?”
“পরে সব বলবো ভাবী যদি সত্যিই কিছু হয়। আমার কেন যেন মনে হয় কিছু হবে না।”

চলবে..

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ২২

আরশি একটা লাল রঙের শাড়ি পরেছে। চুলগুলো খোলা। কোনো এক বনের ভেতর সে কাব্যর হাত ধরে পাশাপাশি হাঁটছে। আরশি কি হাসছে নাকি বিষন্ন সেটা বোঝার জন্য কাব্য আরশির দিকে তাকিয়ে আছে কিন্তু বুঝতে পারছে না কারণ আরশির চুলগুলো তার মুখটা ঢেকে রেখেছে। মুখটা দেখার জন্য একটু এগিয়ে যেতেই হঠাৎ সে একটা বিশাল গর্তে পড়ে গেলো। আরশি কাব্যকে ধরে রাখতে না পেরে চিৎকার দিলো। ঠিক সেই মূহুর্তেই কাব্যর ঘুমটা ভেঙে গেলো। লাফিয়ে উঠে বসলো। ঘাম হচ্ছে হঠাৎ! এ কী আজব স্বপ্ন দেখলো সে? এই স্বপ্নের অর্থ কী?

অদ্ভুত এক ঘ্যার ঘ্যার শব্দে তিরার ঘুম ভেঙে গেলো। প্রথমে ভয় পেয়ে গেলেও কিছুক্ষণের মধ্যে সে আবিস্কার করলো তার সেরা ক্রাশ বিকট শব্দে নাক ডাকছে। তিরা যাদিদের বুকে হাত বুলিয়ে দিলো। সাথে সাথেই তার নাক ডাকা বন্ধ হয়ে গেলো। তিরা আপনমনেই হেসে ফেললো। পরক্ষণেই আবার মনটা খারাপ হয়ে গেলো এই ভেবে যে কাল থেকে ঘুম ভাঙলে এই মানুষটাকে আর পাশে দেখতে পাবে না। কীভাবে কেটে গেলো বিবাহিত জীবনের পাঁচটা দিন! এই পাঁচ দিন সময় এতো দ্রুত কেন অতিবাহিত হলো?

স্বপ্নটা দেখে ঘুম ভেঙে আর ঘুমোতে পারলো না কাব্য। প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে তার, সাথে মাথাব্যথা। আরশি শাড়ি পরতে পছন্দ করে না, পছন্দ করেনা কোনো রঙও। যদিও তার নিজের শাড়ি খুব পছন্দ তবুও যেহেতু আরশির অপছন্দের কথা সে জানে, তার মস্তিষ্কের কখনোই আরশিকে শাড়িতে কল্পনা করার কথা নয়। সচরাচর আমরা যা ভাবি তাই নিয়েই স্বপ্ন দেখি। কিন্তু আমাদের ভাবনার বাইরের বিষয় নিয়ে যখন স্বপ্ন দেখি তার একটা বিশেষ অর্থ থাকে। এই অর্থটা হয় কোনো বিশেষ ঘটনার আগমনী ইঙ্গিত। কাব্য এটা বিশ্বাস করে কারণ একাধিক বার সে এমন অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছে।
সিগারেট ধরালো কাব্য। আপাতত সে এই স্বপ্নের অর্থ খোঁজার চেষ্টা করছে। প্রথমে তারা বনের ভেতর হাত ধরে হাঁটছিলো, এই দৃশ্য বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায় তারা একই পথে হাঁটছে এটার অর্থ হতে পারে আরশি এবং সে দুজনেই দুজনার প্রতি আগ্রহী।
স্বপ্নে সে আরশির মুখটা দেখতে চাচ্ছিলো সে কিন্তু চুলের জন্য দেখতে পারছিলো না। এই দৃশ্যের অর্থ হতে পারে আরশিকে এবং আরশির বিষন্নতার কারণ জানার তার প্রবল আগ্রহ অথচ আরশি নিজের চারপাশে এমন এক দেয়াল তৈরি করে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে যার জন্য সে জানতে পারছে না। স্বপ্নে সে নিজে আরশির চুল সরিয়ে দেখতে পারতো, কিন্তু দেখেনি ঠিক যেমন বাস্তবে সে কখনোই আরশিকে জানার জন্য নিজ থেকে কোনো প্রশ্ন করেনা।
আরশিকে দেখতে গিয়েই সে গর্তে পড়ে গেলো। গহীন জঙ্গলে আরশি একা হয়ে পড়লো। এই দৃশ্যের অর্থ হতে পারে আরশিকে জানতে গিয়ে তার নিজের সাথে বড়ো কোনো দূর্ঘটনা ঘটবে, অন্যদিকে একই দূর্ঘটনায় আরশি গহীন জঙ্গলে একা হয়ে যাওয়ার মতোই কোনো বিপদে পড়বে।
এইটুকু আপাতত ক্লিয়ার কিন্তু আরশির পরনের লাল শাড়ির কোনো অর্থ এখনো খুঁজে পাচ্ছেনা কাব্য।

আসন্ন দূর্ঘটনা থেকে কাব্য যদি নিজেকে এবং আরশিকে বাঁচাতে চায় তাহলে অবশ্যই তাকে আরশির চিন্তা মাথা থেকে নামিয়ে ফেলতে হবে। অনেক দূরে থাকতে হবে তার থেকে। কিন্তু ঢাকা ফিরে আসার পর গত চার-পাঁচ দিনে তার মস্তিষ্ক এতোটাই উত্তপ্ত ছিলো যে আরশিকে নিয়ে ভাবার সু্যোগ পায়নি সে। এ কদিনে সে একবারও আরশিকে দেখেনি কোথাও। এমনকি একটা মেসেজ বিনিময়ও হয়নি। আগের থেকে দূরত্ব বেড়েছে। তাহলে হঠাৎ এমন স্বপ্ন দেখার কারণ কী? মাথাব্যথায় মাথাটা ছিড়ে যাচ্ছে।

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে